রম্যরচনা
শ্রীশ্রীহরপার্বতী সংবাদ
শ্রীমন্ত সেন
কৈলাশশিখরে বসি পতিরে শুধান সতী।
"কহো নাথ ধরণীর বর্তমানে কিবা গতি।।
বঙ্গবাসী ধরে কিবা অভিলাষ কিবা মতি।
কিবা রুচি অভিরুচি, কীসে রত মনোগতি।।"
সর্বজ্ঞ মহাদেব কিয়ৎক্ষণ মৌনাবলম্বন করিলেন। তৎপরে ঈষৎ মালিন্যযুক্ত হাস্যান্তে হরপ্রিয়াকে কহিলেন, "দেবি! তবে শুনহ, আমি বঙ্গবাসীদের বর্তমান আচার-ব্যবহার, মানসিকতা তথা চালচলন সমস্তই তোমাকে বিবৃত করিতেছি। জানি না শ্রবণান্তে তোমার হৃদয়ে কী ভাবের উদয় হইবে।" তদনন্তর শ্রীহর মর্ত্যসংবাদ তথা বঙ্গসংবাদ আরম্ভ করিলেন।
"দেবি! ইদানীং বঙ্গদেশে আর একান্নবর্তী পরিবার বলিয়া কোনও বস্তু নাই। কোনও পরিবারই মদীয় পরিবার সদৃশ বৃহৎ নহে। সকলই ক্ষুদ্রাতিক্ষুদ্র, অধিকপক্ষে তিন বা চারি জন মাত্র সদস্য।" "কেন প্রভু, অবশিষ্টদের কী গতি হইল?" "অবশিষ্ট বলিতে নিশ্চয় পিতামহ, পিতামহী, পিতা-মাতা, জ্যেষ্ঠতাত-খুল্লতাত এবং তাঁহাদের পত্নী ও পুত্রকন্যাদের কথা বলিতেছ?" "হ্যাঁ দেব।" "বর্তমানে পিতামহ, পিতামহীগণের সহিত পৌত্র-পৌত্রীদের কোনও সম্বন্ধ নাই। তাঁহারা বাণপ্রস্থাশ্রমের মতই সম্পর্করহিত অবস্থায় অবহেলায় অন্যত্র আপনাপন কর্মফল ভোগ করিতেছেন, নচেৎ বৃদ্ধাশ্রমে পূর্বাশ্রমস্মৃতি অবলম্বনপূর্বক কালাতিপাত করিতেছেন। আর অধিকাংশ পিতা-মাতারও তদ্রূপ অবস্থা। ইদানীন্তন অণুপরিবারে পুরাতন আসবাবপত্রের ন্যায় তাঁহারা দায় মাত্র। ফলত তাঁহারা বজ্রদগ্ধ শুষ্ক বৃক্ষের ন্যায় পরিত্যাজ্য অবস্থায় স্ব-সামর্থ্য অনুযায়ী জীবনের অবশিষ্ট দিনগুলি কায়ক্লেশে যাপন করিতেছেন।"
"আর জ্যেষ্ঠতাত-খুল্লতাত প্রভৃতি?" "তাঁহারা পৃথগন্ন স্ব-স্ব পরিবারে সমরূপ পরিস্থিতির মধ্য দিয়া যাইতেছেন। যাবৎ তাঁহাদের পুত্রাদি সাবালকত্ব প্রাপ্তির পর কর্মসংযুক্ত এবং বিবাহবদ্ধ না হইতেছেন, তাবৎ তাঁহারা সপুত্র পারিবারিক সুখভোগ করিতেছেন। অন্যথা পৃথগ্বাস ও একাকীত্ববোধ ভুঞ্জন। আর খুল্লতাত-জ্যেষ্ঠতাত ভ্রাতা-ভগ্নী-সংস্রবসুখ ভোগ বর্তমান শিশুকিশোরদের অদৃষ্টে নাই"।
