পিকনিকের কেলেঙ্কারি
সৌরভ সরদার
পৌষ মাসের সকালের সূর্যরশ্মীর সাথে সবেমাত্র মধুর সম্পর্ক স্থাপন হয়েছে। শীতের শুভাগমন খুব দ্রুততার সহিত শুরু হয়ে গিয়েছে, শিশুদের বাৎসরিক পরীক্ষা ও সমাপ্ত হয়েছে সবামাত্র।
এ সময় আমার বাড়িতে মাসতুতো পিসতুতো ভাইবোনেরা প্রতি বৎসর পিকনিক করতে আসে। এবার ও তারা একসাথে গতকাল এসে হাজির হয়েছে। মামার দুই মেয়ে ,মাসির এক ছেলে ও মেয়ে আর পিসির দুই ছেলেমেয়ে। অতএব গোটা বাড়িটা চঞ্চলময় শিয়ালদহ স্টেশনের মতন গমগম করছিল।
না মিথ্যে বলব না, তারা এলে সত্যিই মনে একটু বিরক্তি ভাব কাজ করে । কারণ তারা আসলে আমার সাজানো ফুলবাগান হয় লন্ডভন্ড, গুছানো ঘর হয় এলোমেলো। কিন্তু একথাও অস্বীকার করব না যে তারা আসলে আমিও সব চিন্তা অবসাদের আসর ছেড়ে উল্লাসের প্রাঙ্গনতলে এসে পড়ি।
প্রতিবারে তারা এসে নিজেরাই পিকনিক করার সিদ্ধান্ত নেয় , কিন্তু সে সিদ্ধান্তের আগে থাকে অজস্র মতবিরোধ আর দ্বন্দ্ব। কারণ কোথায় হবে পিকনিক, কি রান্না হবে ইত্যাদি ইত্যাদি। এবার ও তারা সবাই মিলে পিকনিক করার সিদ্ধান্ত নিয়েছে কিন্তু এবার এক আশ্চর্য ব্যাপার ঘটেছে। তাদের মধ্যে কোনো মতবিরোধ হয়নি এবং তাদের সিদ্ধান্ত ও একটাই ! তাদের মধ্যে বয়জেষ্ট পিসির ছেলে পিকু এসে সন্দর্পনে জানালো তারা এবার ডাবুতে পিকনিক করতে চায় এবং সেই পিকনিক দিনান্তে শুরু হবে আর রাত্রে শেষ হবে। শুধু তাই নয় সন্ধ্যা নামলেই ক্যাম্প ফায়ার করে তার পাশে বসে জমিয়ে আড্ডা আর গল্পের আসর ও বসাবে।
ডাবু আমার বাড়ি থেকে 25 কিলোমিটারের দূরত্বে এক নামজাদা পর্যটন কেন্দ্র যেটা ক্যানিং অঞ্চলের ঐতিহ্য । অনেকটা সুন্দরবন অরণ্যের মতো তার পরিবেশ। সুন্দরী, গরান, গোলপাতা, হোগলা, হেতাল, গেঁওয়া এসবের সন্ধান সেখানে সহজেই মেলে । মাতলার তীরের ছোটছোট ফাঁড়ি, ফিশারি, জঙ্গল ওই অঞ্চলকে মাতিয়ে রেখেছে। প্রায় বিঘা কুড়ি জমির উপর ডাবুর এই নির্জনতা, পাখির কলরব, প্রকৃতির প্রাণময় নিঃশ্বাসে জীবন যেন তৃপ্তিতে ভোরে ওঠে।
ডিসেম্বর পড়তেই সেখানে নবীন প্রবীণ তরুণ তরুণীর ভিড় জমে। প্রথমটা কিঞ্চিৎ দ্বিধাবোধ করেছিলাম কিন্তু ডাবুর প্রকৃতির সাথে সাক্ষাতের লোভ সামলাতে পারলাম না। অগত্যা তাদের প্রস্তাবে রাজি হয়ে গেলাম। ঠিক হলো গতকালই বিকালে সেখানে রহনা দেওয়া হবে উপযুক্ত সামগ্রী সহযোগে।
