ভ্রমনের আর এক দিক
দীপক পাল
। ১।
১৯৯৪ এপ্রিল মাসের
একটা ঘটনার কথা বলি। অফিসে যাবার জন্য দমদম জং স্টেশনে দাঁড়িয়ে আছি ডাউন ট্রেন ধরবো
বলে। আমার অফিস রাসেল স্ট্রিট। অফিসে সই করে চা খেয়ে যাবো শেকসপিয়র সরণি ব্যাংকে
টাকা তোলার জন্য। মাসের বাকি দিনগুলোর সংসার চালানোর জন্য। সেদিন কি হয়েছিল কে জানে
ডাউন ট্রেন একদম আসছিল না। এদিকে আপ ট্রেন পরপর চলে যাচ্ছে। অধৈর্য হচ্ছিলাম খুব। কারণ
এতক্ষন পরে যে ট্রেন আসবে তাতে যদি উঠতে না পারি। সময় বয়ে যেতে যেতে হঠাৎ করে মাথায়
একটা বুদ্ধি এলো আচ্ছা যদি ব্যাংক থেকে একটু বেশি টাকা তুলে ওখান থেকে মিনি বাসে করে
চৌরঙ্গী নেমে কাছেই রেলওয়ে বুকিং অফিসে গিয়ে দার্জিলিং যাবার টিকিটের জন্য লাইন লাগাই।
জানি নিশ্চিত পাবো না তবুও একটা চেষ্টা। তখন রিজার্ভেশন টিকিট দিত ৪৫ দিন আগে। অলরেডি
১৩ দিন কেটে গেছে। ৩২ দিন বাকি। আমার এই চেষ্টা আমার পুত্র কন্যার জন্য। ১৯৯১ সালে
হারদ্বার থেকে এক দিনের মুসৌরি টুর করেছিলাম অক্টোবের শেষে। কিন্তু মনে হয় একটা পাহাড়কে
ঘিরে ঘুরে ঘুরে ওপরে ওঠা ওরা সহ্য করতে পারে নি। মাথা ঘুরে বমি করে ঘুমিয়ে পড়েছিল।
হিমালয়ের সৌন্দর্য্য ঠিক উপলব্ধি করে উঠতে পারে নি। তাই ভেবে রেখেছিলাম সুযোগ পেলে
ওদের দার্জিলিঙে বেড়াতে নিয়ে যাবো কোনোদিন। আজ ট্রেনের জন্য অপেক্ষা করতে করতে ওই
কথাটা মনে পড়ল। টাইমে ট্রেন পেলে এই কথাটা মনে আসতো না। ফর্ম নিয়ে, পূরণ করে লাইনে দাঁড়ালাম।
আমার টার্ম আসতে কাউন্টারে ফর্মটা পেশ করলাম। উনি দেখে বললেন 'ওয়েটিং লিস্ট ৪০ এর ওপরে। কনফার্মড হওয়ার সম্ভাবনা নেই।' আমি ফর্মটা ফেরত নিয়ে চলে যাবার জন্য ঘুরতেই উনি আমাকে একটু দাঁড়াতে বলে
জিজ্ঞেস করলেন, 'নিউ জলপাইগুড়ি পরের স্টেশন বেলাকোপার কোটায়
৪ টি সিট আছে, আপনারাতো ৪ জন ভাড়াও এক। এটা যদি চান একবার চেষ্টা
করে দেখতে পারি।' আমি রাজি হতেই আমাকে বললেন নিউ জলপাইগুড়ি কেটে
বেলাকোপা লিখতে। তাই করে আবার পেশ করলাম। উনি দেখে বললেন ৪ টেই আছে। টিকিট নিয়ে মিনিবাস
ধরলাম, পার্ক স্ট্রিটে নামবো। নেমে ভাবলাম রাসেল স্ট্রিটের মুখে
ওরিয়েন্টাল গ্যাস কোম্পানির একটা দার্জিলিঙে হলিডে হোম আছে, অফিসে ঢোকার আগে একটা খবর নিয়ে যাই। গ্যাস কোম্পানির অফিসে ঢুকে খোঁজ করতে
একজন আমাকে বসতে বলে দরজা ঠেলে ভিতরে ঢুকে গেলো। একটু পরেই একজন এসে জিজ্ঞেস করলো,
'কে হলিডে হোমের খোঁজ করছিলেন?' আমি উঠে দাঁড়াতে
আমাকে বললো 'ভেতরে আসুন।' ওনার পেছন পেছন
