নিরঞ্জন মণ্ডল
বহুকাল আগের কথা।দিগন্ত জোড়া এক মাঠ। মাঠের চারপাশে ঘন বসতি পূর্ণ গ্রাম। এক গ্রাম থেকে অন্য গ্রামে যেতে এই বিশাল মাঠ পেরোতে হয়। মাঠ পার হতে কয়েক ঘন্টা লাগে।মাঠটির যেখানে সেখানে গজিয়ে উঠেছে ঝোপ জঙ্গল। আর মাঝে মাঝে বড় আকারের গাছ। এই সব গাছে অনেক রকমের পাখির বাসা।ঝোপ জঙ্গলে সাপ,বেঁজি, শেয়াল,বনবেড়ালদের মতো ছোটো জন্তু জানোয়ারের বাস।দিনের আলোয় ছাড়া কোনো মানুষ এই মাঠ পার হওয়ার চেষ্টা করে না।নেহাত জরুরি দরকার ছাড়া মাঠে মানুষের পা পড়ে না।ফলে বুনো জীবজন্তু আর পাখিরা বেশ নিরাপদেই বাস করে এখানে।কত দিন ধরে এমন চলছে কেউ জানে না।কেবল মাঝে মধ্যে ঝোপ জঙ্গলের শেয়াল বা বেড়াল খাবারের খোঁজে গাঁয়ে ঢুকে পড়লে সোরগোল ওঠে। গাঁয়ের লোক তাড়া করে এদের।হয় মেরে ফেলে নাহয় তাড়া খেয়ে জন্তুগুলো পালায় তাদের ঝোপের নিরাপদ আশ্রয়ে।সাপ,বেঁজিও কখনো সখনো ঢুকে পড়ে চারপাশের লোকালয়ে।তারাও মারা পড়ে।নাহলে পালায় তাড়া খেয়ে।তার পর বেশ কিছুদিন কেউ আর লোকালয় মুখো হয় না। এমনই চলে আসছে।পুরুষের পর পুরুষ ধরে।
মাঠের প্রায় মাঝ-বরাবর একটা বহু পুরোনো পাকুড় গাছ।বিশাল গুঁড়িই তার বয়সের জানান দিচ্ছে।চারিদিকে ছড়িয়ে পড়া ডালপালায় বাসা বেঁধেছে অঢেল রকমের পাখি।সকাল সন্ধ্যায় তাদের কলতানে জীবন্ত হয়ে ওঠে প্রায় অর্ধেক মাঠ।এই পাকুড় গাছের একটা ডালের ঘন পাতার আড়ালে পাশাপাশি বাসা বেঁধেছে একটা কাক আর একটা কোকিল।পাশাপাশি অনেক দিন ধরে থাকার ফলে তাদের মধ্যে গড়ে উঠেছে বন্ধুত্ব।তার উপর ক'দিন আগে কোকিলের ডিম ফুটে বেরিয়েছে গোটা তিনেক ছানা।আর কাকেরও কয়েকটা ডিমে তা দেওয়া চলছে তার বাসায়।দু'চার দিনেই হয়তো ডিম ফুটে তারও ছানা বের হবে।ফলে কাক আর কোকিলের বন্ধুত্ব এখন গড়িয়েছে পারস্পরিক নির্ভরতায়।
ডিমে তা দেওয়া ফেলে যখন তখন কাক যেতে পারে না খাবারের খোঁজে। ডিমের মধ্যেই ছানাদের মারা যাওয়ার ভয়। তাই খুব প্রয়োন ছাড়া কাক বের হয় না বাসা ছেড়ে। গেলেও কোকিলকে জানিয়ে যায়, বলে---খেয়াল রেখো বন্ধু।বাসায় ডিম-ফুটি-ফুটি ছানারা।তোমার জিম্মায় রেখে যাচ্ছি।সতর্ক থেকো।
কোকিলের আবার সমস্যা আরও ঘোরালো।ডিমে তা দেওয়ার সময় ঠিকঠাক খাবার জোটেনি।শরীরে দুর্বলতা আছে।সদ্য ফোটা ছানাদের খিদে মেটানোর তাগিদ আছে।নিজেরও খিদে বেশ বেশি আগের তুলনায়।তাই প্রায় প্রতিদিন তাকে বের হতে হয়।ছানাদের রেখে যায় কাকের জিম্মায়।নিছের আর ছানাদের খাবার যোখাড় করে বাসায় ফিরতে তার বেশ দেরি হয়।কাক ডিমে তা দেওয়ার কাজে বাসায় আটকে থাকলে কোনো অসুবিধা হয় না।সারাক্ষণ কোকিলের ছানাদের খেয়াল রাখে।অসুবিধে হয় যখন কাককেও বের হতে হয় খাবারের খোঁজে।তখন তারা দিনের সময়টা ভাগ করে নেয় অর্ধেক করে।কাকের একার খাবার কোনো রকমে যোগাড় হয়েই যায়।সমস্যা হয় কোকিলের।এমন দিনে হয় তাকে আধপেটা খেয়ে নতুবা না খেয়ে কাটাতে হয়।
