কলকাতার গপ্পো
মিঠুন মুখার্জী
সময়টা অস্থির। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ চলছে। বাংলার বুকে চলছে পঞ্চাশের মহামন্বন্তর ও দুর্ভিক্ষ। যারা সকলের মুখে অন্ন তুলে দেয়, সেই কৃষকেরা সেদিন ছিল নিরন্ন। দুবেলা দুমুঠো ভাত পায়নি তারা। না খেয়ে, কখনো সামান্য আহার করে দিনের পর দিন কেটেছে তাদের। তাই দুটো ভাতের আশায় গ্রাম বাংলার অসংখ্য চাষীরা তাদের সন্তান-সন্ততিদের নিয়ে চলে এসেছিল মহানগর কলকাতার বুকে। ঘুরে বেড়িয়েছিল রাস্তায় রাস্তায়। কিন্তু এক মুঠো ভাত পায়নি তারা। চোখের জলে বিদায় দিয়েছিল সন্তানদের।
এই সকল কৃষকদের মধ্যেই ছিল দেবীনগরের কয়েকজন কৃষক, যারা একসঙ্গে চাষাবাদ করতো একসময়। পরান মিস্ত্রি, গোকুল মন্ডল, জীবন অধিকারী ও গোবিন্দ হালদার। তারাও তাদের পরিবার নিয়ে কলকাতার ফুটপাতে আশ্রয় নিয়েছিল। রাস্তায় বাস, ট্রাম,ছোট ছোট গাড়িতে আগুন ধরিয়ে দিয়েছিল অভুক্ত জনতা। ভারতছাড়ো আন্দোলনের প্রভাবে তখন কলকাতা উত্তপ্ত। কালোবাজারিদের রমরমা। পরাণ মিস্ত্রি নগরবাসীর উদ্দেশ্যে বলেছিল--- "ও বাবুরা, তোমরা কি অন্ধ হয়ে গেছো? আমরাও তো মানুষ। আমাদের কথা না ভাবলেও, কচি কচি সন্তানদের দিকে তাকিয়ে দুটো ভাত দাও গো বাবু। তোমাদের তো অনেক আছে।" এই কথা বলতে বলতে পরাণের দু চোখ বেয়ে অশ্রুধারা নেমে এসেছিল। তাদের চোখের জলের মূল্য দেয়নি কলকাতার অমানবিক অসভ্য মানুষের দল। ইংরেজ সরকারও চালিয়ে ছিল অকথ্য অত্যাচার। যদিও ভারতীয়দের ওপর তাদের কোনো দরদ ছিল না।
উদ্বাস্তু কৃষকেরা ফুটপাতটাকেই আশ্রয়স্থল করে নিয়েছিল। খাবার না পেয়ে বাধ্য হয়েছিল ডাস্টবিনে ফেলে দেওয়া খাবার খেতে। মহানগরী কলকাতার কারো দয়া মায়া ছিল না এদের ওপর। দেখে মনে হয়েছিল নিষ্ঠুর নির্দয় মহানগরীর বুকে প্রাণ নেই। মৃত্যুপুরী কলকাতা। কুকুর ও মানুষ ডাস্টবিন থেকে খাবার কাড়াকাড়ি করে খেয়েছিল। ইংরেজ পুলিশ ক্ষুধার্ত মানুষের উপর গুলি চালিয়েছিল। কী নিষ্ঠুর বর্বরতা চলেছিল কলকাতার বুকে--- দু চোখে না দেখলে বিশ্বাস করা যায় না। পথে পথে অভুক্ত মৃত মানুষের অবস্থান। সামান্য ফ্যানটুকু সেদিন পায়নি কৃষকেরা। মৃত্যুর জন্য শুধু প্রহর গুনতে হয়েছে ---পুরনো কলকাতার এমন গল্প বলেছিল কৃষক গোকুল মন্ডলের ছেলে বলরাম মন্ডল। সেদিন সেও এই সকল ঘটনার সাক্ষী ছিল।
