লেখকঃ ব্রেন্ডা পরস্টার
অনুবাদক - অনিন্দ্য পাল
আজ আমার মেয়ের বয়স হলো আশি। বয়সের তুলনায় তার আকৃতি টা একটু বেশিই খারাপ আর তাই আজকের এই জন্মদিন পালনটা একটু আড়ম্বরহীন হবে। তারি অবনতি পদ্ধতিগতভাবে ধাপে ধাপে হয়েছে। ঠিক তার বাবার মতই। সে অবশ্যই তার বাবাকে অনুকরণ করেছে। আমিও কোন দীর্ঘজীবী প্রাণী গোষ্ঠীর নই কিন্তু আমাকে ওর চেয়ে অনেক ভালো দেখতে। এটা পরিস্কার যে আমার ছোটখাটো সব জিনিস গুলো ঠিকঠাক আছে, তারা ভালোই কাজ করছে, এবং দিগন্তে চিন্তা করার মত তেমন কোনো সমস্যা এখনো নেই। এখনো আমার হাতে সময় আছে সময় এখনও আছে।
আমার এই মেয়ের বাবা, আমার প্রথম স্বামী, তিনি তখন তার বয়সের চেয়ে কুড়ি বছরের ছোট একজন মেয়েকে নিজের প্রেমিকা হিসেবে পেলেন। এখন তিনিও মৃত, ভগবান তাঁকে আশীর্বাদ করুন। আমার চেয়ে দশ বছরের ছোট এবং সে আমার হাত থেকে আমার স্বামীকে সরিয়ে নিতে সাহায্য করেছিল। মৃত এবং কবরস্থ দুটোই। এবং এমন অনেকে ছিলেন যারা আমাদের দুজনেরই বন্ধু ছিলেন। এবং আমার দ্বিতীয় স্বামীও। আমাদের কোন সন্তান ছিল না। তাঁর জন্য শোক করার মত অনেক লোকজন ছিল না তাই। কেউ নেই! সত্যি বলতে কি আমি ছাড়া কেউই ছিল না শোক করার মতো। আমি এখনো দুঃখ করি তার জন্য। এবং কেউ জানেনা কতদিন আমি এটা করব! তবে অবশ্যই আমার মেয়ের চেয়ে বেশি দিন।কার সময় আসছে, আমি এটাকে অনুভব করতে পারি। আজ হতে পারে সেইদিন সে মোমবাতিটা নিভিয়ে দিয়েছে তার শেষ নিঃশ্বাস দিয়ে। খুব খারাপ জিনিস। জরাজীর্ণ মানুষগুলোর জন্য আত্মহত্যা বা নিজেকে লুপ্ত করে দেওয়ার একটা ব্যবস্থা থাকা উচিত।বৃদ্ধাবাস গুলোর জন্য একটা যান্ত্রিক ব্যবস্থা অথবা সেই রকমই কিছু একটা। এটা সবমিলিয়ে ভালোই হতো। যৌবনের হাওয়ার বিভ্রম- সম্পূর্ণ ফুসফুস সমেত। একটা ভালো উপায়। সহানুভূতিশীল হতে পারে, এমনকি বেশ লাভজনক হত। স্পষ্টভাবে বলতে গেলে ভয়হীন একটা ভবিষ্যতের জন্য নিজেকে আশ্বাস দেওয়া।
৪০ বছর বয়সেও আমার কন্যা প্রকৃত সুন্দরী ছিল। সবাই আমাদের দুজনকে বোন বলেই ধরে নিতো। আমাদের চুল, পা এবং কোমর একইরকম। আমরা একই রকমভাবে হাসি। সে এখনো তেমনি আছে যেমনটা ছিল কুড়ি বছর আগে। প্রায় আমারই মতো।
