অঞ্জন রায় চৌধুরী
কালীগঞ্জের চারু মুখুজ্জে ছিলেন অপুত্রক। তিনি আর তাঁর স্ত্রী বাস করতেন একটা ছোট্ট বাড়িতে। একটা ছোট খাটো মুদির দোকান ছিল চারু বাবুর। সারাদিন যা বিক্রি বাটা হতো, তাতে চারু বাবুর ছোট্ট সংসার কোনো মতে চলে যেতো। চারু বাবুর জ্যোতিষ চর্চার বড় সখ ছিল। তাঁর স্বপ্ন ছিল বড় জ্যোতিষী হওয়ার। বাজার থেকে পাঁজি আর কয়েকটা জ্যোতিষ শাস্ত্রের বই পত্র কিনে এনেছিলেন তিনি। অবসর সময়ে সেই গুলো পড়তেন আর দোকানে যে সমস্ত খোদ্দের জিনিস পত্র কিনতে আসতো, তাদের কখনো হাত দেখতেন, কখনো কোষ্ঠী বিচার করতেন। খোদ্দেরদের যা বলতেন তার কিছু মিলতো আবার কিছু মিলতো না। কিন্তু তেমন পসার ছিলো না চারু বাবুর। ফলে কেউই তাঁর কাছে নিজে থেকে আসতো না আর আসলেও দক্ষিণা দিত না।
কিন্তু চারু বাবু হাল ছাড়েন নি। বছরের পর বছর তিনি চেষ্টা করে চলেছেন একজন বাকসিদ্ধ জ্যোতিষী হওয়ার।
একদিন কালীগঞ্জ গ্রামে এক তান্ত্রিকের আবির্ভাব ঘটলো। নাম ভৈরব বাবা। গ্রামের বট তলায় তিনি কয়েকদিন বসছিলেন। গ্রামের মা বউরা কবচ তাবিজের আশায় তাঁর কাছে ধর্না দিতেন। তাঁরা কেউ চাল, কেউ ফল ইত্যাদি নিয়ে যেতেন ভৈরব বাবার সাথে সাক্ষাতের সময়। সারাদিন ধরে যা কিছু ভক্তদের কাছ থেকে পাওয়া যেতো তাতে কোনো মতে দিন চলে যেত ভৈরব বাবার। চারু বাবুর সাধু সঙ্গ করার একটা অভ্যেস ছিল। একদিন দোকান সকাল সকাল বন্ধ করে তিনি গেলেন ভৈরব বাবার কাছে। তখন প্রায় সন্ধ্যা হয়ে এসেছে। ভৈরব বাবার কাছে ভিড় ততক্ষনে পাতলা হয়ে গেছে। সুযোগ বুঝে চারু বাবু এগিয়ে গেলেন ভৈরব বাবার দিকে। "প্রণাম বাবা" বলে বাবার চরণ স্পর্শ করে প্রণাম করলেন। ভৈরব বাবা বললেন," বলো, কি চায় তোমার?" চারু বাবু বললেন," বাবা, আমার খুব বড়ো জ্যোতিষী হওয়ার খুব সখ, বাকসিদ্ধ জ্যোতিষী।" ভৈরব বাবা বললেন, "এর জন্য তো কোনো কবচ তাবিজ হয়না বাবু। এই সবের জন্য সাধনা লাগে। খুব কঠিন সাধনা। তুমি গৃহী মানুষ। তার উপর অদীক্ষিত। তোমার দ্বারা এই সাধনা হবে না। তুমি বরং অন্য রাস্তা দেখো গে।" কিন্তু চারু বাবু দমবার পাত্র নন। তিনি বললেন," আজ্ঞে তন্ত্র দীক্ষা হয় নি বটে কিন্তু ব্রাম্ভন হওয়ার সুবাদে ইষ্ট জপ করি। এই সাধনা কি কেবল সাধু সন্ত বা তন্ত্র দীক্ষিত লোকেরাই করতে পারেন, সাধারণ মানুষের কি অধিকার নেই সেই সাধনা করার?" ভৈরব বাবা খানিকক্ষণ চুপ থেকে বললেন," সেই সাধনা সাধারণ মানুষ করতে পারে কিন্তু তাকে সঠিক পদ্ধতি জানতে হবে। তবে গুরুর দেখানো পথ ছাড়া সেই সাধনায় সিদ্ধি লাভ করা খুব কঠিন। আর যদিও বা তার সিদ্ধি লাভ হয়, তাহলে কিছু নিয়ম না মানলে সেই মানুষের ধ্বংস অবশ্যম্ভাবী।"