পরিকল্পনা করা হলো সেখানে এক আত্মীয়ের বাড়িতে গিয়ে আশ্রয় নেওয়া হবে এবং অবশিষ্ঠ সামগ্রী সেখান থেকেই সংগ্রহ করা হবে ।
পরিকল্পনা মাপিক দুপুরের আহারাদি গ্রহণ করেই পিকনিক যাত্রায় রহনা দিলাম। সাথে তারা পাঁচ জন এবং তাদের সংগীতের সামগ্রী - বাঁশি, গিটার, আর একটা খঞ্জনি। বাদবাকি সুর স্কেল মোবাইলেই সংগ্রহ হবে বলে সিদ্ধান্ত হলো। প্রায় সোয়া চারটে নাগাদ আত্মীয়ের বাড়ি হয়ে পিকনিক স্পটে গিয়ে পৌঁছালাম। সূর্য তখন অস্তিমিত, আর শীতের কামড় ও সবে মাত্র প্রখর রূপ পেয়েছে।পাখিরা ব্যাস্ত ঘরে ফেরার জন্য আর যারা দিনের বেলা পিকনিক করেছিল তারাও বাড়ি ফেরার তোড়জোড় শুরু করে দিয়েছে।
উঁচু রাস্তার দুই ধারে প্রকান্ড মাঠ, যা বর্ষায় ফিশারি হিসাবে কাজে আসে। সেই ফিশারির পাড় বন্য গাছপালায় ভরা। আর তারই পিছনেই জঙ্গলের মধ্যে দিয়ে এঁকে বেঁকে ফাঁড়ি গুলো প্রবাহিত হয়েছে। যেহেতু আমাদের পিকনিক শেষ হতে রাত্রি হয়ে যাবে তাই বেশি গভীর জঙ্গলের দিকে না গিয়ে পথ সম্মুখেই আয়োজন শুরু করলাম। আসে পাশে দৃষ্টি দিয়ে দেখলাম আমরা ছাড়া আরো দুই দল পিকনিক আরম্ভের তোড়জোড় করছে। এক ঝাঁক বক সারি বেঁধে মাথার উপর দিয়ে নদীর দিকে উড়ে গেলো, পাখিদের কিচিরমিচির, ঝিঁঝিঁ পোকার ডাক এসবের জন্যই তো মনটা মরিয়া ছিলো। ক্যাম্প ফায়ার আর পিকনিকের রান্না যখন নিয়ম মাপিক চলিছিল তখন সবাই শীতের জড়তা কাটানোর তাগিদে ফায়ারের চারিদিকে গোল হয়ে বসে আড্ডার আসরে মেতে ছিলাম। বেশ কিছুক্ষন গলা ফাটিয়ে চিৎকার করে বাদ্যযন্ত্র সহযোগে মান্না দের "কফি হাউস" থেকে বাদশার "হায় গার্মি" একাধারে গাওয়া হলো। অর্থাৎ ছয় রাগ ও ছত্রিশ রাগিনীকে স্বাগতম জানানো হয়েছে।
তখনো রান্না সমাপ্ত হতে কিছু সময় বাকি তাই আবার কোনো নতুন খেলার আবিষ্কারের জন্য সকলে উৎসুক ছিলাম। ট্রুথ এন্ড ডেয়ার যেন একটু পুরানো খেলা তাই এক এক জনের উপর গল্পের দায়িত্ব এসে পড়ে। নিজেদের জীবনের সবথেকে রোমাঞ্চ- রোমান্টিক ঘটনাকে গল্পের ন্যায় পেশ করতে হবে। সবার পালা সমাপ্ত হওয়ার পর আমার পালা এলো। কোন ঘটনাকে যে বলবো তা ঠাওর করতে পারছিলাম না এমন সময় আমাদের পিছনের ঝোপ থেকে একটা যুবতী মেয়ের মৃদু খেসখেসে গলার আওয়াজ শুনতে পেলাম অনেকটা হাজার বছরের পুরানো জীর্ণ বেতারের ঝিমধরা শব্দের মতো। সকলকে সেই আওয়াজ এর কথা বললে তারা বললো ও নাকি আমার মনের ভুল, তারা কেউ সে শব্দ শুনতে পায়নি। ছোটছোট ভাইবোনেরা খামোখা