প্রবন্ধ ।। রূপসী বাংলার কবি জীবনানন্দ দাশের মৃত্যু এবং কিছু জিজ্ঞাসা ।। তুষার ভট্টাচাৰ্য
রূপসী বাংলার কবি জীবনানন্দ দাশের মৃত্যু এবং কিছু জিজ্ঞাসা
তুষার ভট্টাচাৰ্য
রবীন্দ্রত্তোর যুগের বাংলা ভাষার শ্রেষ্ঠতম, আত্মপ্রচার বিমুখ, নির্জনতা বিলাসী কবি জীবনানন্দ দাশের মৃত্যু নিয়ে, তাঁর মৃত্যুর ৬৭ বছর পরেও কবির প্ৰিয় অনুরাগী পাঠকদের মনে অনন্ত জিজ্ঞাসা রয়ে গেছে।
এব্যাপারে ' পূর্বাশা ' পত্রিকার সম্পাদক কবি সঞ্জয় ভট্টাচাৰ্য লিখেছেন - আমার মনে হয় জীবনানন্দ ঠিক ট্রাম দুর্ঘটনায় মারা যাননি। যদিও এ কথাটাই বলা হয়ে থাকে, তথাপি আমার ধারণা তিনি আত্মহত্যা করেছেন।
বিশিষ্ট কবি সম্পাদক সঞ্জয় ভট্টাচার্যের মন্তব্য উল্লেখ করে , কবি জীবনানন্দ দাশের ছাত্র কবি অরবিন্দ গুহ তাঁর স্মৃতিচারণায় লিখেছেন - সেসব ঘটনা খুব সুখের নয়।
কবি পত্নী লাবণ্য দাশের সঙ্গে প্রতিদিন জীবনানন্দের একটা মানসিক দ্বন্দ্বর কথা, কবি অরবিন্দ গুহ অকপটে ব্যক্ত করেছেন এবং সঙ্গে সঙ্গে তিনি একথাও জানিয়েছেন যে জীবনানন্দ পারিবারিক জীবনে অসহনীয় দাম্পত্যের টানাপোড়েনের হাত থেকে মুক্তি খুঁজছিলেন ।
একথা ঠিকই যে কবি পত্নী লাবণ্য দাশের (ঢাকার ইডেন কলেজের ছাত্রী,১৩৩৭ বঙ্গাব্দের স্নাতক ) সঙ্গে কবির বিবাহিত জীবন একদমই সুখকর হয় নি।
প্রাত্যহিক জীবন যাপনে যিনি প্রতিনিয়ত দু'দন্ড শান্তি কামনা করতেন, সেই নিরিবিলি শান্তি তিনি কোনওদিনই খুঁজে পাননি কবি জীবনানন্দ দাশ । প্রায়শই বাড়িতে দাম্পত্য কলহ লেগে থাকতো l সম্ভবত কবির অপরিমেয় আর্থিক অনটনের জন্যই ।
'ধূসর পাণ্ডুলিপি'র কবি জীবনানন্দ দাশের মৃত্যুকে হয়তো কিছুটা তরান্বিত করেছিল বেকারত্বের দুর্বিসহ জ্বালা, নিদারুণ আর্থিক কষ্টের জন্যও ।
তাঁর লেখা গল্প, উপন্যাসের বিভিন্ন জায়গায় নায়কের বক্তব্যে, যেন পরতে পরতে কবির আত্মজীবনের কণ্ঠস্বর প্রতিধ্বনিত হয়েছে বারংবার ।
তিনি লিখেছেন - ' ছ'বছর ধরে নানারকম চেষ্টা ও ব্যর্থতার পর অভিজ্ঞতা জমে গিয়েছে অনেক l অপার দারিদ্রতার ভিতরে, যক্ষার, মৃত্যুর সঞ্চার সে টের পাচ্ছে ।
অসীম বেকারত্বের থেকে মুক্তির জন্য কবি কোনও না কোনও সময়ে আসামে, মাদ্রাজে ( অধুনা চেন্নাই ) গিয়েছিলেন। বাসের পারমিটের জন্য রাইটার্স বিল্ডিংএ গিয়েছিলেন পর্যন্ত। ইন্সুরেনসের এজেন্ট হবারও বাসনা পোষণ করেছিলেন।
১৯৫২ - ৫৩ সালে অসম্ভব মানসিক দৌর্বল্যে ভুগছিলেন কবি। ১৯৫৩র মে মাসে কবি অনুরক্ত জলপাইগুড়িতে বসবাসকারী সুরজিৎ দাশগুপ্তকে একটি চিঠিতে লিখেছেন - শরীর বড় অসুস্থ, কোনো কাজই করতে পারছি না ।
