বিভাগ: পত্র-সাহিত্য।। শঙ্খকে লেখা বাদলের চিঠি ।। গোবিন্দ মোদক
শঙ্খকে লেখা বাদলের চিঠি
গোবিন্দ মোদক
স্নেহের শঙ্খ,
তোমার চিঠি পেয়ে বেশ বিচলিত বোধ করছি। বেশ বুঝতে পারছি তুমি তোমার পুত্র এবং কন্যাকে নিয়ে বেশ উদ্বিগ্ন। যাইহোক, এভাবে উদ্বিগ্ন হলে তো কোনও সমাধান হয় না, বরং আলাপ-আলোচনার মাধ্যমে সমাধানের পথ খুঁজতে হয়। তাই একজন কাছের বন্ধু হিসেবে আমি তোমাকে কয়েকটি পরামর্শ দিতে পারি — যদি মনে করো সেগুলো কাজে লাগাতে পারো। ভেবো না এগুলো আমি তোমার ওপর চাপিয়ে দিতে চাইছি।
যাইহোক, তুমি উদ্বেগ প্রকাশ করেছো যে তোমার ছেলে-মেয়ে বাংলা কিছুই পড়লো না। ঠিক আছে, অযথা উদ্বিগ্ন হবার দরকার নেই, কারণ এখনও সময় আছে। যেহেতু তোমার মেয়ে খুবই ছোটো সেইজন্য ওকে ছোটোদের রামায়ণ এবং ছোটোদের মহাভারত দিয়েই শুরু করতে পারো। সেই সঙ্গে তোমাকে দিতে হবে রূপকথার গল্প এবং নানা স্বাদের আজগুবি ছড়া। এক্ষেত্রে উপেন্দ্রকিশোর রায়চৌধুরী, অবনীন্দ্রনাথ ঠাকুর তো বটেই, যোগীন্দ্রনাথ সরকার, সুখলতা রাও, লীলা মজুমদার, নারায়ন গঙ্গোপাধ্যায় এঁদের লেখাগুলো কিন্তু পড়াতে হবে। তুমি নিশ্চয়ই বুঝতে পারছো যে ছোটোদের মন অনেক বেশি কল্পনাপ্রবণ; সুতরাং তাদেরকে এই সমস্ত রূপকথার গল্প এবং ছোটোদের উপযোগী মজার মজার গল্প পড়তে দিলে তাদের মন আরো কল্পনাপ্রবণ হয়, তারা আরও চিন্তাভাবনা করতে শেখে যা পরবর্তীকালে তার চিন্তাভাবনার ব্যপ্তিকে আরও বিশাল করে তোলে। কাজেই রূপকথা পড়া আমি খুব জরুরী বলে মনে করি। এর পাশাপাশি হিতোপদেশের গল্পও কিন্তু পড়তে দিতে হবে। পড়াতে হবে ঈশপের গল্প। এই সমস্ত গল্পগুলো নীতিবাক্যসহ শিশুমনে এক সুদূরপ্রসারী প্রভাব বিস্তার করে এবং বাস্তব জীবনে বহু ক্ষেত্রে কিন্তু কাজে লাগে। সুতরাং হিতোপদেশের গল্প এবং ঈশপের গল্পগুলোকে কোনওভাবেই অস্বীকার করা যায় না। পাশাপাশি ছবিতে গল্প, বাইবেলের গল্প পড়াতে হবে। ছোটদের জন্য সহজ-সরলভাবে লিখিত ইলিয়াড ওডিসির গল্পও কিন্তু পড়তে দিতে হবে। আর একটা কথা — পুরাণকে বাদ দিয়ে কিন্তু আমাদের সাহিত্য নয়। সুতরাং পুরাণ-ও পড়াতে হবে। আর ছোটোদের উপযোগী করে পুরাণের গল্প সবচেয়ে সুন্দর করে লিখেছেন উপেন্দ্রকিশোর রায়চৌধুরী। কাজেই তাঁর লেখা তো পড়তেই হবে — এতে করে তাদের জানার পরিধি অনেক অনেক বাড়বে। পাশাপাশি পড়াতে হবে সুকুমার রায়, রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর, কাজী নজরুল ইসলাম, প্রেমেন্দ্র মিত্র … এবং এভাবে পড়াতে পড়াতে তুমি বুঝতে পারবে আর কি কি পড়ানো দরকার।
