গল্প ।। পশুপ্রেমী ।। অরুণ চট্টোপাধ্যায়
পশুপ্রেমী
অরুণ চট্টোপাধ্যায়
মৌ এসেছে বাপের বাড়ী। বেশ কিছুদিন পরে এল। কি করবে সুভাষের যে সময়ই হয় না একেবারে। পাম ভ্যালি না কি করে। পাম ভ্যালি একটা আর্থিক প্রতিষ্ঠান। মার্কেট থেকে টাকা তুলে সুদ সহ মেয়াদ শেষে আমানতকারিদের ফেরত দেয়।
খদ্দেরদের পিছু পিছু ঘুরে মরতে হয় খালি। আর খরচ করতে হয় রাশি রাশি কথা। এত কথা যে কি করে আসে তার মাথায় সেটা ভাবতে গিয়ে মৌয়ের মাথা ঘুরে যায়। চোখে অন্ধকার দেখে।
পড়াশোনায় তো তেমন ভাল ছিল না মৌ । অঙ্ক পরীক্ষায় ঠোঁটে কলমের ডগা ঠেসে বসে থাকত ঠায় । আর ইতিহাস, ভূগোল কি বিজ্ঞানটা কোনমতে মুখস্থ করে সামাল দিলেও ইংরেজিতে কাত। ব্যাখ্যা লেখ, সারমর্ম লেখ, হ্যান লেখ ত্যান লেখ। অত কথা কি মাথায় আসে মৌয়ের ? বাবা শুধু গজরাতো, লেখাপড়া তো শিখলি না দেখবি বিয়ে কি করে হয় ? বর জুটবে না তোর কপালে।
সত্যি, বাপটার তো দোষ নেই । মা-হারা একমাত্র মেয়ের পড়াশোনার জন্যে অন্যের ক্ষেতে জনমজুর বাপ অনেক করেছে । নিজের সব শখ আহ্লাদ বিসর্জন দিয়েছে।
আগে তো খেতের কাজ প্রায় জুটত না বললেই চলে । ইদানিং তার সঙ্গে ঐ একশ দিনের কাজের সূত্রে যা হয় একটা কিছু জোটে। এখনও কথাটা ভাবতে গিয়ে চোখ দিয়ে ঝর ঝর করে জল পড়ে পরানের। মা-মরা মেয়েটাকে মানুষ করতে গিয়ে কি ভাবে যে সামাল দিয়েছে তার ঠিক নেই। দুবেলা দুমুঠো অন্ন তো বটেই তারপর রয়েছে তার লেখাপড়ার খরচ। আজকাল ইস্কুলে মাইনে নেই বটে তবে খরচ তো কিছু আছেই । খাতাপত্তর প্রাইভেট মাস্টারের কাছে পড়ানো।
বিমলবাবু গ্রামের বেশ বিজ্ঞ লোক। বললেন, পরান এ সব তোমার দরকার নেই । যতই পড়াও বাপু মেয়ে তোমার তার শ্বশুরঘরে গিয়ে রান্না করবে আর ঘর-গেরস্থালী সামাল দেবে । কি হবে পড়াশোনার নামে পয়সাগুলো জলাঞ্জলী দিয়ে? আর ও যখন পড়তেই চাইছে না তখন ওর বিয়ে দিয়ে দাও।
পাত্র ঠিক করে রেখেছেন বিমলবাবু। কলকাতার এক আত্মীয়বাড়িতে কাজ করা এক ছেলে। তলে তলে খোঁজ নিয়েছে পরাণ। সে ছেলে এক নম্বর নেশাখোর । পাজি, বদমাশ আর বখাটে মার্কা । ওর সঙ্গে বিয়ে দেওয়া মানে তো নিজের একমাত্র মেয়েটার সারা জীবন নষ্ট করে দেওয়া।
সোজা সাফটা বলে দিয়েছে পরাণ । বিমলবাবুর মুখের ওপরই মাথাটা দুলিয়ে দুলিয়ে বলেছে, আমার মেয়ের তো এখনও চোদ্দ পেরোয় নি । এর মধ্যেই বে ?