ভেতরে ঢুকলাম। একটা টেবিলে বসে সামনের সিটে আমায় বসতে বললেন। রেজিষ্টার খুলে আমার জার্নি ডেট মিলিয়ে দেখে বললেন,
' প্রথম দুদিন বুকড আছে আপনি পারের তিনদিন নিতে পারেন অথবা জার্নি যদি
দুদিন পিছিয়ে দেন তবে তো কথাই নেই। ' আমি অনওয়ার্ড জার্নির
টিকিটটা দেখিয়ে বললাম, 'আমার কোন উপায় নেই।' আমাকে একটু বসতে বলে তিনি রেজিস্টার নিয়ে একটা চেম্বারে ঢুকলেন। তারপর বেশ
কিছুক্ষণ পরে বাইরে এসে সিটে বসে বললেন, ' আপনারটা হয়ে গেছে।
এই অফিসেরই একজনের বুকড ছিল, সে অন্যসময় বুক করবে বলে এটা উইথড্র
করে নিলো।' টাকা পে করে কাগজ পত্র নিয়ে বেরিয়ে এসে অফিসে ঢুকলাম।
টিফিনের সময় এক বন্ধু বললো, ' আর্জেন্ট কাজ যখন নেই তুই তাহলে
রিটার্ন টিকিটের জন্য লেগে পর আজকে এক্ষুনি। আজ লাকটা তোর স্যুট করছে তাই টিফিন করে
বেরিয়ে পর। তোর বসতো ছুটি নিয়ে কেরলে বসে আছে, তাহলে তোর অসুবিধা
কোথায়? সিয়ালদা বুকিং অফিসে যা, যদিও
ওখানে খুব ভিড় হয় কিন্তু বাড়ি ফিরতে সুবিধা হবে। কথাটা মনঃপুত হলো। টিফিন করে চা
খেয়ে আবার বেরোলাম। দোতলায় বুকিং কাউন্টারে তখন বেশ ভিড়। রেস্ট টাইম চলছে। একটা
লাইনে দাঁড়িয়ে ইতস্তত করছি। তারপর ভাবলাম আধ ঘণ্টা অন্তত দেখি। কিন্তু বহু লোক রিজার্ভেশন
না পাওয়ায় ঘণ্টা খানেকের মধ্যে কাউন্টারে পৌঁছে গেলাম। টিকিটও হয়ে গেলো। আগে এখান
থেকে মেসেজ পাঠানো হতো নিউ জলপাইগুড়ি। নিউ জলপাইগুড়ি থেকে বার্থ রিজার্ভেশন দেওয়া
হতো জার্নি টাইমের দিন বিকালে। কিন্তু টিকিট কনফার্মড। বাড়ি ফিরে যখন বললাম আমরা অমুক
তারিখে দার্জিলিং যাচ্ছি কেউ তখন বিশ্বাস করে নি। আমিই কি জানতাম।
। ২।
১৯৭২ সালের অক্টোবর মাস। বারানসির
ভারত সেবাশ্রম সংঘে দুদিন ধরে আছি। এই দুদিন আমরা ভারত সেবাশ্রম সংঘের সহযোগিতায় বেনারস
দেখা সম্পূর্ণ হয়েছে একদম মনের মতো। এবার এই আশ্রম ছেড়ে দিতে হবে। কারণ এখানে দুদিনের
বেশি থাকা যায় না। এবার তাই এখান থেকে পাততাড়ি গুটাতে হবে। এদিকে একদম ভোর থেকে কাতারে
কাতারে ছাত্র ঢুকতে থাকল ভারত সেবাশ্রম সংঘে। আশ্রমটা তো অনেক বড়ো। কিন্তু গোটা আশ্রমটিতে
ছাত্র গিজগিজ করতে থাকল। সব বারান্দাগুলোতে কতারে কাতারে বসে পরে বই খাতা খুলে এক মনে
পড়ছে। বাথরুমে যেতে পর্য্যন্ত অসুবিধা হচ্ছে। ঘর থেকে বেরিয়ে দেখলাম মাঝের প্রশস্ত
জায়গাটিতে এক মহারাজের পরিচালনায় বাঁশ লাগিয়ে বড়ো করে সামিয়ানা টাঙ্গানোর ব্যবস্থা
চলছে। শুনলাম ভোর থেকে বিভিন্ন প্রদেশ থেকে এক লাখের উপর ছাত্র ঢুকবে বেনারসে কিসের
একটা এক্সামিন না ইন্টারভিউ দিতে। কোনো হোটেলে জায়গা না পেয়ে সব ভারত সেবাশ্রমে আসছে
