পারিজাত কথা
কুহেলী ব্যানার্জী
বসন্ত মানে ফুলের ঋতু। শীতের শেষে যখন ঋতুরাজের আগমন ঘটে তখন প্রকৃতি যেন সেজে ওঠে ফুলে ফুলে। আর এই ফুলের প্রতি ভাললাগা, ভালবাসা তা তো একপ্রকার সার্বজনীন। হওয়াটা স্বাভাবিকও। কারন ফুল তার বর্ণ, গন্ধ আর রূপের সমাহারে অতি সহজেই আমাদের মনে জায়গা করে নেয়। ঠিক সেই কারনেই সুন্দরের প্রতি এক অমোঘ আকর্ষণ আমরা অনুভবও করি।
গত বসন্তে পলাশ অভিযানে পুরুলিয়া গেলে পলাশের মতোই বর্ণজ্জ্বল, নয়ন মনোহর আর এক ফুল নজরে আসে। মান্দার বা পারিজাত মান্দার (Indian coral tree, Tigers claw and Sunshine tree)। যার আঞ্চলিক নাম মাদার বা পালতে মাদার (বৈজ্ঞানিক নাম Erithrina variegata)। হিন্দিভাষী অঞ্চলে একে মান্দার ফরহদ এবং ওড়িষ্যা অঞ্চলে একে পাল্ধুয়া বলে। অতীব সুন্দর এই লাল টুকটুকে রঙের ফুলটির অগ্রভাগ বকের ঠোঁটের মত বাঁকানো। বসন্তে এই গাছের সমস্ত পাতা ঝরে যায়। তখন কাঁটাযুক্ত, পাতাবিহীন গাছটির শাখার আগায় ফুলের মঞ্জরী আসে এবং এক একটি মঞ্জরীতে একাধিক ফুল থাকে। পারিজাতকে স্বর্গের ফুল বলা হয়। তবে ফুলটি দৃষ্টিনন্দন হলেও পলাশের মতোই তা গন্ধবিহীন। তাই প্রাচীনকাল থেকে লোকসাহিত্যের পাশাপাশি সংস্কৃত সাহিত্যেও পারিজাতকে নিয়ে বহু উপমা সৃষ্টি হয়েছে।
''তরবঃ পারিজাতাদ্যাঃ স্নুহিবৃক্ষো মহাতরুঃ''।
অর্থাৎ মনসা যেমন তরু পারিজাতও তেমন। তবে পারিজাত মান্দারকে ব্যঙ্গার্থে যতই মনসার সাথে তুলনা করা হোক না কেন এই গাছের ভেষজ গুনাগুণ কিন্তু অনস্বীকার্য। আয়ুবেদাচার্য শিবকালি ভট্টাচার্য মহাশয় তাঁর "চিরঞ্জীব বনৌষধি" গ্রন্থে এই বিষয়ে বিস্তারিত আলোচনা করেছেন। সুশ্রুত সংহিতায় ও এই গাছটির বিভিন্ন ভেষজ গুণের উল্লেখ পাওয়া যায়। ষষ্ঠ শতাব্দীর অমরকোষে (অভিধান) পারিজাতকে দেবতরু বলা হয়েছে।
পারিজাত (পারিন্ অর্থাৎ সমুদ্র হতে জাত ) গাছটি যে অতি প্রাচীন সে বিষয়ে কোন সন্দেহ নাই। বিভিন্ন পৌরাণিক কাহিনীতে এই ফুলের কথা পাওয়া যায়। মহাভারত ও ভাগবতপুরাণে এই বৃক্ষটি বিশেষ স্থান অধিকার করে আছে। কথিত আছে, সমুদ্রমন্থনের সময় যে সকল চোদ্দ রত্ন উঠে এসেছিল তার মধ্যে অন্যতম এই পারিজাত বৃক্ষ। হরিবংশপুরাণে এর উল্লেখ পাওয়া যায় ''কল্পতরু'' হিসাবে। ইন্দ্রের নন্দন কাননে যে পাঁচটি কল্পতরু ছিল তার মধ্যে এটি অন্যতম। পারিজাতের গঠন বৈচিত্র্য এবং রঙ এতই মনোহর যে দেবতাদের উপাখ্যানেও এর উল্লেখ পাওয়া যায়। ইন্দ্রপ্রদত্ত পারিজাতের মালা নারদ মারফত দ্বারকার অধিপতি শ্রীকৃষ্ণের কাছে প্রেরিত হলে ঘটনাক্রমে তাকে কেন্দ্র করে পরবর্তীকালে প্রাগজ্যোতিষপুরের (আসাম) রাজার সাথে দ্বারকার অধিপতির যুদ্ধ সংগঠিত হয়। দ্বারকাধিপতি তাঁর স্ত্রীদের খুশি করার উদ্দেশ্যে এই বৃক্ষের ডাল এনেছিলেন (আসাম থেকে)বলে জানা যায়। মহাভারতে পঞ্চপাণ্ডব জননী কুন্তিও পারিজাতের ফুল দিয়ে শিবার্চনা করতেন। আবার দেখা যায় শিবপুরাণে শিব- পার্বতী তাঁদের কন্যার রক্ষার্থে এই বৃক্ষের সাহায্য গ্রহন করেছেন। ঠিক একইভাবে আমরা দেখি হিন্দুধর্মের মতোই জৈন্য ও বৌদ্ধধর্মেও এমন কল্পতরুর উল্লেখ আছে। অবশ্য ভারতের বিভিন্ন অঞ্চলে বিভিন্নগাছ কল্পতরু হিসাবে কল্পিত হয়েছে । সেখানে বট এবং অশ্বত্থ সর্বাধিক গ্রহণযোগ্য হলেও কোথাও কোথাও অবশ্য তুঁত ,নারকেলকেও এমন কল্পনা করা হয়।
