Click the image to explore all Offers

ছোটগল্প ।। অব্যক্ত প্রেম ।। শুভাশিস দাশ


 
অব্যক্ত প্রেম

শুভাশিস দাশ

 


প্রতিদিনের মতো আজো এসেছিল মল্লিকা।শ্রাবণের মেঘে ঢেকে ছিল আকাশ ।দু এক পশলা বৃষ্টি হয়ে গেলো কিছু আগেই ।ইতিউতি উঠতি ভালবাসারা উঁকি মারছে ।একটা কেমন ভ্যাপসা গরম ।কাঁধে ঝোলানো ভ্যানিটি ব্যাগ থেকে রুমালটা বের করে শান বাঁধা  ঘেরার উপর পেতে নিয়ে বসে পড়ে মল্লিকা ।মানে মল্লিকা সেন ।
না আজো এলো না অভীক ।প্রায় ঘন্টা খানেক একা একা বসে উঠে পড়ে মল্লিকা ।একটু এগিয়ে যেতেই পিছন থেকে কে যেন বললো এই যে শুনছেন ?
মল্লিকা পিছন ফিরতেই দেখলো এক গাল দাঁড়ি নিয়ে এক যুবক।
যুবকটি কাছে এসে বললো কিছু মনে করবেন না আপনাকে একটা কথা বলবো?
কিছুটা অবাক মিশ্রিত গলায় মল্লিকা বললো কী কথা? আর তাছাড়া আপনাকে আমি চিনিও না ।
যুবকটি উত্তর দেয় আরে চিনতে হবে কেন?
ধরুন পথ চলতি পরিচয় ।
মল্লিকা বিস্ময়ে বলে--মানে ?
না, মানে কদিন থেকেই আপনাকে দেখছি এই চত্বরে ।আপনি ঠিক এক সময়ে আসেন, কিছু সময় থেকে আবার চলে যান ।
মল্লিকা একটু রেগেমেগেই উত্তর দেয় তা আপনার কী? এই সদন কি আপনার পৈতৃক সম্পত্তি ?
যুবকটি হেসে আপনি দেখছি রেগেমেগে সাধারণ জ্ঞান টুকু হারিয়ে ফেলছেন ।
আরে আমার বাবা কেন এই জগৎ সংসারে আমার কেউ নেই ।নেই জন্মগত পরিচয় ।শুনেছি এক অনাথ আশ্রমে বড় হয়েছি ।
ঠিক আছে ঠিক আছে কী বলবে বলো আমার আবার বাস ধরতে হবে ।
বলছিলাম দশটা টাকা হবে?
ভিক্ষে চাইতে লজ্জা করেনা?
এই কলকাতা শহরে টাকা ঘুরে বেড়ায় ।খেটে খাও ।
গা থেকে  জড়ানো চাদর টা ঝেড়ে ফেলে যুবকটি বলে দিদি আর কিছু বলবেন ?
মল্লিকা দেখলো যুবকটির দুটো হাত নেই, গায়ে শত জীর্ণ একটা ময়লা গেঞ্জি ।
মল্লিকা এবার লজ্জা পেলো বললো-বুঝতে পারিনি আর এই কলকাতায় কতো বিচিত্র মানুষ ঘোরাফেরা করে যে হঠাত্‍ বুঝে ওঠা মুশকিল হয় ।
ভ্যানিটি ব্যাগ থেকে একটা পঞ্চাশ টাকা র নোট বের করে যুবকটি কে দিয়ে বললো তুমি থাকো কোথায়?
আমার কোন ঠিকানা নেই ।বলতে পারেন এই রবীন্দ্র সদন ই আমার স্থায়ী ঠিকানা ।এখানেই হাত পাতি, এখানেই মাথা রাখি ,এখানেই ভালবাসা, এখানেই মাখামাখি।
বাহ! চমৎকার বললে তো ছড়ার ছন্দে ।
ঠিক আছে কাল বিকেলে এসময় এসো ।গল্প শুনবো তোমার ।
