স্মৃতিকথা ।। তুমি শুধুই স্বপ্নকন্যা… ।। পিন্টু কর্মকার
ছবিঋণ- ইন্টারনেট।
তুমি শুধুই স্বপ্নকন্যা…
পিন্টু কর্মকার
গতরাত্রেই ছেলে হয়েছে আমার। সারারাত উৎকণ্ঠায় পার করেছি সময়ের সাঁকো! থেমে থাকা জীবন কখনও এত দ্রুত রেলগাড়ির মতো চলতে থাকে ভাবতেই পারি না!দু -বছর আগে পর্যন্ত বিয়ের কথা ভাবতেই পারতাম না, অথচ বিয়ের এক বছরের মধ্যেই আমি এক ছেলের বাবা!
সকালে সূর্যের আলো পৃথিবীতে পৌঁছাতে না পৌঁছাতেই ,হাসপাতালে পৌঁছে গেছে অনেক আত্মীয়-স্বজন, যারা তাদের অসুস্থ আত্মীয়দের একটু সুস্থ দেখার আশায় এসেছে। কেউবা সঙ্গে নিয়ে যাবে একমুখ হাসি-খুশি, আবার কেউ কষ্ট, শব্দেল আর্তনাদ ও নিঃশব্দ কান্না।
আমি আমার শ্বশুরের কাছ থেকে হলুদ কার্ড নিয়ে হাসপাতালের উপরে দুতলায় বউয়ের দরজার কাছে গেলাম। দূর থেকে দেখলাম—অপ্রুস্ফুটিত চোখ মিটমিট করছে আমার ছেলে… বউ পাশে এসে বললো যে ছেলের শ্বাসের একটু সমস্যা আছে, তবে ডাক্তার বলেছেন যে ঠিক হয়ে যাবে। আমিও ঈশ্বরের কাছে সবটুকু দিয়ে প্রার্থনা করলাম যেন ঠিক হয়ে যায়! ১০ মিনিট বাদেই উপর থেকে তাড়া দিতে লাগলো " যান! যান! যান, আর কতক্ষণ!" আমি বউকে "আসি" বলে সিঁড়ি থেকে নামছি, এমন সময় দেখতে পেলাম মুমালীকে !সেই হাত দুলিয়ে হাটা! কোন দিকে না তাকানো! আমি ওর দিকে তাকাতে তাকাতেই ভিড় ঠেলে হাসপাতালে বাহির-পথ দিয়ে বেরিয়ে এলাম। দেখি চা হাতে শ্বশুর…কিন্তু আমার মনে পড়ে গেল কয়েক বছর আগে নতুনবাজার স্কুলের একাদশ দ্বাদশ শ্রেণীতে কাটানো দুই বছরের সেই না ভোলা দিনগুলোর কথা!
আমি ক্লাসের প্রথম বেঞ্চে বসতাম। মুমালী বেশিরভাগ দিনই দেরি করে আসতো। ওর পথ চেয়ে দরজার দিকে চোখ ও গলা ৪৫ ডিগ্রী কোণে ঘুরিয়ে রাখতাম!