- তবে মরগে যা । এর পরে আর মাথা কুটলেও ভাল পাত্তর পাবি না ।
বিমলবাবু ক্ষুণ্ণ হলেন । কারণ বিয়ে হলে মৌকে কাজে লাগিয়ে দেওয়া যেত ও বাড়ীতে । আজকাল কাজের লোক পাওয়া যে কি ঝঞ্ঝাট । আত্মীয়বাড়ীতে নিজের গাঁ থেকে একটা কাজের লোক সাপ্লাই করলে নিজের পজিশনটা আর একটু উঁচু হত ।
শুধু বিমলবাবুই নয়, আরও কয়েকজন পরামর্শ দিয়েছিল পরাণকে, মেয়েটা যখন পড়াশোনা করছেই না তখন আর তাকে পড়িয়ে পয়সাগুলো কেন জলে ঢালছ ? বিয়ে দিলেই তো ল্যাঠা চুকে যায় । কিন্তু পরাণ শুধু বলে, বিয়ের বয়েস হয়েছে নাকি আমার মেয়ের ?
বিয়েতে নিজের একটু মত ছিল না মৌয়েরও । কিন্তু কি করবে লেখাপড়াটা যে সে কিছুতেই করে উঠতে পারছে না । অন্তত মাধ্যমিক পাশটা থাকলেও একটা যা হয় কিছু জুটিয়ে বাবার সাহায্যে লাগতে পারত ।
সেলাইটা শিখল অবশ্য মৌ । এদিক সেদিক করে একটা সেলাই মেশিন জোগাড়ও হল । জামাকাপড় এসব সেলাই করে বাবাকে সাহায্য করতে লাগল বেশ ।
সেই সূত্রেই আলাপ সুভাষের সঙ্গে । সুভাষ সত্যিই সুভাষ । ভাষণে তার জুড়ি মেলা ভার । ঝুড়ি ঝুড়ি মিথ্যে কথা বলে মৌকে কব্জা করে বিয়ে করে ফেলল । সে নাকি জীবনবীমার এজেন্ট । অনেক টাকা রোজগার । বাড়ি তার তিন তিনটে গ্রাম পরে সেই চাকন্দপুরে ।
পরাণ একটু ইতস্তত করে মেনে নিয়েছিল । কি করবে মেয়েটার বিয়ে তো তাকে দিতেই হবে । তবে একমাত্র মেয়ে । ভেবেছিল বিয়েটা যদি এই গাঁয়ে বা অন্তত পাশের গাঁয়ে হয় । কিন্তু সবাই বলল, এমন ভাল পাত্তর কি আর একটা মেলে ? আজকাল এল-আই-সিতে নাকি অনেক টাকা রোজগার হয় । এজেন্টরা সব এমন ডেভেলাপমেন্ট করে যে তারা দুদিনের মধ্যেই ডেভেলাপমেন্ট অফিসার হয়ে যায় । আজ এজেন্ট তো কাল মস্ত অফিসার হয়ে যাবে সুভাষ ।
বিয়ের সময় খাট-বিছানা কোনমতে দিতে পেরেছিল । আলমারি ড্রেসিং টেবিল এসব কিছু নয় । বিয়ের পরে প্রচণ্ড রেগে গিয়েছিল সুভাষ । কিপটে বুড়ো শেষে কিনা এই দিল ?