"প্রভু, পুত্রদের কথা বলিলেন। কন্যাদের সম্বন্ধে তুষ্ণীভাব কেন?" "প্রিয়ে! তুমি শুনিতে চাহিতেছ, তাই কহিতেছি। শুনহ, বর্তমানে কন্যাসন্তানের আর কদর নাই। অধিকাংশ পিতামাতাই পুত্রসন্তানের জন্য লালায়িত।" "কেন প্রভু, সে কি 'পুত্রার্থে ক্রিয়তে ভার্যা, পুত্রপিণ্ডং প্রয়োজনং' বিধায়?" "না প্রিয়ে, বর্তমানে কেহই আর পুত্রপিণ্ডের প্রত্যাশা রাখেন না। পুত্র বংশের মুখ উজ্জ্বল করিবে, প্রৌঢ়ত্বে ও বার্ধ্যক্যে পিতামাতাকে দেখিবে-- এই ভ্রান্ত আশায় তাহারা কেবল পুত্রই কামনা করেন। আর কন্যা পরিণয়ান্তে পরগৃহে চলিয়া যাইবে, সে অর্থে কোনও কর্মেই লাগিবে না, কেবল ভরণপোষণবিবাহাদিতে অর্থদণ্ডই সার হইবে, এই বিধায় কন্যাসন্তান অবাঞ্ছিত বলিয়া প্রতীত হইয়াছে।"
"হা হতোস্মি! এ কী কহিলেন বিশ্বনাথ!" "হরপ্রিয়ে! ইহাতেই মুহ্যমতী হইলে? ইহা তো সূচনা মাত্র। আরও বিষাদ গাথা অবশিষ্ট রহিয়াছে।" "আরও?" "হ্যাঁ প্রিয়ে! ইদানীং গর্ভাবস্থার সূচনা হইলে গর্ভে পুত্র না কন্যা সন্তানের সম্ভাবনা হইয়াছে, তাহা নির্ধারণ করিবার প্রকৌশল মর্তবাসীর অধিগত হইয়াছে। তাহার সাহায্যে গোপনে ভ্রূণের লিঙ্গনির্ধারণ করা হয়। যদি দেখা যায় যে গর্ভস্থ ভ্রূণ স্ত্রীলিঙ্গ, তবে অনেক ক্ষেত্রে চিকিৎসকের সহায়তায় সেই ভ্রূণটিকে নষ্ট করিবার মানসে গর্ভপাত পর্যন্ত করা হয়।"
"সে কী প্রভু! মাতৃসমা স্ত্রীজাতির প্রতি এত অবিচার?" "হ্যাঁ, কল্যাণি!" "তবে তো সৃষ্টি লয় হইয়া যাইবে, নাথ।" "যাইবেই তো। ইতিমধ্যেই সেই ভয়াবহ প্রলয়ের আভাস অনুভূত হইতেছে। মানব ও মানবীর সংখ্যাসাম্যে ভয়ানক চ্যূতি দেখা দিয়াছে। সমাজে মানবের তুলনায় মানবী দুর্লভ হইয়া উঠিতেছে। একদিন এমত দিন আসিবে, যেদিন মানবীর জন্য হাহাকার উঠিবে, সৃষ্টি স্তব্ধ হইয়া যাইবে।" "সে কী নাথ! তবে কি কোনও দিনই মর্তবাসী তথা বঙ্গবাসীর সুবুদ্ধির উদয় হইবে না?" "আর সুবুদ্ধি শিবানি! নারীর প্রতি নরের সেই শ্রদ্ধার মনোভাবই অন্তর্হিত। এখন নরের নিকট নারী কেবলই পণ্যসমা, ভোগের বস্তু মাত্র। তাই পথে প্রান্তরে সর্বত্র পুরুষদ্বারা কন্যা-ভগ্নী-মাতৃসমা নারী অহরহ অপমানিতা, অবমানিতা ও লাঞ্ছিতা হইতেছে।"