কথায় বলে 'চাষীর ছেলে চাষী হয়'। কথাটা পুরোপুরি সত্য নয়। গোকুলের ছেলে কিন্তু চাষী হয়নি। সে হয়েছে একজন সমাজসেবক। হাজার হাজার মানুষ অমানবিক কলকাতার বুকে মারা গেলেও বলরাম মন্ডলকে যমরাজ নিতে পারেননি। সন্তানহারা এক ধনীর চোখে পড়ে গিয়েছিল বলরাম। পরান মিস্ত্রি, গোকুল মন্ডল, জীবন অধিকারী, গোবিন্দ হালদাররা বেঁচে থাকার জন্য অনেক লড়াই দিয়েছিল। কিন্তু ক্ষুধা তৃষ্ণার কাছে হার মানতেই হয়েছিল। ফুটপাতে সেদিন মৃত্যুর ছড়াছড়ি। তারই মধ্য দিয়ে ডাক্তার ভুবনেশ্বর মুখোপাধ্যায় বলরামকে নিয়ে গিয়েছিল বাড়িতে। শিয়ালদার কাছে মৌলালিতে ছিল তার বাড়ি। দুর্ভিক্ষের কিছুদিন আগে হঠাৎ একদিন রাতে হিন্দু-মুসলমানের দাঙ্গা শুরু হয়। চারিদিকে শুধু কাটাকাটি। মানবিকতার গলাটিপে হত্যা করেছিল মানুষ। নিষ্পাপ শিশুদেরও কেটে হত্যা করেছিল তারা। ডাক্তার ভুবনেশ্বরের ছেলে বিধানের তখন বারো বছর বয়স। বাবা-মার কথা না শুনে মারামারি কাটাকাটি দেখতে গিয়েছিল রাস্তার মোড়ে। রাত্রে সে আর ফিরে আসেনি। চোখের জলে বিধানের বাবা-মা সারারাত কাটিয়েছিলেন। সকালবেলা মৌলালির রাস্তায় বিধানের রক্তাক্ত দেহ পাওয়া গিয়েছিল। সেই থেকে বিধানের মা পাথরের মতো হয়ে গিয়েছিলেন। কথা কম বলতেন, কারো সাথে মিশতেন না। বলরামকে আনার পর প্রতিমা দেবী ওর মধ্যে নিজের বিধানকে খুঁজে পেয়েছিলেন। ডাক্তার ভুবনেশ্বর নিজের বিধানের মতো করে বলরামকে মানুষ করেছিলেন। বলরামকে যখন ডাক্তার বাবু নিয়ে এসেছিলেন তখন ওর বয়স ছিল দশ বছর।
এরপর পনেরো বছর দেখতে দেখতে পেড়িয়ে যায়। পরিবর্তন হয়ে যায় অনেক কিছু। ডাক্তার ভুবনেশ্বর মুখোপাধ্যায় ও প্রতিমা দেবীর চুলেও হালকা পাক ধরে। সব রকম সামাজিক বিপত্তির ছায়া সরে যায়। ইংরেজরা ভারতবর্ষ ছেড়ে তাদের দেশে চলে যায়। ভারতবর্ষ স্বাধীনতা অর্জন করে। পনেরো বছর আগের দিনগুলি বলরামের কাছে স্মৃতি হয়ে রয়ে যায়। নিজের বাবা-মার ও গ্রামের মানুষের অনাহারে মৃত্যুর ছবি বারবার চোখের সামনে ভেসে ওঠে তার। তবে সকল দুঃখ ধীরে ধীরে ভুলিয়ে দিয়েছে ডাক্তার ভবনেশ্বর মুখোপাধ্যায়রা। বিএসসি পাশ করেছে সে। চাইলেই একটা চাকরি করতে পারত। কিন্তু মনে মনে সংকল্প করে--- "এই মায়াবীনগর কলকাতা একদিন তার প্রিয়জনদের তাদের সন্তানদের হাত থেকে কেড়ে নিয়েছিল। সেই মায়াবীনগরের বর্তমানে না খেতে পাওয়া মানুষগুলোর পাশে সে দাঁড়াবে এবং দুবেলা অন্নের ব্যবস্থা করবে।" ডাক্তার ভুবনেশ্বর বাবুর অর্থের কমতি ছিল না। ছেলেকে এই সমাজসেবামূলক কাজ করতে দেখে ডাক্তার ভুবনেশ্বর মুখোপাধ্যায় ও প্রতিমা দেবী প্রচন্ড খুশি হন। গরিবের মুখে অন্ন তুলে দেওয়ার পাশাপাশি ডাক্তারবাবু তাদের ফ্রি চিকিৎসা দিতেন ।