তার জন্মদিন ছিল একদম ঠিকঠাক। আমি সেখানে আমার দ্বিতীয় স্বামীর সঙ্গে উপস্থিত ছিলাম এবং সে উপস্থিত ছিল তার একমাত্র স্বামী এবং দুটি সন্তানের সঙ্গে। এখন তারা বড় হয়েছে এবং বিদেশে থাকে। তাদের প্রত্যেকের নিজস্ব পরিবার আছে এবং তাদের মাকে ঘৃণা করে। তারা প্রায় কখনোই তাদের মাকে বা আমাকে দেখতে আসে না যদিও আমি তাদের মায়ের ঠিক পাশের ঘরেই থাকি। তারা তাদের বাবার থেকেই প্রায় সব কিছু নিয়েছিল। রুপ, মেজাজ, যে অর্থে তারা বেঁচে আছে, সম্পত্তি এবং আমাদেরকে দরকার নেই তাদের। আমার মেয়ের স্বামী একজন আমেরিকান, কোন ধরনের কল্পনা ছাড়াই সবদিক থেকেই একজন ভালো স্বামী ছিলেন, জ্ঞানত অনুপস্থিত। সে আমাদেরকে ছেড়ে শান্তির দেশে গেছে। এবং আমরা তার মৃত্যু সম্পর্কে প্রায় কিছুই জানতাম না শুধুমাত্র তার সন্তানদের আকস্মিক স্থান ছাড়া।
আমার কন্যার ৪০ তম জন্মদিনে আমরা সমুদ্রসৈকতে সবাই একসঙ্গে হয়েছি। শিশুরা আমাদেরকে টেবিল পরিষ্কার সাহায্য করছিল। তারা তাদের বাবার থেকেই পেয়েছিল বিভিন্ন তীব্রতার রোদে পোড়া ত্বক। তারপর আমরা সবাই অনক রাত পর্যন্ত বাচ্চাদের কাছে থাকার জন্য বারান্দার দিকে গেলাম। একটা ঝাপসা চোখের বিড়াল আমাদের পায়ের ফাঁক দিয়ে ছুটে গেল। সেদিন সকালেও বাগানে এটাকেই দেখা গেছিল। বাচ্চারা একটা ছোট্ট জন্মগত জারজকে ধরেছিল, তার গায়ের পোকা বেছেছিল এবং সেদিন সন্ধ্যায় তার মায়ের কাছে দেবার জন্য পোষাক পরিয়েছিল।
গ্রীষ্মের রাতে, কালো রাতে একটা বিবর্ণ অন্ধ চাঁদের নীচে আমরা সবাই, বাচ্চারা ইতিমধ্যেই শুয়েছিল। এখন আমরা সবাই জানি কিভাবে আমাদের জন্মদিন উদযাপন করা উচিত। তখনি আমার মেয়ে ফোনের কাছে ছুটে এল।
তার বর্তমান প্রেমিক তাকে বলেছিল যে সে নিজেকে আটকে রাখতে পারছে না, সে তার প্রেমিকার স্বর শুনতে চায়, সে তার প্রেমিকার জন্মদিনে তার সঙ্গে থাকতে চায়। সে তার নিজের পদ্ধতিতেই এই জন্মদিনটা পালন করতে চায়। আমার মেয়ে দেওয়ালে আটকানো একটা রিসিভারে খুব নরম সুরে কথা বলছিল। শুরুতেই সে তার নগ্ন পা-টাকে এবং বিশাল পায়ের পাতাটাকে উপর নীচে দোলাচ্ছিল। তার সুন্দর ঠোঁটের উপর আবেগময় শ্বাস প্রশ্বাস লেগে ছিল। তার স্থির স্কার্ট, তার ব্লাউজ, তার লম্বা চুল মাথার পিছন দিকে সুন্দর করে ধাপে ধাপে খোঁপা বাঁধা রয়েছে। এখন আমরা সবাই সত্যিই এখানে আছি। শিশুরা সুখে ঘুমাচ্ছে। আমি এবং আমার বর ওয়াইনটা শেষ করছি। আমেরিকানটা সোপানের স্তম্ভের দিকে তাকিয়েছিল, তার পিছন থেকে তাকে মনোযোগী এবং হতাশ মনে হচ্ছিল। মনে হচ্ছিল এভাবে সে তার চলে যাওয়াটা যে খুব জরুরি সেটা বোঝাতে চাইছে। বারান্দায় তার খুব কম বয়সী এবং সুখি স্ত্রীও ছিল। বেড়াল ছানাটা ছিল সম্পূর্ণ কালো।