"কিন্তু, কেন এই দুরবস্থা, দেব?" "কী আর কহিব ভবানি! শিক্ষা আর মূল্যবোধের অবক্ষয়ই আজ এই অবস্থার সৃষ্টিকর্তা। মানব আজ মানবেতর প্রাণীর ন্যায় ব্যবহার করিতেছে। মানবের আজ একমাত্র কামনা তাহারা নিজে কী করিয়া ভাল থাকিবে, কীসে তাহাদের সর্বাধিক স্বার্থসিদ্ধি ঘটিবে, যেন তেন প্রকারেণ অর্থোপায় দ্বারা ভোগের যাবতীয় আয়োজন সম্ভব হইবে। তাহার জন্য যদি তাহাদের পিতামাতা-স্বজন-বন্ধুবান্ধব এমন কি দেশের স্বার্থও জলাঞ্জলি দিতে হয়, তবে তাহা দিতেও তাহারা পশ্চাৎপদ নহে। আর সত্য বলিতে কী, ইহার জন্য তাহাদের পিতামাতারাও কম দায়ী নহে।"
"এরূপ কেন বলিতেছেন প্রিয়?" "কারণ তাহাদের পিতামাতারা তাহাদের শাসন করিতে ভুলিয়া গিয়াছেন। শৈশব হইতে তাহারা যাহা চাহে, সে ন্যায্য হউক বা অন্যায্য হউক, তাহাই তাঁহারা বিনা প্রশ্নে তাহাদের দিবার ব্যবস্থা করেন। তাঁহারা একবারও ভাবিয়া দেখেন না যে 'ন জাতু কামঃ কামানামুপভোগেন শাম্যতি। হবিষা কৃষ্ণবর্তেব ভূয় এবাভিবর্ধতে।।' অর্থাৎ কামের উপভোগের দ্বারা কাম কদাপি শান্ত হয় না, অগ্নিতে ঘৃতাহুতির ন্যায় তা কেবলই অভিবর্ধিত হয় মাত্র।" "কী বলিতেছেন প্রভু!" "হ্যাঁ দেবি! ন্যায্য অন্যায্যের বোধ, শুভাশুভের বোধ, কল্যাণ-অকল্যাণের বোধ তাহাদের শেখানো হয় না। গুরুজনদের প্রতি শ্রদ্ধা, দেব-দ্বিজে ভক্তি, প্রতিবেশীদের প্রতি কর্তব্য, সমাজের অন্যজনদের প্রতি মমত্ববোধ তথা দায়িত্ববোধ, অনাথ-আতুরদের প্রতি দায়ভাগ ইত্যাদির লেশ মাত্রও তাহাদের শেখানো হয় না। ফলে তাহারা আত্মপরই হইয়া ওঠে, সেখানে অন্য কাহারও জন্য এতটুকু মায়া-মমতা-দায়িত্ব-কর্তব্য-বাধ্যবাধকতা কিছুই নাই।"
"এই রূপে কি কোনও জাতি বাঁচিতে পারে, প্রভু?" "অবশ্যই পারে না। তাহারা কবিবাক্য বিস্মৃত হইয়াছে, 'আপনারে লয়ে বিব্রত রহিতে আসে নাই কেহ অবনী পরে। সকলের তরে সকলে আমরা প্রত্যেকে আমরা পরের তরে।।' পরের জন্য কিছু করিবার যে কী আনন্দ, সেই সব স্বার্থান্বেষী, আত্মভোগী, হতভাগ্য তরুণদল তাহার কীই বা বুঝিবে। তাহারা স্বার্থসাধন যন্ত্রমাত্র, সেই স্বর্গীয় অনুভূতি তাহারা কোথায় পাইবে? সেই হতভাগ্য মর্তবাসী তথা বঙ্গবাসীদের জন্য সত্যই বড় দুঃখ হয়। তবে একটি কথা..." "কী কথা প্রভু!"