স্বামীর ব্যবহারে বেশ ক্ষুব্ধ মৌ একবার ভাবল বেশ চোটপাট করে সুভাষকে । বাবাকে সে খুব ভালবাসত । বাবা ছাড়া যে আর কেউ ছিল না এতদিন । কিন্তু আবার ভাবল বাবা নয়, সুভাষের সঙ্গেই ঘর করতে হবে তাকে আজীবন । তাই বাবার দুঃখে বুক ফাটলেও মুখকে ফুটতে দেয় নি এতদিন ।
তাছাড়া সুভাষ নাকি শিক্ষিত । জীবনবীমার এজেন্ট বলে কথা । লোক চরিয়ে খায় । নিজের লেখাপড়াটা না শেখার সত্যটা বেশ লজ্জা দিতে লাগল মৌকে । তাছাড়া সুভাষকে সে তো ভালবেসেই ঠাই দিয়েছে মনের মধ্যে ।
ভাবল সুভাষের বলা এই "কিপটে বুড়ো"ই তো সারাজীবন একটা লুঙ্গি আর স্যান্ডো গেঞ্জি পরে মেয়েকে মানুষ করেছে । কিছুতেই হবে না জেনেও তাকে লেখাপড়া শেখানোর আপ্রাণ চেষ্টা করেছে । এ শুধু তাকে বিরাট বড় দেখার জন্য নয় । তাকে একটা স্বনির্ভর মানুষ করার জন্যে । কিন্তু মৌ সামান্য মাধ্যমিকটা পাশ করেও দেখাতে পারল না এ তার বড় লজ্জা ।
বিয়ের পরে ক্রমে ক্রমে সব জানতে পেরেছে মৌ । গ্রাজুয়েট নয়, মাধ্যমিকের বেড়াটা অতিকষ্টে ডিঙিয়েছে সুভাষ । আর জীবনবীমাও নয়, সে করে পাম ভ্যালি নাকি । এজেন্ট নয় এজেন্টের একজন সহকারী মাত্র । খদ্দেরদের সঙ্গে বকে বকে তাকে পটিয়ে পাটিয়ে এজেন্টের হাতে তুলে দেওয়াই তার কাজ । কত আর জোটে নামমাত্র । এজেন্টের আলগা মুঠির ফাঁক দিয়ে যেটুকু গলে আর কি ।
আর একটা রোজগার আছে । কলের ঠিকেদার । ঠিকে পেলে মিস্তিরি লাগিয়ে কল ঠিক করে দেওয়া । সেটা এই গ্রামে তেমন হয় না । গ্রামে কলই বা কটা আছে যে তার মিস্তিরি লাগবে ? এর পরের বড় শহরটাই তার কর্মক্ষেত্র । সেই জন্যেই এ গ্রামের লোক তেমন বিশেষ কিছু জানে না এ ব্যাপারে ।
মৌয়ের ভালবাসা নয়, সুভাষের হয়ত আশা থাকবে আরও বড় কিছু । অনেক ছেলের কাছেই বিয়েটা একটা পাওনাকড়ি আদায়ের । বেশ কিছু পেলে মনমেজাজ ভাল থাকে । না পেলে সেটা বিগড়ে যায় । আর সুভাষ অন্য কোনও গ্রহের প্রাণীও নয় ।
রোজ কপচায়, কিপটে বুড়ো আমায় ঠক্কেছে । বিয়েতে দিল শুধুই লবডঙ্কা । একটা তো মেয়ে নাকি আর একটা তো মাত্তর জামাই ?
মৌ মন খারাপ করে বলল, কি আর দেবে বল ? বাবার আর আছেটা কি ? ঐ লুঙ্গি আর একটা স্যান্ডো গেঞ্জি । তা বাবা মরে গেলে খুলে নিয়ে নিতে পার তো আমি আপত্তি করব না ।
- কেন এক কাঠা চার ছটাকের জমিটা তো রয়েছে । আর সঙ্গের ভিটেটা ?
মৌ এবার রাগ করে, বুড়ো মলে ওটা তো তুমি পাবেই । তর সইছে না বুঝি ?
অত দূর থেকে বাস ঠেঙ্গিয়ে হাঙ্গাম করে কে আর বাপের বাড়িতে আসে । তাছাড়া সুভাষের কোনও উদ্যোগ নেই মৌকে নিয়ে আসার । আক্ষেপ করে বলেছে, একটা শাশুড়িও নেই যে জামাইষষ্ঠীর একটা নেমন্তন্ন পাব । বৌয়ের ভালবাসা ধুয়ে ধুয়ে কি আর সারাজীবন জল খাওয়া যায় ?