চারু বাবু ভৈরব বাবাকে অনুরোধ করলেন," তাহলে আপনি আমাকে শিষ্য করে নিন, আমাকে তন্ত্র দীক্ষা দিন।" ভৈরব বাবা বললেন," আমি খুব নগন্য এক সাধু। এই সাধনা সম্পর্কে আমি জানি বটে কিন্তু শিষ্য আমি কাউকে বানাইনা, বা দীক্ষা ও দিই না। তবে তোমার একটা উপকার আমি করতে পারি।" " কী বাবা?" চারু বাবু জিজ্ঞাসা করলেন। "আমি তোমাকে এই সাধনার পদ্ধতি বলে দিতে পারি, মন্ত্রও বলে দিতে পারি, কিন্তু যদি কোনো বিপদ ঘটে তার দায় কিন্তু আমি নেবো না। সবটাই তোমাকে নিজের ঝুঁকিতেই করতে হবে। যদি রাজি থাকো ত বলো।" চারু বাবু তখন খ্যাতির নেশায় বুঁদ। ভালো মন্দ চিন্তা করার অবকাশ এখন তাঁর নেই। তাঁকে বাক সিদ্ধ জ্যোতিষী হতেই হবে যে কোনো মূল্যে। চারু বাবু রাজি হয়ে গেলেন ভৈরব বাবার শর্তে। ভৈরব বাবা বললেন," বেশ। আগামী কাল অমাবস্যা। গ্রামের শেষ প্রান্তে যে শ্মশান আছে সেখানে চলে আসবে। আমি তোমাকে সাধন পদ্ধতি বলে দেবো। মন্ত্র ও শিখিয়ে দেবো। এবার তোমার উপর বাকি টা নির্ভর করবে।" সেদিনকার মতো ভৈরব বাবা কে প্রণাম করে চারু বাবু নিজের বাড়ি চলে এলেন।
নির্দিষ্ট দিনে একটু রাত বাড়তেই সাফ শুদ্ধ হয়ে চারু বাবু চললেন গ্রামের শ্মশানে। সেখানে গিয়ে দেখলেন, কালী মন্দিরে শ্মশানকালীর সামনে বসে আছেন ভৈরব বাবা। চারু বাবু প্রথমে মা কে, তারপর ভৈরব বাবা কে প্রণাম করলেন। তারপর ওনার সামনে বসলেন। ভৈরব বাবা বললেন, " তাহলে তুমি সাধনার জন্য প্রস্তুত তো? " " আজ্ঞে হ্যাঁ" চারু বাবু মাথা নেড়ে সম্মতি জানালেন। ভৈরব বাবা বলতে লাগলেন," শোনো তবে। আজ অমাবস্যা। আগামী কাল আমি এই ঘাঁটি ত্যাগ করবো। আবার আমাদের কবে দেখা হবে, জানি না। আজ আমি তোমাকে সেই সাধনা, তার পদ্ধতি, মন্ত্র এবং বিধি নিষেধ সম্পর্কে বলে দেবো। তারপর থেকে তুমি যে কোনো কৃষ্ণ পক্ষের প্রতিপদ তিথি তে এই সাধনা শুরু করতে পারো। কিন্তু এর সুফল এবং কুফল দুটোর কোনোটারই দায় আমি নেবো না। ঠিক আছে?" চারু বাবু আবারও মাথা নেড়ে সম্মতি জানালেন। ভৈরব বাবা বলতে আরম্ভ করলেন, " বেশ, যে সাধনার কথা আমি তোমাকে বলতে চলেছি তার নাম কর্ণ পিশাচিনি সাধনা। এই বিশ্বে মানুষ আর প্রেতের মাঝামাঝি এক শ্রেণীর জীব আছে। তাদের বলা হয় পিশাচ। তারা মানুষের মতো বোধ বুদ্ধি বিশিষ্ট না হলেও এদের ক্ষমতা অসীম। যদি সাধক সাধনা বলে এদের তুষ্ট করতে পারে, তাহলে পিশাচ কে কাজে লাগিয়ে সে অনেক অসাধ্য সাধন করতে পারে। কিন্তু পিশাচ সাধনা করলে সাধকের মধ্যেও কিছু পৈশাচিক আচরণ লক্ষ্য করা যায়। সবচেয়ে বড় কথা পিশাচ নিয়ে কাজ করা আর আগুন নিয়ে খেলা দুটোই সমার্থক, একটু অসতর্ক হলে মৃত্যু অনিবার্য। তাই পিশাচ সাধনার আগে নিজের ইষ্ট দেবতার বীজ মন্ত্র জপ করে রক্ষা কবচ বানিয়ে নিতে হয়, যাতে বিপদ আসলে ওই কবচ রক্ষা করতে পারে। তাই অদীক্ষিত লোকজনদের পিশাচ সাধনা নিষেধ।
এর পরও কি তুমি সাধনা করতে চাও?"
