Click the image to explore all Offers

স্মৃতিকথা ।। আশ্রয় ।। অনন্যা ঘোষাল মুখার্জি

           
                ছবিঋণ- ইন্টারনেট। 
 
 
 আশ্রয় 
অনন্যা ঘোষাল মুখার্জি
 
     উত্তম নারকেল তেলের গন্ধটা আজও পাই। ইচ্ছে করে নাকটা ডুবিয়ে দি সেই  গন্ধমাখা সাদা, নরম শাড়ির ভাঁজে, বার্ধক্যের অচল শরীরকে আষ্টেপৃষ্টে জড়িয়ে রাখি দুই হাতের আলিঙ্গনে। 
   নিজের ঘরের মধ্যে, হাতে ভর করে বসে বসে এগিয়ে চলা, মরণের ওপারে; আমার ঠাকুমা। এখনো আমার অস্তিত্ব, সেই স্মৃতিকে প্রদক্ষিণ করে। ঘরটা ছিল একান্নবর্তী পরিবারের প্রাণকেন্দ্র। নাতি নাতনিদের গল্প দাদুর আসর থেকে আরম্ভ করে মা, কাকিমাদের পাড়ার সব খবরাখবরের "আজকে সুমন"।
    পিসিরা, বাবা ও কাকা,সবাই অফিস থেকে ফিরে সটান ঠাকুমা। মেঝেতে চিৎপাত। ঠাকুমার ঝুলি থেকে বেরোতো গুড়ের বাতাসা, নাড়ু। আমরাও ভাগ পেতাম। ভাগিদার হতাম পূর্ণিমার মার রান্না করা প্রত্যেক একাদশীতে সাবুর খিচুড়ি। ঠাকুমা  র খাওয়ার পরিমাণ ছিল যৎকিঞ্চিত, তাতেও ভাগ বসাতে গিয়ে বকুনি জুটত মার কাছে। কিন্তু পঞ্চাশের দোরগোড়ায় দাঁড়িয়ে বুঝি, সেই সাবুর খিচুড়ি বিরিয়ানি মনে হত, ঠাকুমার ছোঁয়ায়। আর ছিল স্বর্ণসিন্দুর-খল-নুড়িতে দুধের সর দিয়ে তৈরি। আহাঃ, ....ঠাকুমার পর কেউ আর এমন করে তৈরি করে জিভে ঠেকিয়ে দেয়নি-এই গোলাপি রঙের মিষ্টি দ্রব্য। শেষ বয়সের চোখে দেখতে না পাওয়া মানুষটার হাতের কাজের নমুনা আজও ছোটবেলার  বাড়িতে। কাপড়ে সুতোর কারুকার্য, রংবেরঙের উল দিয়ে নানা জাতকের কাহিনী ফুটিয়ে তোলা, মাছের আঁশ দিয়ে মাছ আঁকা, - এমন আরও কত কী। আসলে ঠাকুমা বলত,  যতক্ষণ শরীর আছে, কর্মে থাকতে হয়; মন টা দিয়ে ভালবাসতে হয়। বন্দুক তোলা হাত কখন ও সাদা হাতির উপদ্রব থেকে সন্তান কে যেমন আগলে রেখেছে, সেই সোনা বাঁধানো হাতেই ঝংকৃত হয়েছে সরোদের মূর্ছনা। তার সুর ও লয় বেঁধে দিয়েছে সকলকে বংশ পরম্পরায়। হাঁপানির রোগী যখন মীরার ভজন গুনগুন করত, বাড়ির আট থেকে শুরু করে সকলে সেই আশি কে ঘিরে বসে থাকত। জীর্ণ হাত দুটো কবে নিরাভরণ হয়ে গেছে, চার ছেলে মেয়ে র জীবন অলংকৃত করতে। তবুও ক্লান্তি নেই সেই হাতে। ময়দা দিয়ে চসি বানাত সারাক্ষণ। মা কাকিমার কাজ ছিল রোজ সকালে বাড়িতে আসা দুধের প্যাকেট ধুয়ে শুকিয়ে দেওয়া। ঠাকুমা সেই প্যাকেটে পরিমাণ মতো চসি ভরে মুখ বন্ধ করে রেখে দিত।পরিচিত মানুষ আসলে বলে দিত কতটা দুধের সাথে চসি দিয়ে পায়েস তৈরি হবে।