এবং আসতেই থাকবে।
মহা চিন্তায় পরে গেলাম। যদি
কোনো হোটেল না পাই তাহলে কি করবো। এদিকে বলা হচ্ছে যাদের দু দিন হয়ে গেছে তারা যেন দুটোর
পর ঘর ছেড়ে দেয়। আমরা মোট ছয় জন। আমার স্ত্রীর দিদি ও তার ছেলে আমাদের চার জনের
সাথে আছে। নিরুপায় হয়ে বড়ো মহারাজের কাছে গিয়ে তাকে আমাদের সমস্যার কথাজানালাম।
তিনি বললেন 'কোনো উপায় নেই আমাদের কাছে, এখন ছাত্রদের থাকা খাওয়ার ব্যবস্থা করতে হবে। আরও যে কত আসবে ঠিক ধারণা নেই।
আমি বরং আপনাদের সাথে একজনকে দিচ্ছি সে আপনাদের সাহায্য করবে।' তিনি ডেকে পালবাবুকে আমার সাথে দিয়ে বললেন, 'এনাদের
হোটেলে, বা হোটেল না পেলে একটা এই ছয়জনের কোনো প্রাইভেট ব্যবস্থা
করে দিতে পারো নাকি দেখো।' আমরা পাল বাবুকে নিয়ে বেরিয়ে আসলাম।
এই দুদিন যে সেবাশ্রমের পরিচালনায় আমরা ঘুরেছি, বিশ্বেশ্বর মন্দিরে
পুজো দিয়েছি তাদের মধ্যে এই পালবাবুও ছিল। তাই ওনার সাথে খুব ভালো আলাপ হয় আমাদের।
খুবই আলাপী সাহায্যকারী। ওনাকে নিয়ে দু তিনটে হোটেলে গেলাম কোনো জায়গা নেই। পালবাবু
এবার আমাকে বাঙালি টোলায় একটা বাড়িতে নিয়ে গেলেন। বাড়ির মালিক নিচে নেমে এসে একটা
চাবি দিয়ে একটা ঘর খুলে দিয়ে উপরে উঠে গেলেন। পালবাবু আমাকে নিয়ে ঘরে ঢুকলো। ঘরে
ঢুকে আমি চমকে গেলাম, গা ঘিন ঘিন করতে লাগলো। ঘর ভর্তি মাকড়সা।
সিলিং থেকে চারদিকের দেওয়াল বেয়ে একেবারে নিচে পর্য্যন্ত শয়ে শয়ে মাকড়সা। আমি
বললাম এই ঘরে কি করে থাকবো রাতে মশারী ছাড়া। বাথরুমটা দেখে রীতিমতো ভয় লাগলো। পালবাবুও
বললো এই ঘরে থাকা সত্যি অসম্ভব। চলুন তাহলে অন্য জায়গা দেখি। ওখান থেকে একটা অটো করে
গোধুলিয়ায় গেলাম। প্রথমে একটা টুরিং অফিসে গিয়ে একদিন অন্তর দুটো ট্যুরের টিকিট
কাটলাম। একটা বিন্ধ্যাচল, চুনার ইত্যাদি, আর একদিন এলাহাবাদ ও ত্রিবেণী। এরপর আরো দুতিন জায়গায় কন্ট্যাক্ট করেও কোনো
জায়গা পেলাম না। ইন্টারভিউয়ের জন্য আগেই সব হোটেল ফটেল বুক হয়ে গেছে। আর বেশি সময়
দিতে পারলাম না। সবাই আমার ফেরার জন্য অপেক্ষা করছে নিশ্চয়। রিক্সা করে বাঙালি টোলায়
সেই বাড়িতে এসে থামলাম। রাতটা কাটাতে হবে তো। দুদিনের পুরো ভাড়া দিতে হলো। কিছু বলার
নেই।
স্নান খাওয়া সেরে মাল পত্র
নিয়ে অফিস রুমে গিয়ে মহারাজের কাছে বিদায় নিতে যেতে উনি জিগ্গেস করলেন অ্যাকমোডেশনের
কথা। সব কথা বললাম তাকে,গম্বির হয়ে তিনি পালকে ডেকে পাঠালেন।
সে আসতেই তাকে খুব ধমকালেন। ' তুমি আমায় রিপোর্ট করনি কেন?
