মুক্তগদ্য ।। বাঁচিয়ে রাখি বই পড়ার চিরায়ত অভ্যাস ।। পাভেল আমান
বাঁচিয়ে রাখি বইপড়ার চিরায়ত অভ্যাস
পাভেল আমান
সৃষ্টির ঊষালগ্ন থেকেই মানুষ শাশ্বত প্রবৃত্তি,জিজ্ঞাসু মনন ও মানসিকতাকে সাঙ্গ করে উত্তরণ ঘটিয়েছে পৃথিবীতে।অজানাকে জানা ও অচেনাকে চেনার যে চিরায়ত আগ্রহ মানুষের আছে, সেই আকাঙ্ক্ষা পূরণের সবচেয়ে সহজাত পথ বই পড়ার অভ্যাস। এ প্রসঙ্গে প্রথিতযশা সাহিত্যিক লিও তলস্তয়ের একটি উক্তি বিশেষভাবে তাৎপর্যপূর্ণ ও চিরস্মরণীয়। তিনি বলেছেন 'তিনটি জিনিস মানুষের জীবনে প্রচন্ড ভাবে প্রয়োজন, বই, বই এবং বই'। অর্থাৎ শিশু থেকে বৃদ্ধ পর্যন্ত সমস্ত মানুষের কাছে জীবন গড়া, বিকাশের ধারক ও বাহক হচ্ছে বই।এখন কান পাতলেই চারিদিকে শোনা যাচ্ছে বই পড়ার অভ্যাস কমছে সর্বদা।সাধারণ মানুষের এই 'বই বিমুখতা'র কারণ খুঁজতে গেলে তার নানা দিক ,অভিমুখ আমাদের সম্মুখে উদ্ভাসিত। মানুষের জীবনে প্রযুক্তি- নির্ভরতা দারুন ভাবে বৃদ্ধি পাওয়ায এর একটা অন্যতম প্রধান কারণ। আধুনিক বিজ্ঞানের জয়যাত্রায় তথ্য-প্রযুক্তির ক্ষেত্রে যে অভূতপূর্ব উত্তরণ ঘটেছে, তার সুবাদে এখন প্রত্যেকের নিকটে ইন্টারনেট ব্যবহারের সহজ লভ্যতা পৌঁছে গেছে ঘরে ঘরে। প্রযুক্তির অপার হাতছানিতে অধুনা যুব সমাজ সোশ্যাল নেটওয়ার্কিংয়ের বিভিন্ন মাধ্যমকে বিনোদনের মাধ্যম হিসেবে সব পেয়েছির মতো গোগ্রাসে গিলছে বাছবিচার না করে। নিদারুণ ফলস্বরূপ পাঠকের সঙ্গে বইয়ের সম্পর্কটি ক্রমশ শিথিল থেকে শিথিলতর হচ্ছে। আবহমানকাল ব্যাপী চলে আসা মুদ্রিত বই যেন এখন তার গ্রহণযোগ্যতা, প্রাসঙ্গিকতা, কার্যকরীতা হারাতে বসেছে ।এর সঙ্গে লেজুড়বৃত্তি হয়েছে ইন্টারনেটে গেম খেলা, চ্যাট করার ভয়ঙ্কর অভ্যাস।এখন পাঠ্যবইয়ের বাইরে পড়া ব্যাপারটা শুধুই ফেসবুক, হোয়াটসঅ্যাপ আর অনলাইনের কিছু পত্র-পত্রিকায় সীমাবদ্ধ। 'ই –বুক'-এর প্রচলন হলেও তা কি হাতে নেড়ে বই নিয়ে পড়ার চাহিদা কি পূরন করতে পারে? প্রযুক্তির প্রতি মানুষের এত বেশি প্রবণতা, জিজ্ঞাসা তার প্রভাব বড় সুখের নয়। মানুষের আচার-ব্যবহার হাব,ভাবে তার নেতিবাচক প্রভাব স্পষ্ট পরিলক্ষিত।বিষজ্ঞেরাও সদা বলছেন, সুচারু মন, মানসিকতার জন্য বই পড়া খুবই প্রয়োজন। রুচিশীলতা,সৃজনশীলতা, মননশীলতা, মহানুভবতা—প্রভৃতি গুণাবলির জারিত করতে বই শ্রেষ্ঠ সঙ্গী।বই থেকে ক্রমশ বিচ্যুত,দূরে সরেএই যন্ত্র-নির্ভর সভ্যতায় আজ আমরা নিরবধি আত্মকেন্দ্রিক ও স্বার্থপর, আত্মভোলা হয়ে উঠছি। যেন প্রতিনিয়ত আমরা সৃষ্টি সুখের উল্লাসে ভেসে বেড়াচ্ছি। অথচ এটা ঘটনা যে, বই পড়ে যে নির্মল, অমলিন, অপার আনন্দ পাওয়া যায়, তা অন্য কিছুতে দুষ্কর। তাই আমাদের চিরকালীন জীবনের নিঃস্বার্থ ও শ্রেষ্ঠ বন্ধু। রবীন্দ্রনাথের কথায়, ''ভালো বই আত্মশুদ্ধির শ্রেষ্ঠ উপায়।''