পঞ্চাশ বছর বয়সটা একজন মহিলার জন্য একটা মাইলস্টোন। (শরীরটা কিছু সময়ের জন্য তার নিজের কারণ অনুসরণ করছে,) কিন্তু আকস্মিক ভাবে তারা নিজেদেরকে পরিষ্কার করে তোলে, তারা লুকানোর জায়গাটা থেকে বের হয়ে আসে।
এখন এটা স্পষ্ট যে রৌদ্রে বেরিয়ে আমার মেয়ের শরীরটা আক্রমণ আর আত্মরক্ষার কৌশল খুঁজে পেয়েছে। সে তার পানীয়টা নিয়ে বাগানে ঘাসের উপর এসে বসেছে। এখন সে কালো চশমার ভিতর দিয়ে আকাশটাকে দেখেই যাচ্ছে। সেদিন সন্ধ্যায় আমরা একটা বড় পার্টির আয়োজন করেছিলাম শুধু এবং শুধুমাত্র সৌভাগ্যের জন্য এবং সে সাহসী ভাবে একটা নিচু গলার পোশাকের জন্য সম্পূর্ণ সৌরস্নান পেতে চেয়েছিল। বিড়ালটা তার পাশেই শুয়ে ছিল এটার ছোট্ট কালো মাথাটা তার বিবর্ণ যৌনকেশের উপর বিশ্রাম নিচ্ছিল। বিড়ালটার নরম লোমশ শরীরটার নীচে তার পেটটাকে খুব মসৃণ দেখাচ্ছিলো। সত্যি কথা বলতে কি তার দ্বিতীয় সন্তানের জন্মের পর তার চামড়াটা কুঁচকে গেছিল। টানটান ওজনের ছোট ছোট ভাঁজগুলো যেগুলো বছরের পর বছর যাবৎ ভালো টানটান ত্বকের উপভোগ দিয়েছিল, সেগুলো এখন শুধু পুরু চামড়ার ওজনই বাড়াচ্ছে তার সর্বদাই ছিল ছোট ছোট স্তন। আমার কন্যা কিন্তু এখন সেখানে শুধুমাত্র দুটো স্থূল বেগুনি বর্ণ স্তনবৃন্ত উদ্ধতভাবে নিজেদেরকে ফেলে রেখেছে তার বুকের উপর। তার কাঁধ পা হাত এবং পায়ের পাতার ত্বক এখনো বেশ টাটকা তাজা টানটান এবং গভীর সৌরস্নান ধীরে ধীরে এটাকে একটা ভেলভেট এর মত রূপ দিচ্ছে। সে কালো কাছের পিছন থেকে আকাশের দিকে তাকাল এবং বিড়ালটা মাথাটাকে নিতম্বের নিচে ঝুলন্ত নরম মাংস পিন্ডের উপর ঘোরালো যেটাকে ফরাসিরা বলে 'স্যাডল ব্যাগ'।
এটা কখন শুরু হয়েছিল? কখন থেকে আমার ছোট্ট মেয়েটা বয়স্ক হতে থাকলো? মেয়েটার বয়স এতটা বেড়ে গেল কবে থেকে? একেবারে শুরু থেকেই স্পষ্টতই, প্রত্যেকের মতই, কিন্তু আজ এই সম্পর্কে কোন প্রশ্ন নেই। এবং আমার? আমি কবে বৃদ্ধ হওয়া থেকে থেমে আছি? আরো জটিল! প্যাঁচালো! এটাই যদি হতো শুরু থেকে তাহলে আমিও এখনো রক্তনীল হয়ে শুয়ে থাকতাম আমার মায়ের বিছানায় সদ্য কাটা নাড়ি সমেত, কখন? যখন সে ছোট ছিল, আমার মেয়েটা নিজেকে ঠিক আমার মত দেখতে করে তুলতে চাইত, আমার মত সেজে 'আমি' হয়ে ওঠার চেষ্টা করত, এবং এখন আবার সে আমার মত হতে গিয়ে নিজেকে ঠিক আমার মত দেখতে করে তুলেছে, সে সামনে এবং পিছনে যাচ্ছে বারংবার। আমি কখনো