ছোট ছোট ছেলে মেয়েকে নিয়ে কি ওই ঘরে শোয়া যায়? আবার দুদিনের টাকাও দিয়ে দিয়েছো। এখন যাও সঙ্গে ওনাদের। কিছু করার হলে করো।'
আমরা গিয়ে দেখি ঘরে একটা মাত্র তক্তপোষ দিয়েছে আর ঘরের ঠিক বাইরে অতিরিক্ত
বাথরুমটা খুলে দিয়েছে। সেটা একটু ভালো। রোজ সকালে বেরিয়ে গিয়ে রাতে ডিনার খেয়ে
দশটার পরে ঢুকতাম। দু'রাত নরক যন্ত্রনা সহ্য করে তৃতীয় দিন কলকাতা
বিশ্রাম ভবনে শিফট করেছিলাম।
। ৩।
১৯৮৯ সালের অক্টবরের আর একটা
ঘটনা বলি। পুরী থেকে চিলকা যাবার পথে বাস যখন পূর্ব ঘাট পর্বতমালার পাশ দিয়ে যাচ্ছিল
তখনত বেশ ভালো লাগছিল। আমরা তিন অফিসের বন্ধু ফ্যামিলি নিয়ে গিয়েছিলাম। চিলকায় পৌঁছে
রেস্টুরেন্টে লাঞ্চের অর্ডার দিয়ে টিকিট কেটে মটোর বোটে উঠলাম। বেশ নিস্তরঙ্গ হ্রদ।
দশ মিনিট হয়েছে কি হয় নি, চিলকা ফুঁসতে লাগলো। তারপর কিছু পরেই
বড়ো বড়ো ঢেউ আছড়ে পড়তে লাগলো বোটের উপর আর আমাদের প্রায় স্নান করিয়ে দিচ্ছিল।
বোট ভীষণ ভাবে দুলতে লাগলো। মহিলা ও বাচ্চারা চিৎকার করে দাঁড়িয়ে পড়ছিল। মাললারা
চেঁচিয়ে বলে যাচ্ছে সবাই চুপ চাপ বসে থাকুন বোট উল্টে যাবে কিন্তু। সামনে তাকিয়ে
দেখি আগের দুটো বোট যেন ডুবে গেলো। তাই দেখে সবাই আরও ভয় পেয়ে গেলো। এবার এলো বুঝি
আমাদের পালা। কিন্তু ওই বোট দুটোকে আবার ঢেউয়ের ওপর দেখা গেলো। এবার দেখি ছোটরা বমি
করছে। আমারও গা গুলিয়ে উঠছে। বমির ওষুধ যাদের দেবার তাদের খাইয়ে দিলাম, নিজেও খেলাম। একটু পরে এক
জায়গায় বোট দাঁড়ালো। একটা জাগ্রত মন্দির নাকি ওপরে আছে। কেউ কেউ গেলো। আমরা কেউ
যাইনি। বমি করে বাচ্চারা নেতিয়ে পরেছিল। ফেরার সময়ও ঢেউ ভেঙে ভেঙে ফিরলাম।
এই কথা অনেককেই বিশ্বাস করাতে
পারি নি। বলে চিলকা তো ভীষন শান্ত, কই আমাদের তো ওরকম হয়নি।
কিন্তু এক নবীন দম্পতি বিশ্বাস করেছিল। বেনারসে বোটে করে যখন বিশ্বনাথ মন্দিরে যাচ্ছিলাম
তখন ওরা বলেছিল চিলকায় ওই ভয়ঙ্কর পরিস্থিতিতে ওরাও পড়েছিল। কেউ ওদের কথা বিশ্বাস
করতে চায় নি।
। ৪।
এরপর ১৯৯৭ সালের ২০ শে মে
আমার একটা স্মরণীয় দিন গেছে যা কোনোদিন ভোলার নয়। ঠিক ওই দিনটাকে সামনে রেখে আমি
আমার ছেলে, মেয়ে, স্ত্রী ও তার দিদিকে
নিয়ে কেদার বদ্রি আর ট্রিযুগিনারায়ানের উদ্দশ্যে রওনা দিয়েছিলাম। ২০ শে মে ছিল বুদ্ধ
