Click the image to explore all Offers

গল্প।। বন্ধ কোরো না পাখা ।। অভিষেক ঘোষ


 

বন্ধ কোরো না পাখা

 অভিষেক ঘোষ 

 

মোজেস আর সূরিয়াস পার্বত্য অধিত্যকার বন্ধুর ভূভাগ অতিক্রম করে নেমে আসছে সানুদেশ পঞ্চনদের দেশে শৈত্য প্রবল

আর্যাবর্তের গাঙ্গেয় অববাহিকার তুলনায় এখানে বর্ষণ স্বল্পতর, প্রকৃতি মনোলোভা ধরিত্রীমাতা এখানকার অধিবাসীদের অন্তর করেছেন কুসুমকোমল, হৃদয়ে অর্পণ করেছেন পুরুষকার, বহিরঙ্গে নগাধিরাজতুল্য উচ্চতাঅন্তরের বিস্তারে, দার্ঢ্যে এরা মহীয়ান খরস্রোতার মতো চঞ্চল, হিমাদ্রির তুল্য শীতল নিশ্চল

 মোজেস এসে দাঁড়ায় এক নাতিকায় দেবায়তনের দ্বারদেশে সূরিয়াস দ্বারদুটি উদ্ঘাটন করে প্রবেশ করে গর্ভগৃহে দেবগৃহের গর্ভকক্ষটি তমসাচ্ছন্ন একটি বৃহদায়তন দীপ রজনীর তমসা অতন্দ্র কর্তব্যে মোচন করে করে প্রভাতে নিষ্প্রভ হয়ে গেছে, তবু নির্বাপিত হয়নি মন্দিরে দীপালোক অহর্নিশ প্রজ্জ্বলিত থাকে সূরিয়াস গর্ভগৃহের দক্ষিণপার্শ্বের বৃহত্ বাতায়নটি খুলে দিলে বহির্লোকের অনাদি জ্যোতিঃ এবং হিমস্পর্শী সমীরণ ছুটে আসে

মুহূর্তে উদ্ভাসিত হয়ে ওঠে সেই কক্ষ, আদিত্যদেবের ভাস্বর প্রতিমার দুটি বৃহত্ আয়ত চক্ষু প্রভাতের সকল দীপ্তি নিয়ে প্রোজ্জ্বল হয়ে ওঠে

আদিত্যস্তব উচ্চারণ করতে করতে কক্ষে প্রবেশ করে সূরিয়াস

এই আদিত্যপ্রতিমা মিহিরাদিত্য নামেই সমধিক প্রসিদ্ধ দূর প্রদেশ থেকে পুণ্যার্থীর দল এখানে আসেন এই স্থানে আদিত্যগৃহ বিরল নয় এই মন্দিরটি ঐশ্বর্যমণ্ডিত নয়, তবে লোকবিশ্বাস অনুসারে, আদিত্যদেব এখানে নিত্যজাগ্রত তাই ভক্তকুলের শ্রদ্ধার দানে মন্দিরটির ব্যয় নির্বাহ নিত্যার্চনের কর্তব্য সম্ভব হয়

সূরিয়াস শাকদ্বীপীয় ব্রাহ্মণ দূর অতীতে তার পূর্বপুরুষ মধ্যপ্রাচ্যের শকস্থান থেকে এদেশে এসেছিল জাতিতে ভোজক ব্রাহ্মণ এই নিত্যপূজকদ্বয় মন্দিরটির রক্ষণাবেক্ষণ করে, তাদের বয়স বেশি নয় মোজেস এই সবে ঊনবিংশতি বর্ষে পদার্পণ করেছে সূরিয়াস তার খুল্লতাতের জ্যেষ্ঠপুত্র তার বয়স অনধিক পঞ্চবিংশতি বর্ষ সে শাকদ্বীপীয় প্রথায় সূর্যার্চনের শিক্ষা নিয়ে কিছুদিন হল এই মন্দিরের দায়িত্ব পেয়েছে তার পিতা পক্ষাঘাতে পঙ্গু হয়ে শয্যালীন তিনিই ছিলেন এই মন্দিরটির প্রধান পুরোহিত নাম, কিছু একটা ছিল বটে, এখন সকলেই তাঁকে ভানুমিত্র নামে চেনে