চারু বাবু কিছুটা ভয় পেলেও প্রকাশ করলেন না। পাছে ভৈরব বাবা তাঁকে নিরুৎসাহ করেন, তাই তিনি বললেন," নিশ্চয় করবো বাবা। আমাকে বাক সিদ্ধ হতেই হবে। আপনি সাধন পদ্ধতি বলুন।" ভৈরব বাবা বললেন," বেশ। এই কর্ণ পিশাচিনি হলেন এক শ্রেণীর পিশাচ।এনাকে যদি তুষ্ট করতে পারো তাহলে এই পিশাচিনী তোমার কানে সর্বক্ষণ কিছু না কিছু বলতেই থাকবেন। আর এঁর মাধ্যমেই তুমি যে কোনো লোকের, যে কোনো বিষয়ের ভূত, ভবিষ্যত, বর্তমান জানতে পারবে। কিন্তু সাবধান। এই সাধনা খুব গোপন সাধনা। বাড়িতে তো কোনো মতেই নয়, বাইরে কোথাও করলেও কেউ যেনো জানতে না পারে আর একটা কথা, সিদ্ধি লাভ করলে নিজের স্ত্রী এর থেকে দূরে থাকবে, ঘনিষ্ঠ হয়েছ তো মরেছো।" চারু বাবু কারণ জিজ্ঞাসা করতে যাচ্ছিলেন, ভৈরব বাবা তাঁকে বললেন," যা বললাম, সেটা মেনে চলাই ভালো। নয়তো তুমি তো মরবেই সাথে তোমার স্ত্রীরও ক্ষতি হতে পারে। ভেবে দেখো। এখনও সময় আছে।" চারু বাবু বুঝতে পারলেন সাধনা সহজ নয়, বিপদ সঙ্কুল। কিন্তু তিনি খ্যাতির নেশায় মত্ত হওয়ায় সাধনা করার একটা চেষ্টা করবেন ঠিক করে ফেলেছিলেন। তাই উনি বললেন," ঠিক আছে। আমি রাজি।" ভৈরব বাবা তখন একে একে সাধন পদ্ধতি, সাধন মন্ত্র, সাধনার প্রয়োজনীয় সামগ্রী ইত্যাদি বিস্তৃত ভাবে চারু বাবু কে জানিয়ে দিলেন। চারু বাবু সব কিছু শুনে, বুঝে নিয়ে ভৈরব বাবাকে প্রণাম করে নিজের বাড়ি ফিরে এলেন। এরপর প্রতিদিন একটু একটু করে সাধনার সমস্ত সরঞ্জাম জোগাড় করতে লাগলেন তিনি।
এর পরের অমাবস্যা পক্ষের প্রতিপদ তিথির সকালে চারু বাবু বাড়িতে জানালেন এক বিশেষ কাজে তাঁকে শহর যেতে হবে। কাজ মিটতে দিন পনেরো লাগবে। তিনি তাঁর গিন্নি কে সেইদিন সকালে বাপের বাড়ি রেখে এলেন। বলে এলেন কাজ মিটলে চারু বাবু গিন্নি কে ফিরিয়ে নিয়ে যাবেন। সেদিন মাঝ রাতে চুপি চুপি নিজের বাড়ি থেকে বেরিয়ে কালীগঞ্জের শ্মশানে এলেন। সাধনার উপকরণ তিনি আগে থেকেই জোগাড় করে রেখেছিলেন। শ্মশানে পৌঁছে তিনি দেখলেন মরার কাঁথা মাদুর আর পোড়ানোর বাঁশ দিয়ে যে চালাটা ভৈরব বাবা তৈরি করেছিলেন নিজের জন্য শ্মশানের বট গাছের তলায়, সেটা এখনো অক্ষত আছে। চারু বাবু সেই চালাতে ঢুকলেন। পুজোর সমস্ত উপকরণ সেখানে রেখে এবার পুকুর থেকে স্নান করে এলেন। একটা ঘট কে ভালো করে রক্ত চন্দন লেপে স্থাপন করলেন ওই চালার ভেতরে। একটা তেলের প্রদীপ প্রজ্জ্বলিত করলেন। এইবার ভৈরব বাবা যে যে ভাবে পুজো পদ্ধতি বলেছিলেন সেই ভাবে পুজো করে তেলের মধ্যে আঙুল ডুবিয়ে মন্ত্র জপ করতে লাগলেন