উত্তরণ
সান্ত্বনা ব্যানার্জী
"আজ হাঁটতে বেরোবে তো নাকি,অয়নের মা নীচে এসে ফোন করছে।" অনিন্দ্যর ডাকে তাড়াতাড়ি আধো ঘুম থেকে উঠে পড়ে নন্দা।ইতিমধ্যেই অনিন্দ্য নীচের গেটের তালা খুলে সবিতাকে ওপরে আনতে চলে গেছে। মুখে চোখে জল দিয়ে ঘরে ঢুকে তৈরী হয়ে নিয়ে বেরিয়ে আসে নন্দা হালকা একটা চাদর সঙ্গে নিয়ে। ড্রইং রুমে বসে টুকটাক কথা বলছে সবিতা আর অনিন্দ্য। নন্দাকে রেডি দেখে উঠে পড়ে সবিতা, দুজনে বেড়িয়ে পড়ে হাঁটতে।
এই মাস খানেক হলো অনিন্দ্য আর নন্দা এসেছে নিউ টাউনে ছেলের ভাড়া নেওয়া ফ্ল্যাটে। আটটা ফ্ল্যাটের প্রত্যেককে নীচের গেটের একটা করে চাবি দেওয়া আছে, নীচে থেকে কেউই সরাসরি ফ্ল্যাটে উঠে আসতে পারেনা।তাই
যত বারই বাইরে যেতে হোক বা ভিতরে আসতে হোক ওই তালা খোলাখুলি করতে হবে। এ যেন আর এক গৃহবন্দী অবস্থা। অথচ গ্রামের বাড়িতে এদিক ওদিক দরজা খোলাই থাকে।সামনের প্রশস্ত উঠোনে পায়চারি করতে করতে দশ মিনিটে দশজনের সঙ্গে কথা হয়ে যায়।....কেমন আছো বৌদি?... গাছে জল দিচ্ছ?....ছেলে বৌমার খবর পেয়েছো?...ওরা ভালো আছে তো...এই রকম কথা, কুশল প্রশ্নের আদান প্রদান চলতেই থাকে। এখানে এসে থেকে এখনো পর্যন্ত কারও সাথে আলাপই হয়নি। দেখতেও পাওয়া যায় না কাউকে। কে যে কখন লিফট দিয়ে ওঠে নামে কে জানে!ভাগ্যিস ছেলের এক
বন্ধুর পরিবার দুটো ব্লক পরেই থাকে, তাই বিকেলে একটু বেরোনো হচ্ছে। ছেলে অভীর বন্ধু অয়নের মা সবিতা। এখানে দুজন দুজনকে পেয়ে খুব খুশি। ক' দিন দুজনে মিলে হেঁটে হেঁটে রাস্তাঘাট, মার্কেট, মল্, অনেকটাই চিনে ফেলেছে।কলকাতার মধ্যে যে এমন সুন্দর সাজানো গোছানো জায়গা আছে ভাবা যায়না।
অবশ্য কলকাতার কতটুকুই বা দেখেছে নন্দা। ওই হাওড়া স্টেশন, বড়বাজার, কলেজ স্ট্রীট, দু চারবার। বিয়ের পর যৌথ পরিবারের সকলে মিলে চিড়িয়াখানা, বেলুড় মঠ, দক্ষিণেশ্বর, সেও প্রায় কুড়ি বছর আগে।সহকর্মী নীলিমাদির দৌলতে দুটো নাটক দেখার সৌভাগ্য হয়েছিল কলকাতার হলে , সৌমিত্র চট্টোপাধ্যায় ও কৌশিক সেন এর টিকটিকি আর প্রথম পার্থ। কি অপূর্ব!এর বেশি পরিচয় আর ঘটেনি কলকাতার সঙ্গে।
"একটু বসবে নাকি নন্দা?বড্ডো হাঁফিয়ে গেছি। সবিতার কথায় চমক ভাঙে নন্দার। সত্যি তো!অনেক টা পথ হেঁটে বেশ ক্লান্তই লাগছে। বিশ্ববাংলা গেটের দিকে চওড়া যে রাস্তা টা গিয়েছে তার পাশে পাশে সুন্দর চেয়ার আছে বসার জন্য। তারই একটাতে বসে পড়ে দুজনে। সন্ধ্যে পার হয়েছে সবে, আর চারদিক দিনের আলোর মত ঝলমল করে উঠেছে। দু দিকের আপ ডাউন রাস্তায় অবিরত গাড়ী ছুটে চলেছে। অবাক হয়ে ভাবে নন্দা। এত আলো!