এবার তোমার ছেলের কথায় আসি। তোমার ছেলে সপ্তম মান বলছো, ভালো কথা। ও বিভিন্ন কমিকসের বই পড়ে তাও ভাল কথা। ওকেও কিন্তু রামায়ণ-মহাভারত-পুরাণের গল্প পড়তে দিতে হবে। আমি মনে করি রামায়ণ-মহাভারত অবশ্যপাঠ্য। পাশাপাশি ইলিয়াড ওডিসি পড়তে দিতে হবে। পড়াতে হবে আশাপূর্ণা দেবী, হেমেন্দ্রকুমার রায়, লীলা মজুমদার, সত্যজিৎ রায়, শিবরাম চক্রবর্তী প্রমুখের লেখা। লীলা মজুমদারের পদিপিসির বর্মী বাক্স পড়িয়ে দিও, পড়িয়ে দিও হেমেন্দ্রকুমার আবার যখের ধন। পড়তে দিও দেড়শো খোকার কান্ড। স্বপনবুড়ো লেখা কিন্তু পড়ালে ভালো হবে। সেইসঙ্গে সত্যজিতের ফেলুদা, শঙ্কু, সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়ের কাকাবাবু, সেইসঙ্গে পান্ডব গোয়েন্দা, ফ্রান্সিস, বাটুল দি গ্রেট, হাঁদা ভোঁদাও পড়তে দিতে হবে। পড়তে দিতে হবে বিভূতিভূষণ বন্দ্যোপাধ্যায়ের পথের পাঁচালী। পড়তে দিতে হবে চাঁদের পাহাড়। আসলে এইগুলোর মধ্যে লুকিয়ে থাকে একটা ফ্যান্টাসির জগৎ যা ছোটোদের মনের বিকাশের পক্ষে খুব দরকার। ছোটদের মনের বিকাশ এবং কল্পনার স্তরকে উন্নত করার জন্য এগুলোর কোনো বিকল্প নেই। রবীন্দ্রনাথ, শরৎচন্দ্রের ছোটদের উপযোগী লেখাগুলি আছে, সেগুলিও কিন্তু পড়া জরুরী। রবীন্দ্রনাথের 'কথা কাহিনী'র মতো ভালো বই কিন্তু আর হয় না, এটা পড়িয়ে দিও। সম্ভব হলে দীনেন্দ্রকুমার চট্টোপাধ্যায়ের দুরন্ত ঈগল পড়তে দিও ছেলেকে। অসামান্য একটি কিশোর উপন্যাস, ছেলের সঙ্গে তুমিও পড়ে দেখতে পারো, ভাল লাগবে। পড়াতে পারো নাম তার ভাবা, নীল ঘূর্ণি, মরণের জয়ডঙ্কা বাজে — এ রকম আরও অনেক কাহিনী। সেইসঙ্গে কিন্তু ইংরেজি সাহিত্যও কিছু পড়া দরকার। ছোটদের জগতে এনিড ব্লাইটন তো অনবদ্য। পড়িয়ে দিও ঈশপের গল্প, হিতোপদেশ এর গল্প ইত্যাদি যেগুলো ইংরেজিতে লেখা। এগুলো ভবিষ্যতে খুব কাজে দেবে বলেই আমার বিশ্বাস। সেইসঙ্গে কিন্তু সাধারণ জ্ঞানের বই পড়াতে ভুলো না, কারণ আগামী কর্মজীবনে ওই সাধারণ জ্ঞানের বই ভীষণভাবেই কাজে লাগবে। আর ছেলেমেয়েদেরকে এটা বোঝাবে যে বইয়ের চেয়ে বড় বন্ধু পৃথিবীতে আর দুটো নেই।
আর একটা কথা — পড়াশোনার পাশাপাশি ওদেরকে খেলতে দাও। অন্য সঙ্গী না পাক, তুমি নিজেই ওদের সঙ্গে খেলো, ওদেরকে সময় দাও, ওদের সঙ্গে গল্প করো। তুমি নিজে একটা গল্প পড়ে সেটিকে ওদেরকে শোনাও। ওদেরকে সময় দাও। মনে রেখো ছেলেমেয়েদেরকে তুমি যদি আজ সময় দাও, আগামী দিনে ওরাও কিন্তু তোমার জন্য সময় দেবে। যাইহোক, ভালো থেকো, ছেলেমেয়েদেরকে ভালো রেখো। অনেক অনেক শুভেচ্ছা ও শুভকামনা সহ।
— তোমার বন্ধু বাদল।
চিত্রঋন- ইন্টারনেট।
=======================
গোবিন্দ মোদক।
সম্পাদক: কথা কোলাজ সাহিত্য পত্রিকা।
রাধানগর, ডাক- ঘূর্ণি, কৃষ্ণনগর, নদিয়া।
পশ্চিমবঙ্গ, ভারত।