সায়ংকালের পরে এই মন্দির বিজন হয়ে যায় দিবাকালীন ভক্তদলের যাতায়াত নিমেষেই বন্ধ হয়ে গেলে মোজেস সূরিয়াস দ্রুত মন্দিরের কপাট রুদ্ধ করে স্থান পরিত্যাগ করে

কথিত আছে, মিহিরদেব রাত্রিকালে নররূপে মন্দির পরিভ্রমণ করেন শোনা যায়, অনেকেই নাকি গভীর রাতে আপাদজানু চর্মাবৃত কঠিন পাদুকার খট্ খট্ গম্ভীর ধ্বনি শুনেছে

এই সূর্যপ্রতিমার রূপ ভিন্নতর পায়ে গামবুট, শরীরঢাকা জোব্বামণ্ডিত দেহ, কোমরে রত্নময় কটিবন্ধনী, কণ্ঠে প্রলম্বিত রক্তমালিকা বক্ষে বর্ম, মাথায় উষ্ণীষ ধারণ করে খড়্গপাণি আদিত্য সাতঘোড়ার রথে আরূঢ় আদিত্যের একটি হাতে বরমুদ্রা হাতে বাজুবন্ধ, কপালে রত্ন, শরীরে অব্যঙ্গ উপবীত প্রতিমা বৈদেশিক এর অর্চনা ভিন্নতর অর্চনায় সামান্য ত্রুটি হলেও আদিত্যকোপে পতিত হতে হয়

 

রাত্রি দ্বিপ্রহর গতপ্রায় চরাচর যেন লোকান্তরের নিশ্ছিদ্র তমসার চাদরে আবৃত শারদচন্দ্রিকা মহামেঘভারে নিমীলিতপ্রায়নক্ষত্রদল যেন কোন্ অযাচিত আতঙ্কে বারিগর্ভ মেঘের অন্তরালে সুপ্ত থেকে বিপদের প্রহর গুনছে হিমস্পর্শী বায়ু যেন কিঞ্চিৎ দ্রুততর হয়ে আদিত্যালয়ের উন্নত চূড়ার প্রস্তরবক্ষে কাঁপন ধরিয়ে ছুটে যাচ্ছে দূরে বিতস্তার কূলে

একটি যাত্রীদল এসে থামে মন্দিরপ্রাঙ্গনেছোটো দল, তিনটি উষ্ট্রে, দুটি অশ্বে এবং একটি চতুর্দোলায় সমধিক দশটি নারী-পুরুষ, তাদের ব্যবহার্য আবশ্যক সামগ্রী

সম্ভবতঃ তারা বিদেশী, এই স্থানের বিধি-বিধান তাদের জানা নেই অথবা তারা জানে, কিন্তু নিরুপায়

দলটির এক পুরুষসদস্য, হয়তো বা দলপতি উষ্ট্র থেকে নেমে আসে তার পোষাকে আভিজাত্যের ছাপ স্পষ্ট কটিদেশে রত্নময় খড়্গ, শিরে তেমনই বহুমূল্য উষ্ণীষ, গলে লম্বমান মুক্তার মালিকা, তার মধ্যস্থলে একটি বৃহত্ দ্যুতিময় হীরকখণ্ড আগন্তুকের ললাটে জ্যোতির্ময় আদিত্যমণ্ডলের প্রতিরূপ অঙ্কিত বোঝা যায়, এই ব্যক্তি সূর্যোপাসক

কুণ্ঠিত, ইতস্ততঃ পদক্ষেপে ব্যক্তি এগিয়ে চলে মন্দিরের গর্ভগৃহের অভিমুখে পশ্চাতে নিশ্চল সহযাত্রীদল, ধীরপদক্ষেপে সোপানশ্রেণী অতিক্রম করে করে লোকটি অগ্রসর হয়

গর্ভগৃহের দ্বারদুটি ভিতর থেকে রুদ্ধ এটি দেখতে পেলে আগন্তুক নিশ্চয়ই বিস্মিত হতো অথবা আগন্তুক একথা জানে কি?