সারা রাত। তারপর জপ শেষে ঠিক সূর্যের আলো ফোটার আগেই তিনি কর্ণ পিশাচির উদ্দেশ্যে হোম সেরে পূজা সম্পন্ন করলেন সেই রাতের মত। এইভাবেই চলছিল সাধনা। চারু বাবু ভৈরব বাবার কথা মত চালাতেই রয়ে গেলেন। প্রাকৃতিক সকল কাজ কর্ম ওই চালার মধ্যে সম্পন্ন করতেন। স্নান করতেন না। নিজের বিষ্ঠা দিয়ে শরীরে তিলক কেটে সারাদিন মন্ত্র জপ করতেন আর পিশাচিনির ভৈরব বাবা বর্ণিত অবয়ব কল্পনা করতেন। এইভাবে পনেরো দিন অতিক্রম করার পর তিনি প্রায় হতোদ্যম হয়ে পড়লেন। ততক্ষনে তিনি প্রায় উন্মাদে পরিণত হয়েছেন। গায়ের রং কালচে হয়ে গেছে, দুর্গন্ধে পুরো চালা ঘর টা একটা নরকে পরিণত হয়েছে। তাঁর গা দিয়েও অতিশয় দুর্গন্ধ বেরোচ্ছে। সে একদম বিচ্ছিরি অবস্থা। সেই অমাবস্যার সন্ধ্যায় চারু বাবু সিদ্ধান্ত নিলেন আর না। আজ যদি সে আসে তো ভালো, নয়তো আজই শেষ সাধনা। তিনি আর সাধনা করবেন না আগামী কাল থেকে। গত পনেরো দিনে পিশাচ সাধনা করতে গেলে যত টা নিকৃষ্ট হতে হয়, যতটা পৈশাচিক হতে হয়, তিনি হয়েছেন। নিজ মল মুত্র এমনকী শ্মশানের শব দেহ থেকে মাংস পর্যন্ত তিনি ভক্ষণ করেছেন। আর পৈশাচিক তিনি হতে পারছেন না। এই সাধনার সিদ্ধি যদি আজ পাওয়া যায় তো ভালো, নয়তো আবার তিনি তাঁর পূর্ব জীবনেই ফিরে যাবেন। দরকার নেই বাক সিদ্ধির। এই সিদ্ধান্ত নিয়ে সন্ধ্যা থেকে তিনি উপাচার সাজিয়ে বসলেন সাধনায়। তখন প্রায় মধ্য রাত। তিনি হোম কুন্ডে পূর্ণ আহুতি দিলেন। চারিদিক নিস্তব্ধ নিঝুম। একটা গাছের পাতাও নড়ছে না। এমন সময় তাঁর নাকে এলো একটা তীব্র মিষ্টি গন্ধ। তিনি শুনতে পেলেন নূপুর পায়ে কে যেনো চালাঘরে প্রবেশ করলো। প্রদীপের হালকা আলোয় চারু বাবু দেখলেন এক অপরূপ সুন্দরী যুবতী। স্বল্প পোশাক পরিহিতা। চোখে মুখে তীব্র আকর্ষণ। সে ঢুকে ধীর পায়ে এগিয়ে এলো চারু বাবুর দিকে। পাশের নর কপালে যে কারণ বারী রাখা ছিলো, সেটা তুলে সে একটা চুমুক দিলো। তারপর চারু বাবুর মুখের কাছে সেটা এগিয়ে দিল। চারু বাবু যেনো মন্ত্র মুগ্ধ। ওই নর কপালে চারু বাবুও চুমুক দিলেন। সেই মিষ্টি তীব্র গন্ধটা চারু বাবুর ভেতরের জন্তুটাকে জাগিয়ে দিলো। চারু বাবু যুবতীর সাথে রতি ক্রিয়ায় মেতে উঠলেন। চারু বাবুর বাহ্যিক জ্ঞান লোপ পেলো। শুধু জেগে রইলো তাঁর কামনা। এই ভাবে সারা রাত রতিক্রিয়া চলার পর অজ্ঞান হয়ে গেলেন চারু বাবু। যখন জ্ঞান ফিরলো, তখন সারা দেহে বিষ ব্যথা। কিন্তু তার মধ্যেও চারু বাবু প্রসন্ন হলেন সিদ্ধি লাভের আনন্দে। তবে কি আজ থেকেই তিনি বাক সিদ্ধ?