বাড়তি সাজগোজ করিনি। কিন্তু ওটা কখন শুরু হয়েছিল এবং শেষ হয়েছিল? একদিন সে তখন আট কি নয় বছরের হবে, আমরা আমাদেরকে একেবারে কাটল্ ফিসের মত উলঙ্গ করে আয়নার সামনে দাঁড়িয়ে ছিলাম সবকিছুই ঠিকঠাক ছিল। ঠিক তখনই আমার প্রথম স্বামী ঠিক আমাদের পিছনে এসে দাঁড়ালো এবং আয়নায় তার স্ত্রী আর মেয়ের ওই প্রতিফলন দেখে হাসিতে ফেটে পড়ল। এখনো সেই একই রকম ভাবেই চলছে এবং তারপর তার স্কুলের বন্ধুরা বলেছিলো আমাদেরকে দুই বোনের মত লাগছে। তাদের মধ্যে অনেকে এমন কি আমার প্রেমে পড়ে গেল কিন্তু তখনও আমি তার মা-ই ছিলাম। যুবতী দেখতে কিন্তু তখনও তার মা-ই ছিলাম। এখনও তাই আছি। এবং তারপর, কুড়ি বছর তিরিশ বছর চল্লিশ বছর।
একটি সুন্দর মেয়ে, তারপর নারী, সে পরিণতির দিকে এগিয়ে চলেছে। সুসামঞ্জস্যপূর্ণ এবং আমি বৃদ্ধ বয়সে কি আমি আমার পরিপক্কতার শিখরে এলাম? আমার দ্বিতীয় স্বামী একজন সত্যিকারের ভাগ্যবান মানুষ ছিল। তার একজন তরুণীর দরকার ছিল না। সে খুঁজত বা চাইতোও না। মাঝে মাঝে আমি আশ্চর্য হই যে সে তখন এটা উপলব্ধি করার মত অবকাশে ছিল কিনা। আর অন্যদের? আর অন্য কিছু?
আমার মেয়ে হাত-পা ছড়িয়ে দিল। খুব যত্নে বেড়ালটাকে পাশে ঠেলে দিয়ে লনের উপর বসে পড়ল। সে তার চশমাটাকে কপালের উপর তুলে নিল এবং মৃদু হেসে আমার দিকে ফিরল। তার মুখের পাশে দুটো বেশ গভীর বলিরেখা, তার চোখের দু-পাশে আরও কতগুলো বেশ উৎফুল্ল দাগ রয়েছে, সেই দাগ গুলো বেশ বড় এবং পরিষ্কার। তার সমস্ত দাঁতগুলো আমেরিকান অর্থোডন্টিকসদের দরকার মত সাজানো। হতে পারে এগুলোই তার স্বামীকে তার প্রতি আকর্ষিত করেছিল। চকচকে টালি বাঁধানো ঘরের মেঝে, দারুণ রান্নাঘরটা যেখান থেকে ঠাকুমার পিঠের গন্ধ পাওয়া যেত, যে গন্ধে আবার কলোরাডোর কথা মনে পড়ে যেত- এগুলোও কারণ ছিল বৈকি। স্নায়ু চাপে নিপীড়িত সৌন্দর্য মাখা মুখে হাসি নিয়ে সে আমার দিকে তাকাল। এই সান্ধ্য অনুষ্ঠানে সে নিজের সঙ্গেই বেশ সুখী ছিল। এর সঙ্গে ছিল পড়শির সুইমিং পুলে বাচ্চাদের তাদের বান্ধবীদের সঙ্গে জলকেলির আনন্দ। যদিও সে কয়েক বছর ধরে সত্যি সত্যিই আমাকে দেখে নি তাও সে আমার দিকে একটা মিষ্টি হাসি ছুড়ে দিল। মাত্র একবারই সম্ভবত: আমরা পাশাপাশি বসে ছিলাম। দুটো বিভিন্ন টাউনে আমরা অনেক সময় ধরে ছিলাম। অনেকটা বেশি সময় ধরে থাকার ফলে আমি তাকে বেড়ে উঠতে এবং বুড়ো হতে দেখেছি। এটা কম যন্ত্রণার নয়। এক্ষেত্রে কোন সঠিক