সে ধীরে ধীরে করাঘাত করে মন্দিরের দ্বারে পরপর তিনবার তারপর একনিমেষের ব্যবধানে আবার তিনবার একইভাবে আবারও তিনবার তারপর ধীরে ধীরে উদ্ঘাটিত হতে থাকে দ্বারদেশে একটি ছায়ামূর্তি অস্পষ্ট থেকে ক্রমশঃ স্পষ্ট হয় সূরিয়াস একটি ক্ষীণপ্রভ দীপ হাতে নিয়ে মন্দিরদ্বারে দাঁড়ায় আগন্তুক এগিয়ে এসে একটি পাঞ্জা দেখায় এবং একটি মুদ্রাঙ্কিত পত্র এগিয়ে দেয় পত্রটি বহুমূল্য চর্মে লিখিত, তার চারটি পার্শ্বে স্বর্ণ রৌপ্যের সূক্ষ্মজটিল মনোরম কারুকার্য, একটি সঙ্করধাতুর দণ্ডে সংযুক্ত করে হিরণ্যসূত্রে যত্নে বদ্ধ হয়েছে সূরিয়াস পত্রটি গ্রহণ করে নামমুদ্রাটি পরীক্ষা করে সম্রাট বাসিষ্কের নাম সংযুক্ত পত্রে অনুজ্ঞা পত্রবাহকের নাম লেখা আছে আগন্তুকের নাম মিহিরগুপ্ত প্রীতমুখে চোখের ইঙ্গিতে ভোজক ব্রাহ্মণ কিছু নির্দেশ করে স্থানুবত্ দণ্ডায়মান মিহিরগুপ্ত দ্রুত ফিরে আসে চতুর্দোলার কাছে পটাবরণ অপসারণ করে দুজন নারী একটি কিশোরী কন্যাকে নামিয়ে আনে কিশোরী সংজ্ঞাহীন, তার বেশভূষা অবিন্যস্ত কিন্তু রাজকীয় মেয়েটির বয়ঃক্রম আনুমানিক পঞ্চদশ কি ষোড়শ মুখশ্রী অপরূপ কিন্তু দীর্ঘ রোগপীড়ায় ক্লিষ্ট বিশেষ কিছু লক্ষ্য করা যায় না, সকলে ধরাধরি করে মেয়েটিকে গর্ভগৃহে প্রবেশ করে অস্পষ্ট বার্তালাপ শোনা যায়, মৌহূর্তিকের ভবিষ্যদ্বাণীতে শয্যালীনা মেয়েটির আয়ু হয়ত আর কয়েকদিন বা তাও নয় হয়ত প্রভাতের আগেই তার প্রাণবায়ু নির্গত হয়ে যাবে মিশে যাবে মহাকালের গর্ভে দুরারোগ্য অনির্ণেয় কোনও পীড়ায় মেয়েটি ক্ষীণ, তার বাকরোধ হয়ে গেছে

মোজেস একটি অদ্ভুতদর্শন পাত্র থেকে মেয়েটির মুখে পেয় শীতল জল দেয় ওষ্ঠের প্রান্তদেশ থেকে জলের ধারা নেমে যায় অসাড় হয়ে আসা দেহটি যেন আরও বিশীর্ণ দেখায় সূরিয়াস তার নাড়ীপরীক্ষা করছিল একমনে হঠাৎ ধীরে ধীরে মাথা নাড়ে সে মিহিরগুপ্ত আশঙ্কিত মুখে তাকায় তার মুখ শিশিরদষ্ট পদ্মপত্রের মতো ক্লিশ হয়ে ওঠে ক্ষণিকেই

সূরিয়াস বলে, " আমার অধীতবিদ্যা যদি সত্য হয়, আমার উপলব্ধি যদি অভ্রান্ত হয়, তবে এই কন্যা দীর্ঘজীবিনী হবেন আমার পরিবারে মৌহুর্তিক বিদ্যা বংশপরম্পরায় চর্চিত, আমি বয়সে নবীন, কিন্তু এই বিদ্যাপ্রয়োগে এখনও আমার কিছু ত্রুটি ঘটেনি আমার প্রতি যদি আস্থা রাখেন…"

মিহিরগুপ্ত উজ্জ্বল মুখে বলেন, "আপনাদের বংশপরম্পরায় অভ্রান্ত গণনার কথা প্রসিদ্ধ দূর উত্তরাপথেও ভানুমিত্রের প্রসিদ্ধি অধুনা তিনি পক্ষাঘাতে পঙ্গু ভ্রষ্টস্মৃতি সেকথা আমাদের জানা ছিল না এটি আমার একমাত্র কন্যা, ত্রয়োদশবর্ষীয়া যখন, তখন থেকেই অসূর্যম্পশ্যা, রৌদ্রের স্পর্শমাত্রেও ওর প্রাণবায়ু নির্গত হয়ে যাওয়ার উপক্রম ঘটে দোহাই আপনার, আপনি এর প্রাণরক্ষা করুন"।