অনেক দিন পরে এসেছে মৌ । পরাণের শরীর বড় খারাপ । জ্বরটা আর যেন কিছুতেই ছাড়ে না। অত পরিশ্রম করেছে শরীর এখন তার শোধ তো তুলবেই ।
মৌ এসে রয়েছে দিন তিনেক । সুভাষ পৌঁছে দিয়ে চলে গেছে । দিন তিনেকের ছুটি দিয়েছে । নিজে যাবে একটু বন্ধুদের সঙ্গে ফুর্তি করতে কি একটা জায়গায় নাম করেছিল মৌ মনে রাখতে পারে নি । সেখানে যাবার বায়না করেছিল সে কিন্তু সুভাষ তাকে বলেছিল, তবে তো তোমার বাপের বাড়ী যাওয়া হবে না । ভেবেছিলাম এই সময়টায় তোমাকে ওখানে রেখে আসব ।
অনেক দিন বাবার সঙ্গে দেখা হয় নি । লোকটা কেমন আছে কে জানে । তাই মৌ সানন্দে চলে এসেছে এখানে । দিন তিনেক পরে মানে আজ এসে তাকে নিয়ে যাবে ।
এই দুটো দিন মৌ অনেক যত্ন করে রান্না করে বাবাকে খাইয়েছে । লোকটাকে যে আজ দেখার কেউ নেই । রোগের জন্যে মাঠের কাজেও তেমন যেতে পারে না । কেমন করে দুটো ভাত জোটায় কে জানে ।
বাবার মুখটার দিকে তাকাতে পারে না সে । মেয়ে হয়ে তো কোনও কাজেই লাগল না বাবার । ভাল একটা জামাই পর্যন্ত দিতে পারল না । বাবার কত আশা ছিল মৌ একটু লেখাপড়া শিখবে সে আশাটাও পূর্ণ করতে পারে নি । গরীব ঘরের কটা বাবা চায় তার সোমত্থ মেয়ের বিয়ে না দিয়ে তাকে পড়াতে ? কিন্তু মৌয়ের বাবা চেয়েছিল । এমন বাবা অনেক ভাগ্য করে মেলে ।
আজ পরাণ একটু সুস্থ । মেয়ের ভালবাসা যত্নেই হয়ত । খাটের ওপর বসেছিল । মৌ কাজ করছে রান্না ঘরে । ভাতের ফ্যান গালছে । পরাণ হঠাৎ চিৎকার জুড়ল । মৌ ছুটে এল পড়ি মরি করে ।
- কি হল বাবা ? চেঁচাচ্ছ কেন ?
- দেখ তো মা আমায় কি যেন একটা কামড়াল । বড্ড জ্বলছে । উঃ আর পারছি না রে ।
ছুটে গেল মৌ বাবার দিকে । পরাণের চেঁচামেচিতে ছুটে এসেছে পাশের বাড়ির কাকলি । সে বাড়ির বাগানে শাকপালা তুলছিল । সেই ডাকল মৌকে, মৌ মৌ ইদিকে আয় শিগগির ।
- দাঁড়াও কাকলিদি । বাবাকে কি যেন কামড়েছে ।
- আঃ বলছি ইদিকে আয় । এই দ্যাখ –
একটা সাপ তক্তপোশের তলা দিয়ে দরজা দিয়ে বেরিয়ে যাচ্ছে লতিয়ে লতিয়ে ।
- এ তো ঢোঁড়া সাপ নয় এ যে জাত –
সবলে কাকলির মুখটা চেপে ধরেছে মৌ । ফিসফিসিয়ে বলে, করছ কি ? মানুষটা যে শুনেই হার্টফেল করবে ।
কথাটা কিন্তু চাউর হতে সময় লাগল না । হাওয়ার দাপটে ফাঁকা মাঠে আগুন যেমন করে ছড়ায় তেমন করে খবরটা ছড়িয়ে পড়ল সারা গ্রামে । কচিকাঁচা, বুড়ো-বুড়ি, দাদা-দিদি, মামা-মাসি, খুড়ো-জ্যাঠা সব ছুটে এল । পেল্লায় ভীড় ।
- সাপটা কোথায়, সাপটা ? ধরা গেছে ?