বিচার করা যায় না, আর সেটাই আহত করে। আমার মেয়ে সব সময় নিজের সময়টাকে ভালবাসতো এবং সে এটাকে বেশ ভালো ভাবেই মানিয়েও নিয়েছিল। একটা নির্দিষ্ট সীমার পরে আমার পালাও আসবে। অমরত্ব কখনোই আমার যুক্তিগ্রাহ্য আকাঙ্ক্ষা ছিল না। এই অমরত্বের সঙ্গে একটা অসহ্য একাকীত্ব হাত ধরাধরি করে চলে। একটা কিছু হারাবার জন্যই যেন বেঁচে থাকা।
সে কিন্তু প্রকৃতপক্ষে তার ষাটতম জন্মদিন পালন করতে চায় নি। হতে পারে ব্যাপারটা ভাঙা পায়ের জন্যই হয়েছে। এর সঙ্গেই, সেই আমেরিকানটা তার সন্তানদের সঙ্গে নিয়ে চলে গেছে। প্রচুর বন্ধু, আমার মেয়ের অসংখ্য বন্ধু। এক কখনো-সখনো প্রেমিকের সঙ্গে অনাবশ্যক কথাবার্তা বলে একটু বেশিক্ষণ তাকে ধরে রাখতে চাইছে। তবে আনন্দ করার জন্য তাদের কাছে খুব কিছু কারণ ছিল না। এবং ষাট বছরের জন্মদিনে শহরের বাইরে অন্য কোথাও একটা সামুদ্রিক খাবারের রেস্তোরাঁতে নিজের জন্য মোমবাতি নিয়ে আসা, অবশ্যই একটা বড় প্রাপ্তি।
আমার মেয়ে আমাদের জন্য একটা টেবিলের কথা বলতে আমার আগেই ঢুকে গেল ভিতরে। সে সব সময় নিজেই সব কিছু করতে চায়। এমনকি ক্রাচ এবং অন্যান্য কিছুতেও সে নিজেই সব করে। তার অতিরিক্ত পরপোকারী কাজের কারণও ছিল তার ভাঙা পা। হাসপাতালে তারা আমাকে জিজ্ঞাসা করেছিল, আমি আমার মায়ের হাসপাতালে ভর্তির কাগজে সই করব কি না? এই রেস্তরাঁয় তারা জিজ্ঞাসা করেছিল যে তার মেয়ে কোথায় খেতে পছন্দ করবে ভিতরে বা বারান্দাতে? তার মেয়ে আমি, আমার মাকে হারিয়েছি ছোট বেলায়। এতে বরং ভালোই হয়েছিল। আমার কষ্টের ব্যাপক উপশম হয়েছিল। তিনি ছিলেন কুৎসিত এবং কর্তৃত্ববাদী এবং তিনি আমার জন্য আমার মিষ্টি, সুপুরুষ বাবাকে ছেড়ে চলে গেছিলেন। এই ঘটনাটা আমি আমার দুই স্বামীর কাছে অনেকবার বলেছি। আমার কাছে যখন বিষয়টা গুরুত্বপূর্ণ হয়ে ওঠে তখন আমি সেটাকে পুনরাবৃত্তি করতে পছন্দ করি। এবং শেষ বারের মত এই ষাট বছর বয়স্কের জন্য তারা দুজনেই হিংসুটে হয়ে উঠেছিল। এবং তাই আমি আর আমার মেয়ে একসঙ্গেই যাচ্ছি। আমার বাবা, তাকে আমি খুব ভালবাসতাম, এবং হতে পারে আমার বৃদ্ধ না হবার কারণ তিনিই। কারণ সময় কখনও চলে যায় না, এটা সব সময় একই থাকে, এমনকি তিনি অনেক বছর আগেই চলে গেলেও। একই অনুভূতি। অনুভূতিটাও একই রয়ে গেছে। আমরা সব সময়ই দেখা হওয়াটার অভাব বোধ করি। এমনকি যদি সেটা বিভিন্ন সময়ে হয় তাও। কিছু সময় পর আমার নাতিও এমনটাই বলেছিল। একটা