গোপন ইচ্ছে
আরতি মিত্র
অনেকক্ষণ থেকে একটা মিষ্টি ডাক শুনতে পাচ্ছিল শ্যামলী। জানালার গরাদে মুখ দিয়ে দেখার চেষ্টা করছিল। কিন্তু শত চেষ্টা করেও কিছুই চোখে পড়লো না তার। তাহলে কি তার শোনার ভুল?
একা মানুষ, সকাল থেকে সংসারের কাজকর্ম সেরে সবে বসেছে সবেমাত্র। যতক্ষণ কাজের মধ্যে থাকে কোন দুশ্চিন্তাই তাকে ছুঁতে পারে না।
ঐ আবার ডাকছে - বোধহয় বৌ কথা কও।
কই কেউ তো তাকে বকছে না।
অথচ এই হাসিখুশী বেশী কথা বলার জন্যই একদিন শ্বশুরবাড়ি থেকে বিতাড়িত করা হয়েছিল তাকে।
বৌ তো কথা বলবেই, সে কি বোবা?
বোবা সেজেই থাকতে বলেছিল সবাই তাকে।
বলেছিল সব সহ্য করে থাকতে হবে, কোন কিছুর কোন প্রতিবাদ করে কথাটি বলতে পারবে না।
সে তা পারেনি বলে, একদিন শাশুড়ি আর তার বর সৌরভ ঘাড় ধরে অপমান করে তাড়িয়ে দিয়ছিল তাকে সে বাড়ি থেকে। সে চলে এসেছিল তার বাপের বাড়ি।
বাবা মা সবাই তখন বেঁচে ছিলেন, সবে দাদার বিয়ে হয়েছে। বিষয়টি কেউই ভালো চোখে দেখেনি। তবু বাবা মা থাকতে দাদা তাকে বাড়ি থেকে তাড়াতে সাহস পায়নি। মুখ বুজে সব মেনে নিতে হয়েছিল দাদাকে।
এক সময় বাবা মা গত হলেন। একদিন দাদা তাকে ডেকে বলল, সে এই সংসারের বোঝাস্বরূপ। তাকে এ বাড়ি ছেড়ে চলে যেতে হবে। শ্যামলী প্রতিবাদ করতে পারত, তাতে
কিছু লাভ হত না। তাতে অশান্তি দিন দিন আরও বাড়ত বই কমত না।
তাই সে একদিন অনির্দিষ্ট পথের সন্ধানে বেরিয়ে পড়েছিল। আজ একার জীবন তার। একটা ঘর ভাড়া নিয়ে গড়ফায় থাকে। একসময় শেলাই শেখার ফলে আজ নিজের ভরণপোষণ নিজেই করতে পারছে। মনের ভালোলাগাটুকু এখনও মরে যায়নি তার।
তাই সময় পেলেই প্রকৃতির সান্নিধ্য লাভে ছুটে যায় গাছগাছালি মাঝে নিজের শিশুমনকে খুঁজতে। মনে পড়ে তার ছেলেবেলার কথা। সমবয়সী বন্ধুদের সঙ্গে খেলার আনন্দ ছুঁয়ে যায় মন। ভালোলাগার পরশের মধ্যে মানস চক্ষে সে দেখতে পায় বাবুয়াদাকে। কয়েক মাসের জন্য তাদের পাশের বাড়ী ভাড়াটে হয়ে এসেছিল। ওদের পরিবারের ছেঁড়া ছেঁড়া কিছু কথামালা ভালোবাসা বুলিয়ে দিয়ে যায় তার ভাঙাচোরা মনে। তারপর কোথায় হারিয়ে গেলো সেসব সোনায় মোড়া দিনগুলি।
ভাবতে ভাবতে আনমনা হয়ে গিয়েছিল শ্যামলী
হঠাৎ কানে এল- ' মলি না?'
এসময় এই নামে কে ডাকলো তাকে!
খুব আশ্চর্য হয়ে চারপাশে তাকাতেই চোখে পড়ল তার বাবুয়াদাকে। যদিও এতদিনে চেহারার অনেক পরিবর্তন হয়েছে তার। তবুও চিনতে অসুবিধে হলো না কোন। শ্যামলী তাকে আপ্যায়ন করে এনে ঘরে বসালো। শ্যামলী বলল, বসুন বাবুয়াদা, আপনার জন্য একটু চা করে আনি।
বাবুয়াদা বলল, না না সেসব কিছুর দরকার নেই।
শ্যামলী হেসে বলল, না না বললে শুনব কেন? এতদিন পরে প্রথম এলেন বাড়িতে, আপনাকে কিছু না খায়িয়ে আমি ছাড়তে পারি?
