স্মৃতিকথা।। এলোমেলো মেলামোচ্ছবের দিন ।। চন্দন মিত্র
ছবিঋণ- ইন্টারনেট।
এলোমেলো মেলামোচ্ছবের দিন
চন্দন মিত্র
একটা টিনের ঢোল কেনার জন্য বায়না ধরেছিল, পেয়েওছিল অনায়াসে। সেই ঢোলখানা গলায় ঝুলিয়ে নেচেনেচে মেলায় ঘুরে বেড়িয়েছে প্রাইমারি স্কুলের দ্বিতীয় বা তৃতীয় শ্রেণির ছেলেটি। সেই ছেলেটিই বহুবছর পরে আজ এই লেখাটি লিখতে বসেছে। তবে সেই প্রথমবারের নন্দারমেলায় কী কী দেখেছিলাম এখন আর স্পষ্টভাবে মনে পড়ে না। এখন ভাবতে বসলে বড়োপুকুর, নানান দোকান, মন্দির, বেদি, রেললাইন, পোড়াকয়লার উঁচু ঢিবি, লোকের ভিড়, প্ল্যাস্টিকের রাধাকৃষ্ণ হাতে নাদুসনুদুস মিষ্টি— সব মিলেমিশে বর্ণাঢ্য কোলাজের মতো এক ছায়াছবি মাথার মধ্যে পাক খেয়ে যায়। মনে আছে আমাদের দলে ছিল জ্যাঠা-জেঠি, গৌরের মা, মিষ্টির মা ও মিষ্টি। বড়োদের মধ্যে জেঠিমা ছাড়া আর কেউ নেই এখন। দিনগুলো ফেলে অনেকটা এগিয়ে এলেও মাথার ভিতর থেকে প্রথম দেখা বড়োসড়ো মেলাটির স্মৃতিমেদুর কোলাজ এমনভাবে উঁকিঝুঁকি দিত যেন একবার চাক্ষুষ না-করলে নিস্তার নেই।
পড়াশোনার পাঠ চুকিয়ে অনেক ঘাটের জল খেয়ে শেষমেশ টিউশনিতে এসে থিতু হলাম। একদিন আমাদের লক্ষ্মী টি স্টলের আড্ডায় এক ভদ্রলোকের সঙ্গে আলাপ হল তাঁর বাড়ি রায়দিঘি। আমি তাঁর কাছে নন্দার মেলা সম্পর্কে জানতে চাইলাম। তিনি উৎসাহের সঙ্গে সেই মেলার খুঁটিনাটি বলে যেতে লাগলেন। হিসাব করে বললেন মেলার তিথি আসতে তখনও মাস তিনেক বাকি আছে। আমিও নোট নিলাম— চৈত্র মাসের শুক্ল প্রতিপদ তিথিতে মেলাটি অনুষ্ঠিত হয় আদিগঙ্গার অবরুদ্ধধারা নন্দানামক এক পুষ্করিণীকে কেন্দ্র করে। পরে যখন নির্ধারিত দিনটি এসে পড়ল, খেয়াল করে দেখলাম সেই ভদ্রলোকের কাছ থেকে আমি মেলায় পৌঁছানোর কোনো তথ্যই নিইনি। পথে বেরোলে পথই গন্তব্যে পৌঁছে দেয়, এই ভরসায় স্নান-খাওয়া সেরে বেলা বারোটার দিকে বেরিয়ে পড়লাম।
একটা অনুমান তো ছিলই। তার ওপর ভরসা করে রায়দিঘিগামী একটা মিনিবাসে বসে পড়লাম। কিছুক্ষণ পরে কনডাক্টর ভাড়া চাইলেন। আমি থতমত খেয়ে গেলাম। আমি তাঁর হাতে একটা নোট ধরিয়ে দিলাম। তিনি জিজ্ঞাসা করলেন, কোথায় নামবে? আমি পড়লাম মহাসংকটে। কোন জায়গার নাম করব! তিনি ততক্ষণে আঙুলের ফাঁকে নোটটি গুঁজে আমার পাশের যাত্রীর টিকিট কাটায় মন দিয়েছেন। টিকিট কাটা শেষ করে আবার আমাকে বললেন, কই বললে না তো কোথায় নামবে? বললাম, ওই নন্দার মেলায়। তিনি টিকিট ও বাকি টাকা আমাকে ফিরিয়ে দিলেন। আমি আশ্বস্ত হলাম। যাক ঠিক বাসেই চেপে বসেছি।