"বিচলিত হবেন না" সূরিয়াস বলে, "কোনও অজ্ঞাত বা জ্ঞাত অনাচারেই কন্যা আজ বিপন্না তবে ওর কপালে মৃত্যু নেই দীর্ঘ জীবনপথে মিহিরাদিত্য নিশ্চয়ই সর্বতোভাবে রক্ষা করবেন একটি উপায় আছে একটিই মাত্র

"আমি অত্যন্ত কুণ্ঠিত, নিয়মের বিরুদ্ধে এইভাবে রাত্রিকালে এই মন্দিরে উপস্থিত হয়েছি স্বীকার করি, অন্যায় আমার অনবধানতাবশত নয়, জ্ঞানতঃ, দীর্ঘকালীন নিয়মের ব্যত্যয় ঘটিয়েছি দেব ভানু আমাকে যে শাস্তি দেবেন আমি তা নতশিরে স্বীকার করি কিন্তু আমার কন্যাটিকে আরোগ্য দিন প্রভু" স্খলিত স্বরে বলেন মিহিরগুপ্ত

"বিচলিত হবেন না, মিহিরদেবের ইচ্ছার ব্যতিরেকে কিছুই হওয়ার নেই পাপপুণ্যের তিনিই একমাত্র বিচারক, তিনি জ্যোতিরুত্তম, দিবশ্চক্ষুআপনি মাননীয় সম্রাটের প্রতিনিধি আমার গণনায় প্রমাদ নেই আপনি ধৈর্য ধারণ করুন" দৃঢ়স্বরে বলে সূরিয়াস

একটি ব্যজন হাতে নিয়ে সে পার্শ্ববর্তিনী দুই নারীকে ইঙ্গিত করে, তারা মেয়েটিকে পূর্ববত্ বহন করে নিয়ে চলে মিহিরগুপ্ত অগ্রসর হতে যান সূরিয়াস দক্ষিণহস্ত ঊর্ধ্বে উত্তোলিত করে বলে ওঠে "আপনি সপার্ষদ নির্ভয়ে এখানেই থাকুন"

আদিত্যবিগ্রহের পশ্চাতে একটি ক্ষুদ্র প্রস্তরপীঠ সেটি অপসারণ করলে দেখা যাবে একটি শীর্ণ সোপানশ্রেণী ক্রমশঃ অতল অন্ধকারে তলিয়ে যাচ্ছে এটির সন্ধান একমাত্র বংশপরম্পরায় এই মন্দিরের পূজকগণই জানেন কেবল কিন্তু এখানে নয়, রোগজীর্ণা কন্যাটিকে নিয়ে তিনটি ছায়ামূর্তি এগিয়ে চলে মন্দিরের বহির্দেশে বাইরে ঘোরা রজনীর সূচীভেদ্য তমঃ, বায়ু পূর্ববত্ চঞ্চল, চারপাশের তরুশ্রেণীর আন্দোলনে এক অপূর্ব নিক্কণধ্বনি শোনা যায়, তাকে যেন গ্রাস করতে চায় মহীরুহগুলির উন্মত্ত আন্দোলনের কোলাহল, দূরে দূরে রাতপাখির তীক্ষ্ণ আর্তরব, কখনও বা অশ্রুতপূর্ব কিছু ধ্বনি, যেন অমর্ত্যলোকের হাহাকার বহন করে চলে

সূরিয়াস ঊর্ধাকাশের দিকে তাকিয়ে ভ্রূকুঞ্চিত করে তার ললাটে এই হিমের রাতেও কিছু স্বেদবিন্দু দেখা দেয়

সে অনুচ্চস্বরে মন্দিরপার্শ্বের এই অরণ্যভূমির একটি নির্দিষ্ট স্থান দেখিয়ে বলে, "কন্যাকে এখানে শায়িত করে তোমরা মন্দিরে ফিরে যাও"

রমণীদ্বয় ইতস্ততঃ করছে দেখে আরক্তমুখে সূরিয়াস সংক্ষেপে বলে "আমার আদেশ"

দুই নারী ত্বরিতে নিষ্ক্রান্ত হয় সূরিয়াস হতচেতন কন্যাটির দেহে ব্যজন করে সর্বাঙ্গে বুলিয়ে দেয় শ্বেতচামর তারপর একটি দীর্ঘশ্বাস ত্যাগ করে এগিয়ে যায় মিলিয়ে যায় অরণ্যের গভীরে