রাতে শুয়ে অভীক কে একটা ফোন করলো ।
ব্যাস্ত টোন ।কী জানি ইদানিং ভীষণ এড়িয়ে চলছে ।হঠাত্‍ কী হলো জানিনা ,আসলে ভুলটা আমার ই হয়েছে ।দেখে তো ভাবিনি ওর বয়সটা অনেক কম ।এসব ভাবতে ভাবতেই অভীকের ফোন -হ্যালো মল্লিকা?কাল আমি আমেরিকা যাচ্ছি পারমানেন্টলি।
মল্লিকা যেন আকাশ থেকে পড়ল বললো-মানে?
তাহলে আমি?
নানা তোমাকে নিয়মিত টাকা পাঠাব ।ভয় নেই না খেয়ে মরবে না ।
মল্লিকার কথা বলতে আর ইচ্ছে করলো না ।
ফোন কেটে দিলো ।
মল্লিকা এর আগে আঁচ পেয়েছিল ।কিন্তু গা করেনি।মোবাইল ফোনের সুইচ বন্ধ করে দিলো ।
মল্লিকা রায়ের অনেক কথা মনে পড়ে গেলো ।
সেই ছোট বেলায় মা র হাত ধরে এপার বাংলায় আসা ।বেনাপোল বর্ডার।
তারপর কতো জায়গায় ঘুরে শেষে এক দূর আত্মিয়র বাড়িতে আশ্রয় ।অবশ্য সেখানে যত্ন আর্তি ভালোই ছিল । মা আর আমি ।
জোড় বাগানে বাড়ি ছিল সেই আত্মীয় ।মামা বলেই ডাকতাম ।পরে বুঝেছিলাম আদর করার মানে ।
পেশায় ম্যাজিস্ট্রেট সেই মামা র একজন বাড়ির কেয়ারটেকার দরকার ছিল ।মা ছিল বেশ শক্ত পোক্ত।দুজনের চাহিদা পূরণ হলো ।উদ্বাস্তু মা মেয়ের পেট চলতো আর মামার সংসারে র কাজও চলে যেতো ।তবে মামীমা ছিলেন রাশভারী মানুষ । মামার ছেলে রিপন প্রায় সম বয়সী একটা বন্ধুত্ব হয়ে গিয়েছিল ।
প্রেম ছিল কিনা জানিনা তবে একদিন বেড়াতে বেরিয়ে রিপন বলেছিল হ্যারে মলি আমাকে তোর ভালো লাগে? ও আমাকে মলি ডাকতো।
বলেছিলাম কেন লাগবে না।দাদা কী আর খারাপ হয় ?
আর তোমার ভিতর তো কোন অহংকার দেখিনি ।
সেসব অনেক স্মৃতি ।মা মারা যাবার পর মামা মামী দুজনেই মারা গেলেন ।
হঠাত্‍ একদিন রাতে রিপন প্রচন্ড ড্রিংক করে ঘরে আসলো । কিছু বোঝার আগেই আমাকে জড়িয়ে ধরে.....!
পরদিন সকাল না হতেই আমি নিরুদ্দেশের পথে বেরিয়ে পড়ি ।
কাগজে দেখেছিলাম পেয়িং গেস্ট এর বিজ্ঞাপন ।ফোন নম্বর টা সেফ করে রেখেছিলাম ।যোগাযোগ হলো।তারপর থেকে ওই ঠিকানায় ।
ক্লাস সিক্সের মেয়ে মন্টি কে পড়ানো ।
মধ্যবিত্ত চাকুরে বাবা মায়ের একমাত্র মেয়ে ।
অনেক টানাপোড়েন ।
কতো কথা মনের ভিতর তোলপাড় করতে করতে রবীন্দ্র সদনের সেই ছেলেটির কথা মনে পড়ল ।নিজেকে খুব অপরাধী মনে হলো মল্লিকার ।না বুঝেই বেফাঁস কথা বলে ফেলেছিল আজ ।এসব ভাবতে ভাবতেই চোখ দুটো বুঁজে এলো মল্লিকার ।