বলরাম সমাজসেবার পাশাপাশি ডাক্তার ভুবনেশ্বরের কাছ থেকে ডাক্তারির খুঁটিনাটি শিখেছিলেন। যাতে পালিত পিতার অবর্তমানে সেও গরিব মানুষগুলির সেবায় নিজেকে নিয়োজিত করতে পারে। তার মানুষের প্রতি এই সহানুভূতি দেখে সবাই অবাক হয়ে যেতেন। এত পড়াশুনা করে চাকরি না করার কারণ অনেকেই তার কাছে জানতে চাইত। তাদের কাছে স্বাধীনতা পূর্ববর্তী পুরনো অমানবিক কলকাতার গল্প বলত সে। প্রিয়জনদের দুমুঠো পেট ভরে খেতে না পাওয়ার কষ্ট এখনো মাঝে মাঝে তার মনকে ভারাক্রান্ত করে তোলে। পিতা-মাতার মৃত্যুর কথা ভাবলে এখনো চোখে জল আসে তার। তার মনে পড়ে যায় পিতার মৃত্যুর আগে তাকে বলে যাওয়া সেই কথাগুলি--- " বলো, যদি বেঁচে থাকিস তবে আমাদের মতো দরিদ্র মানুষের জন্য কিছু করিস। এই কলকাতার মানুষের অর্থ আছে, কিন্তু মন নেই। এরা নিজের স্বার্থে চালিত। মানবিকতাকে এখানে হত্যা করা হয়েছে। গরিবরা যে নগর কলকাতার মানুষের থেকে অনেক মানবিক তুই তা প্রমান করবি। তবেই আমাদের আত্মা শান্তি পাবে।"
ভারতবর্ষ স্বাধীন হলেও নগর সভ্যতার মানুষের পরিবর্তন হয়নি। অর্থের অহংকার জাতির অহংকার চামড়ার অহংকার থেকেই গিয়েছিল। তবে কিছু ব্যতিক্রম তো ছিলই। ডাক্তার ভুবনেশ্বরের মতো কিছু মুষ্টিমেয় সহানুভূতিশীল মানুষ তো সকলের ভালো করতে পারেনা। দুর্ভিক্ষের সময় বলরামের মতো হাজার হাজার গ্রামের চাষীর ছেলে-মেয়েরা ফুটপাতে না খেতে পেয়ে মরেছে। কিন্তু সবাই ডাক্তার ভুবনেশ্বর মুখোপাধ্যায়ের মতো মানুষদের চোখে পড়েনি।
বলরাম তার পালিত পিতা-মাতার ঋণ কোনদিন ভুলবে না বলে জানায়। ডাক্তার ভুবনেশ্বরের পত্নী প্রতিমা দেবী বলরামকে পেয়ে বিধানকে একেবার ভুলেই যায়। তাকে বিয়ের কথা বললে, সে তার পালিত মাকে জানায়--- "আমি সংসারের মধ্যে নিজেকে আবদ্ধ রাখবো না। আমার বাকিটা জীবন তোমাদের ও কলকাতার না খেতে পাওয়া, চিকিৎসা না পাওয়া মানুষের সেবায় উৎসর্গ করেছি। মানুষের সেবাতেই আমার আনন্দ। তোমাদের মুখে হাসি দেখলেই আমার হাসি।" এরপর মা বলেন--- "তাই বললে হয়! আমরা না থাকলে তুই একেবারে একা হয়ে যাবি। এ পৃথিবীতে একাকিত্বের জীবন বিষসম। তখন আফসোস করবি।" পালিত বাবাও তাকে জীবন সম্পর্কে অনেক গুরুত্বপূর্ণ যুক্তি দিয়েছিলেন। বাবা-মায়ের কথা মতো বলরাম শেষে বিয়ে করতে রাজি হয়। কিন্তু তাদেরকে সে বলে-- "নগর কলকাতার মেয়ে আমি বিয়ে করব না। আমি বিয়ে করলে গ্রামের কোনো অসহায় মেয়েকে করব। যার মধ্যে থাকবে মানবিকতা-সহানুভূতিবোধ, মানুষের জন্য কিছু করার প্রবণতা।" অনেক খুঁজে খুঁজে শেষে ডাক্তার ভুবনেশ্বর মুখোপাধ্যায় দেবীনগর গ্রামের একটি মেয়েকে পেয়েছিলেন। যে একেবারে বলরামের মনের মতো। তার নাম সম্প্রীতি পোদ্দার।একটা শুভ দিন দেখে তাদের চার হাত এক করে দেন তারা। সম্প্রীতিরাও দুর্ভিক্ষের সময় গ্রাম ছেড়ে মামার দেশে চলে গিয়েছিল। তখন তার চার বছর বয়স। কষ্ট হলেও তার কেউ মারা যায়নি। তাদের পরিবার কৃষক গোকুল মন্ডলকে চিনতো।
