সেটা ছিল ১৯৯৮ সাল। কর্মসূত্রে তখন আমি বীরপাড়াতে পোস্টেড। এখন জায়গাটা আলিপুরদুয়ার জেলায়। তখন আলিপুরদুয়ার আলাদা জেলা হয়নি, বীরপাড়া তখন ছিল জলপাইগুড়ি জেলাতেই । জায়গাটা চা-বাগানে ঘেরা একটা ছোট্ট জনপদ। আদিবাসী আর নেপালীদের সংখ্যাই বেশি। কিছু বিহারী আর মারোয়াড়ি ব্যবসায়ীও আছেন। বাঙালীদের সংখ্যা হাতে গোণা। তখনও আমি বীরপাড়াতে বাড়িভাড়া খুঁজে পাইনি। তাই অফিস ছুটির পর রোজই শেষ বাস "বালাজি" ধরে আধঘন্টায় চলে যেতাম বানারহাট। সেখানে প্রিয় বন্ধুর বাড়ির উষ্ণ আতিথ্যে সন্ধ্যাটুকু কেটে যেত। আর পরদিন সকালে আবার বীরপাড়া চলে আসতাম।
দিন কাটছিল চমৎকার। ধীরে ধীরে বীরপাড়ার মানুষদের সাথেও সম্পর্ক গড়ে উঠল। বাড়ি ভাড়াও পেয়ে গেলাম। শোভা প্রিন্টিং প্রেসের দাদা তপন দেবের সাথে মাঝে মাঝেই আড্ডা জমে উঠত। জানতে পারতাম চা বাগান শ্রমিকদের দৈনন্দিন জীবনযাত্রার নানা খুঁটিনাটি চিত্র।
একদিন দুপুরবেলা আমার অফিসে এক প্রৌঢ়া এসে একটি অভিযোগপত্র জমা দিলেন। জানা গেল, তিনি একটি চা বাগানের নার্স ছিলেন। সম্প্রতি অবসর নিয়েছেন। কিন্তু সেই চা বাগান কর্তৃপক্ষ তাঁকে প্রাপ্য গ্র্যাচুইটির পুরো টাকাটা দিতে অস্বীকার করছেন।
আমি সাথে সাথেই বিষয়টি সম্পর্কে বিস্তারিত তদন্ত করলাম । তারপর আবেদনকারিণী এবং সেই চা বাগান কর্তৃপক্ষকে ডেকে পুরো ঘটনাটা নিয়ে হিয়ারিং করলাম। ভদ্রমহিলা জানালেন, তিনি ০১/০৪/১৯৬৪ থেকেই ঐ চাবাগানে একটানা নার্স হিসেবে কাজ করে আসছেন। মাঝে ১৯৮২ সালে বাগানটি লিকুইডেশনে চলে যায়। তার পরের বছর, মানে ১৯৮৩ সালে বর্তমান কোম্পানি বাগানটি নিয়ে চালাতে থাকেন । ৩১/১২/১৯৯৭ তে উনি অবসর নিয়েছেন। এখন বাগান কর্তৃপক্ষ তাঁকে ১৯৮৩ থেকে ১৯৯৭ সালের জন্য গ্র্যাচুইটি দিতে চাইছেন। কিন্তু তাহলে ওঁনার ১৯৬৪ থেকে ১৯৮২ পর্যন্ত কাজের গ্র্যাচুইটি কে দেবে ? এতদিন পর পুরনো লিকুইডেশনে চলে যাওয়া কোম্পানিকে কিভাবে খুঁজে পাওয়া সম্ভব?
বর্তমান চা বাগান কর্তৃপক্ষের তরফে কলকাতা হাইকোর্টের এক দুঁদে উকিল এসেছিলেন। উনি কাগজপত্র দেখিয়ে বললেন, ১৯৮৩ সালে কোর্টের নির্দেশ অনুসারে তাঁরা বাগানটি নিয়েছেন "ফ্রী ফ্রম অল ইমকামব্রেন্সেস" হিসেবে। কোর্টের আদেশে বলা ছিল যে আগেকার কোম্পানির যেসব কর্মী ফিজিক্যালি ফিট এবং মেন্টালি অ্যালার্ট থাকবেন, তাঁদের সবাইকেই কাজে নিয়োগ করতে হবে। তাঁরা শুধু কোর্টের নির্দেশ টুকুই পালন করেছেন। তাই কোনও ভাবেই ১৯৮৩ এর আগেকার সময়ের জন্য গ্র্যাচুইটি দেওয়ার কোনও প্রশ্নই ওঠেনা।
উভয় পক্ষের সব বক্তব্য শোনার পর পর আমি মালিকদের উকিল কে জিজ্ঞেস করলাম,
-------আপনারা যখন ১৯৮৩ সালে বাগানটা নিয়ে চালাতে শুরু করেছিলেন, তখন কি সব কর্মীদের ফ্রেশ অ্যাপয়েন্ট লেটার ইস্যু করেছিলেন ?