১৯৫৪ সালের ৪সেপ্টেম্বর ' পূর্বাশা ' পত্রিকার সম্পাদক কবি সঞ্জয় ভট্টাচাৰ্যকে ব্যক্তিগত চিঠিতে লিখেছেন - অনেকদিন থেকে আমার শরীর বিশেষ অসুস্থ....... । এই প্রেক্ষিতে সঞ্জয় ভট্টাচাৰ্য লিখেছেন - মৃত্যুর পূর্বাভাষ ছিল সেই চিঠিতে । সেই সময়ে 'বেকার ' কবি জীবনানন্দ মনের মতো একটি কাজ পেলে হয়তো আরও কিছুদিন নিশ্চিন্তে জীবন কাটাতে পারতেন । লেখালেখিতে আরও মনোনিবেশ করতে পারতেন ।
একদিকে বেকারত্বের জ্বালা যন্ত্রণা , অন্যদিকে একের পর এক সাহিত্য - সমালোচকদের সমালোচনা কবিকে শরবিদ্ধ করেছে, মানসিকভাবে ক্ষত বিক্ষত করেছে প্রতিনিয়ত
কবি সমালোচক মোহিতলাল মজুমদার, (১৩৩৬ বঙ্গাব্দে ) জীবনানন্দের 'বোধ 'কবিতার সমালোচনা করে লেখেন - কুঁজ গলগন্ড, নষ্ট শসা, পচা চাল কুমড়ার আড়ম্বরের মধ্যে ভাষার শ্বাসরোধ হয়ে এসেছে ।
'শনিবারের চিঠি'র সম্পাদক সজনীকান্ত দাস, অত্যন্ত কুতসিৎভাবে জীবনানন্দ দাশকে প্রতিনিয়ত আক্রমণ করেছেন ।
এমনকী পঞ্চাশের দশকের বিখ্যাত
'কবিতা 'পত্রিকায় ( আশ্বিন সংখ্যা, ১৩৫৩ বঙ্গাব্দ ) সম্পাদক বুদ্ধদেব বসু তির্যক ভঙ্গীতে লেখেন - জীবনানন্দ দাশ কী লিখছেন আজকাল? আমাদের এই নির্জনতম স্বভাবের কবি, প্রকৃতির কবি তিনি , তাছাড়া কিছুই নন - হয়তো কেন নিশ্চয়ই কিন্তু পাছে কেউ বলে তিনি এস্কেপিষ্ট কুখ্যাত আইভরি টাওয়ারের নির্লজ্জ অধিবাসী, সেই জন্য ইতিহাসের চেতনাকে তাঁর সাম্প্রতিক রচনার বিষয়ীভূত করে তিনি এইটেই প্রমাণ করবার প্রাণান্তকর চেষ্টা করছেন যে তিনি পিছিয়ে পড়েননি । করুণ দৃশ্য এবং শোচনীয় । হুজুগের হুঙ্কারে তিনি আত্মপ্রত্যয় হারিয়েছেন । মনের অচেতনে তাঁর এই কথাই কাজ করেছে যে আমি যদি এখনও মাকড়শার জাল, ঘাস আর শিশিরের কথা লিখি, তবে আর কি তাঁর পাঠক জুটবে? শুধু কবিতার মাঝে মাঝে রোম - বার্লিন দেখলে লোকে একথা অন্তত ভাববে যে লোকটা নিতান্তই মরে যায়নি । আমাদের আধুনিক কবিদের মধ্যে জীবনানন্দ দাশ সবচেয়ে নির্জন, সবচেয়ে স্বতন্ত্র । বাংলা কাব্যের প্রধান ঐতিহ্য থেকে তিনি বিচ্ছিন্ন এবং গেল দশ বছরের যে সব আন্দোলনের ভাঙাগড়া আমাদের কাব্যজগতে চলেছে তাতেও কোনো অংশ তিনি গ্রহণ করেননি ।