পরেরদিন সকালে স্নান সেরে ঘট টাকে জলে বিসর্জন দিয়ে পরিষ্কার কাপড় পরে তিনি চললেন শশুরবাড়ি স্ত্রীকে আনতে। পথে এক পরিচিত ব্যক্তির সঙ্গে তাঁর দেখা হলো। তিনি বুঝতে পারলেন তাঁর কানে কানে কে যেনো ফিস ফিস করে বলছে," ওর নাম তো নকুল বেরা। কালিগঞ্জে বাড়ি। কাল রাতে স্ত্রীর সাথে ঝামেলা হয়েছে, এখন চলেছে হাট বাজার করতে। কিন্তু ওর বউ আজ সন্ধ্যায় বিষ খাবে।" কথা গুলো শুনে চারু বাবু প্রথমটা একটু ভ্যাবাচ্যাকা খেয়ে গেলেন। তারপর নকুল বাবু সামনে আসতেই জিজ্ঞাসা করলেন," আরে নকুল যে, বাজার চললে বুঝি?" নকুল বাবু থেমে গিয়ে চারু বাবুর দিকে চেয়ে বললেন," হ্যাঁ,ওই আর কি। আপনি ভালো আছেন তো চারু বাবু? আপনাকে কেমন জানি দেখাচ্ছে। অসুখ টসুখ হয়েছিল বুঝি? খুব কালো হয়ে গেছেন।" চারু বাবু বললেন," ও কিছু না। আসলে তোমার বউদি নেই তো, তাই নিজে খেটে খেতে হচ্ছে। তাই অমন লাগছে দেখতে।" চারু বাবু বলতে লাগলেন," বৌমা কেমন আছে নকুল? শুনলাম তোমাদের মধ্যে কি নিয়ে যেনো ঝামেলা চলছে?" নকুল বাবু তো থ। " আপনি কিভাবে জানলেন?" " না ওই মানে কে যেনো বলছিলো। যাকগে শোনো, সন্ধ্যা বেলা কি করছো আজ?" নকুল বাবু বললেন," ঠিক করিনি, কেনো বলুন তো?" চারু বাবু বললেন," আজ সন্ধ্যা বেলা তুমি বাড়িতেই থেকো। বৌমাকে একা ছেরো না।" নকুল বাবু জিজ্ঞাসা করলেন," কেনো চারু বাবু? আপনার বৌমার কি কোনো বিপদ আছে?" চারু বাবু শুধু বললেন,"যা বললাম টা করো গিয়ে।"
বলে চারু বাবু নিজের পথে পা বাড়ালেন। মনে মনে তিনি ভাবলেন," বলে তো দিলাম যা শুনলাম। এখন যদি সত্যি হয়, তাহলেই বোঝা যাবে সাধনার ফল।" শশুর বাড়ি পৌঁছে পনেরো দিন পরে গিন্নিকে দেখে ওনার মন যে পরিমাণ পুলকিত হওয়ার কথা তাতো হলোই না, বরং কেমন যেনো বিরক্তি জন্ম নিল চারু বাবুর মনে। আবার সেই মহিলার খবরদারি, ঘ্যান ঘ্যান করা সেই স্থানু বৈচিত্র্যহীন জীবন আবার সেই সংসার এই সব ভেবে চারু বাবু কিছুটা বিরক্তই হলেন। কিন্তু চেহারায় প্রকাশ করলেন না। ওনার গিন্নি তো ওনার কালো হয়ে যাওয়া শরীর দেখে উৎকন্ঠিত হয়ে বললেন, "কি গো, তোমার কি হয়েছে? অমন কালো হয়ে গেছো কেনো, শরীর খারাপ?" চারু বাবু উত্তরে শুধু বললেন," আমি ঠিক আছি। তুমি তাড়াতাড়ি তৈরি হয়ে নাও।" সহজ সরল চারু বাবুর এ হেনো