--------দ্যাটস্ ইররেলিভেন্ট ম্যাটার।
--------আই থিঙ্ক, দ্যাটস্ দ্য মোস্ট রেলিভেন্ট । কারণ, আপনারা নতুন অ্যাপয়েন্টমেন্ট লেটার না দেওয়ার ফলে কেউ জানতেই পারেনি যে পরে আর আপনারা আগেকার পিরিয়ডের গ্র্যাচুইটি দেবেন না। এটা তখন জানতে পারলে তখনই কর্মীরা আগেকার কোম্পানির কাছে গ্র্যাচুইটি ক্লেম করতে পারতেন।
--------বাট উই ওয়ার নট ডাইরেক্টেড বাই দ্য কোর্ট টু ইস্যু ফ্রেশ অ্যাপয়েন্টমেন্ট লেটার।
--------দ্যাট ইজ নট সো ইম্পর্ট্যান্ট। মোরওভার, আপনারা তো বাগানটা নিয়েছিলেন "ফ্রী ফ্রম অল ইমকামব্রেন্সেস", তাইনা ?
--------একজ্যাক্টলি।
--------বেশ। নাউ টেল মি, সেই সময়, আই মিন, ইন দ্য ইয়ার নাইটিন এইট্টি থ্রি, বাগানের ওয়ার্কিং এমপ্লয়ীরা কি আপনাদের অ্যাসেট ছিলেন, নাকি লায়াবিলিটি ?
---------অবভিয়াসলি, দে ওয়ার আওয়ার অ্যাসেট।
---------থ্যাঙ্কিউ। তাহলে তাঁদের সেই মুহূর্তে গ্র্যাচুইটি পাওনাই হয়নি, কারণ তাঁরা তখন কাজ করছেন। তাঁদের সাথে আপনাদের এমপ্লয়ার- এমপ্লয়ী রিলেশনশিপও বজায় ছিল। তাহলে তাঁদের ১৯৮৩ এর আগেকার কাজের জন্য পাওনা গ্র্যাচুইটি তো কিছুতেই "ইমকামব্রেন্সেস" এর মধ্যে আসতে পারেনা।
উকিল বাবু বুঝে গেলেন, আমার যুক্তি অকাট্য, প্রতিবাদ করে কোনও লাভ হবেনা। আমি ১৯৬৪ থেকে ১৯৯৭ পর্যন্ত পুরো গ্র্যাচুইটির টাকা সুদসহ ৩০দিনের মধ্যে পেমেন্ট করার জন্য মালিকপক্ষকে আদেশ দিলাম।
উত্তরবঙ্গের চা-বলয়ে আমার দেওয়া সেই অর্ডার নিয়ে ঝড় উঠেছিল। কারণ, একজনকে ঐ টাকা দিলে আরো প্রায় 712 জনকে এইভাবেই পুরো গ্র্যাচুইটি দেবার দাবী আসতো। তাই আমার আদেশের বিরুদ্ধে মালিকপক্ষ অ্যাপীল করেন। কিন্তু লাভ হয়নি। সেখানে হেরে গিয়ে তাঁরা মহামান্য কলকাতা হাইকোর্টের দ্বারস্থ হন। চারবছর মামলার পর কলকাতা হাই কোর্ট আমার দেওয়া অর্ডারটিকেই সঠিক ঘোষণা করেন। এরপর শেষ অস্ত্র হিসেবে মালিকেরা ভারতের মহামান্য সুপ্রিম কোর্টে আমার আদেশের বিরুদ্ধে অ্যাপীল করেন।
বহুদিন পর আমি একটা ফোন পেয়েছিলাম। একটি ছেলে আমাকে ফোনে জানিয়েছিল, তার মা বেঁচে নেই। তবে মালিকপক্ষ তাকে তার মায়ের প্রাপ্য গ্র্যাচুইটির পুরো টাকাটাই দিয়ে দিতে বাধ্য হয়েছে। তবে ১৯৮৩ এর আগের অংশটুকু একসাথে গ্র্যাচুইটি বাবদ না দিয়ে লাম্প-সাম হিসেবে দিয়েছে।
আমি জানি, জাস্টিস ডিলেইড মিনস জাস্টিস ডিনায়েড। দুর্ভাগ্যজনক ভাবে বিনা দোষে সেই নার্স ভদ্রমহিলা জীবদ্দশায় আইনসঙ্গত প্রাপ্য গ্র্যাচুইটি পাননি। তবুও তাঁর ছেলে সেটি পেয়েছিল। তার পেছনে আমারও সামান্য অবদান ছিল, এই ভাবনাটা আজও ভীষণ আনন্দ দেয়।
অবসর নেবার পরেও প্রথমজীবনে দেওয়া সেই অর্ডারের স্মৃতি কখনো ভুলব না।
-------------------------
চন্দন দাশগুপ্ত
রামকৃষ্ণ উপনিবেশ,
কলকাতা।