    মনে পড়ে জামাইষষ্ঠীর কথা। সারি দিয়ে ঠাকুমার তৈরি আসনে বসতাম সব নাতি আর নাতনিরা। এখনকার ছোটরা মাটিতে বসে খাওয়ার মজাই জানল না। কাঠের পিড়ে থাকত; ছোট থেকে বড় সাজানো, বয়সানুক্রমে বসার জন্য। সেই পিড়ের ওপর ঠাকুমার হাতের নক্সাকাটা আসন পেতে হত ষষ্ঠীর উৎসব। একটা হাতপাখায় থাকত আম- কলা-ফুল মিষ্টি। সাদা জামা বানিয়ে তার ওপর সুতোর রঙিন প্রজাপতি, ফুলের বাহার তুলে দিত বড় পিসি।সকলে একসাথে হলে, অবশ্যই হত গানবাজনার আসর। কাকামণি তার তবলায় যেই " তেরেকেটে ধিন্ ধিন্ ধা" বলে সমে   ফিরত, স্কেল চেঞ্জার টেনে বসে পড়ত ছোটপিসি, আমাদের আদরের 'কুটু'। শেখাত কিভাবে তানপুরা ধরতে হয়।বাবাই দিদি ও  কুমকুমও সুর মেলাত।জুটে যেত শুক্লা পিসি, বীরেন কাকুরা। "বৌদি, চা ....."বলে হাঁক পেরে চলে যেত সোজা ছাদে। অন্ধকার আকাশের নিচে বসত মজলিস। ছাদের টবের বেলফুলের গন্ধের সাথে মিশে যেত "পিয়া ভোল অভিমান, মধুরাতি বয়ে যায়...."।বড়পিসি হাতে চায়ের কাপ নিয়ে বসে পড়ত; একের পর এক চলত গান-আখতারীবাঈ থেকে সন্ধ্যা মুখার্জি।
    আমাদের কিছু গানবাজনার  অনুষ্ঠান ছিল বাঁধা। রবীন্দ্রজয়ন্তী, নজরুল জয়ন্তী। কুটুর গানের স্কুলের ছাত্র ছাত্রী মিলে পালিত হত বার্ষিক অনুষ্ঠান। একবার মহাসমারোহে অনুষ্ঠিত হয়েছিল কলকাতার রবীন্দ্রসদনে। নৈহাটি থেকে ট্রেনে চেপে একসাথে যাওয়া; জীবনের প্রথম রবীন্দ্রসদনের চৌকাঠ পেরোনো ...আজও উজ্জ্বল।
     মনে পড়ে বিখ্যাত সঙ্গীত শিল্পী, কানাইলাল বৈরাগী যখন দেহ রাখলেন, ওনার স্মরণে নৈহাটি টাউন হলের অনুষ্ঠানে গাইতে এসেছিলেন আজকের প্রথিতযশা শিল্পী, গুরুজী অজয় চক্রবর্তী মহাশয়। ছিলেন ওনার স্ত্রী, শ্রীমতি চন্দনা চক্রবর্তী ও।খুব সুন্দর ছিল সেই উপস্থাপনা, যা সেই শিশু মনেও দাগ কেটেছিল।বুঝতে শিখেছিলাম, সঙ্গীতের কোন জাত হয় না। রাগসঙ্গীত থেকে গণসঙ্গীত; গজল, ঠুমরি থেকে শ্যামাসঙ্গীত - সকলি জাতি-ধর্ম নির্বিশেষে ঈশ্বরের উপাসনা।
    