 

সুড়ঙ্গপথে একটি উজ্জ্বল দীপ নিয়ে নেমে চলেছে মোজেসঅতলান্ত পথ যেন, তবু শেষ হয় এক বর্গাকার চত্বরে ঘন অন্ধকার, স্বল্পালোকে তবু চোখে পড়ে চারটি প্রস্তরময় কঠিন ভিত্তি, কোণে কোণে জমে থাকা অগাধ দুর্ভেদ্য অন্ধকার পার হয়ে চোখে পড়তে পারে একটি সংকীর্ণ অলিন্দ চত্বরের একটি কোণ থেকে ক্রমশঃ দুর্জ্ঞেয় অভ্যন্তরে প্রবেশ করেছে পথটির মুখে পড়ে আছে একটি প্রাচীন নরকঙ্কাল, তার করোটি অপরাপর অস্থিসমূহ দুর্বল হয়ে ঈষৎ বিচ্ছিন্নপ্রায় কোনও দীর্ঘদেহী মানুষের কঙ্কালটির শ্বেতকায় কালের প্রবাহে ম্লান হয়েছে, তবু যেন তার দন্তবিকাশের দারুণ বিভীষিকা সকল ফেলে আসা সময়ের নির্বাপিতপ্রায় ইতবৃত্ত, অপসৃয়মাণ কাহিনীর অন্তরালের দুর্মর রহস্যকুটিলতাকে সপ্রাণ করে তোলে মোজেস কঙ্কালটির দিকে অপাঙ্গদৃষ্টি নিক্ষেপ করে হাতের দীপটি ভূমিতে স্থাপন করার জন্য নত হতে যায় দেবতার নির্দেশ যেমন ভাবেই হোক তা পরিপালন করতে হবে নত হতেই তার গ্রীবায় একটি শীতল ধাতবস্পর্শ অনুভূত হয় পশ্চাতে একটি বজ্রকঠিন কণ্ঠস্বর শোনা যায়, "যদি মরতে না চাও, স্থির থাকো"

মোজেস ত্বরিতে দীপটি নিবিয়ে দেয় ঘরে নেমে আসে সূচীভেদ্য অন্ধকার

 

সূরিয়াস ধীর পদক্ষেপে অরণ্যভূমিতে প্রবেশ করে একটি সুবৃহত্ বৃক্ষশাখার অন্তরালে নিজেকে গোপন করে ব্যজন চামর পরিত্যাগ করে বৃক্ষের একটি গোপন স্থান থেকে গ্রহণ করে তীক্ষ্ণধার অসি দ্রুত পদক্ষেপে এগিয়ে চলে পূর্বের স্থানে সেই বৃক্ষতলে শায়িতা কন্যাটি তখন নিদ্রা ত্যাগ করে উঠে বসেছে তার চক্ষুদ্বয় চতুর্দিকে কিছু অনুসন্ধান করছে যেন একসময় সম্মুখে দৃকপাত করেই সে চমৎকৃত হয়, তার শরীরের ভিতরে বয়ে চলে হিমস্রোত

"কে তুমি" কঠিন কণ্ঠে সূরিয়াস প্রশ্ন করে তার হাতে উদ্যত অসি

"আমাকেআমাকে মারবেন না আমি প্রাণভিক্ষা চাইছি আমি রাকা"

"আমি নারীহত্যা করি না আমি যে কোনও হত্যার বিরুদ্ধে একমাত্র জীবনরক্ষার জন্য যদি অস্ত্র ধরতে হয়, সেজন্যই এই অসি অসি আমি ধারণ করেছি ভয় নেই, তুমি যদি নির্দোষ হও, তোমার জীবনের আশঙ্কা নেই কিন্তু তুমি অসুস্থা নও তবে কেন এই প্রতারণা"?

"আমার জীবনসঙ্কট রোগে মৃত্যু না হলেও ওরা আমায় হত্যা করবেই, আপনি আমাকে রক্ষা করুন"

"ওরা কারা, কারা তোমাকে হত্যা করতে চায়, নির্ভয়ে বলো, আমি মগজাতীয় ভোজক ব্রাহ্মণ তোমার ললাটে মৃত্যু নেই, আমি দেখেছি এখন নিশ্চিত হলাম, কিন্তু মিহিরগুপ্তের মতো ব্যক্তি, যিনি সম্রাট বাসিষ্কের স্নেহধন্য, তাঁর কন্যা হয়ে তোমার কীসের ভয় কন্যে"?