মাধ্যমিক পাস করার পর একাদশে ভর্তি হয়েছিলাম নতুনবাজার স্কুলে । ছেলে মেয়ে উভয় ছিলাম আমরা…
ক্লাসে ভর্তি হওয়ার ঠিক ৭-৮ দিন পর মুমালী হঠাৎ আমায় ডেকে জিজ্ঞেস করে," তোর নাম কিরে ? তোর বাড়ি কোথায় ?"আমি লাজুক হয়ে বললাম ,"হীরথ ,বাড়ি নিদাসপুর ।"সাহসের ডানায় ভর করে আমিও জিজ্ঞাসা করলাম ,"তোর নাম কি ?"ও বলল ,"মুমালী" । পপ সিঙ্গারের মত গলায় নামটা শোনার পর মনের ভেতর যে ভালো লাগার ঢেউ খেলে যায়, তা বোঝানোর মতো কোনো শব্দই ছিলো না আমার কাছে…। মুমালী ছিল ক্লাসের সবচেয়ে সুন্দরীদের মধ্যে একজন অত্যন্ত আমার চোখে । মুমালীর সঙ্গে প্রথম কথা হওয়ার পর অনেকবার কথা হয়েছে । অস্বীকার করার কিছু নেই , মুমালীকে আমি মন থেকে ভালবাসতাম, ও আমায় ভালবাসত কিনা জানতে পারিনি ,তবে আমি যেমন ওর সঙ্গে কথা বলার জন্য ইচ্ছার নদীতে ভাসতাম ।ওকেও দেখেছি আমার সঙ্গে কথা বলার জন্য ও একটা বাড়তি তাগিদ অনুভব করতো ,তবে সেটা শুধু বন্ধু হিসেবে না অন্য কিছু বুঝতে পারিনি! কখনো পড়ার প্রশ্ন বুঝতে না পারলে ,সবার আগে ও আমাকে জিজ্ঞেস করত ।ক্লাসে আমি প্রথম না হলেও আমার প্রতি ওর ভরসার জায়গা অনেকটাই ছিল ।একবার আমাকে রাখি পড়াতে চেয়েছিল, কিন্তু আমি মানিকপুর ডাক্তার দেখাতে যাওয়ার জন্য সেদিন স্কুলে যেতে পারিনি! হাত দেখতে পারি বলেছিলাম বলে ও একদিন ওর সুন্দর পান পাতার মতো হাত আমার দিকে প্রসারিত করেছিল ,কিন্তু আমি ওর হাত স্পর্শ করতে চেয়েও পারিনি!
স্কুলে জীবনের প্রথম গানের মঞ্চে আমি গান গাইতে গাইতে দেখেছিলাম, ও ছবির মত আমার দিকে তাকিয়ে আছে …। প্রথম যেদিন ইউরোপিয়ানদের মতো ইংরেজি বলেছিলাম ক্লাসে ,সেদিন যার হাত ও চোখ সবচেয়ে বেশি সমর্থন জানিয়েছিল আমায়, সে ছিল মুমালী!
কত টুকরো স্মৃতি আছে নতুনবাজার স্কুল ঘিরে, তা হয়তো সবটা মনে নেই, তবে আমার কাছে নতুনবাজার স্কুলের স্মৃতি বলতে নিরেট মুমালী। মুমালীই ছিলো যেনো আমার নতুনবাজার স্কুল!!!
সময়ের একমুখী মহাজাগতিক স্রোতে মুমালী ও আমি ছিটকে যাই উচ্চমাধ্যমিকের পর ।পরেও দুই একবার দেখা হয়েছে ওর সঙ্গে ,কিন্তু স্কুলের সেই উত্তেজনার পারদস্তম্ভ একেবারে তলানিতে !শুনেছিলাম ও বাজুর সঙ্গে প্রেম করত !তারপর নাকি কৃতিরাম!
এখনো ও শ্যামপুর সদর হাসপাতালে সিনিয়র নার্স, সঙ্গে এক মেয়ের মা , কৃতীরাম ওর স্বামী। নার্সিং নিয়ে পড়ার কথা আমিই উচ্চমাধ্যমিকের পর বলেছিলাম ওকে। ও সফল হয়েছে তাতে আমি খুশি। জীবনে চাইলে সব পাওয়া যায় না! অনেক না পাওয়ার মধ্যে কিছু পাওয়া থাকে!
শ্বশুর বলে উঠলেন ,"হীরথ তুমি চা খাবে না!মুখ ধুয়ে নাও। " আমি বাস্তবের আলোকে ফিরে এলাম, কিন্তু ওর সঙ্গে যোগাযোগের ইচ্ছাটা দমিয়ে দিলাম!
শুধু মনে মনে ভাবলাম," তুই ভালো থাকিস…"
====================
পিন্টু কর্মকা।
দক্ষিণ দিনাজপুর।
পশ্চিমবঙ্গ , ভারত।