সুতপা ব্যানার্জী(রায়)
গাভী গোমাতা যতই সুলক্ষণা হোক তাকে কেন্দ্র করে বিভ্রাটের গল্পও কম নেই। সুন্দর ঝকঝকে চেহারার সঙ্গে ঐ মসৃণ শিং কখনো কখনো প্রাণঘাতী হয়। ছোটবেলায় দুগ্ধপোষ্যের স্মৃতি অবশ্য এই স্তন্যপায়ীর প্রতি চিরকৃতজ্ঞতা পাশে আবদ্ধ রাখে। তবে সবাই অবশ্য এই শ্বেতধারার শর্করাকে হজম করতে পারে না। ছানার টানে যখন মিষ্টির কারিগর নিজের জীবন ঢেলে দিচ্ছে তখন মানুষ ও মাছি দুইই তাকে কেন্দ্র করে ভনভন করে। রক্তশর্করা যখন তার অন্তিম মাত্রা ছাড়ায় তখন সেই মধুমেহধারীদের শয়নে স্বপনে ছানাশিল্প তথা মিষ্টি মরীচিকা হয়ে ধরা দেয়। নিতান্ত ভূষি,খোসা ও ফ্যানে প্রতিপালিত হলেও সময় সুযোগে দরকারি কাগজও ভক্ষণ করে। আমার এক বান্ধবীর ডাক যোগে আসা অনার্সের স্পেশাল নোটস অবলীলাক্রমে চিবিয়ে খেয়েছিল। একবার ভরা বাজারে এরই পুরুষ রূপের তাড়নায় পড়ে গিয়ে ঝাঁকার ডিম ভেঙে দিয়ে আর্থিক গুনেগার দিতে হয়েছিল। পাড়ার ধুনি পিসীর তো আরো শোচনীয় অবস্থা হয়েছিল। প্রথমবার শিংয়ের তাড়নায় হাত ভেঙেছিল। দ্বিতীয়বার মাজা ভেঙে পাড়া বেড়ানোর নেশা চিরতরে ঘুচে গিয়েছিল। বুদ্ধিভ্রংশ এক ফটফটে সাদা গাভীকে একবার সামনাসামনি ফুলদানির প্লাস্টিকের ফুল চিবোতে দেখেছিলাম। অবশ্যই তা খেয়ে ফেলার আগে তাকে বিপন্মুক্ত করেছিলাম। কৃতজ্ঞতা স্বরূপ শিং নেড়ে অভিবাদন করেছিল যদিও আমি ঘটনাটাকে নিরামিষ অভিবাদন না ভেবে আক্রমণ ভেবে ছিলাম। একবার এক বিশাল ঝড়ের রাতে দরজার শব্দে ও গোমাতার ছায়া দেখে নিধু রাঁধুনির গোভূত দর্শনের অনুভূতি হয়েছিল। পরদিন হরিশ বাগাল যখন ঢ্যারা পিটিয়ে জানালো যে তার সাধের ধবলিকে পাওয়া যাচ্ছে না তখন সবাই নিধুকে চেপে ধরেছিল এই বলে যে গতরাতের গোভূত আসলেই ভূত না হরিশের সাধের ধবলি। গো'পালনের দৌলতে পাড়ার নয়ন কাকিমার হাতের ক্ষীর চাঁছি খাওয়ার অভিজ্ঞতা হয়েছিল। তরকারির খোসা আর ফ্যান সরবরাহের রিটার্ন গিফ্ট স্বরূপ ঐ চাঁছির প্রাপ্তি ঘটত। তবে নিন্দুকে বলত ওটা নয়ন কাকিমার চাঁছি তৈরীর পুড়ে যাওয়া কড়াইয়ের তলানি। আমাদের খেতে মন্দ লাগত না বলে নিন্দুকদের কথায় কর্ণপাত করতাম না। এদের ব্যবহারের বিষয়ে ধর্মীয় ভেদাভেদে দেশ তোলপাড় হলেও এরা নিজেরা বড্ড শান্তিপ্রিয়। একবার এক গণ্ড গ্রামে পথশ্রমে ক্লান্ত হয়ে পৌঁছে আমাদের গাড়ি নিতে আসবে শুনে উৎফুল্ল হয়েছিলাম। সেই প্রথম ধুলো উড়িয়ে আমাদের নিতে আসা গরুর গাড়ি দেখে ধাক্কা খেয়েছিলাম। তবে গাঁয়ের পথে ঐ গরুর গাড়ি চড়ে বাস্তবের পথের পাঁচালিকে প্রত্যক্ষ করেছিলাম। কলুর বলদ-এই প্রবচনকে আক্ষরিক অর্থে সামনে দেখে খুব মনখারাপ হয়েছিল। হাড় জিরজিরে চেহারা নিয়ে ক্ষেতে লাঙ্গল টানছে,ঘানিতে তেল পিষছে। তবে গফুরের মহেশের মতো মানুষের সঙ্গে ভালোবাসার টানও দেখেছি। যেখানে কর্মক্ষমতা হারিয়ে গেলেও সাদরে প্রতিপালিত হচ্ছে। রচনা লেখার সময় বা কোন বক্তব্য রাখার সময় কেউ যখন ঘুরিয়ে ফিরিয়ে একই কথা লেখে বা বলে তখন জগতে এত প্রাণী থাকতে তাকে 'গরুর রচনা' বলা হয় কেন,এ এক অবাক বিস্ময়। আমাদের শৈশবকেই যে দুগ্ধসিক্ত রেখে মায়ের খ্যাতি আদায় করে নিয়েছে তাই নয়,আমাদের ভবিষ্যৎ শিক্ষাদীক্ষার চালিকা শক্তি হয়ে উঠছে। এর রকমসকম,পালন অধ্যয়ন করে ডেয়ারি ফার্মিংয়েও প্রতিষ্ঠা,এমন কি সরকারি চাকরিও পাওয়া যায়। আকার,আকৃতি ও রঙের রকমারিতে ধবলী,কালো,দুলি কতরকমের হয়। পার্বত্য অঞ্চলে যে চমরি গাই পাওয়া যায় তার রকমসকম,লোমের প্রকৃতি, শিং,গঠন কাঠামো সবই
আলাদা। তবে একটা বিষয়ে মিল আছে,যেমন দুধ দেয় তেমন ভার বহনেও ভূমিকা নেয়। বাঙালি মায়েরাও সন্তানের মঙ্গল কামনায় বলে-"আমার সন্তান যেন থাকে দুধেভাতে।" বিরিয়ানি, পোলাও কালিয়া নয়,সন্তানের সুখের জন্য এই শান্তির চাওয়াটুকুর মধ্যেই নিবদ্ধ আছে আমাদের গো মহিমা।
........................................................................
ফোন ও হোয়াটসআপ নম্বর-9674386270