জীবন সিঁড়ি
সোমনাথ মুখার্জী
আমিই ওকে প্রথম আবিষ্কার করি বলতে পারিস। অভিসিক্তা হেসে বলে উঠল। একটু যেন মেনে নিতে কষ্ট হল আধুনিকা লীনার। সমবয়সী না হওয়া সত্ত্বেও আশ্চর্য বন্ধুত্ব। লীনা নীরবতায় থাকল। ও জানে অভিসিক্তার কষ্টের ব্যাপার। তবুও সবসময়ই আনন্দে থাকার প্রচেষ্টা চলে। সামান্য সময় অন্য দিকে তাকিয়ে ছিল অভিসিক্তা। উত্তরের ব্যালকণিতে দুজনে বসে আছে। ছয় তলার ছোটো ফ্ল্যাটে থাকে অভিসিক্তা। ওর ছেলের নাম অর্চিষ্মান। মাঝে মধ্যে লীনা আসে উইকেন্ড কাটাতে। গড়িয়ার এই কামালগাজি অঞ্চলে অনেক এরকম ফ্ল্যাট বানানো চলছে। সময় এখন অন্যরকম। সকলেই সুখী হতে চায়।
লীনা দেখল আজ অভিসিক্তা বেসামাল। সন্ধ্যার আকাশে আলোর বিষণ্ণ মায়া। কেউ বুঝি বসে আছে অন্তরালে। তার কথা রঙের মাধ্যমে ছড়িয়ে পরছে অনন্তে। লীনা আধুনিকা, তবুও কোথাও যেন চিন্তার গভীরতা ছুঁয়ে আছে। হতে পারে সেকারণে অভিসিক্তাকে আপন করতে পেরেছে।
লীনা বলল, কী এত ভাবছিস। চা বানাব, খাবি? আমি জানি তোর রান্নাঘরে কোথায় কী আছে।
চা খাবো না। আজ আমায় কথা বলার রোগে ধরেছে। আমি যেদিন প্রথম ওকে আবিষ্কার করি সেদিন এক আশ্চর্য দিন ছিল মনে আছে আজও। কলকাতা শহর থমথম করছে। বনধ ছিল। কোথাও হয়ত গন্ডগোল হয়ে সবেমাত্র থেমেছে। আশপাশের অবস্থা দেখে ভয় ধরে গেল। বাড়িতে মায়ের খুব অসুখ। কোথাও ওষুধ না পেয়ে যখন দিশেহারা তখন ভগবানের মত উপস্থিত হল বোধিসত্ত্ব।
আমার খুব ঘন কাছে এসে বলল, আপনি বোধকরি বিপদগ্ৰস্ত। আমি আপনাকে সাহায্য করতে পারি। খুবই আস্তে ভদ্রভাবে কথাটা বলল।
লীনা সবই জানে। তাও বললো, তারপর।
অভিসিক্তা লীনার দিকে তাকাল। তাকানোর মধ্যে বিষণ্ণতার ঢেউ আছড়ে পরল যেন। তারপর বলল, আমার কী হল আমি জানি না। চিৎকার করে উঠলাম। কিন্তু কেউ কোথাও নেই। মানুষজন রাস্তা থেকে উবে গেছে হঠাৎ। তারপর স্তিমিত চোখে ওর দিকেই চোখ মেললাম। আশ্চর্য আমার ভেতর তরঙ্গ বয়ে গেল। মন বলল, এর কাছে ধরা দিতে ভাবার দরকার নেই। অথঢ, এত কিছুর পরও বোধিসত্ত্ব আমার পাশেই এতক্ষণ ছিল। বললাম, আমাকে বাঁচন আপনি। আমার মা খুব অসুস্থ। ওষুধ পাচ্ছি না।
বোধিসত্ত্ব আমার হাত ধরল। আমি অবলীলায় একজন অচেনা পুরুষের কাছে পরাজিত হলাম।অনেক পরে জেনেছিলাম ও আমাকে বহুদিন ধরে নজরবন্দি করে রেখেছিল। অথচ, আমি কোনোদিন ওকে রাস্তায় লক্ষ্য করিনি। তারপর বহুক্ষণ সময় কোথায় ভেসে গেল আমি আজও স্মৃতি পটে আঁকতে পারি না। কথার মালায় সঠিকভাবে গাঁথতেও পারি না। আমার আপাতত সব সমস্যা মিটে গেল।
মুঠোফোনে গান বাজল। অর্চি ফোন করেছে। অভিসিক্তা বলল হেসে, কী হল বাপন তোমার! হঠাৎ ফোন করলে! বন্ধুর জন্মদিন আনন্দ করো। সব সময় এত মা মা কেন!