বিকেল পাঁচটা।আজ কেমন একটা ভ্যাপসা গরম ।রবীন্দ্র সদন চত্বর আজ অনেকটা ফাঁকা ।
মল্লিকা সেন প্রতিদিনের মতো এদিনও হাজির ।
না আজ অভীকের জন্য নয় ,স্রেফ ওই ছেলেটির জন্য ।একটু বাদেই ছেলেটি এলো ।সেই ময়লা চাদর জড়ানো।মল্লিকা বললো বসো ।
ছেলেটি একটু দূরত্ব রেখেই বসলো ।
মল্লিকা বললো আজ তোমার গল্প শুনতে এসেছি কারো জন্য অপেক্ষা নয় ।
মানে ?এই রাস্তার একটা ছেলের গল্প শুনতে?
আগে তোমার নামটি বলো?
আমার নাম সুজিত বসু। ছোট বেলা বাবা মারা যাবার পর মা লোকের বাড়িতে কাজ করে আমাকে মানুষ করেছেন ।
কলেজে পড়তে পড়তেই একটা সরকারি চাকরির সুযোগ আসে।আমরা তখন বেলেঘাটা থাকি ।
চাকরিটার জয়েনিং ছিল মালদা। রাতের উত্তরবঙ্গ এক্সপ্রেস ধরে রওনা দিয়েছি।আমার আবার ট্রেনের দরজা তে দাঁড়িয়ে দৃশ্য দেখতে খুব ভালো লাগতো ।
একটা সময় দরজা খুলতেই পিছন থেকে কে যেন ধাক্কা দিলো ।ব্যাস ।তারপর যখন জ্ঞান ফিরলো তখন আমি কলকাতা মেডিক্যাল কলেজের সার্জিক্যাল বিভাগের বেডে শুয়ে।
আস্তে আস্তে সব বুঝলাম ।ঈশ্বরকে বললাম এভাবে কেন বাঁচিয়ে রাখলে ?
তারপর?
মেডিক্যাল কলেজের এক হৃদয়বান ডাক্তার বাবু অবশ্য খুব জোড় করেছিলেন আমাকে তাঁর বাড়িতে নিয়ে যাবেন । ইচ্ছে ছিলো তাঁর ছেলে কে পড়াতে হবে ।এবং স্থায়ী ভাবে আমি যেন তাঁর বাড়িতেই থেকে যাই ।কিন্তু আমার মা ?
আমার ব্যাগের কাগজ পত্র ঘেঁটে কেউ মাকে ফোন করে জানিয়ে ছিলো ,মা আর সহ্য করতে না পেরে স্ট্রোক করে মারা যান ।
অনেক বার আত্মহননের চেষ্টা করেছি। 
জানেন অনেকদিন পর মনে হলো এভাবে বেঁচে
থাকাটা মূল্যহীন নয় ।
মল্লিকা রুমাল দিয়ে চোখের কোণ মুছে বললো কেন ?
আপনার মতো কিছু মানুষ তো আছে যাঁরা খোঁজ নেয় আর এই খোঁজ নেয়ার মধ্যেই নতুনের আলোর সন্ধান থাকে ।
সুজিত তুমি থাকো কোথায়?
সময় থাকলে চলুন দেখিয়ে আনি ।
দুজনেই উঠে পড়ে ।
রবীন্দ্র সদন ছেড়ে অনেকটা দূর হাঁটতে হাঁটতে একটা পরিত্যাক্ত কাটগোলা দেখিয়ে সুজিত বলে ওই যে আমার আশ্রম ।রাতে কোনরকম মাথা গুঁজে থাকি ।কথা বলতে বলতে আনমনা হতেই মল্লিকার পাশ থেকে ছিটকে পড়ে গেলো সুজিত।একটা পূল্কার জোড় ধাক্কা মেরে চলে গেলো ।
কিছু বোঝার আগেই সব শেষ।
নতুন আলোয় আর সুজিতের পৃথিবীটা দেখা হলো না।
শ্রাবণের আকাশ আবার কালো করে এলো নিষ্পলক দাঁড়িয়ে রইলো মল্লিকা।দূর থেকে কে যেন বলে গেলো আবার আসব মল্লিকা দি।
=================== 
শুভাশিস দাশ
দিনহাটা
মো 9932966949









Post a Comment

0 Comments
* Please Don't Spam Here. All the Comments are Reviewed by Admin.