- না না । ঘুলঘুলি দিয়ে কোথায় যেন পালিয়ে গেল ।
মৌ কেঁদে ভাসাচ্ছে, বাবার কি হবে বাঁচবে তো ? ও কাকলিদি বাবা বাঁচবে তো ?
একজন বলল, এক্ষুনি হেলথ সেন্টারে নিয়ে যেতে হবে । নইলে বাঁচবে না ।
কিন্তু বললেই তো হবে না । হেলথ সেন্টার এখান থেকে কম-সে-কম পাঁচ-সাত কিলোমিটার দূরে। পলাশ বলল, বিমলকাকুর গাড়ি নিয়ে চল । এক্ষুনি । বিমলবাবু শুনে আঁতকে উঠলেন । অবশ্য মনে মনে । অমন সাধের নতুন গাড়ি তাঁর । রিটায়ার করার পর বেড়াতে ইচ্ছে কার না হয় ? আর আজকাল রাস্তায় লোকজনের যা ভীড় বাপরে বাপ । একটু গাড়ি করে গেলে ভীড়টা এড়ানো যায়। কিন্তু ভাড়া গাড়ি কি আর সবসময় মেলে ? এ গাঁয়ে আর কার গাড়ি আছে ? আনতে হলে তো আনতে হবে ছ কিলোমিটার দূরের শহর থেকে । গাড়ি আসতে না আসতেই মনের ইচ্ছেটাই না ফুড়ুত করে পালিয়ে যায় ।
কিন্তু ঐ সাপে-কাটা রুগিকে নিয়ে যাবে অমন ঝকঝকে গাড়িতে করে ? কতগুলো অশিক্ষিত হেটো লোক পায়ে কাদামাটি লাগিয়ে বসবে অমন ঝাঁ চকচকে সীটগুলোতে ? ইজ্জত থাকবে গাড়িটার ?
গাড়িটা দেওয়াও যায় না আবার না বলাও যাচ্ছে না । মানে সরাসরি তো নয় বটেই । কে জানে কোন গাছের আড়াল থেকে একটা ঢিল কাঁচের ওপর পড়লেই এখন পাঁচশ কি হাজারের ধাক্কা ।
বিমলবাবু খুব দয়ালু লোক । পশুপাখী অন্ত প্রাণ । কুকুর-বেড়াল, গরুছাগল সারাক্ষন তাঁর বাড়িতে একেবারে লাইন দিয়ে থাকে । সবাই জানে লোক খুব ভাল ।
বড় আশা করে এসেছে দলবল । শুধু শুধু তো ফেরান যায় না । তাতে পরাণ আবার তাঁর প্রতিবেশী বলে কথা । ব্যস্ত-সমস্ত হয়ে উঠে পড়ে বললেন, আমি এক্ষুনি যাচ্ছিলাম পরাণকে দেখতে । বড় ভয়ংকর কথা । ছি ছি কি কেলেংকারি বল তো ।
দীপক বলল, এখন আর দেখেটেখে সময় নষ্ট করার সময় নেই কাকা । শিগগির চাবি খুলে গ্যারেজ থেকে গাড়িটা বার করে চলুন হেলথসেন্টারে । জানিনা সাপের বিষের প্রতিষেধক আছে কিনা তবু বেচারিকে নিয়ে তো যেতেই হবে ।
দুহাত কপালে দিয়ে রগ ডলছেন বিমলবাবু, হায় আমার কপাল । গত কাল আমার গাড়িটা সারাতে দিয়ে দিয়েছি বাবারা । কি একটা ক্যাঁচক্যাঁচ শব্দ হচ্ছিল । নতুন গাড়ি কি জানি কি থেকে কি হয় । তাই দিয়েই দিলাম । কিন্তু এখন কি হবে ? তোরা বরং ভেটকোর ভ্যানটা নিয়েই যা বাবা । যা যা আর ফেলে রাখিস না বেচারিকে ।
কালিপদ খুব রগচটা ছেলে । সন্দেহে চোখমুখ কুঁচকে বলল, কাল পর্যন্ত তো গাড়ি বেরোবার আওয়াজ পাই নি জ্যাঠা ?