তখনকার দিনে বাসে-ট্রেনে অনায়াসে ধূমপান করা যেত। সেসময় আমার ওই বদভ্যাসটা ছিল। নতুন রাস্তায় যাচ্ছি পথের শোভা দেখতে দেখতে যাব সঙ্গে থাকবে একটু সুখটান। জানলা দিয়ে বিষবাষ্প বাইরে পাচার করা যাবে; কারোর অসুবিধাও হবে না— এই ভাবনা থেকেই বাসের একেবারে পিছনে জানলার ধারের সিটটাই নিয়েছিলাম। কিন্তু ঠোঁটে তাম্রকূট গুঁজে যতবারই দেশলাইকাঠি জ্বালি, ততবারই তা নিভে যায়। আমি খেয়াল করিনি, কিন্তু আমার দিকে খেয়াল রেখেছিলেন জনৈক ভদ্রলোক। আমার সামনের সিটের জানলার ধারে বসেছিলেন তিনি। তিনি হাত বাড়িয়ে একটি গ্যাসলাইটার এগিয়ে দিলেন। আমি খুশি মনে তাম্রকূটে অগ্নিসংযোগ করে তাঁকে লাইটারটি ফেরত দিয়ে ধন্যবাদ জ্ঞাপন করি। তাঁর সঙ্গে আলাপ জমে ওঠে। আমি তাঁকে জিজ্ঞাসা করি দাদা আপনি কোথায় নামবেন? তিনি বলেন, রায়দিঘি। মাথায় একটা বুদ্ধি খেলে যায়। আচ্ছা, ওই ভদ্রলোকের কাছে জেনে নিলে হয় না, নন্দারমেলা আর কতদূর! আমার জিজ্ঞাসার উত্তরে তিনি বলেন, 'আমাকে তো নন্দারমেলার উপর দিয়েই যেতে হবে, তা তোমাকে বলে দেব।' এরপর তাঁর সঙ্গে আমার নানান কথাবার্তা শুরু হয়। তিনি আমার কাছে নন্দারমেলায় যাওয়ার কারণ জানতে চান। আমি অকপটে তাঁকে সবকথাই জানাই। তিনি জানান, তিনি ডায়মন্ড হারবারে এসেছিলেন ছেলেকে ডাক্তার দেখানোর জন্য। তাঁর স্ত্রী ছেলেকে নিয়ে সামনের দিকের একটি সিটে বসেছেন। তিনি আঙুল দিয়ে দেখিয়েও দেন স্ত্রী-পুত্রকে। কথায়-কথায় বিষ্ণুপুর স্টপেজ এসে যায়, বাস থামে। ওই তো রেললাইন তার উপর দিয়ে আমাদের বাস চলে যাবে সোজা। বামদিকে মহাশ্মশান, পোড়া কয়লার বিশাল স্তূপ। ওই কয়লার স্তূপের ভিতরে কতো নরনারীর যত্নলালিত কাম-ক্রোধ-লোভ-মোহ-মদ-মাৎসর্য শাসিত দেহাবশেষ মিশে আছে তার ইয়ত্তা নেই। গাড়ি আবার ছুটতে থাকে।আমি ভাবনার সাগরে ডুবে যাই। কিন্তু চোখ থাকে জানালায়। এক্সময় ভদ্রলোক আমাকে সজাগ করে দেন। দেখি নির্ধারিত স্টপেজ এসে পড়েছে। রাস্তায় বেশ জ্যাম। অগণিত পুণ্যার্থীর সমাগম হয়েছে মেলায়। আমি তাঁকে বিদায় জানিয়ে বাস থেকে নেমে পড়ি।
মনটা বেশ ভালো হয়ে যায়। কেমন যেন নস্টালজিক হয়ে পড়ি। হারিয়ে যাওয়া মানুষগুলি যাঁদের সঙ্গে আমি কতো আগে এই মেলায় এসেছিলাম, তাঁদের কথা মনে ভিড় করে; বিশেষত জ্যাঠামশাইয়ের কথা। তিনিই তো আমাকে টিনের ঢোলটি কিনে দিয়েছিলেন, আরও কত কী খাইয়েছিলেন। আমার থেকে বছরদুয়েকের ছোটো মিষ্টির কথাও মনে পড়ে যায়। আমি নিশ্চিত আমার টিনের ঢোলের মতো তার রঙিন কৃষ্ণরাধাও হারিয়ে গেছে সময়ের স্রোতে। জানি না মিষ্টি এখন কোথায়। যেখানে থাকুক, ভালো থাকুক। সে জানবে না আজ এতদিন পরে তার কথা কেউ লিখছে, কেউ তাকে মনে রেখেছে। পুণ্যার্থীদের ভিড়ে স্মৃতিকাতর আমি একলা হয়ে পড়ি। রেললাইন, পোড়া কয়লার স্তূপ দেখেছি, এবার সেই পুকুর, সেই মন্দির, সেইসব বেদি পর্যবেক্ষণ করতে হবে। ভিড় ঠেলে আমি হনহন করে এগিয়ে যাই। হঠাৎ পিছন থেকে কেউ চিৎকার করে ওঠেন— ও ভাই, ভাই