পূর্ণিমা। ওই দিন নাকি আকাশ পরিষ্কার থাকলে কেদারনাথ মন্দিরের চতুর্দিকে হিমালয়ের
বরফাদৃত চূড়ায় চাঁদের আলো পড়ে যে অপূর্ব দৃশ্যের সৃষ্টি হয় তা নাকি কখনো ভোলার
নয়। ওই আলোতে নাকি বইও পড়া যায়। কেদার পৌঁছবার ঠিক এক কিলোমিটার আগে এমন বৃষ্টি
শুরু হলো যে মনে হচ্ছিল ওইটুকু দূরত্বও পৌঁছতে পারবো না। যাই হোক বৃষ্টি থামার পর একটু
এগোতেই এক পান্ডা, নাম রাকেশ শর্মা, এর
সাথে আলাপ হলো। সে আমাদের মন্দির কমিটির গেস্ট হাউসে নিয়ে তুললো। গেস্ট হাউসে ঢুকতেই
আবার বৃষ্টি শুরু হলো আর সঙ্গে মেঘের গর্জন যা অত উঁচু উচ্চতায় ভেঙে খান খান হয়ে
যাচ্ছে। রীতিমত ভয় করে। অনেকগুলো, মানে বহু নামে, পুজো দেবার ব্যাপার ছিল। সেগুলো এক এক করে নোট করলো রাকেশ। গোত্র, টাকার অঙ্ক গুলো লিখলো। ছাতা খুলে বেরিয়ে গেলো, বলে
গেলো সন্ধ্যা আরতির সময় হলে ডেকে নেবে। কিছুক্ষণ পরেই রকেশের ডাকে আমরা গেলাম মন্দিরে।
কি সুন্দর মন্দির। কত বছরের অপেক্ষার ইতি। সন্ধ্যারতি দেখার মতো। মন ভরে যায়। তারপর
ঘরে ফিরে একেবারে লেপের তলায় ঢুকলাম। বৃষ্টি শুরু হলো আবার তার সঙ্গে মেঘের গর্জন।
কখন গল্প করতে করতে ঘুমিয়ে পড়েছি। ঘুম ভাঙলো রাকেশ শর্মার ডাকে আর দরজার ধাক্কায়।
' বাবু জলদি নিকালিয়ে ঘর সে, দেখিয়ে কিতনা সুন্দর
চন্দ্রমা '। লেপ সরিয়ে কাঁপতে
কাঁপতে বাইরে বেরিয়ে আসতেই একেবারেই চক্ষুস্থির। পরিষ্কার আকাশে অসংখ নক্ষত্র আর ঝকঝকে
চাঁদের আলোয় চরাচর ভেসে যাচ্ছে। চতুর্দিকে তুষার শুভ্র হিমালয়ের গায়ে চাঁদের আলো
পরে সুস্পষ্ট ভাবে তাদের গর্বিত উপস্থিতি জাহির করছে যেন। পাহারের গা থেকে চাঁদের আলো
ঠিকরে পড়েছে গোটা ভ্যালিতে। কি দেখছি এটাই কি স্বর্গ। আসতে আসতে আওড়ালাম, জয় বাবা কেদারনাথ,
জয় বাবা মহাদেব আমাদের সবার প্রণাম, নাও। পাশে
সবাই এসে গেছে আগেই। সবাই উচ্ছ্বসিত, চোখে মুখে মুগ্ধতা।
ভারত সেবাশ্রমে আগেই খাবারের
অর্ডার দিয়ে রেখেছিলাম। বেগুনি আর পাঁপড় সহযোগে ধোঁয়া ওঠা গরম গরম খিচুড়ি খেতে
ওই ঠান্ডায় কি যে ভালো লাগলো কি বলব। এরপর আরেকটু সময় কাটিয়ে ঘরে ঢুকলাম। এই সময়
রাকেশ এসে সবার সামনে আমাকে বলে গেল যে ও কাল ভোর সাড়ে চারটায় এসে আমাকে নিয়ে গিয়ে
মন্দিরে পুজো দেবার লাইনে বসিয়ে দেবে। আমি যেন বসার জন্য গরম কিছু নিয়ে যাই। ভাবলাম