সবজান্তা কৌতুহলী বয়ঃসন্ধি এবং দার্শনিক ভণিতা। এটা সব সময়েই মনে হয়। প্রধাণত মনে পড়ে যখন আমি পেডিকিওর করতে যাই। এই মুহূর্তগুলোকে আমি এড়িয়ে যেতে চাই, তখন আমি পেডিকিওর, ম্যানিকিওর, ওয়াসিং, হেয়ার-ড্রেসারসদেরকেও এড়িয়ে যেতে চাই তখন, কারণ তখনি ভাবনাগুলো ভিড় করে আসে। ওরা নিজেদের অস্তিত্ব জানান দেওয়ার ঠিকঠাক সময়ের সুযোগটা নেয়। ব্যাপারটা খুব অপ্রিতিকর ছিল। কিন্তু সৌভাগ্যক্রমে আমার খুব বেশি রক্ষণাবেক্ষণের প্রয়োজন হয় না। আবার বিপরীতে, আমার মেয়ে যে কিনা টাকা বাঁচানোর জন্য নিজের সবটাই নিজে করে। ভাবনাগুলোকে সে খুব একটা ভয় পেত না। একদমই নয়, অথবা সে তাদের চেয়েও উজ্জ্বল হয়ে থাকে। কিন্তু সে তার চুলগুলো বহুদিন যাবৎ রং করে না।
একটা ছোট্ট সাদা মাথা এবং একটা বড় বাদামী মাথা।আমরা আমাদের এই রকম কেক গুলো খেয়েছি। মা এবং মেয়ে, অতীতে। এবং আমার জন্মদিন গুলো? কেউ কি এখন তাদেরকে মনে করতে পারে? এটা সেই তখন থেকেই ঘটেছে যখন থেকে আমি জন্মদিন পালন করেছি। প্রকৃতপক্ষে এগুলো হয়েছে আমার বাবার মৃত্যুর পর। কবে জন্মেছিলাম আমি সেটা ভোলার ব্যবস্থা করে ফেলেছি। দিন, মাস এবং বছর ও। এবং সেই স্থানটাকেও ভুলে গেছি। এবং শেষ পর্যন্ত প্রত্যেকেই সেটা ভুলে গেছে।
কাছের টেবিলে বসা দুজন মানুষ আমাদের দিকে কেমন একটা চোরা চাউনিতে তাকাচ্ছিল। কিন্তু আমরা উঠে চলে এলাম। আমাদের হাতে নষ্ট করার মত কোন সময় ছিল না। আমাকে আমার বাড়িতে, আমার দ্বিতীয় স্বামীর কাছে ফিরতে হবে। সে আমার চেয়ে অনেকটাই, কিন্তু এতটাই বৃদ্ধ যে সে নিজের দূর অতীত, প্রস্রাব এবং হেঁটে চলে বেড়ানোর কোনটাই একা করতে পারে না। সমস্তটাই সমস্যার, দরকারি ওষুধের ক্ষেত্রেও ব্যাপারটা এরকমই। এবং তারপরেও তাকে আর তার হিংসুটেমি কে আমার সঙ্গে না আনার জন্য আমাকে ক্ষমা চাইতে হয়েছে। বাড়িতে আমরা দুজন শান্তিতেই থাকি আর আমি এখনও সেটার অভাব বোধ করি। সেই সময় আমরা এই ব্যাপারটাকে ভালোভাবেই সামলেছিলাম।
সবচেয়ে যতটা খারাপ ভাবে হতে পারে দিনটা ততটাই খারাপভাবে শুরু হয়েছিল। আমি তাকে বলেছিলাম, আমি কখনোই প্লাস্টিক সার্জারির দিকে যাব না। আমি খুব জোর দিয়ে বলেছিলাম, কিন্তু কোন লাভ হয় নি। হ্যাঁ, তোমার শাশুড়ির উচিত ছিল, কিন্তু এটা তার কাছে কোনও ব্যাপার ছিল না। কখনোই ছিল না। সে কখনোই তার সৌন্দর্য সম্পর্কে সচেতন ছিল না এবং এখন সে তার বার্ধক্যকে উপেক্ষা করে। কখনোই