দাঁড়াও। আমাকে এই বিভুঁয়ে ভাই ডাকার মতো কেউ থাকার কথা নয়। আমি না-থমকিয়ে পা চালাই, ওই তো নন্দা পুষ্করিণী ওই তো পাড়ে ইতস্তত স্মৃতিবেদি। পিছন দিক থেকে কেউ ছুটে এসে আমার হাত ধরে ফেলে। আমি চমকে উঠি দেখি, বাসের সেই ভদ্রলোক। একটু পরে তাঁর স্ত্রীও ছেলেকে কোলে নিয়ে এসে হাজির। তিনি স্বামীর বোকামির কথা আমাকে ফলাও করে শোনান— 'দ্যাখো তো ভাই কেমন আমুদে লোক। তুমি নেমে যাওয়ার পরে বলে কিনা চলো আমরাও নামি। তা আমি বলি কী, এখানে নামবে কেন, আমাদের তো রায়দিঘি পর্যন্ত টিকিট কাটা আছে। উনি বললেন, মন টেনেছে না-নামলে মনটা অস্থির হয়ে উঠবে। তা নেমে পড়লাম। আবার গাড়ি ধরে যেতে হবে। কতগুলো পয়সা বাড়তি খরচ হল।' ছিলাম একা জুটে গেল সঙ্গ। জগৎটা এমনই বিচিত্র। চললাম একসঙ্গে। সরবত খেলাম, আমিই জোর করে দাম মেটালাম। মেলায় বেশ কিছুক্ষণ কাটানোর পর আমার মাথায় রায়দিঘির ভূত চাপল। সে ভূত বলল, আমাকে দেখেছিস? আমি বললাম, না। তখনও রায়দিঘিতে পা রাখিনি। যাই, এত কাছাকাছি এসেছি যখন একবার ঘুরে আসি। আমি তাঁদের কাছে বিদায় চাইলাম। তাঁরা দুইজনেই আবদার করে বসলেন, 'ভাই চলো আজ আমাদের বাড়িতে থেকে কালকে ফিরবে।' মানুষের মুখের ভাষা অকপট হলে তা হৃদয় ছুঁয়ে যেতে বাধ্য। তবুও সেই আন্তরিক ডাকে সাড়া দেওয়া সম্ভব ছিল না আমার। পরের দিন অনেকগুলো ব্যাচ ছিল। দূর দূর থেকে ছেলেমেয়েরা এসে না-পড়ে চলে যাবে সেটা ভালো কিছু নয়। আমি তাঁদের বুঝিয়ে বিদায় নিলাম। কেবল আমি যে সরাসরি বাড়ির পথ না-ধরে রায়দিঘির দিকে যাত্রা করব সেটা গোপন করলাম।
ট্রেকার ধরে রায়দিঘি চলে গেলাম। নেমে কিছুটা এগিয়ে যেতেই মণি নদীর সান্নিধ্য পেলাম। পঁচিশ বা পঞ্চাশ পয়সা দিয়ে ফেরিনৌকায় চেপে বসলাম। কী শান্ত ও শুনশান। নৌকা থেকে নামলাম না, সেই নৌকাতেই ফিরে এলাম। ঘাটে নেমে একটু ঘোরাঘুরি করে একটা মিষ্টি দোকানে ঢুকে পড়ি। আত্মারাম শান্ত হওয়ার পরে বাসের খোঁজ করি। আবার সেই বাসের একেবারে শেষে জানলার ধারের সিট। মিনিট দশেক পরে বাসের চাকা গড়াতে শুরু করল। একটু ধীর গতিতে, যদি দুয়েকজন যাত্রী জুটে যায়। আমি জানলা দিয়ে বাইরে চোখ রেখেছি। আমার চোখে পড়েনি; আমিই তাঁদের চোখে পড়ে গেলাম। তাঁরা ততক্ষণে রায়দিঘিতে পৌঁছেছেন। আমাকে দেখে আবার সেই ডাক— 'ও ভাই ভাই। নেমে এসো।' আমি হাত নাড়া দিলাম। বাসের গতি বাড়ছে। তাঁরা ছুটে আসছেন। যখন বুঝলেন বাস থামবে না, আমার নামাও সম্ভব নয়, তখন আমার সেই দাদা চেঁচিয়ে বলতে লাগলেন, নদীর ওপারে গিয়ে আমার নাম বললে যে-কেউ আমার বাড়ি দেখিয়ে দেবে আমার নাম...। দাদা তাঁর নামটি বলেছিলেন। আমি ভুলে গেছি।
------------------
চন্দন মিত্র
ভগবানপুর ( হরিণডাঙা )
ডায়মন্ড হারবার, দক্ষিণ চব্বিশ পরগনা