গম্ভীর উত্তরে ওনার স্ত্রী কিছুটা চিন্তিতই হলেন। অগত্যা বিকেল বিকেল ওনারা নিজেদের বাড়ি ফিরে এলেন। রাতে চারু বাবু সকাল সকাল খাওয়া দাওয়া করে অন্য ঘরে শুয়ে পড়লেন নিজের মত। অন্যদিন গিন্নির সাথে গল্পঃ গুজব করতেন, একসাথে শুতেন কিন্তু আজ আর তা করলেন না। গিন্নী ব্যাপার টা ঠিক বুঝতে পারলেন না। ঠিক মধ্যরাতে একটা তীব্র মিষ্টি গন্ধে চারু বাবুর ঘুম ভেংগে গেল। উনি শুনলেন সেই নূপুর পড়া পা এর আওয়াজ। তারপর ঘরের দরজা আস্তে করে খুলে ঘরে প্রবেশ করলো সেই কর্ণ পিশাচিনি। মোহিত, বাহ্য জ্ঞান শূন্য চারু বাবু মত্ত হলেন তার সাথে রতি ক্রিয়ায়। সারা রাত চললো সেই ক্রীয়া। পরদিন সকালে চারু বাবুর ঘুম ভাঙলো বেশ বেলায় নকুল বাবুর ডাকাডাকিতে। চারু বাবু বেরিয়ে আসতেই নকুল বাবু হাউ মাউ করে বলে উঠলেন," চারু বাবু, আপনি সত্যি বাক সিদ্ধ পুরুষ। আপনি গতকাল যা বলেছিলেন সেটাই ঘটেছে। আমি ছোট ছেলেকে নিয়ে বাড়ির উঠোনে বসেছিলাম গরম লাগছিলো বলে। হঠাৎ একটা কাঁচের শিশি পরার শব্দ শুনে ভেতরে গিয়ে দেখি আমার বউ বিষ খেয়েছে। সঙ্গে সঙ্গে লোক জন ডেকে গ্রামের হাসপাতালে নিয়ে যাই। এখন অবস্থা স্থিতিশীল। ভাগ্যিস আপনি বলেছিলেন বৌমার কাছাকাছি থাকতে, নয়তো অনর্থ ঘটে যেত।" এইভাবে আস্তে আস্তে চারু মুখুজ্জের সুনাম ছড়িয়ে পড়তে লাগল দিকে দিকে। দূর দূর থেকে মানুষ আসতে লাগলো চারু বাবুর কাছে। কর্ণ পিশাচিনি আগে থেকেই যারা আসছে তাদের ভূত , ভবিষ্যত সব কিছুই চারু বাবু কে কানে কানে বলে দেয় আর চারু বাবুও ভবিষ্যতবাণী করে তাদের আগত বিভিন্ন সমস্যা বিপদের সতর্কতা দিয়ে বেশ মোটা অর্থ আমদানি করছিলেন। রোজ রাতে পিশাচিনীর সাথে রতিক্রিয়া আর তার পরিবর্তে খ্যাতি আর অঢেল অর্থ উপার্জন করার সুবাদে নিজের অর্ধাঙ্গিনী কে বেমালুম ভুলেই গিয়েছিলেন চারু বাবু। শুধু দু বেলা খাওয়ার সময় দেখা আর হ্যাঁ না তে কথা ছাড়া গিন্নীর সানিধ্যে খুব একটা যাচ্ছিলেন না চারু বাবু। চারু বাবুর অসময়ের সঙ্গী আজ কাল অবহেলায় পড়ে থাকেন পরিত্যক্ত জিনিসের মত ঘরের এক কোণে।