বিমলবাবু দেখলেন ছোকরাকে । বেশ ডাকাবুকো মস্তান । তাতে আবার নেশাটেশা করে । কেউ কেউ বলে ড্রাগফাগ নাকি নেয় । বুকটা ছলাত করে উঠলেও সামলালেন । খুব মিহি গলায় বললেন, অনেক রাত্রে মিস্ত্রি এসে নিয়ে গেল । আমি আর থাকতে না পেরে ফোন করলুম । আমাকে আবার সামনের মাসে দীঘা যেতে হবে । বুড়োবুড়িতে যাব তাই আর ঝুঁকিটা রাখি নি বাবা । হ্যাঁ বাবা, কাটা জায়গাটায় বাঁধন টাধন দিয়েছিস তো ভাল করে ?
কালিপদর মুখ দেখে মনে হল কথাটা সে বিশ্বাস করে নি । কিন্তু কেউ আর এ নিয়ে ধামসা ধামসি করতে চাইল না । একটা মানুষের জীবনসংকট এ সময় এসব কার ভাল লাগে ? তারা বিকল্প খুঁজতে লাগল । একজন এসে খবর দিল ভেটকোকে নাকি পাওয়া যাচ্ছে না । বোধহয় ভাড়া খাটতে গেছে । আর একজন নীলমণির খোঁজ করতে গিয়ে শুনল নীলমণি গেছে মাসির বাড়ি।
- চল চল পরানকাকাকে নিয়ে আমরা কজন বরং কোলে করে খালপারে যাই । ও মোড়ে বাইরের অনেক ভ্যান আসে ।
এমন সময় হুড় মুড়িয়ে ঢুকল সুভাষ । এসেই তাড়া দিল মৌকে, হয়েছে তোমার ? চল চল । এখানে এত ভীড় কেন ?
হঠাৎ চোখ গেল পড়ে থাকা পরাণের ওপর । সব শুনে টুনে বলল, আরে তোমরা সাপটার খোঁজ করনি ? কোথায় ঢুকে বসে আছে আবার কাকে না কাকে কামড়াবে তখন ? তারপরে রোজা ডাকলে সাপটা তো চাই নাকি ? বিষ তুলবে কি করে ?
সত্যি কথা তো । এসব কথা তাদের জানা থাকলেও সংকটকালে সব ভুলে মেরে দিয়েছিল । সুভাষ এসে যেন সকলের চোখ খুলে দিয়েছে । কিছু লোক তখন ব্যস্ত হয়ে পড়ল সাপ খুঁজতে । খুঁজেও পাওয়া গেল । কথায় বলে সাপে জব্দ লাঠিতে । সন্ধান পাওয়া মাত্রই তার পিঠে পড়তে লাগল লাঠির পর লাঠির ঘা । কথাটা কানে যেতেই তো ছুটে এলেন বিমলবাবু বেজায় খাপ্পা হয়ে। বললেন, নিরীহ সাপটাকে তোমরা মেরে ফেলবে নাকি ? ও বেচারির কি দোষ সে তো তার ধর্ম পালন করেছে ?
বিমলবাবুর কথায় কেউ কান দিল না । এমনিতেই সাপের ওপর অনেকের রাগ থাকে । তাতে বিমলবাবুর গাড়িটা না পাওয়ায় সবাই খাপ্পা তাঁর ওপর । কথা শুনতে বয়েই গেছে ।
বিমলবাবু বাড়ি ফিরে এসেই টেলিফোন নিয়ে বসলেন । কি আর করবেন । ওখানে তাঁর মত বয়স্ক মানুষের কথা কেউ শুনছে না ।
সকলে ঠিক করেছে সাপটাকে মেরে তাকে পুড়িয়ে ফেলতে হবে । শত্রু আর সাপের নাকি শেষ রাখতে নেই । জলবাতাসের ছোঁয়া পেয়ে আবার নাকি জ্যান্ত হয়ে ওঠে মরা সাপ । কিন্তু তাকে কব্জা করা কি সহজ নাকি ? দমাদ্দম পিঠে পড়ছে লাঠির বাড়ি তবু তার মরণ নেই । কিলবিলিয়ে ঢুকে পড়ছে আনাচে কানাচে । আবার হৈ হৈ বাধিয়ে তাকে টেনে বের করা হচ্ছে ।
থানা থেকে জীপ এসে দাঁড়াল । সমাদ্দারবাবু নামলেন । নেমেই ছাড়লেন হাঁক, তোমরা কি করছ?
