চিত্রঋন- ইন্টারনেট।
ঘুণপোকা
নিরঞ্জন মণ্ডল
কোলকাতা বইমেলা প্রাঙ্গন।মেলা শুরু হয়েছে ক'দিন আগেই।বেশ জমে উঠেছে মেলা।উপচে পড়া মানুষের ভিড়।যদিও নতুন বইয়ের টানে আসা মানুষ তুলনায় কম।ঘোরার মজা নিতে আসা মানুষই বেশি।এটাই এখন কোলকাতা বইমেলার বৈশিষ্ট হয়ে উঠেছে।
মেদিনীপুর শহরের লাগোয়া গ্রাম থেকে মেলায় এসেছেন অলোকেশ বর।এখন শুধুই অলোকেশ।উস্কোখুস্কো চেহারা।জীর্ণ পাঞ্জাবী পায়জামা আর ক্ষয়ে যাওয়া হাওয়াই চটি।মুখে খোঁচা খোঁচা দাড়ি।কাঁধে ঝোলানো আধছেঁড়া ব্যাগ।সব মিলিয়ে দারিদ্র্যের ছাপ স্পষ্ট।এক সময় কেরানির চাকরি করতেন জেলাশাসকের অফিসে।গল্পকার হওয়ার নেশা ধরেছিল কিভাবে যেন! অখ্যাত লিটিল ম্যাগাজিনে হঠাৎ একদিন ছাপা হয়েছিল তাঁর একটা গল্প। চমৎকৃত হয়েছিলেন।গল্প লেখার নেশায় ডোবার শুরু তখন থেকেই।বিভিন্ন লিটিল ম্যাগাজিনে গল্প পাঠানো---ছাপা হওয়া।ধীরে ধীরে বড় গল্পকার হওয়ার স্বপ্নে ডুবে যাওয়া।বের করতে শুরু করেন একটা ছোটো পত্রিকাও।লেখা আসতে শুরু করে চারিদিক থেকে।সম্পাদনার কাজ বাড়তে থাকে।পত্রিকা সূত্রে পরিচয় সুমন্ত্র ঘড়াইয়ের সঙ্গে।মেদিনীপুর সীমান্তে পুরুলিয়ার ছেলে।অলোকেশের সমবয়সী।সুমন্ত্রও গল্প লেখেন।প্রথম ছাপা হয় অলোকেশের পত্রিকায়।তার পর একদিন হুট করে সুমন্ত্র চলে আসেন অলোকেশের বাড়ি।দীর্ঘ আলোচনা গল্প নিয়ে।শেষে পত্রিকার সহসম্পাদকের দায়িত্ব দেওয়া হয় তাঁকে।
সুমন্ত্র মাঝেমধ্যে তাঁর গল্প নিয়ে হাজির হতেন কোলকাতার প্রতিষ্ঠিত মাসিক পত্রিকার দপ্তরে।গল্প দিতেন।ছাপা হত না।বার বার আসা যাওয়ায় একটা পত্রিকার দপ্তরের অস্থায়ী কর্মীর সঙ্গে বন্ধুত্ব হয় তাঁর।এই কর্মীর হাত ধরে পত্রিকার সহসম্পাদকের সঙ্গে আলাপ।একদিন তাঁর একটা গল্প চেয়ে নেন সুমন্ত্র।ছাপা হয় অলোকেশের পত্রিকায়।কপি নিয়ে সুমন্ত্র ছোটেন কোলকাতায়।ধীরে ধীরে সহসম্পাদকের সঙ্গে তাঁর বন্ধুত্ব হয়।সময় গড়ায়।বিভিন্ন আঞ্চলিক পত্রিকার সঙ্গে যোগাযোগ গড়ে তোলেন সুমন্ত্র।নিজের নাম পরিবর্তন করে সুমন্ত্র চৌধুরী হয়ে যান তিনি।বন্ধুত্বের সুবাদে কোলকাতার পত্রিকায় তাঁর গল্প বের হয়।অলোকেশ কিছুই জানতে পারেন না।শেষে এক সময় এই পত্রিকার দপ্তরের অস্থায়ী কর্মী হয়ে যান সুমন্ত্র।অলোকেশের সঙ্গে বন্ধ করেন যোগাযোগ।গ্রামের পাট চুকিয়ে কোলকাতার অস্থায়ী বাসিন্দা হন তিনি।বিভিন্ন সাময়িকীর সঙ্গে গড়ে তোলেন যোগাযোগ।আজ সুমন্ত্র চৌধুরী প্রতিষ্ঠিত গল্পকার।