তার নিজের রূপ সম্পর্কে ভয় পাওয়ার মত অনেকটা সময় ছিল না এবং আমিও কখনো এরকম করিনি। আমরা দুজনেই কর্মরত মহিলা, আমরা প্রত্যেকেই নিজেদের ক্ষেত্রেই আছি। এবং আমরা আছি পরিবারের সঙ্গেই। এবং একটা অপ্রত্যাশিত সংবেদনশীল জীবন। আমার সেই বোকা নাতনিটা আমাকে বিশ্বাস করতো না। এবং কী করে একটা প্লাস্টিক সার্জারি আমাকে জীবনের এই সবকিছু দিতে পারে? প্রিয় আমি অবিশ্বাস্য রকম বেঁচে আছি এবং খুব ভালো ভাবেই বেঁচে আছি। আর এই বেঁচে থাকাটা এতটাই ভালোভাবে যে আমি ভয় পাই যে এই বাঁচাটা কখনোই শেষ হবে না। আমার মহান নাতনি রান্না ঘরের মেঝেতে টেবিলের কাছে খেলছিল।
রবিবার দিনটা সত্যিই খুব খারাপ ভাবে শুরু হয়েছিল। খুব বিরক্তিকর প্রশ্নটা দিয়েই প্রাতঃরাশটা শুরু হয়েছিল। নীচে যাওয়ার আগে আমি আয়নার সামনে নিজেকে অনেকটা সময় ধরে দেখলাম। আশায় ছিলাম এমন কিছু চিহ্নের, যে গুলো আমার বয়সটাকে বোঝাতে পারে। তখন আমার মেয়েটা ভিতরে এল। তার পোষাক তার কাঁধের হাড় ছেড়ে নেমেছে এবং তার কাগজের মত পাতলা বাহুগুলোর অর্ধেকটাই খোলা। রেশমি কাপড়ের পোষাকের নীচে তার শরীরটা এখনও তার প্রকৃত আকৃতিটা ধরে রেখেছে। কিন্তু ত্বকের নীচে প্রায়শই ঘটে চলা বিস্ফোরণের জন্য এটা ঝাপসা হয়ে গেছিল। সে তার চকচকে আর ছোপ ছোপ দাগ পড়া চকচকে ডান হাতের আঙ্গুলগুলো দিয়ে একটা কাপ ধরেছিল। তার আঙ্গুলগুলোর নখগুলো সব দাঁতে কাটা, এই দাঁত দিয়ে নখ কাটার অভ্যাস সে আজও ছাড়তে পারে নি। তার কোলে চড়ে বসে তার নাতনি একটা বিস্কুটে কামড় দিচ্ছিল। সে তার ঠাকুমাকে চুমু খেল এবং বললো, হ্যাপি বার্থডে ঠাকুমা, সবাইকে হ্যাপি বার্থডে। আর আমাকে বললো, তুমি কবে জন্মেছিলে ঠাকুমা? তুমি আমাকে প্রমাতামহী বা বড়মাও বলতে পার, এই উত্তরটা না দিয়ে আমি উত্তর দিলাম, তুমি তো একটা ঠাকুমা ইতিমধ্যেই পেয়েছ। আমি আমার মেয়ের মাথায় চুমু খেলাম, তার মাথায় চুলও বেশ কমে গেছে। তারপর আমি সাজসজ্জার জন্য চলে এলাম। আমার জন্য কী রাখা ছিল? পৃথিবীতে কি আমার মত অবস্থায় কেউ আছে? করিডরের আয়নাটার সামনে দিয়ে আমি আবার গেলাম। এবং তারপরে আবার আমার শোবার ঘরে। রাতের গাউনটা না পরেই আমার চুলগুলোকে আঁচড়ালাম। দৃঢ় স্তন, নিতম্ব, পা, আমার সেই ত্বক, সবই তো সর্বত্র সেই একই রকম রয়েছে। এবং আমার মেয়েটা আবার নীচে চলে এল। তার সঙ্গে এল তার পুত্রবধূ এবং নাতনি। সত্তর, যে বয়সটা আমি কিছুদিন আগেই পেরিয়ে এসেছি, এবং