"আপনি যা জানেন তা সত্য নয়, ভ্রান্ত"

 

মোজেস হস্তে ধৃত দীপটি এক নিঃশ্বাসে নির্বাপিত করে ভূমি ফেলে দিয়ে পশ্চাতের ব্যক্তিকে বলল, "মিহিরগুপ্ত, আপনি যা করেছেন তা মন্দিরের নিয়মবিরুদ্ধ এই অতলে প্রবেশাধিকার একমাত্র নিত্যপূজকের বংশক্রমে আমরা এই কর্তব্য পালন করছি এখানে অনুপ্রবেশকারী প্রতারকের মৃত্যু অবধারিত আমি নিরস্ত্র আদিত্য আমায় রক্ষা করবেন আর তোমাকে তোমার কর্মের যথাযোগ্য শাস্তিবিধান করবেন যদি দীপের আলোয় দেখে থাকো, তাহলে জানবে, এখানে আনাচে কানাচে এমন নরকঙ্কাল বায়ুভূত হওয়ার দিন গুনছে"

"কঙ্কাল তো তুই হবি, তোর মৃত শরীরটা এখানেই থাকবে আর মগটা যদি ফিরে আসে, সেও তোর পাশেই স্থান পাবে, নিশ্চিন্ত থাক"

"আমি এখনও বলছি আদিত্যদেব তাঁর ভক্ত আর তাঁর সম্পদ একাই রক্ষা করবেন আর বিনাশ করবেন শত্রুদের, যেমন পূর্বেও করেছেন" মোজেস বলে, তার কণ্ঠ হিমশীতল, কিন্তু তা অবরুদ্ধ হয়ে আসে

"আর শত্রুর শেষ রাখতে নেই" পশ্চাতে আরেকটি গম্ভীর বজ্রকঠিন স্বর বেজে ওঠে অন্ধকারে তীক্ষ্ণ অসির সামনে মৃত্যুমুখে থাকা এক ভোজক তরুণ ব্রাহ্মণ, আর খড়্গধারী দুজনেই কেঁপে ওঠে, তারপরেই তরবারি প্রবল আঘাতে খসে পড়ে মিহিরগুপ্তের খড়্গ, গগনবিদারী অন্তিম আর্ত চীত্কারে খসে পড়ে মিহিরগুপ্তের শরীরউপর থেকে সোপানশ্রেণী ধরে ক্রমে নেমে আসে দীপহস্তা রাকা

মোজেস সবিস্ময়ে দেখে তাকে

সূরিয়াস স্মিত হেসে বলে, "এই হল রাকা আর এই ব্যক্তি মিহিরগুপ্ত নন, মিহিরগুপ্ত তাঁর মৃত্যুপথযাত্রিণী কন্যা এণা সম্রাটের মুদ্রাঙ্কিত পত্র নিয়ে এই দেবালয়ে আসছিলেন, সত্য পথে এণার মৃত্যু ঘটে দুরারোগ্য চর্মরোগে এণার প্রাণবায়ুটুকুই ছিল কেবল তা পথশ্রমে নির্গত হলে শোকসন্তপ্ত মিহিরগুপ্তের কাছ থেকে সাহায্যের ছলে সকল কাহিনী জেনে সর্বস্ব লুণ্ঠন করে মিহিরগুপ্তকে হত্যা করে এই ব্যক্তি এর অনুচরেরা মিহিরগুপ্তের পরিচারিকা রক্ষীদের হত্যা করে তাদের রূপ ধারণ করল আর এই ব্যক্তি নিল আদিত্যোপাসক মিহিরগুপ্তের বেশ এর নাম মণিভদ্র সপ্তসিন্ধুর দেশের অত্যন্ত শঠ ধূর্ত এই প্রতারকের জীবিকা বাণিজ্য মূল্যবান রত্নের ব্যবসায়ী "