অর্চি শুধু বলল, মা তুমি তো আমার কথা শুনলেই না। অন্যের কথা শোনা সভ্যতার অংশ। তুমিই একদিন বলেছিলে। আমি তোমাকে জানাতে চাই যে আমার ফিরতে দেরী হবে। ফোন কেটে গেল।
অনেকক্ষণ চুপ করে বসে রইল অভিসিক্তা। নীরব। লীনা তাকিয়ে আছে তার হুঁস যেন নেই। সম্বিত ফিরল যখন ঘরের ভেতর থেকে টিকটিকি ডেকে উঠল। বলল, মরণ। আপদ গুলো যায় না কেন? কাকে বলল ঐ এক ভগবান জানে।
লীনা নিরাসক্ত ভাবে বলল, তারপর।
হ্যাঁ তার পর কী? সবই মোটামুটি জানিস। তবে নিরপেক্ষ ভাবে জানিস না। তাই আজ আমার এত কথা বলার। অভিসিক্তা হেসে বলল, শুধু ওকে অভিসম্পাত দিলে সত্য ভ্রষ্ট হব আমি। আমার ভেতর অদ্ভুত এক আগুন জ্বালিয়ে ছিল বোধিসত্ত্ব। না কামনা নয়। শিক্ষার আগুন। আমি তখন কলেজে পড়ি। স্বপ্ন দেখি প্রফেসর হবার। কিন্তু সফল হয়ে ওঠা বড় কঠিন। বাবা তখন আকাশে। কীভাবে সংসার গড়ায় সেকথা থাক। খারাপ কোনো কাজ করিনি। নিজের কাছে স্বচ্ছ ছিলাম। আচমকা ওকে দেখে মিশে মনে হল এমন বিদ্বান হয়। একা মানুষ। তিনকূলে কেউ নেই। চাকরি করে। আর বই ছাড়া জীবনে কিছু নেই। তখন দোষের মধ্যে সিগারেট খেত। আমি মিশে গেলাম। আমার সাফল্যে ওর সাহায্য ভীষণ জরুরী। মা বিরক্ত হত। বাবার বানানো বাড়িতে থাকতাম বলে অর্থ সাশ্রয় হত।
ফোন বেজে উঠল। মা বললেন, কীরে তোর আবার কী হল। আজ তো গড়িয়া যাবি না বলেছিলি। অর্চি কে পাঠালি না। তোকে আমি আজও বুঝে উঠতে পারি না। জামাই এর সাথে তোর যে কী হল। আমার এই আশি বছর বয়সে আর কত সহ্য করব। তুই কাছে থেকে দূর রচনা করলি গানের মতো। থেমে গেলেন। অনীতা এক সময়ে গান শিখতেন। মাঝে মধ্যে তারই অণুরণন শোনা যায়।
অভিসিক্তার মাথায় আগুন ধরল। হঠাৎ রেগে উঠে বলে বসল,আঃ মা। আমায় সুখী করার আর চেষ্টা কোরো না। তুমি আমাদেরকে নিয়ে এত ভাববে না। আমি এখন একা থাকতে চাই। ভুল বুঝো না। কান থেকে মুঠোফোন নামিয়ে নিল। লীনার দিকে তাকিয়ে বলল,মা জামাইকে খুব শ্রদ্ধা করে। আমার পছন্দ হয় না। আমিও তো কম কিছু নই। তোমার জামাই বিদ্বান ঠিকই। ও শুধু পড়ে। লিখতে সেভাবে সৃষ্টিশীল নয়। কিন্তু আমার কতগুলো বই প্রকাশ হয়েছে তুই তো জানিস। ও তো অলস।হ্যাঁ যা বলছিলাম। মায়ের অসুখ দুজনকে কাছে এনে দিল। বিপদ থেকে উদ্ধার পাওয়ার পর আমাদের আবেগ ঘন হল।বিয়ের পিঁড়িতে বসাও হল। সাফল্য এল। আমার বিদ্যার গুণগ্ৰাহী হল একজন বিদেশী। এবার শুরু হল জীবনের অন্য অধ্যায়। আমায় একটু জল খাওয়া লীনা। আর ঘরের আলো জ্বেলে দিস্ একটু। তোকে আজ সেই কথাটা বলব যা কাউকে বলিনি। হাসল।
লীনা অবাক হল।
অভিসিক্তার ফোন বাজল।টমাস ফোন করেছে। হাভার্ড ইউনিভার্সিটি থেকে। বলল হ্যালো অভিসিক্তা। টমাস। তোমার কাছে বাংলা ভাষা শিখে আমি এখন ভালই বলি। অর্চি কেমন আছে। ওকে আমার কাছে মানে বিদেশে পাঠাও।
আর মিউচ্যুয়াল করে আমার কাছে চলে এসো। ফোন কেটে গেল।
অভিসিক্তা কান্নায় ভেঙে পরল। লীনার হাতের জল হাতেই রইল। রাত নামছে। সম্পর্কের সুতো বাঁধার সময় এখন। অথচ লীনা যেন অচেনা গলা শুনতে পেল। বহুদূর থেকে ভেসে আসছে, অর্চিষ্মান বোধিসত্ত্বর পুত্র নয়। আমায় ক্ষমা কোরো আমার জীবনদেবতা। ভালোবাসলে কত যে সহ্য করতে হয়। জলের গ্লাসটা ভেঙে টুকরো টুকরো হয়ে ছড়িয়ে পরল অনন্ত সময়ে।
=====================
শ্রী সোমনাথ মুখার্জী
৫৬১/সি,লেক ভিউ পার্ক রোড,বনহুগলী, সোলারিস ফেজ-১, টাওয়ার-১, ফ্ল্যাট নম্বর -১০০৫, কলকাতা-৭০০১০৮