তবে এই পারিজাত ফুল নিয়ে বেশকিছু মতপার্থক্যও রয়েছে। মান্দার ফুলের সাথে সাথেই শিউলি এবং পাখিফুলকেও স্বর্গের ফুল পারিজাতের সাথে তুলনা করা হয়। পুরাণ অনুসারে শিউলিফুল যদি পারিজাত হয় তবে একটা সন্দেহ তৈরি হয়, তা হল দ্বারকাধিপতি শ্রীকৃষ্ণ যে পারিজাত বৃক্ষের ডাল পুঁতেছিলেন তা শিউলি গাছ হওয়ার সম্ভাবনা খুব কম । কারন এই গাছ কখনই ডাল থেকে হয় না। কিন্তু মান্দার পারিজাত অতি সহজেই ডাল থেকে জন্মায় ।
বাংলা সাহিত্যেও ফুলটি এক বিশেষ স্থান অধিকার করে আছে। বিভিন্ন কবিতায় ,গানে তার ব্যবহার লক্ষ্য করা যায়। নজরুলের গানে দেখি –
''পরো কুন্তলে, ধরো অঞ্চলে
অমলিন প্রেম- পারিজাত।''
রবীন্দ্রনাথের বিভিন্ন গানেও পায় –
''ফাগুন হাওয়ায় রঙে রঙে
পাগল ঝোরা লুকিয়ে ঝরে
গোলাপ জবা পারুল পলাশ
পারিজাতের বুকের পরে।
আবার-
'' পারিজাতের কেশর নিয়ে ধরায় শশী ছড়ায় কী এ
ইন্দ্রপুরীর কোন রমণী বাসর প্রদীপ জ্বালো। ''
কবির বর্ণনায় দেখি পারজাতের কেশরের কথা । কিন্তু শিউলির কোন কেশর নেই। অন্যদিকে মান্দার ফুলের কেশর বর্তমান। বাংলাদেশের প্রকৃতিবিজ্ঞানী বিপ্রদাস বড়ুয়া রচিত "গাছপালা তরুলতা'' গ্রন্থে মান্দার,পাখি ও শিউলি এই তিনটি ফুলই ভিন্নভাবে আলোচিত হয়েছে। সেখানে তিনি মান্দারকেই পারিজাত বলে উল্লেখ করেছেন। আয়ুবেদাচার্য শিবকালি ভট্টাচার্য মহাশয়ও তাঁর গ্রন্থে মান্দার পারিজাতর পৌরাণিক কাহিনী সহ তার ব্যবহারিক ও ভেষজ গুণের দিকে আলোকপাত করেছেন। বিশিষ্ট উদ্ভিদবিদ দ্বিজেন শর্মা তাঁর ''ফুলগুলি যেন কথা'' নামক গ্রন্থে এই মান্দার পারিজাত গাছ সম্পর্কে বলেছেন।
পত্রমোচী এই মান্দার বৃক্ষটি উষ্ণমন্ডলীয় এবং নাতিশীতষ্ণমন্ডলীয় উভয় পরিবেশেই জন্মায়। গাছটি কাঁটা যুক্ত, কাঠ অতি নরম। দেশলাই ও কাগজ তৈরিতে ব্যবহার হয়ে থাকে। তবে সাধারণত আবাদি জমিতে বেড়া দেওয়ার কাজে লাগে। ভারত ছাড়াও শ্রীলঙ্কা, মায়ানমার, মালয়েশিয়া এবং বাংলাদেশে এই গাছের দেখা মেলে। ঝড় –ঝঞ্ঝা প্রতিরোধ করতে সক্ষম হওয়ায় উপকূলবর্তী এলাকাতেও জন্মে। বুনো গাছ হওয়ায় বিশেষ যত্নের ও প্রয়োজন হয় না। তবে বর্তমানে ভেষজ গুণ সমৃদ্ধ এই গাছটি পরিবেশের প্রভাবে হারিয়ে যাচ্ছে। আমাদের উচিত গাছটি যাতে বিলুপ্ত না হয়ে যায় সেদিকে নজর দেওয়া।
তথ্য- '' চিরঞ্জীব বনৌষধি'' , উইকিপিডিয়া
***************************************
কুহেলী ব্যানার্জী।
জন্ম বীরভূম জেলায়। বর্তমানে স্বামীর কর্মসূত্রে সিউড়িতে থাকা। ইতিপূর্বে একটি স্থানীয় পত্রিকায় ছোটগল্প প্রকাশিত হয়েছে। বেশকিছু ভ্রমণকাহিনী আনন্দবাজারের জেলার পাতায় স্থান পেয়েছে। লেখালেখি করা ছাড়াও আমার অন্যতম শখ ফটোগ্রাফি ।
Kuhali Bandyopadhyay
C/O –Anirban Bandyopadhyay
Lalkuthipara govt. housing
Suri, Birbhum
Pin-731101