মোজেস ভূপতিত রুধিরস্রাবী দেহটি দেখে, তারপর সংশয়াকুল দৃষ্টিতে দেখে রাকাকে

সূরিয়াস বলে, রাত্রি প্রভাতের দিকে চলেছে উষাকাল সমাগত কাহিনী এখানেই শেষ নয় আরেকটি উপসংহার এবং আমার একটি পবিত্র কর্তব্য এখনও অকৃত আছে চল উপরে চল, আদিত্যের ভাস্বর জ্যোতিতে অন্তর-বাহিরের সকল অন্ধকার বিদূরিত হোক

দেবালয়ের প্রাঙ্গনে প্রস্তরমূর্তির মতো উষ্ট্র অশ্বগুলি দণ্ডায়মান ছিল শূন্য শিবিকাটি পড়ে আছে বৃক্ষতলেউদ্যত তরবারি নিয়ে ধাবমান সূরিয়াসকে দেখে অপরাপর প্রতারকগণ দ্রুত স্থান থেকে পলায়ন করেছে এরা দস্যু নয় নিতান্তই অর্থের লোভে মণিভদ্রের অনুগামী হয়েছিল রাকাকে আসতে দেখে সকল মায়া ত্যাগ করে প্রাণ বাঁচিয়েছে

সূরিয়াস দেবালয়ের বাইরে এসে প্রাণভরে শ্বাস নেয় হাতের রক্তমাখা তরবারি ফেলে দেয়, বাষ্পাকুল চোখে বলে "আমি নরহত্যা করেছি, কিন্তু দুটি প্রাণরক্ষা পেয়েছে আমি যে প্রায়শ্চিত্ত করেছি, মিহির আমাকে নিশ্চয়ই পতন থেকে রক্ষা করবেন"

"প্রায়শ্চিত্ত"? মোজেস সবিস্ময়ে জিজ্ঞাসা করে "কীসের প্রায়শ্চিত্ত দাদা"?

"পিতৃকৃত অপরাধের প্রায়শ্চিত্ত"

নীরবে দণ্ডায়মান রাকার দিকে তাকিয়ে মোজেস বলে "তার মানে"?

"আমার পিতা ভানুমিত্রের প্রকৃত নাম মায়ু তিনি যৌবনে আদিত্যসাধনায় একনিষ্ঠ ছিলেন ক্রমশঃ স্বীয় সাধনার বলে অর্জন করলেন অভিনব ঐন্দ্রজালিক শক্তি সেই সময় রবিসেন নামক জনৈক সূর্যব্রতী এলেন এই দেবালয়ে দুজনের প্রগাঢ় সৌহার্দ্য গড়ে উঠল রবিসেন তাঁর স্থৈর্য, অধ্যবসায় সাধনার বলে দেব মিহিরের আশীর্বাদ লাভ করলেন এই সময় দেশে অনাবৃষ্টি এল ভানুমিত্রের গণনায় ফল দিল না কিন্তু রবিসেন যে ভবিষ্যদ্বাণী করলেন তা অক্ষরে অক্ষরে মিলে গেল নির্দিষ্ট দিনে নামল ধরাপ্লাবী বর্ষণ ভানুমিত্রের মনে সঞ্চিত হতে থাকা ঈর্ষা তাঁকে ভ্রষ্ট করেছিল এরপর ভানুমিত্র কৌশলে বিশেষ অভিসন্ধিতে রবিসেনকে পাঠালেন গান্ধারে তাঁর পশ্চাতে নিয়োগ করলেন গুপ্তঘাতক রবিসেন গান্ধারে এক বণিককন্যার প্রণয়ে আবদ্ধ হলেন সেই গুপ্তঘাতক আর ফিরে আসেনি কোনও রহস্যময় কারণে সে একেবারে নিরুদ্দেশ হয়ে গেল বিবাহের পর তাঁদের একটি কন্যা ভূমিষ্ঠ হল কিন্তু নিয়তি বড়ই নির্মম রবিসেন তখন রত্নের ব্যবসায়ী মূলস্থানের আদিত্যালয় তাঁর সাধনক্ষেত্র একদিন তিনি জানতে পারলেন এই দেবালয়ে যুগ যুগ ব্যাপী এক অমূল্যরত্ন এক গূঢ়স্থানে রক্ষিত আছে তার তুল্য রত্ন পৃথিবীতে দুর্লভ সাধনার সর্বোচ্চ পর্যায়ে পৌঁছলে আদিত্য স্বয়ং তার সন্ধান দেন ধন আদিত্যের সম্পদ রবিসেন কীভাবে তা জেনেছিলেন তা বলা কঠিন কিন্তু বহুদিন পর তিনি আবার উপস্থিত হলেন এই সূর্যক্ষেত্রে পরম সুহৃত্কে বিশ্বাসভরে জানালেন এই তথ্য ভানুমিত্র প্রবল আক্রোশে ভূমির গভীরে পাতালকক্ষে বন্দী করলেন রবিসেনকে তাঁর ধারণা ছিল রবিসেন রত্নের সন্ধান জানেন কিন্তু প্রকৃত-ই তা দুর্জ্ঞেয় রবিসেনের কী পরিণতি হয়েছিল তা অনুমেয় কিন্তু ভানুমিত্রের পরিণতি হল দুর্বিষহ তিনি আদিত্যের কোপে পক্ষাঘাতে পঙ্গু জড়বত্ হয়ে গেলেন সকল শক্তি হারিয়ে প্রবল অনুতাপ অনুশোচনায় দগ্ধ হতে লাগলেন প্রতিনিয়ত তাঁর পূর্বজীবনের এই কাহিনী একমাত্র জানি আমি আর জানতেন মাতা এখন বুঝতেই পারছো রাকা কার সন্তান" দীর্ঘ বক্তব্যের পর একটি উষ্ণ শ্বাস ত্যাগ করে সূরিয়াস