এক সময় অলোকেশ জানতে পারেন বিষয়টা।এটাও জানতে পারেন যে তাঁর পত্রিকাকেই ব্যবহার করে নিজের আখের গুছিয়েছেন সুমন্ত্র।জিদ চেপে বসে অলোকেশের মনে।পুরোপুরি ডুবে যান পত্রিকার প্রকাশনায়।চাকরিস্থলে দিনের পর দিন অনুপস্থিতি বাড়তে থাকে তাঁর।শেষে জেলাশাসক ডেকে সতর্ক করেন তাঁকে।চাকরি ছাড়েন অলোকেশ।গল্পকার তাঁকে হতেই হবে।পত্রিকাই তার মূলধন।বিয়ে--সংসার--সন্তান সবই ঘটে নিয়ম মেনে।আর্থিক চাপ বাড়তে থাকে।বাপের রেখে যাওয়া সামান্য সম্পত্তি বেচতে শুরু করেন।বাড়তে থাকে দারিদ্র্য।শেষে সবকিছু হারিয়ে অলোকেশ হয়ে যান দিনমজুর।বন্ধ হয় পত্রিকা।কিন্তু গল্পকার হওয়ার স্বপ্ন মোছে না।আর মোছে না এই বইমেলায় আসার নেশা।বই কেনার সামর্থ্য নেই।তবু কি এক নেশায় যে তিনি ফি-বছর আসেন! কাঁধে ঝুলতে থাকা আধছেঁড়া ঝোলাটায় থাকে কিছু নতুন লেখা গল্প।যদিও মাঝে মধ্যে মফস্বলের বিভিন্ন লিটিল ম্যাগাজিনে ছাপা হয় তাঁর দু'একটা গল্প।তবু বইমেলা স্পেশাল কিছু গল্প তিনি আনেন প্রতি বছর।ঘোরেন বিভিন্ন পত্রিকার স্টলে।পত্রিকা নাড়াচাড়া করেন।কথা হয় স্টলের কর্মিদের সঙ্গে।তাঁর প্রকাশিত গল্পের ফিরিস্তি শোনান অলোকেশ।তার পর অবধারিত অনুরোধ--আপনাদের পত্রিকায় একটা গল্প দিতে চাই।লজ্জার মাথা খেয়ে কোনো কোনো পত্রিকা- স্টলের কর্মী গল্প নেনও।কিন্তু ছাপা হয় না।এ ভাবে দারিদ্র্যের চাবুক আর পত্রিকাগুলোর বঞ্চনায় আজ অলোকেশ প্রায় অর্ধোন্মাদ।তবু নেশা কাটেনা তাঁর।কি এক অদ্ভুত নেশায় তিনি ছুটে বেড়ান কোলকাতার মাসিক পত্রিকাগুলোর দপ্তরে দপ্তরে।এমনই এক দিন তিনি হাজির হন সুমন্ত্রের পত্রিকা-দপ্তরে।সুমন্ত্র তখন প্রখ্যাত গল্পকার।পত্রিকার সহসম্পাদক।অলোকেশের গলার স্বর তিনি শুনতে পান প্রায় বন্ধ কাঁচের দরজার আড়াল থেকে।বেরিয়ে আসেন।বিস্ময় প্রকাশ করে বলেন--অলোকেশ, তুই এখানে?অলোকেশকে বসান নিজের ঘরে নিয়ে।
পুরোনো দিনের কথা ওঠে।অলোকেশের হতদরিদ্র্য অবস্থার কথা জেনে দুঃখ প্রকাশ করেন।চেয়ে নেন কিছু গল্প।তা প্রায় ডজন দেড়েক।ঝোলা উপুড় করেই দিয়েছিলেন অলোকেশ।সুমন্ত্র কথা দেন তাঁর গল্প পত্রিকায় ছাপার।হাল্কা টিফিন করিয়ে ছাড়েন তাকেঁ।শোনান--তাঁর পত্রিকা থেকেই যে যাত্রা শুরু করেছিলেন।সুমন্ত্রের অমায়িক হাসি,তার আন্তরিকতায় মুগ্ধ হয়েছিলেন অলোকেশ।অনেক আশা নিয়ে পত্রিকার পরবর্তী সংখ্যাটা কিনেছিলেন অলোকেশ।রক্ত জল করা পয়সায়।না----কোথাও নেই অলোকেশের নাম।তবে সুমন্ত্র আছেন।তাঁর গল্প বেশ চমৎকার ছবি সহ ছাপা হয়েছে।ছবিটা দেখে একটা খটকা লাগে অলোকেশের।পড়তে আরম্ভ করেন গল্পটা।তাঁরই গল্প।