তারপরেও সেখানে, অন্য সব সময়ের মতই সমুদ্রের ধারের সেই বাড়িটাতে আমি ছিলাম। আমার পদচারনা, আমার অনলস অঙ্গভঙ্গি, আমার হাসি, আমার দৃষ্টি-- হ্যাঁ, আমার জীবন। এই সমস্ত জীবনের উপযোগিতাটা কী? নাতি নাতনি এবং পো-নাতি পো-নাতনিদের ব্যাবস্থাপনায় সেই সন্ধ্যায় সেখানে হয়ে যাওয়া সারপ্রাইজ পার্টির চিহ্ন খুঁজতে আমি সেই ঘরের মধ্যে হাঁটতে লাগলাম। এবং আগের বেড়ালটার মতই কালো সেই জ্যাঠা মার্কা বেড়ালটা আমার মেয়ের বিছানায় বছরের পর বছর ধরে জমে থাকা গন্ধে নাক ডুবিয়ে কুঁকড়ে শুয়ে ছিল। এটা আমার প্রথম স্বামীর ছিল, এবং কিছু বছর পরে আমার দ্বিতীয় স্বামীও সেটা পেয়েছিল। চেয়ারের উপর তার পরার জামাকাপড় গুলো পড়ে ছিল। আমি কিছু লুকোতে চাইলে অথবা আমি যদি একটা ছদ্মবেশ ধারণ করতে চাই তবে কোনটা পরবো। অতিথিদের শৌচাগারে অনেক মোড়ক আর ফুলের তোড়া, সব জলের মধ্যে পড়ে আছে। ঘরের বাইরের গ্রীষ্মের উষ্ণতা সবসময়ই আমাদের পার্টিকে ঘিরে রাখে। কালক্রমে অন্ততঃ দুটো বেড়াল সেখানে ছিল যাদেরকে প্রায় একই রকম মনে হয় বলে গুলিয়ে ফেলাটাও খুব সহজ ছিল। একজনের পরে আর একজন, বয়ঃক্রম অনুসারে পরপর। আমাকেই আমার সব কাজ করতে হয়।
আজ আমার কন্যা আশি বছর বয়সের হল। খুব কম সময়ের এবং দ্রুত সম্পন্ন হওয়া একটা উদযাপন অনুষ্ঠান। এখন মোমবাতি গুলো নেভাবার সময়। প্রত্যাশিত প্রযুক্তির অভাবের মধ্যেও আমরা তাকে সাহায্য করলাম, এবং সেখানে খুব একটা জটিলতা ছিল না। একটা গভীর শ্বাস নেওয়া এবং তারপর সেটাকে ছেড়ে মোমবাতিটাকে নেভানো। সবাই একসঙ্গে। চুমু এবং সাদর করতালিতে তার অভিব্যক্তিহীন তাকিয়ে থাকাটাকে উদযাপন করা হল। তারপর সম্ভবত নিশ্চিত ভাবেই সে বিছানায় গেল। অবশেষে সে বিশ্রাম পেল। তার জন্য এটা একটা সৌভাগ্য।
লেখক পরিচিতি:
ব্রেন্ডা পরস্টার ফিলাডেলফিয়াতে জন্মেছিলেন। কলিম্বয়া বিশ্ববিদ্যালয় থেকে ইংরেজি এবং তুলনামূলক সাহিত্যে স্নাতক হন। ইতালির ফ্লোরেন্সে তিনি বহু বছর স্কুলে ইংরেজি পড়িয়েছেন। ইতালিয়ান কবিতার রিভিউ লিখেছেন বিভিন্ন পত্র-পত্রিকায়। বহু পত্রিকায় তাঁর ইংরেজি এবং ইতালিয়ান ভাষায় লেখা কবিতা গল্প এবং প্রবন্ধ ছাপা হয়েছে।
অনুবাদক : অনিন্দ্য পাল
ঠিকানা*
======
অনিন্দ্য পাল
প্রজত্নে -- বিশ্বনাথ পাল
গ্রাম -- জাফরপুর
পোঃ-- চম্পাহাটিি
পিন - ৭৪৩৩৩০
থানা -- সোনারপুর
জেলা -- দক্ষিণ চব্বিশ পরগনা
পশ্চিমবঙ্গ, ভারত
Mob: 9163812351