মোজেস অবাক হয়ে তাকায় রাকার দিকে সূর্যের প্রথম আলো এসে তার অলকগুচ্ছে হিরণ্যের আভা ছড়িয়ে দিচ্ছে মুখে প্রসারিত হচ্ছে অনুপম কমনীয় জ্যোতিঃ লাবণ্য

"রাকা জানতো না এই কাহিনী তার মুখে তার পিতার নাম তাঁর অন্তিম গন্তব্যের স্থানটির নাম শুনে আমি চমৎকৃত হই" বলে সূরিয়াস

"কিন্তু…"

"জানি মোজেস, কী বলতে চাও রাকা অনাথ কিছুদিন পরেই তার মাতা সপরিবারে দস্যুদের হাতে নিহত হলেন শিশুটি দস্যুদের করায়ত্ত হল তাদের কাছ থেকেই মণিভদ্র ক্রয় করে শিশুটিকেসেও শুনেছিল এই দেবালয়কেন্দ্রিক কিংবদন্তীটি তার আশ্রয়েই রাকা পালিত তবে রাকার প্রকৃত পরিচয় তার জানা ছিল না রাকা ক্রীতদাসী মণিভদ্র তাকে কন্যারূপে পালন করেননি, মিহিরদেব-ই রাকাকে এইস্থানে নিয়ে এসেছেন"

একটি দীর্ঘশ্বাস ফেলে মোজেস কেবল বলে "যাক, এতদিনে রাকা তার সত্যিকারের গৃহ পেল আমি পেলাম একটি সুহৃত্"

রাকা লজ্জিতা হয়, তার মুখে ছড়িয়ে পড়ে কৌতুকের প্রভা

সূরিয়াস স্মিত হেসে বলে "পিতার কৃত পাপের প্রায়শ্চিত্ত আমি করার চেষ্টা করেছি জানি, নরহত্যা ক্ষমার যোগ্য নয় তবে যে অপরাধ অন্যের জীবন রক্ষা করে তা হয়তো মার্জনা পায় মিহিরাদিত্য আমাদের ক্ষমা করবেন, উত্তরণের পথ দেখাবেন নিশ্চয়ই"

সূরিয়াস তার দক্ষিণহস্ত প্রসারিত করে রাকার দিকে রাকার ধীরকম্পিত হাতদুটি ধীরে ধীরে স্পর্শ করে তাকে প্রভাতের অরুণকিরণ সেই মহামিলনের ক্ষেত্রে ছড়িয়ে দেয় স্বর্ণপ্রভা সূরিয়াসের হাতের স্বর্ণবলয় সেই আলোয় মণ্ডিত হয়ে সুদীপ্ত হয়ে ওঠে রাকার অঙ্গুলিতে ধৃত  পদ্মরাগমণিখচিত এণার অঙ্গুরীয়কটি জ্যোতির্ময় হয়ে ওঠে

****************************



Dr. Abhishek Ghosh 

Assistant Professor, Department of Sanskrit 

Bagnan College 

University of Calcutta 


Post a Comment

0 Comments
* Please Don't Spam Here. All the Comments are Reviewed by Admin.