ক্যাবলা আমি
প্রদীপ দে
ডায়েরি - দিনাঙ্কঃ ০১-০১-১৯৭৩
--------------------------------------------
প্রাচী সিনেমা হলের সামনে দাঁড়িয়ে আছি হাওড়া যাবো ৮ বি বাস ধরবো বলে। মিনিট দশেক পরে দৃশ্যমান হলো মৌলালি থেকে এগিয়ে আসা লাল রঙের দোতলা বাসটি। সামনে আসতেই আগে গিয়ে হুড়মুড়িয়ে আগে উঠে পড়লাম সিড়ি ধরে উপরে যদি দোতলায় একটা সিট পাওয়া যায়। ওমা! একি সব যে ভর্তি। চোখ ঘুরে গেল -- না ওইতো একটা ধারের সিট খালি -- ওঃ জানালার ধারে যে একটি মহিলা বসে আছে! - পাশে বসা যাবে ইতস্ততঃ করছি - মহিলার পাশে বসা মানে বুকের দাপট থাকা চাই - যদি কিছু বলে? তবুও দোতলা বাসের উপরে বসার মজাই আলাদা। লজ্জা সরিয়ে বসে পড়লাম। আহা কি ভালোই লাগছে যেন। বাসটা একটু বাঁদিকে হেলে চলছে। ভয় লাগে যদি উল্টে যায়! কিন্তু শুনেছি এই বাসের এমন সিস্টেম আছে যে এটা উল্টাবে না। মেয়েটির উড়ে যাওয়া চুলের ফাঁক দিয়ে বাইরের নীচেটা দেখতে চেষ্টা চালালাম। কষ্টকর ! কী কপাল আমার? জানালার ধার কেন পেলাম না। মেয়েটিকে হিংসা হচ্ছে। এরকমই হয় যা চাই তা আর পাই না! কেন কে জানে? চাওয়ার কি কোন ভুল থাকে?
মেয়েটার দিক থেকে এক সুন্দর সুভাস ভেসে আসছিল। বিনুনিটা খুবই ভালো। মোটা চুলের গোছা। মুখ দেখা যাচ্ছে না। একনাগাড়ে বাইরে তাকিয়ে আছে। বাস ততক্ষণে মহাত্ম গান্ধী রোড ধরে হাওড়া মুখি।
জাম রঙের শাড়িতে হালকা শরীর। মন কেমন যেন আনচান করে উঠলো। আমি ভীষন ভীতু। ভাবছি কি করে আলাপ জমানো যায়। ভাবছি আর ভাবছি। ভাবতে ভাবতে দেখি মেয়েটি উঠে পড়েছে, স্ট্রান্ড রোড ক্রসিঙে নামার জন্য, আর আমাকে এড়িয়ে এমনভাবে সিটের বাইরে আসতে চাইছে যেন আমি কোন টিবি রুগী। আমিও সিঁটিয়ে সরে গেলাম। আর মেয়েটি তার আঁচলটা আমার মাথার চুলগুলোকে এলোমেলো করে এঁকেবেঁকে সিঁড়ির দিকে চলে গেল। তবে মেয়েটার মুখ আমি দেখে নিলাম -খুব সুন্দর লাগলো - আসলে আমার মনে যে তখন। গোধুলীর রং মাখানো আকাশ।
দিনাঙ্কঃ ০৩:০৩:১৯৭৩
-------------------------------
মনে একটা ক্ষত ছিল। এই সময়ে সহজে কাউকে ভালোলাগা জানানো যায় না। পুরুষেরা পারলেও মহিলারা নৈব নৈব চ ……
প্রিয় বন্ধু অরিত্রের সঙ্গে ওর আর এক আত্মীয়র বাড়ি গেছি আহিরীটোলা। ওদের ওখানে কোন পুজো ছিল। ইতস্ততঃ করেও দ্বিধা ছেড়ে দিয়েছিলাম যখন বুঝলাম এটা পুজোর ব্যাপার খাওয়াদাওয়ার কোন ব্যাপার নেই। ওখানেই আচমকা দেখে ফেললাম আমার হারিয়ে যাওয়া রূপসীকে। অরিত্রের কাকার মেয়ে,ওর নাম শ্রাবণী।
শ্রাবণী আমায় দেখলো কোন অনুভূতি প্রকাশ করলো না। আমি বোঝার চেষ্টা করা বিফল হল। আমি বোকা তাই এরকম ভাবি। এ ভাবার কোন অর্থ হয় না। কথায় তো মেয়েদের বুক ফাটে তো মুখ ফোটে না।
আমি আর অপেক্ষা না করে বাইরে বেড়িয়ে ফেরার পথ ধরলাম কাউকে কিছু না জানিয়ে। অরিত্রকেও জানালাম না। শ্রাবণীর প্রতি একটা ভালোলাগা মাথা থেকে ঝেড়ে ফেলে দিলাম। মনে মনে হেসে ফেললাম নিজের পাগলাপনা মনের কথা ভেবে।
বাসস্ট্যান্ডে এসে দাঁড়িয়ে থাকা বাসে গিয়ে উঠে পড়লাম। বাসে একটাই সিট খালি ছিল তাও জানালার ধারটার। অবাক হলাম এই ভেবে কেউ জানালার সিট ছেড়ে দুজনার সিটের সামনে বসে? সে আবার কে? একজন মহিলা ঘোমটা পরিবৃতা হয়ে। তা মরুক গে, আমি ওনাকে কাটিয়ে জানালার ধারে বসে পড়লাম খুব আলগা ভাবে যাতে উনি আবার কিছু না ভাবেন। মহিলাদের হতে খুব সাবধান হওয়াটাই শ্রেয়।
আমি জানালার বাইরে তাকিয়ে, বাস সিটি মেরে গড়িয়ে গড়িয়ে স্ট্যান্ড ছাড়ছে, কিরকম যেন অনুভূতি হলো নারী স্পর্শ পেলাম, ওমা দেখি পাশের মহিলা আমার গায়ের উপর এসে পড়তে চাইছে যেন! অস্বস্তিকর অবস্থায় আমি। মহিলাট আরো চমকে দিল আমায়, সে তার মাথার ঘোমটা খুলে ফেলে আমার কাঁধে মাথা দিয়ে চোখ বুঝে নিল, মুখ থেকে নিঃসৃত হল শব্দের মেলা,
-- ক্যাবলা? জড়িয়ে ধরো আমায় ……
আমি ভালো করে চেয়ে দিকে ও যে শ্রাবণী!
বাস তখন ছুটছে ……
---------
প্রদীপ কুমার দে
বিরাটী আবাসন
এল আই জি -৯
এম বি রোড
নিমতা
কলকাতা -৭০০০৪৯