একটু ঘষেমেজে নিজের নামে ছাপিয়ে দিয়েছে সুমন্ত্র।বুঝতে পারেন সুমন্ত্রের ভালো মানুষ চেহারার আড়ালের নোংরা রুচির আদল।পর দিন পরিচিতের কাছে পয়সা ধার করেই কোলকাতায় ছোটেন।সুমন্ত্র আগের মতোই হেসে আপ্যায়ন করেন।অলোকেশের একটাই দাবী।গল্পগুলো ফেরত চাই।আকাশ থেকে পড়েন সুমন্ত্র।কোন গল্পগুলো ফেরত চাচ্ছেন অলোকেশ বুঝতে না পারার ভান করেন।শেষে প্রবল বাদানুবাদে ছিন্ন হয় সম্পর্ক।অদ্ভুত নেশার ঘোরে সুমন্তের পত্রিকার পরবর্তী সংখ্যাগুলো চেয়েচিন্তে খুঁটিয়ে পরীক্ষা করেন অলোকেশ।পরপর তাঁরই দেওয়া গল্পগুলো একটু অদলবদল করে ছাপা হচ্ছে সুমন্ত্রের নামে।প্রতিবারই অলোকেশের মুখ থেকে অস্ফুটে বেরিয়ে আসে অশ্রাব্য ভাষা।
উদভ্রান্তের মতোই আজ বইমেলায় ঘুরছেন অলোকেশ।হঠাৎ মেলাপ্রাঙ্গনের একটা ফাঁকা জায়গায় কিছু মানুষের অর্ধাকৃতি জমায়েতে আকৃষ্ট হন তিনি।পায়ে পায়ে এগিয়ে যান সেদিকে।জমায়েতের সামনে একটা ছোট মঞ্চ।মাইক্রোফোনে বক্তব্যরত সুমন্ত্র চৌধুরী।প্রখ্যাত গল্পকার।একটা লিটিল ম্যাগাজিনের উদ্যোগে আলোচনা সভা।বিষয়--"ছোটো গল্পের একাল-সেকাল"।সামনের সারিতেই দাঁড়ান অলোকেশ।শুনতে থাকেন সুমন্ত্রের কথা।অনেক জ্ঞানগর্ভ কথাবার্তা।শেষে সুমন্ত্র বলেন--গল্পকার হতে গেলে দীর্ঘ লড়াই লড়তে হয়।অনেক ত্যাগ স্বীকার করতে হয়।অনেক শ্রম,বিনিদ্র রাতের ফসল একজন ভালো গল্পকার।
অলোকেশের জিভের ডগায় এসে যায় একটা বাক্য--অনেক তেল মালিসের ফসল----!আপ্রাণ চেষ্টায় বাক্যটাকে গলধকরণ করেন তিনি।একটু নড়েচড়ে ওঠেন।মুখ ফস্কে বেরিয়ে আসে একটা শব্দাংশ--শা---!দৃষ্টি আকৃষ্ট হয় সুমন্ত্রের।থেমে যান সুমন্ত্র।এক ঝলক দেখেন অলোকেশকে।বেশ জোরালো গলায় শুরু করেন আবার---আজকাল তো কিছু তথাকথিত গল্পকার আমার গল্পের বিষয় চুরি করে নিজের মতো করে খাড়া করে একটা লেখা।আর মজা হল এমন চুরির কিছু ফসল এসে পৌঁছোয় আমারই পত্রিকার দপ্তরে।অবধারিত ভাবে আমার কাছেও।এদের বোধের দৌড় বুঝে হাসি পায়।এরা কি পাগল!না কি-----!
অলোকেশের মুখে দলা পাকিয়ে ওঠে এক তাল থুতু।সব বিবেচনাই হারিয়ে যায় তাঁর।থুতুর তালটা সামনের দিকে শূন্যে ছুঁড়ে দেন তিনি।কোনো দিকেই তাকান না আর।দ্রুত পায়ে সেখান থেকে একটু এগিয়ে মিশে যান ভিড়ে।
মাইকে ঘোষণা হয়--প্রখ্যাত গল্পকার শ্রী সুমন্ত্র চৌধুরী আমাদের ডাকে সাড়া দিয়ে তাঁর মহামূল্য বক্তব্য রাখলেন।আমরা আপ্লুত, গর্বিত।তাঁকে ধন্যবাদ দিয়ে ছোটো করতে মন চাইছে না। তাঁকে আমাদের অন্তরের শ্রদ্ধা।
---------------------------
নিরঞ্জন মণ্ডল
রাজারহাট/উত্তর 24 পরগণা।