এইভাবে কয়েক মাস চলার পর চারু বাবুর গিন্নী একপ্রকার নিশ্চিত হয়ে গেলেন যে চারু বাবু বার বনিতা সঙ্গ করছেন। তাঁর আর নিজের স্ত্রীর উপর কোনো টান নেই। চারু বাবুর গিন্নী একদিন জিনিস পত্র গুছিয়ে নিয়ে নিজের ভাইকে ডেকে বাপের বাড়ি চলে গেলেন বেশ কিছু দিনের জন্য। যাওয়ার সময় চারু বাবুর সঙ্গে তিনি দেখা করে গেলেন ঠিকই কিন্তু চারু বাবুর কোনো রকম আচরণ পরিবর্তন তিনি লক্ষ্য করলেন না। চারু বাবু সম্পূর্ন উদাসীন রইলেন গিন্নীর গৃহত্যাগ করার ব্যাপারে, বরং তিনি খানিকটা খুশিই হলেন দৈনন্দিন অশান্তির হাত থেকে কয়েকদিনের জন্য নিষ্কৃতি পাওয়ার জন্য। চারু বাবুর সারাদিন এখন কাটে বিভিন্ন জজমানদের আগাম ভবিষ্যতবাণী করে মোটা অর্থ রোজগার করে আর রাতে কর্ণ পিশাচিনীকে তুষ্ট করে।
ওদিকে চারু বাবুর গিন্নী তাঁর বাপের বাড়ী গিয়ে যোগাযোগ করলেন বিশু ঠাকুরের সাথে। উনি ওই গ্রামেই থাকেন, মস্ত বড় তান্ত্রিক। চারু বাবুর গিন্নী তাঁকে সব কথা খুলে বলতে উনি একটা সুপুরি মন্ত্রপূত করে ওনাকে দিলেন, বললেন," এটা পানের সঙ্গে স্বামীকে খাইয়ে দিস। তোকে ছাড়া আর কাউকে বুঝবে না।"
চারু বাবুর স্ত্রী চারু বাবুকে কিছুই না জানিয়ে একদিন ফিরে এলেন নিজের বাড়ি। সন্ধ্যা বেলায় চারু বাবু বাড়ি ফিরে দেখেন গিন্নী ফিরে এসেছেন। গিন্নীর সাথে টুকটাক কথা বার্তার পর চারু বাবু পাশের ঘরে শুয়ে বিশ্রাম করছেন আর কর্ণ পিশাচিনীর সঙ্গে ঘনিষ্ঠ হওয়ার মুহূর্তগুলো চিন্তা করে মনে মনে আনন্দিত হচ্ছেন। আবার আজ রাতে সেই একই আনন্দের অংশীদার হবেন চারু বাবু। হঠাৎ একটা দমকা হাওয়ায় মাথার কাছের জানলাটা খুলে গেলো আর সাথে সাথে সেই তীব্র মিষ্টি গন্ধটা ঘরময় ছড়িয়ে পড়লো। সাথে সাথে একটা হিস্ হিস্ শব্দ শুনতে পেলেন চারু মূখুজ্জে," মৃত্যু আসন্ন, সাবধান।" একি শুনলেন চারু বাবু! তাঁর ভেতরটা কেমন যেনো অস্থির হয়ে উঠলো। এমন সময় গিন্নীর গলা শুনতে পেলেন," কী গো, খাবে এসো।" চারু বাবুর স্ত্রী ভাত বেড়ে অপেক্ষা করছিলেন। গিন্নীর গলা পেয়ে চারু বাবু কিছুটা স্বাভাবিক বোধ করলেন। উনি খেতে বসলেন। গিন্নী পরম যত্নে তাঁকে খাওয়ালেন। তারপর চারুবাবু কে অনুরোধ করলেন," আজ রাত টা একসাথে শুলে কি তোমার সমস্যা হবে?" এই অনুরোধে চারু বাবু কিছুটা অস্বস্তি বোধ করলেও তিনি গিন্নী কে না বললেন না, কর্ণ পিশাচিনীর সাবধান বাণী তাঁর মনে ভয়ের সঞ্চার করেছিল। তিনি ভাবলেন গিন্নীর সাথে একসঙ্গে শুলে ভয় কিছুটা প্রশমিত হবে। গিন্নী