ত্রিফলা লাইট, এল ই ডি ল্যাম্প, রংবেরংয়ের আলোর ফিতে জড়ানো পিলার, কি নেই! সব মিলে যেন এক স্বপ্ন রাজ্য!নিজের অজান্তেই চোখের সামনে ভেসে ওঠে গ্রামের পথ। দুএকটা লাইটপোষ্টের মাথায় আলো জ্বলে টিমটিম করে, তাও পাড়ায় পাড়ায় চাঁদা তুলে গ্রামের ক্লাবগুলোর উদ্যোগে। এখন যদিও গ্রামের ভিতর ঢালাই রাস্তা কিছু হয়েছে। কিন্তু ভেঙে গেলে সারানো আর হয় না। ব্যাংক, এ টি এম এর জন্যও পাঁচ সাত মাইল দূর যেতে হয়।
"সত্যিই যেন স্বর্গ রাজ্য!"উচ্ছসিত হয়ে বলে নন্দা।"হ্যাঁ গো, এখানে সব কিছুই ভালো, সব রকমের সুখ সুবিধা,তবুও মানুষ খুশি নয়। তোমরা গ্রাম থেকে শহরে এসেছো আর এই শহরের মানুষ গুলো চলে যাচ্ছে অন্য রাজ্যে বা বিদেশে আরও সুখ, বিত্ত বৈভবের আশায় ,আত্মীয় স্বজন বাবা মাকে ফেলে রেখে।"
অবাক হয়ে দেখে নন্দা ,কেমন যেন বিষাদের সুর সবিতার গলায়। "জানো এত সুখেও ঘরে ঘরে ডিভোর্স! আমাদের ওপর তলার মিলনের দু বছর হলো বিয়ে হয়েছে, নিজেদের পছন্দেরই বিয়ে। ভালো চাকরি, গাড়ী,ফ্ল্যাট, তবুও বউ বাপের বাড়ী গিয়ে আর এলোনা, ডিভোর্সের নোটিশ পাঠিয়ে দিলো। শুনলাম ওর আর এক বন্ধু নাকি আমেরিকায় চাকরি পেয়ে চলে যাচ্ছে, বউ তাকে বিয়ে করে বিদেশ চলে যাবে। বোঝো তাহলে।"বুকটা কেমন কেঁপে ওঠে নন্দার। কোনকালে একান্নবর্তী পরিবারে বাবাকাকার দেখে দেওয়া পাত্রের সঙ্গে সাত পাক ঘুরে শ্বশুর বাড়ী এসেছিল মনেও নেই। কুড়ি পঁচিশ জন সদস্য
পরিবারে, শ্বশুর, শাশুড়ী, মাসশাশুড়ী, জা, দেওর,ভাসুর, তাদের ছেলেমেয়েরা, ভাগ্নে,সবার সঙ্গে সুখে দুঃখে কাটিয়েছে প্রায় পঁচিশ বছর!
এখন ছেলে বৌমাকে নিয়ে এই সাজানো গোছানো ছবির মত শহরে এসেও স্বস্তি নেই! অজানা আশঙ্কায় চাপা পড়ে যায় আশা আর আনন্দের অনুভূতি। কে জানে এই আপাত উত্তরণ সত্যি স্থিতিশীল কি না!এই আলো ঝলমল বর্ণচ্ছটার মাঝে চোখের সামনে ভেসে উঠলো টিমটিমে আলোয় অনুজ্জ্বল গ্রামের মাঝে নিজেদের সেই সাবেকী বাড়ীটা, যার প্রতিটি কোনায় কোনায় ছড়িয়ে আছে ছোট্ট অভীকে নিয়ে কত শত সুখের স্মৃতি!
" এবার ওঠো গো নন্দা, ছেলে বৌমাদের ফেরার সময় হয়ে গেল"। সবিতার কথায় যেন এক অন্য জগৎ থেকে বাস্তবে ফেরে নন্দা।একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে উঠে পড়ে নন্দা, হাঁটতে থাকে দুজনে ক্লান্ত পায়ে ফ্ল্যাটের দিকে।
==================
Santwana Banerjee
Po +vill Boinchigram
Dist Hooghly
Pin 712135