- এই যে সাপ মারছি স্যার । সকলে মহা উৎসাহে বলে উঠল, ব্যাটা পরাণকাকাকে কামড়ে কেমন নাজেহালটাই করেছে দেখুন না ।
- এই চুপ চুপ । থাম সবাই । সমাদ্দারবাবুর বাজখাঁই ধমকে সাপ-নিধন পর্বে ভাঁটা পড়ল ।
- পশু-পাখি-কীট মারা অপরাধ জানা নেই তোমাদের ? কনস্টেবল সব কটাকে জীপে তোল।
তখন শুরু হল হৈ চৈ । পুলিশ সাহেবের কাছে সবাই ক্ষমা চাইতে লাগল, এ বারেরটা ক্ষমা করে দিন স্যার । আর কক্ষনো হবে না ।
বনবিভাগের কর্তা এসেছেন সঙ্গে কজন কর্মচারী । তারা কায়দা করে একটা ঝোলাতে ভরল সাপটাকে । বনকর্তা সাপটার অবস্থা দেখে বললেন, আর একটু দেরি হলে তো বেচারির শ্রাদ্ধ- শান্তি চুকিয়ে দিচ্ছিলে ? মরলে জেল হয়ে যেত জান ?
বনকর্তাকে সঙ্গে নিয়ে জীপে উঠছেন সমাদ্দারবাবু । কালীপদ এসে ধরল, স্যার আপনার জীপে কি একটু জায়গা হয় না ?
সমাদ্দার সাহেব ভুরু কুঁচকে বললেন, কেন ? লক আপটা বেড়ানোর শখ হয়েছে বুঝি ?
দীপক মুখ কাচুমাচু করে বলল, পরাণকাকাকে একটু যদি হেলথ সেন্টারে নিয়ে যাওয়া যেত তো বাঁচানো যেত হয়ত।
- আচ্ছা আমি একটা ভ্যান রিক্সো পাঠিয়ে দিচ্ছি । বলে সমাদ্দার সাহেব জীপে উঠলেন ।
আধঘন্টা কেন চল্লিশ পঁয়তাল্লিশ মিনিট কেটে গেল । পুলিশ সাহেব কি তবে ভড়কি দিল তাদের ? এদিকে পরাণের শরীরটা যেন কেমন নেতিয়ে আসছে । সবাই তাকে অনেক আশা দিয়ে যাচ্ছে । মা মনসার ধ্যান স্তব স্তুতি এমন কি রোজাকে খবর পাঠানোর তোড়জোড় চলছে ।
প্রায় ঘন্টা দুয়েক পরে থানার পাঠানো ভ্যানরিক্সো পৌঁছে দিল হেলথ সেন্টারে । কম্পাউন্ডার মধু ঘুমোচ্ছিল। ডেকে তোলা হল । চোখ রগড়ে বলল, প্রতিষেধক নেই । শহরে হাসপাতালে যাও ।
ভ্যানরিক্সোর চালক বলল, আবার আমাকে অতটা ঠেলতে হবে ? সে কম দূর বল তো ? ও পঁচিশ টাকায় হবে না একশ পঁচিশ লাগবে ।
সকলের পকেট হাতড়ে হাতড়ে টাকাটা জোগাড় হয়ে গেল । মিনিট পঁয়তাল্লিশ লাগল হাসপাতালে পৌঁছতে । ইমারজেন্সিতে পড়ে রইল আরও আধঘণ্টা । ডাক্তার নার্স আয়া কত লোক পরাণের পাশ দিয়ে তো বেরিয়েই যাচ্ছে ।
তখনও পরাণের গায়ে উত্তাপ ছিল । মৌ তার চোখ থেকে পড়া জলের ফোঁটাগুলো বাবার গা থেকে মুছতে গিয়ে টের পেয়েছিল । সুভাষ এর মধ্যে ঘুরে গেছে বেশ কয়েকবার । তার অনুযোগ, এর চেয়ে রোজার হাতে দিলে বুড়োটা বেঁচে যেত ।