কলকাতার বড় বড় জোতদার-মজুতদারদের প্রতি বলরামের আক্রোশ ছিল। যারা মন্বন্তরের দিনে মানুষের সঙ্গে অন্যায় করেছিল, তাদের অন্যায়ের বিরুদ্ধে বলরাম মাঝে মাঝে সোচ্চার হয়ে ওঠে। তাই কলকাতার ধনীদের প্রতি তার মধ্যে বিদ্বেষ, রাগ ও ঘৃণা দেখা যায়। সম্প্রীতি তার সমস্ত কাজে তাকে সহযোগিতা করে যোগ্য সহধর্মিনী হয়ে ওঠে। বলরাম অসহায় দরিদ্র মানুষদের কথা ভেবে পালক পিতার পরামর্শ নিয়ে তৈরি করে "প্রতিমা সেবা কেন্দ্র" নামে একটি প্রতিষ্ঠান। যেখানে একেবারে অসহায় মানুষদের,যাদের দেখার কেউ নেই, খেতে পায় না, অসুস্থ তাদের রাখার ব্যবস্থা করে। প্রতি বছর পঞ্চাশ জনের দায়িত্ব নেয় সে। ফ্রি সার্ভিস তারা এক বছরের জন্য পাবে। তারপর শুধু দুবেলা ফ্রিতে খেতে পারে। ডাক্তার ভুবনেশ্বর মুখোপাধ্যায় তার সারা জীবনের আয় ও সম্পত্তির একটা ভাগ ছেলের এই মহৎ কাজে ব্যয় করেছিলেন। বলরাম আরো মানুষকে সাহায্য করবে বলে মনে করলেও আর্থিক কারণে তা সম্ভব হয়নি। তাই সংস্থাটি পরিচালনার জন্য ডোনেশন চেয়ে বিভিন্ন মাধ্যমে বিজ্ঞাপন দেয়। ধীরে ধীরে অনেক জায়গা থেকে ডোনেশন আসতে শুরু করে। বছর তিনের পর ভারতের এক বড় শিল্পপতি তাকে সহযোগিতা করতে এগিয়ে আসেন। বলরামকে প্রথমে দুই কোটি টাকা দান করেন। সেই টাকা দিয়ে "প্রতিমা সেবা কেন্দ্র" আরো বড় করে তোলে সে। পঞ্চাশের জায়গায় প্রতিবছর তিনশো জনের দায়িত্ব নেয়। সে বাবার বুদ্ধি নিয়ে একটা হাসপাতাল নির্মাণ করে মৌলালিতে। সেখানে অতি অল্প পয়সায় চিকিৎসার ব্যবস্থা করা হয়। সেই শিল্পপতি তার এই মহৎ কাজে আরো অর্থ দান করেছিলেন। হাসপাতালের নাম দেওয়া হয় " গরিব সেবা কেন্দ্র "।
কলকাতার ধনপতিরা সামান্য চাষী র ছেলে বলরামের গল্প শুনে অবাক হয়ে যেতেন। অর্থ থাকলেই হয় না। মানুষের জন্য কিছু করার মন দরকার। ভগবান চাইলে অর্থ যোগানোর লোকের অভাব হয় না। কেউ কেউ তার এই উন্নতি মেনে নিতে পারেননি। যারা গরিব মানুষের রক্ত চুষে খাচ্ছিল তারা বলরামের পিছনে লেগে যায়। কিন্তু 'রাখে হরি মারে কে'। কলকাতায় থেকে গ্রামের চাষীর ছেলে বলরাম মন্ডল কলকাতার অসভ্য, বর্বর, হৃদয়হীন ধনী ব্যক্তিদের এভাবেই শিক্ষা দিয়েছিল। অর্থের অহংকার ও ব্যক্তি স্বার্থ কখনো মহান হতে দেয় না। মানুষ হয়ে মানুষের বিপদে পাশে না দাঁড়ালে, কিসের মানুষ!! পশুরাও এর থেকে ভালো হয়। সমাজসেবক হয়ে এভাবেই পালিত বাবা-মা ও পত্নী সম্প্রীতিকে নিয়ে ভবিষ্যতের পথে পা বাড়ায় বলরাম।
========================
মিঠুন মুখার্জী
C/O-- গোবিন্দ মুখার্জী
গ্ৰাম : নবজীবন পল্লী
পোস্ট+থানা -- গোবরডাঙা
জেলা -- উত্তর ২৪ পরগণা
পিন-- 743252