চা - মিষ্টি খেতে খেতে শ্যামলীর ব্যর্থ জীবনের কথা জানতে পেরে বাবুয়ার মন বিষাদাচ্ছন্ন হয়ে পড়ল।
ভারাক্রান্ত মনে সে শ্যামলীকে জানাল যে গত দু'বছর আগে তার স্ত্রী হৃদরোগে মারা গেছে।
এখন সেও একদম নিঃসঙ্গ।
বাবুয়াদা তারপর শ্যামলীকে বলল, আমরা কি পরস্পরের সুখ-দুঃখকে দুজনে ভাগ করে নিতে পারি না?
কথাটা শুনে শ্যামলীর মনে ভাললাগার শিহরণ বয়ে গেল। কিন্তু মুখে কোন অভিব্যক্তি প্রকাশ করল না সে। সে বাবুয়াদাকে বলল, না না তা হয় না।
এরকম কোন ঘটনা সমাজ-সংসার মেনে নেবে না।
উত্তরে বাবুয়াদা বলল, এতদিন সমাজ কি এসে তোমার পাশে দাঁড়িয়েছে? তোমার লড়াইয়ে তারা সামিল হয়েছে?
তোমাকে তো একাই সব করতে হয়েছে। বাবুয়াদার কথায় ঝাঁজ ছিল।
কিছুক্ষণ চুপ করে থেকে শ্যামলী বলল এক্ষুনি আমি কিছু বলতে পারছি না বাবুয়াদা।
বাবুয়াদা জানতে চাইল, তাহলে আমি কবে আসব বল, তোমার উত্তর জানতে?
শ্যামলী বলল আপনার আসার কোন দরকার নেই, আপনি বরং আপনার ফোন নম্বরটা দিয়ে যান। আমিই যোগাযোগ করে নেবো।
ফোন নম্বর তাকে একটা কাগজে লিখে দিয়ে বাবুয়াদা, যথারীতি সেদিন চলে গেল।
কয়েকদিন পর শ্যামলী ফোন করল,সেই নম্বরে। ফোনটা বেজেই গেলো,কেউ ধরলো না।
এভাবে টানা চারদিন ফোনে সে বাবুয়াদার কোন খবরাখবর না পেয়ে খুবই অস্থির হয়ে উঠল মনে মনে।
একবার তার মনে হল নম্বরটা কি ভুয়ো? বাবুয়াদার ঠিকানাটা কেন রাখল না সেদিন? মানুষটার কি কোন বিপদ আপদ হল?
যতদিন দেখা হয়নি বাবুয়াদার সাথে,ততদিন শ্যামলী নিজের কাজকর্ম নিয়ে বেশ ছিল।
একা ভাল থাকার চেষ্টা করেছে।
যখন তার প্রতি বাবুয়াদার সহমর্মিতা সে অনুভব করলো, তখন তাকে যেন পাগল করে তুলতে লাগল বাবুয়াদার অভাব।
শেলাইয়ের কাজ আর আগের মতো করতে ভাল লাগে না। যেন নাওয়া খাওয়া ভুলে গেছে সে।রাতে দু'চোখের পাতা এক করতে পারে না।
হঠাৎ যেন এক ঝড় এসে তছনছ করে দিয়ে গেছে তার সবকিছু। দ্বন্দ্বমুখর ঢেউয়ে উথাল পাথাল হল মন। এ কী হল আমার ! ভাবল শ্যামলী।
ভালোবাসার আস্বাদ যে কোনদিন পায়নি আজ বুভুক্ষু হৃদয়ে এমন দোলা দিয়ে সে আবার চলে গেল কেন?
শ্যামলী ভাবল,সে যে বড্ড অভাগী । এসব তার জন্য নয়। মনটাকে ফিরিয়ে নেওয়াই বোধহয় শ্রেয়। এলোমেলো ভাবনা তোলপাড় করে দিল মনের ভিতরটা। চোখের জল বাঁধ মানছে না যে। কোথায় ছিল এতো জল?
সব তো শুকিয়ে গিয়েছিল । পাথর মন সবুজায়নের ছোঁয়ায় কি গলে গেল?
কি করবে এখন সে? কোথায় যাবে? বাবুয়াদার ঠিকানা না রাখা বড়ই ভুল হয়ে গেছে তার।
জানলা দিয়ে চড়া রোদ এসে মুখে পড়ায়, শ্যামলীর ঘুমটা ভেঙে গেল। কাল অনেকগুলি সেলায়ের কাজ শেষ করে, শুতে শুতে তার অনেক রাত হয়ে গেছিল। তাই সে এত বেলা পর্যন্ত ঘুমিয়ে ছিল। কিন্তু একী স্বপ্ন দেখল সে!
এমন চোখে তো সে কোন দিন বাবুয়াদাকে দেখেনি। তবে এই স্বপ্ন দেখল কেন সে?
স্বপ্ন বিষারদরা বলেন, স্বপ্নে নাকি অবচেতন মনের অবদমিত গোপন ইচ্ছার প্রকাশ ঘটে। তবে কি তার অবচেতন মনে গোপন ভাবে বাবুয়াদা এমন ভাবে লুকিয়ে ছিল? সে মোটেও টের পায়নি?
===================
Arati Mitra.
267/3 Nayabad,
Garia