ভুতের ভয় পেতে পারে ভেবে অগত্যা কথা না বাড়িয়ে চুপ করে গেলাম। কিন্তু দ্বিতীয়বার যখন একই ঘটনা ঘটল তখন আর সেটা আমার মনের ভ্রম রইলো না আমার মতো সবাই পরিষ্কারভাবে শুনল এক যুবতীর গুন গুন স্বর। আশেপাশের পিকনিকের দলের আওয়াজ ও এখন স্তব্দ। মৃদু কুয়াশায় কনকনে শীতে এমন হাড় হিম করা পরিবেশে আমার অন্তরাত্মা যেন এক অজানা আশঙ্কায় দোলা খেয়ে উঠলো। হঠাৎ করে জঙ্গলের উঁচু গাছাগুলোয় বসে থাকা পাখিগুলো বিদ্রোহ ঘোষণা করে উঠল। তাদের ডানার হাওয়ায় আমার শরীরের লোমকুশের সাথে সাথে মাথার চুলগুলো ও একপ্রকার সোজা হয়ে গেলো । তাহলে কি সত্যিই কোনো অশুভ আত্মার উপদ্রব?.….... প্রেত ?
চারিদিক খাঁ খাঁ, কুয়াশার দরুন দৃষ্টির প্রখরতা অনতিদুর।কোনো জনমানবের আওয়াজ আর নেই। সেলফোনটা বের করে দেখলাম রাত সাড়ে নটা বাজে। আনন্দ আল্লাদে কখন যে এত রাত হয়ে গিয়েছে তা ঠাওর করতে পারিনি।
এদিকে সেই যুবতীর গলার আওয়াজ ক্রমশ স্পষ্টতর হয়েছে। সেই আওয়াজ এখন পরিণত হয়েছে চাপা কান্নায় যার আওয়াজ যেন এক মায়াবী বিনের মতো। সাহস করে আমি সেলফোনের আলো জ্বালিয়ে দাঁড়িয়ে উঠলাম এবং অনুভব করলাম আমার উরু সমেত হাঁটু দ্বয়ের তীব্র কম্পন। নিজেকে সাহসী প্রমান করার তাগিদে সাহসী বীরের মতো দীর্ঘশ্বাস ফেলে সেই সুরকে অবলম্বন করে এগিয়ে গেলাম। একএক পা ফেলবার সাথে সাথে এক গুন করে হৃদস্পন্দন বেড়ে চললো।
গিয়ে দেখলাম সেখানে একটা পুরানো জীর্ণকায় চাদহীন ঘর স্তম্ভের মতো দাঁড়িয়ে আছে। তার পুরো মেঝে শুকনো পাতায় ভরা ।একটি মেয়ে তার উপর উপুড় হয়ে শুয়ে আপন মনে নিরন্তর কেঁদে চলেছে। আমার ফোনের আলো তার গায়ে পড়ল তবুও তার শারীরিক অঙ্গভঙ্গিতে বিশেষ কোনো পরিবর্তন আসলো না। তার মাথার চুল এলোমেলো, সারা অঙ্গ ধূলিমলিন, পরনের সুন্দর হলুদ চুড়িদার ফেকাশে রূপ ধারণ করেছে।অনেক সাহস করে ধীর স্বরে তাকে বললাম - শুনছেন?
কিছুক্ষন চুপ করে থাকার পর সে মুখ তুলে চাইলো আমার দিকে। কি প্রখর তার দৃষ্টি। যেন তীরের ফলার মতো হিংস্র ভাব তার চাহনিকে ধাবিত করছে। তার চোখের কাজলের দরুন মুখের শ্রী নষ্ট হয়েছে, চোখ গুলো সূর্যাস্তের মতো লাল বর্ণের। তার শানিত দৃষ্টির দারুন শীতেও আমার গা ঘামে ভিজে যাচ্ছিলো। পায়ের তলার মাটি ক্রমশ আলগা হচ্ছিলো।
অনেক প্রশ্ন মনে থাকার শর্তেও অনেকখানি সাহস জুগিয়ে তাকে কেবল কয়েকটি প্রশ্ন করিলাম - কে আপনি..?