"তাহাদের এই বিপথগামিতা তথা বিপদগামিতার জন্য বিজ্ঞানের উন্নতিও কম দায়ী নয়, প্রিয়ে!" "সে কীরূপ?" "ইদানীং বিজ্ঞানের প্রভূত উন্নতি সাধিত হইয়াছে। চিকিৎসা বিজ্ঞান, ব্যবহারিক বিজ্ঞান প্রভৃতির পাশাপাশি আমোদ-উপকরণেও যুগান্তকারী আবিষ্কার ঘটিয়াছে। দূরদর্শন নামক একটি আয়তাকার যন্ত্রের সাহায্যে পৃথিবীর বিভিন্ন প্রান্তে সংঘটিত ঘটনা, দৃশ্য-শ্রাব্য-কলা অহরহ দূরদূরান্তে নিমেষ মধ্যে সঞ্চারিত হইতেছে, বিশ্বজনীন প্রমোদ বিতরিত হইতেছে..."। ভগবতী পার্বতী তাঁহাকে অর্ধপথে বাধা দিয়া কহিলেন, "মহাভারতে সঞ্জয় যেরূপ কুরুক্ষেত্র যুদ্ধের ঘটনা স্বচক্ষে দেখিতে পাইতেছিলেন এবং ধৃতরাষ্ট্রকে তাহার বর্ণনা দিতেছিলেন, সেইরূপ প্রভু?"
"হ্যাঁ, কিঞ্চিৎ তদ্রূপই বটে। তবে এক্ষেত্রে যন্ত্রসাহায্যে, এই যা পার্থক্য।" "সে তো উত্তম কথা, নাথ। ইহাতে অনিষ্ট কী দেখিলেন?" "আর প্রিয়ে, সে কথা তোমাকে বলিতে লজ্জা বোধ হয়। আজি কালি ওই সকল সম্প্রচারে হিংসা-দ্বেষ-অসূয়া সহ যৌন বিষয়ের আধিক্য ঘটিয়াছে। ওই বন্ধনহীন প্রচার জনসমাজ বিশেষত যুব সম্প্রদায়কে বিপথগামী করিয়া তুলিতেছে। এক সঙ্গে বসিয়া অণুপরিবারের সদস্যগণও সেই সম্প্রচার দেখিতে লজ্জা বোধ করেন। কেবল ইহাই নহে, নিত্যপ্রচারিত ধারাবাহিক কাহিনিগুলিতে ওই সকল কামোদ্দীপক বিষয় তো থাকেই, অপিচ এমন কোনও কাহিনি দেখা যায় না যেখানে পুরুষ বা নারীর একাধিক বৈবাহিক সম্পর্ক, বিবাহবহির্ভূত সম্পর্কের উল্লেখ নাই। আর মধ্যবর্তী বিজ্ঞাপনগুলিও হইয়াছে তদ্রূপ। সেখানেও বিশেষ কামোদ্দীপক ঔষধ সেবনের ফলস্বরূপ নবদম্পতির সপ্তাহে একাধিকবার খট্টাঙ্গভঙ্গপুরাণ, পুরুষেন্দ্রিয়ের সঞ্জীবিত-অহি-বিভঙ্গ প্রকাশ! কলিযুগান্তের আর বিলম্ব নাই বোধ হয়। বোধ করি ভাবিবার সময় সমুপস্থিত-- ইহার পরে মর্তলোকে পূজার চারি দিন গমন তোমার বা আমাদের কন্যাদের পক্ষে নিরাপদ কি না।"
"সত্যই বলিয়াছেন দেবাদিদেব। শুনিয়াই গাত্রে শিহরণ হইতেছে। তবু প্রভু, ইহার কী কোনও প্রতিবিধান নাই? আমাদের মর্ত্যসন্তান-সন্ততির মতি পরিবর্তন করা যায় না?"
"দেবি! তুমি সর্বমঙ্গলা-- সর্বার্থসাধিকা। তুমিই পারো উহাদের মতি পরিবর্তন করিতে। একবার দেখিতে পারো।"
-----
Srimanta Sen,
29/A/11, Bhagirathi Lane,
P.O.—Mahesh,
Dist—Hooghly,
PIN—712 202
Mobile No.—94341 99700(with whatsapp).