প্রগতি শিবিরের কবি সাংবাদিক সমর সেন, পদাতিক কবি সুভাষ মুখোপাধ্যায়ও নিরন্তর আক্রমণ করেছেন জীবনানন্দকে । সুভাষ মুখোপাধ্যায় 'পরিচয় ' পত্রিকার ( শ্রাবণ সংখ্যা ১৩৬০ বঙ্গাব্দে ) আলোচনায় লেখেন - সময়হীনতার শাদা কাপড় দিয়ে সময়ের আপাদমস্তক তিনি ঢেকে দেন l কালের কাছ থেকে হরণ করে নেন গতি । মানুষের প্রতি নিদারুণ বিদ্বেষে, পৃথিবীর প্রতি উদ্ধত অবজ্ঞায় তিনি পলায়ন করেন প্রকৃতির নির্জন বানপ্রস্থে । তাঁর কল্পনার স্বাধীনতা মানুষের হাতের শৃঙ্খলকে চিরস্থায়ী করে ।
'ধানকানা' উপন্যাস খ্যাত সাহিত্যিক ননী ভৌমিক জীবনানন্দের সমালোচনা করে লিখেছেন - জীবন ও সমাজের অস্বীকৃতিরই আর একটি মুখোশ হলেন - জীবনানন্দ । তিনি সমাজ সচেতন কবি হলে হতে পারতেন রবীন্দ্রত্তোর যুগের একজন মহৎ কবি । তার অভাবে তিনি হয়ে গেলেন একজন ব্যর্থ কবি।
সাহিত্যজগতের চারপাশে নিরন্তর বিরূপ সমালোচনায় ক্লান্ত, কবি জীবনানন্দ ১৯৫৩ সালের মে মাসে কবির একান্ত অনুরাগী সুরজিৎ দাশগুপ্তকে লেখেন -
এদেশে বড়ো সমালোচক আজকাল নেই- ই একরকম । আমার কবিতা সম্বন্ধে চারদিকে এত অস্পষ্ট ধারণা যে আমি নিজে এবিষয়ে একটি বড়ো প্রবন্ধ লিখবো ভাবছিলুম ।
প্রতিদিনের পারিবারিক অশান্তি, বেকারত্ব, লেখার বিরূপ সমালোচনা সহ্য করতে না পেরেই সম্ভবত ১৯৫৪ সালের ১৪ অক্টোবর সন্ধ্যার একটু পরে দক্ষিণ কলকাতার দেশপ্ৰিয় পার্কের কাছে বালিগঞ্জমুখী একটি চলন্ত ট্রামের ধাক্কায় ( সম্ভবত তিনি আনমনা ছিলেন কিংবা মরণ ঝাঁপ দিয়েছিলেন ) কবি জীবনানন্দ দাশ গুরুতর আহত হন l ২২ অক্টোবর, শুক্রবার রাত্রি ১১টা ৩৫ মিনিটে তাঁর মৃত্যু হয়।
তাঁর অনুরাগী কবি নরেশ গুহ লিখেছেন - পরদিন সকালে রাসবিহারী এভিনিউ l নীরবে তাঁর দেহ কেওড়াতলা শ্মশানঘাটে নিয়ে গেলাম আমরা । তাঁকে চিনতেন, জানতেন, ভালবাসতেন, শ্রদ্ধা করতেন, তাঁরা এসেছিলেন । ছিল একটি শোকযাত্রীর দল । তরুণ কবিরা ছিলেন । নারায়ণ গঙ্গোপাধ্যায় গিয়েছিলেন শ্মশানে । সুদূর বজবজ থেকে ছুটে এসেছিলেন সুভাষ মুখোপাধ্যায় ।
কবি সঞ্জয় ভট্টাচাৰ্য লিখেছেন - সজনীকান্ত দাশ শেষকৃত্য পর্যন্ত যে আন্তরিক সহযোগিতা দেখিয়েছেন এবং সুধীন্দ্রনাথ দত্তর চোখে মুখে যে বিমূঢ় ভাব দেখেছি শেষ দু'দিন, তা আমার মনে চিরস্মরনীয় হয়ে থাকবে ।
মৃত্যুকে কিভাবে দেখেছিলেন জীবনানন্দ - 'নিশান্ত পাখি ওড়ার l মানুষ খুঁজুক শ্রেয় সুখ, মৃত্যু থাক তার আয়তনের বাইরে।
শেষপর্যন্ত রূপসী বাংলার নির্জনতা বিলাসী প্রচারবিমুখ কবির মৃত্যুর ৬৯ বছর পরেও ( জন্ম ১৮ ফেব্রুয়ারি ১৮৯৯, মৃত্যু -২২ অক্টোবর ১৯৫৪ ), তাঁর অনুরাগী পাঠকদের মনে কিছু প্রশ্ন এবং জিজ্ঞাসা আজও রয়েই গেছে ।
----------------------------
তুষার ভট্টাচাৰ্য l
কাশিমবাজার, বহরমপুর মুর্শিদাবাদ।