কিন্তু কোনো উত্তর এলো না কেবল সে হতভম্বের মতো চেয়ে রইলো আমার দিকে। তার মৌনতা দেখে আবার প্রশ্ন করলাম-" এখানে কি করছেন এত রাত্রে?"
মেয়েটি এবার খেশখেসে গলায় বলল - "আমি ও পিকনিক করতে এসেছিলাম আপনাদের মত, নিকোটিনের নেশায় চুর হয়ে এখানে এসে বসেছিলাম আমার সঙ্গীদের সাথে। কিন্তু ....…"।
"কিন্তু কি?"-... আমি অধীর হয়ে প্রশ্ন করলাম।
মেয়েটি এবার একটু মুচকি হাসি হেসে বললো- " ওরা আমায় এখানে রেখে চলে গিয়েছে, আমি এখানেই থাকি?"।
শুনে দারুনভাবে শক পেলাম, অবাক হয়ে বললাম - "এখানে থাকেন মানে?"
আমার প্রশ্ন শেষ হবার সাথে সাথে তক্ষণাৎ মেয়েটির গলা থেকে আকাশ ছিঁড়ে দেবার মতো নির্মম অট্যহাসি বেরিয়ে এলো। আর আমার অন্তরের রক্তপেশিগুলো ও যেন হটাৎ বেপরোয়া হয়ে উঠলো। মেয়েটি তার উদ্ভট হাসি থামিয়ে করুন সুরে বললো - খুব খিদে পেয়েছে একটু খেতে দেবে?
তার বলা প্রশ্ন আমার কান অব্দি এলো কিন্তু আমার মুখ যেন বরফের ন্যায় শান্ত হয়ে গেলো। হঠাৎ করে এক শীতল স্রোত বয়ে গেলো আমার মস্তিষ্কের শিরায় শিরায়। তার দিকে তাকিয়ে আমার সারা শরীর যেন শিহরিত হয়ে গেলো। দেখলাম তার দাঁতে লেগে রক্তের কালচিটে দাগ আর এতক্ষন যে বিষয়টি আমি লক্ষ করিনি তা এখন দেখলাম। তার ডান দিকের কানের পাশ থেকে গলা পর্যন্ত সদ্য কাটার দাগ। ক্রমে তার নাক গাল মাথা হতে রক্ত ঝরে পড়তে শুরু করেছে। তার পৈশাচিক হাসি পাহাড়ের ন্যায় বিশাল হয়ে আকাশ বাতাস প্রকৃতিকে কাঁপিয়ে দিতে আরম্ভ করল। আমার হৃদস্পন্দন ও এত জোরে হতে শুরু করলো যেন এক্ষুনি আবার হৃদপিন্ডটা বাইরে বেরিয়ে আসবে।
ক্রমশ তার নোখালো হাঁটগুলো আমার গলার দিকে এগিয়ে এলো। আমি নড়াচড়ার শক্তি হারিয়ে বিবস হয়ে রইলাম। হিমালয়ের বরফের থেকেও শীতল স্পর্শ আমার গলার উপরে পড়ল,আমার হাত পা সারা শরীর অবশ হতে শুরু করলো । আমি পার্থিব জগৎ থেকে যেন বিচ্ছিন্ন হয়ে যাচ্ছিলাম। আমার শ্বাস প্রশ্বাস ক্ষীণ হয়ে এলো আর চোখের পাতা আস্তে আস্তে বন্ধ হয়ে এলো।
সহসা আমার ঠাকুমা এসে উষ্ণ ব্লাঙ্কেট টেনে হাতের শীতল স্পর্শ গায়ে দিয়ে বলল - " বেলা তো অনেক হলো ! মহারাজের এখনো ওঠার সময় হলো না ? "
_______________
সৌরভ সরদার,
গ্রাম- দাঁড়িয়া,
থানা- ক্যানিং,
পোস্ট - ঠাকুরানী বেড়িয়া,