হেলথ সেন্টারে যাবার আগে সে পই পই করে বুঝিয়েছে মৌকে । বলেছে তার গ্রামে এক খুব বড় রোজা আছে । যদি বল তো খবর দিই ।
মৌ রাজি হয় নি । বাবা তাকে মাধ্যমিক পাশ করাতে পারে নি এতে তার আক্ষেপ । কিন্তু মাধ্যমিক পাশ সুভাষের ঐ রোজা-তত্ত্ব সে কিছুতেই যে মেনে নিতে পারে নি তাতে তার দুঃখ নেই এতটুকু । মৌয়ের সন্দেহ সুভাষ হয়ত চায় টেঁসে যাক ঐ "কিপটে বুড়ো" আর এক কাঠা চারছটাকের জমি সমেত বাড়ীটা তার কব্জায় আসুক সহজে ।
ডাক্তার এসে নাড়ি টিপে বলল, এর কি চিকিৎসা আর আমি করব ? বাড়ি থেকে একটু আগে এনে ফেলতে পারোনি এখানে ? বাড়িতে কি করছিলে – রোজা- ওঝা না গুণীন ? ডিসগাস্টিং !
মর্গে ঢুকবে পরাণের শরীর । কিন্তু কখন কে জানে ? সেখানে গিয়ে নাকি কাটা ছেঁড়া হবে একটা ময়লা লুঙ্গি আর স্যান্ডো গেঞ্জির মালিকের । মাধ্যমিক ফেল মৌয়ের মনে হল এটাই হয়ত আসল চিকিৎসা । মেয়েকে শিক্ষিত স্বাবলম্বী দেখতে চেয়েছিল, অল্প বয়েসে বিয়ে দিতে চায়নি যে লোকটা। আসলে এ সবই হয়ত কোনও কঠিন রোগে ভোগার লক্ষন । ওষুধে হয় নি, এবার এরা কাটা ছেঁড়া করে দেখতে চায় আসলে রোগটা কি । রোগটা বুকে না মাথায় ।
দিন দুয়েক পরে সবাই ভীড় করেছে চৌমাথার মোড়ে । এখানে রাস্তার পাশে চাটাই খাড়া করে রোজকার খবরের কাগজ সেঁটে সকলকে পড়াবার ব্যবস্থা করা হয়েছে । ব্যবস্থাটা বিমল কাকু আর গ্রামের কয়েকজন হোমড়া চোমড়া মিলে করেছে । বেশ কিছু বড় কাগজের সঙ্গে স্থানীয় কিছু সংবাদপত্রও স্থান পায় সেখানে ।
সেই কাগজের একটা পাতায় বিমল বাবুর ছবি সহ একটা সুন্দর খবর পড়ল সবাই । ভারি সুন্দর করে লেখা রিপোর্টটা সবাই সাগ্রহে পড়তে থাকে । গ্রামের থানার বড়বাবু আর বন-কর্তাদের তৎপরতায় একটা সাপকে ক্রুদ্ধ গ্রামবাসীদের হাত থেকে বাঁচানো গেছে । আসল কৃতিত্বের দাবীদার অবশ্য ঐ গ্রামের এক বয়স্ক, বিজ্ঞ আর পশুপ্রেমী ব্যক্তি । এমন ব্যক্তিদের উপযুক্ত পুরস্কারদানের জন্য সরকার ভেবে দেখতে পারেন ।
দীপক চিৎকার করে উঠে বলল, দেখ দেখ বিমল কাকুর কি সুন্দর ছবিটা বেরিয়েছে ।
====================
Dr. ARUN CHATTOPADHYAY
181/44 G.T.ROAD (GANTIR BAGAN)
P.O. BAIDYABATI,
DIST. HOOGHLY (PIN 712222)
W.B. INDIA
MOB. (91) 8017413028 W.A. (91) 8017413028
Email: chattopadhyayarun@gmail.com