ছোটবেলায় আনন্দ-অনুষ্ঠানের ঘাটতি ঘটেনি কখনো। জন্মদিন তো ছিলই। স্কুলের বন্ধু, অসমবয়সী পাড়ার বন্ধু সকলে মিলে খাওয়া দাওয়া, খেলাধুলা ও নির্ভেজাল আড্ডা। সকলের জন্মদিন মিটে গেলেও, উদযাপনের তালিকায় থাকত, পুতুলের বিয়ে। আজো চোখ ভিজে ওঠে ভাবলে, যে ছেলে পুতুলের খোঁজে কুটুর সাথে   শহরময় ভ্রমণ। অফিসফেরত ভিড় ট্রেনে দাঁড়িয়ে থাকার ক্লান্তি র পরিবর্তে দেখেছিলাম পরবর্তী প্রজন্মকে আশ্রয় দেওয়ার আনন্দ। পুতুল খোঁজা দিয়ে উৎসব শুরু। বানান হত মাটির উনুন। মেনু তৈরি সব ছোটদের অভিলাষ অনুযায়ী। নিমন্ত্রিতদের তালিকার খসড়া তৈরি থাকত। তাদের বাড়ি গিয়ে নিমন্ত্রণ করে আসতাম দুই বোন, কুটুরসাথে। রবিবার হত বিয়ের উৎসব। বারান্দায় বসত বরকনে।বেলুন দিয়ে হত সাজানো। ঠাকুমাকে জোর করে বাক্স থেকে বের করে নতুন শাড়ি পড়ান হত। বড়, বাবা, পিসেমসাই, কাকমণি, সকলেই থাকত খোসমেজাজে। মা কাকিমা কুটু মিলে রান্নার জোগাড়ে লেগে যেত। অতিথি আপ্যায়নে কুমকুম আর আমি, দিদি তদারকিতে। কুমকুমের ছেলের সাথে আমার মেয়ের বিয়ে। চলে আসত গরম গরম ফুলকো লুচি, আলুর দম, বেগুন ভাজা, পায়েস। সে এলাহি আয়োজন। কিছুদিন চলত উপহার পাওয়া রান্নাবাটিতে বরবউ এর যত্ন-আত্তি, তারপর স্কুলের পড়ার ঠেলায় কোথায় চলে যেত তারা, হিসেব থাকত না।
      রাতের ঘুম আসত ঠাকুমার ঘাঘাসুরের গল্পে। অন্য পাশে কুটুর তানপুরায় বাগেশ্রীর আলাপ...আজও আমার চলার ছন্দ।আমাদের শৈশব ছিল ধুলোবালি মেখে মাটির সাথে মেশা,সম্পর্কের পোক্ত আবর্তের বন্ধনে। আজ ছোটরা চেনেনা এই সম্পর্কগুলো কে। এই দুধের স্বাদ ঘোলে মেটায় মোবাইল দিয়ে।তারা জানে হাতের মুঠোয় অন করলেই লাইভ চ্যাট, প্রতিনিয়ত পরিবর্তিত হওয়া সম্পর্কের সাথে। অপরিণত মনগুলো হারিয়ে যায় কৃত্রিম আশ্রয়ের মরীচিকায়। পারিবারিক বন্ধনের জায়গায় তৈরি হয় অগম্য দূরত্ব। 
কাঠগড়ায় আমরা, আজকের বাবা মা রা। সন্তানের মঙ্গল চেয়েও কিভাবে যেন পরোক্ষ ক্ষতি করে ফেলছি। আমরা তাদের হাতে গিটার তুলে দিচ্ছি,অথচ মূর্ছনা ছড়ানোর জন্য যে আকুতি লাগে, সেই প্রাণের স্পন্দন জাগাতে পারছি কই!! ছোটদের সেই বটবৃক্ষের আশ্রয় কোথায়, যেখানে তারা নির্দ্বিধায়, পরম নিরাপদে মাথাটা রাখবে!
       তানপুরার ছেঁড়া-তার, কীভাবে বাঁধতে হয়, তাই শেখাতে গিয়ে, মুহূর্তের জন্য অলি বৃষ্টির মধ্যে ছুঁয়ে গেলাম আমার ছোটবেলাকে। হয়ত তারাও কোনদিন এভাবেই  ছুঁয়ে থেকে, বাঁচিয়ে রাখবে সম্পর্কগুলো কে। আশ্রয় পাবে অস্তিত্ব। বেঁচে যাবে প্রজন্মের পর প্রজন্ম,....সম্পর্কের আশ্রয়ে।
--------------------------------

অনন্যা ঘোষাল মুখার্জি
আসানসোল। 

Post a Comment

0 Comments
* Please Don't Spam Here. All the Comments are Reviewed by Admin.