তাই বই পড়ার অভ্যাস হওয়া উচিত জীবনের শিখন প্রবাহ শৈশব থেকে। এ কথা বলা যায় শৈশবই ব্যক্তিত্ব বিকাশের প্রথম পর্ব। সময়ের সরণি বেয়ে বর্তমান কম্পিউটার-ইন্টারনেট তথ্যপ্রযুক্তির দুনিয়ায় বই পড়ার চিরায়ত, অনিন্দ্য সুন্দর সৃজনশীল অভ্যাস আমাদের প্রজন্মের কাছ থেকে বিলীন হচ্ছে।পাঠ্য বইয়ের জগৎটাই ক্রমশ সঙ্কুচিত হয়ে আসছে। তরুণ বয়সে তাদেরই মনো সংযোগ, মনোনিবেশ আবর্তিত হচ্ছে ইন্টারনেট ভিত্তিক সোশ্যাল মিডিয়া বা বিনোদন মাধ্যমগুলির প্রতি। এ ভাবেই তারা গতবাঁধা পড়াশোনায় অভ্যস্ত হয়ে উঠছে। আসলে বাবা-মায়ের স্বপ্নপূরণের লক্ষ্যে ইন্দুর দৌড়াতেই তাদের প্রাণ শক্তি নিঃশেষিত। তাই ছেলেবেলায় যখন পাঠক হিসেবে এক জনের হাতেখড়ি হওয়ার কথা, তখনই নানা পারিপার্শ্বিক কারণে বইয়ের প্রতি তাদের বিরূপ মনোভাব তৈরি হচ্ছে। প্রাণঘাতী করোনা সংকটে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান বন্ধ থাকায় ছাত্র-ছাত্রী থেকে সমস্ত পড়ুয়াদের পড়ার অভ্যাসে তাল কেটে যাচ্ছে। পড়াশোনার আগ্রহ ইচ্ছে এই কঠিন পরিস্থিতিতে তাদের কাছ থেকে হারিয়ে যাচ্ছে। সেই শূন্যস্থান পূরণে ইন্টারনেট অনলাইনের পঠন-পাঠন তাদের চরম ভাবে আকৃষ্ট করছে। কিন্তু এই অতিমারির সময়ে সুকোমল মতি পড়ুয়া থেকে শুরু করে যুব প্রজন্মকে দেশ গড়ার কারিগর রুপে গড়ে তুলতে আমাদের অবশ্যই বই পড়ার চিরায়ত অভ্যাস, আগ্রহ কে চারাতে, গড়ে তুলতে তাদের প্রতিনিয়ত উৎসাহ, অনুপ্রেরণা যোগাতে হবে। ভুলে গেলে চলবে না বইয়ের বিকল্প এখনো শুধুমাত্র বই। এই বই পড়ার অভ্যাস থেকে আমাদের বিচ্ছিন্ন হওয়া কখনোই চলবেনা। পরিশেষে আমরা সকলে সচেতন অভিভাবক অভিভাবিকা হিসেবে দায়িত্বশীলতার পরিচয় দিয়ে আমাদের ভাবী প্রজন্মকে শিক্ষিত করার পাশাপাশি যোগ্য নাগরিক হিসেবে গড়ে তুলতে তাদের বই পড়ার অভ্যাস কি উৎসাহ দিয়ে থাকি। সবাই বলি একসাথে -ব এ বন্ধু ,ব এ বই/এসো আমিও সঙ্গী হই। বাঁচিয়ে রাখি বই পড়ার চিরায়ত অভ্যাস। আমাদের প্রত্যেকের কাছেই এই অতিমারির সঙ্কটেও শ্রেষ্ঠ সঙ্গী, সময় যাপনের চিরসাথী হিসেবে বই এখনও আমাদের কাছে অপরিহার্য। আমাদের বিবেক, চিন্তা চেতনা, অনুভূতি, উদারতা, মহানুভবতা, সৃজনশীলতাকে বিকশিত, জারিত করতে আমরা আমরন বই পড়ার অভ্যাসকে চিরায়ত করে তুলি।
=====================
রচনা-
পাভেল আমান -হরিহরপাড়া,
মুর্শিদাবাদ, পশ্চিমবঙ্গ।