ততক্ষনে সেই সুপুরি মিশ্রিত পান নিয়ে হাজির। চারু বাবুকে এক গ্লাস জল দিয়ে তারপর পান টা এগিয়ে দিলেন। চারু বাবু পান টা মুখে পুড়ে চোখ বন্ধ করে চিবোতে লাগলেন। যখন চোখ খুললেন তখন তাঁর ঈষৎ মোটা শোটা গিন্নিকে তন্বী যুবতী দেখতে লাগলেন। তিনি গিন্নিকে নিজের বাহু পাশে জড়িয়ে ধরলেন। গিন্নী ও মনে মনে বিশু ঠাকুর কে প্রণাম করে নিজের স্বামীর কাছে নিজেকে সঁপে দিলেন। চারু বাবু নিজের স্ত্রীর সাথে ঘনিষ্ঠ হলেন। এইভাবে যখন তেনাদের রতিক্রিয়া প্রায় শেষ পর্যায়ে, তখন হঠাৎ বাতাস ভারী হয়ে উঠলো সেই তীব্র সুগন্ধে, আর চারু বাবু শুনতে পেলেন কান ফাটানো হাসির শব্দ। শয্যা থেকে তিনি ধড়মড়িয়ে উঠে পড়লেন। স্ত্রীর দিকে তাকিয়ে দেখলেন তাঁর গিন্নীর কাটা মাথাটা মেঝেতে পড়ে আছে। আর মুণ্ডুহীন দেহটা খাটের প্রান্তে বিবস্ত্র অবস্থায় ঝুলছে। চারু বাবুর হৃদপিন্ড গলায় আটকে এলো। তিনি স্মরণ করতে লাগলেন ভৈরব বাবার সাবধান বাণী। মস্ত বড় ভুল করে ফেলেছেন চারু বাবু। চিৎকার করে কাঁদতে কাঁদতে তিনি ক্ষমা চাইতে লাগলেন কর্ণ পিশাচিনীর কাছে। কিন্তু তাঁর সমস্ত প্রার্থনা বিফলে গেলো। একটা জমাট বাঁধা অন্ধকারের স্তূপ আস্তে আস্তে এগিয়ে আসতে লাগলো চারু বাবুর দিকে। সঙ্গে সঙ্গে ঘরের বাতাস ভারী করে সেই তীব্র সুমিষ্ট গন্ধ পরিণত হলো তীব্র পুতি গন্ধে। চারু বাবু ঘরের দরজা খুলে ছুটতে আরম্ভ করলেন গ্রামের শ্মশানের দিকে। ওখানে শ্মশান কালীর সামনে একবার যদি পৌঁছানো যায় তাহলে হয়তো চারু বাবু রক্ষা পেতে পারেন নিশ্চিত মৃত্যুর হাত থেকে। পেছন ফিরে দেখলেন অন্ধকারের স্তূপ আরো বড় আকার ধারণ করে তাঁকে অনুসরণ করে আসছে আর সঙ্গে খল খল হাঁসি আর তীব্র পূতি গন্ধ। একটা পাথরে হোচট খেয়ে পড়ে গেলেন চারু মুখুজ্জে। অন্ধকারের স্তূপ টা ধীরে ধীরে ক্রমশ এগিয়ে আসছে আরো কাছে। হাঁটুতে আঘাত এমন গুরুতর যে ওঠার ক্ষমতা হারালেন চারু বাবু। শেষ রক্ষা আর হলো না।
পরেরদিন সকালে গ্রামের লোক জন শ্মশানের রাস্তায় আবিষ্কার করলো চারু মূখুজ্জের মৃত দেহ। কেউ যেনো তাঁর মুন্ডুটা ধরে পেছনের দিকে বেঁকিয়ে দিয়েছে। যে খ্যাতির জন্য এত কৃচ্ছ সাধন, সেই খ্যাতির জন্যই শেষ হয়ে গেলো চারু বাবুর জীবন লীলা। খ্যাতির বিরম্বনা মনেহয় একেই বলে।
….…………👹👹👹👹👹…………..