তাতেও কি বসে থাকা যাবে। সন্ধ্যা আরতি দেখতে গিয়ে নিচে কার্পেটের মতো কিছু একটা পাতা
থাকলেও পা রাখা যাচ্ছিলনা এত ঠাণ্ডা। সওয়া নটা বাজতেই লেপের তলায় শুয়ে কিছুক্ষণের
মধ্যে ঘুমিয়ে পড়লাম। রাত বারোটা নাগাদ ভয়ানক কাঁপুনি দিয়ে আমার জ্বর এলো। স্ত্রীকে
ডাকলাম। লেপের তলায় আমার কাঁপুনি দেখে কপালে হাত দিয়ে বললো, ' তোমার তো ভীষণ জ্বর দেখছি'। ও নিজের লেপের অর্ধেকটা আমার গায়ে চাপিয়ে দেওয়ায় আমার কাঁপুনি
একটু কমলো। আমার বুক পকেটে প্যারাসিটামল ছিল। বার করে বললাম 'খাইয়ে দাও'। খেলাম। ওদিকে সবাই
জেগে গেছে। দিদি খুব চিন্তায় পড়ে গিয়ে বললো, 'এত জ্বর নিয়ে তো ফেরা যাবে না কাল,
কি হবে তাহলে। এখানে কোথায় কি আছে তাই তো জানি না । ' দেখি কাল সকালে রাকেশ আসুক,
কিছু একটা ব্যবস্থা তো করতেই হবে। কালকের দিনটা থেকে দেখা যাক কি করা
যায়'। আমিও ভাবছিলাম কালকে
থেকেও যদি জ্বর না কমে এত ঠান্ডায় তাহলে কি করবো? সবাই তো আমার ওপর নির্ভর করে আছে। কিছুতেই আমাদের
কারো ঘুম আসছিল না। জ্বর সামান্য কমেছে। আবার বাড়বে মনে হয়। জলের বোতল নিয়ে আর একটা
প্যারাসিটামল খেলাম। ঘুমিয়ে পড়লাম।
'বাবু হাম রাকেশ আগেয়া,
মন্দিরমে লাইন দেনা হ্যায়, আইয়ে।' দরজা ধাক্কা দিচ্ছে রাকেশ। শীলা, আমার স্ত্রী,
দরজা খুলে দিল। আমার খুব জ্বরের কথা বলতেই ও বিশেষ পাত্তা দিলনা। খালি
বললো, ' ভুখার অভি চলা জায়েগা। ঠিক হ্যায় বাবু থোড়া বদমে জায়গা
আপ হি কিসিকো লেকে লাইন দিজিয়ে। হাম মন্দিরকো আশ পাশ রহেগা।' চলে গেলো রাকেশ। শীলা রেডী হয়ে ছেলে শুভকে নিয়ে সওয়া পাঁচটায় গিয়ে লাইন
দিলো। সাড়ে পাঁচটায় দিদি বেরিয়ে গেলো। আমি মেয়েকে নিয়ে ছটায় বেরোলাম। কোনো জ্বর
নেই, কোনো অশ্বস্তী নেই। ধীর পায়ে লাইনে ওদের পাশে গিয়ে দাঁড়ালাম।
শীলা জিগগেস করলো 'শরীর কেমন লাগছে। আজকে ফিরতে পারবে?'
আমার কিন্তু একটুও মনে হচ্ছে না যে আমার মাঝরাতে ভয়ানক জ্বর হয়েছিল।
মনে হচ্ছে ওটা কি স্বপ্ন দেখেছি। আমি শুধু উত্তর দিলাম, 'সত্যি
কি আমার জ্বর হয়েছিল? আমি কিন্তু একেবারই বুঝতে পারছি না'।
-০-০-০-০-০-০-০-০-০-
ছবিঋণ- ইন্টারনেট।
-----------------------------------
Dipak Kumar Paul,
DTC, Southern Heights,
Diamond Harbour Road,
Kolkata-700104.