এমনই এক দিনের কথা বলতে যাচ্ছি।এই দিনটার আগের দিন কাক আর কোকিল সময় ভাগাভাগি করে বেরিয়েছিল।ফলে কোকিল পরিমান মতো খাবার যোগাড় করতে পারে নি।তাকে প্রায় না খেয়েই কাটাতে হয়েছে গত রাত।আজ কাক আর বের হবে না খাবারের খোঁজে।তার ডিমের ভেতর ছানারা নড়াচড়া শুরু করেছে।যে কোনো সময়ে বের হয়ে আসবে ডিম ফুটে।এই আনন্দঘন সময়টা বাইরে কাটাতে চায়নি কাক।কোকিলের কোনো উপায় নেই।ছানাগুলো খিদেয় চিঁ-চিঁ শুরু করেছে।তার নিজের পেটেও প্রবল খিদে।তাই বের তাকে হতেই হল।যাওয়ার আগে কাককে পইপই করে বলে গেল--বাধ্য হয়েই আমাকে বেরুতে হচ্ছে বন্ধু।ছানাদের আর আমার খিদের তাড়না সহ্য হচ্ছে না।আকাশটাও ভালো ঠেকছে না।বৃষ্টি নামতে পারে।ঝড়ও উঠতে পারে যে কোনো সময়ে।সতর্ক থেকো।খেয়াল রেখো আমার ছানাগুলোর।তোমার জন্যেও একটু খাবারের যোগাড় করার চেষ্টা করব আমি।তোমার ভরসাতেই বের হচ্ছি।সবার খাবার যোগাড় করতে হয়তো অনেক দূর পর্যন্ত যেতে হবে আমাকে।যাই হোক না কেন খাবার না নিয়ে ফিরব না আমি।খেয়াল রেখো বন্ধু।খে--য়া--ল---রে---খো---ও---ও--।
কোকিল বেরিয়ে পড়ে খাবারের খোঁজে।কাক পাহারা দিতে থাকে দুটো বাসার।কোকিলের কপাল আজ বেশ মন্দ।মাঠের যেখানে যেখানে খাবার মিলতে পারে তার সব খানেই নিবিড় ভাবে খোঁজে সে।কিন্তু খাবারের কোনো চিহ্নই সে দেখতে পায় না।আসলে গত কালকের প্রবল গরমে হয়তো পোকা-মাকড় গুলো অন্য কোথাও পালিয়েছে।গরমের হাত থেকে বাঁচার জন্যে।কোথায় লুকোতে পারে তারা---ভাবতে থাকে কোকিল।কোনো হদিস করতে পারে না সে।একে গতকালের উপোস।তার উপর এই লাগাতার খোঁজাখুঁজি! উড়ে চলা এক জায়গা থেকে অন্য জায়গায়! বেশ ক্লান্ত হয়ে পড়ছে কোকিল কিছুক্ষণেই।বারবার বিশ্রাম নিতে হচ্ছে তাকে।সময় গড়িয়ে যাচ্ছে সকাল থেকে দুপুরে।কোকিল এগিয়ে চলে দূর থেকে আরও দূরে।অবশেষে এক সময় মাঠের শেষ প্রান্তে পৌঁছে যায় সে।কিন্তু তখনও কোনো খাবারের সন্ধান পায় না কোকিল।কি করবে ভেবে পায় না সে।বাসায় ছানারা খিদেয় কাতর!দুপুর গড়িয়ে যাচ্ছে বিকেলের দিকে।সে কি ফিরে যাবে বাসায়? কিন্তু----!খাবার না পেলে মারা যেতে পারে ছানারা।আজও উপোসে কাটালে তার নিজের অবস্থাও হবে কাহিল।আগামীকাল কি সে বের হতে পারবে খাবারের খোঁজে?
সব সমস্যার থেকে রেহাই পেতে কিছু খাবার তার দরকার।কিন্তু--কোথায় পাবে সে সেই মূল্যবান খাবার?ভাবতে থাকে কোকিল।শেষে সিদ্ধান্ত নেয় সে লোকালয়ে ঢোকার।অবসন্ন প্রায় ডানা ঝাপটে সে উড়ে চলে লোকালয়ের অন্দরে।দূর থেকে আরও দূরে।মাঝে মাঝে ছোটো গাছের ডালে বসে সাময়িক বিশ্রাম।ছোটো ঝোপ দেখলেই আঁতিপাতি খোঁজ খাবারের।আবার এগিয়ে চলা।এদিকে বিকেল গড়াচ্ছে সন্ধ্যার দিকে।প্রবল গরমের আঁচে সারাটা দিন ঝলসেছে তার ডানা।সে দুটো নড়াচড়ায় অবাধ্য হয়ে উঠছে ক্রমশঃ। শরীর ও অবসন্ন হয়ে আসছে।কিন্তু---খাবার যে চাইই চাই তার! থেমে থাকলে কি করে মিলবে খাবার?বাধ্য হয়েই কোকিল এগিয়ে চলে সমুখ পানে।এক লোকালয় থেকে অন্য লোকালয়ে।এক ঝোপ থেকে অন্য ঝোপে।শেষে এক সময় সে সন্ধান পায় কিছু খাবারের।পোকামাকড় গুলোকে মেরে জমাতে থাকে গলার ভিতর।সময় গড়িয়ে চলে।পর্যাপ্ত খাবার যোগাড়ের পর কোকিল থামে।উড়ে গিয়ে বসে একটা গৃহস্থ বাড়ির পেছনের ছোটো আম গাছের ডালে।চারদিক ভালো করে তাকিয়ে আঁচ করতে চায় সময়ের।চমকে যায় কোকিল।এখুনিই যে আঁধার নামবে!যত তাড়াতাড়ি সম্ভব ফিরতে হবে তাকে বাসায়।সারা দিনের উপোসে তার ছানাদের কি হাল হয়েছে ভেবে বুক দুরুদুরু করে ওঠে।কিন্তু কোন দিকে গেলে দেখা পাবে সেই পরিচিত মাঠের? কতটা পথ উড়তে হবে তাকে? মাঠ কিনারে পৌঁছোতে পৌঁছোতে কি দিনের আলো নিভে যাবে? তখন কি সে হদিস করতে পারবে কোন দিকে তার চেনা পাকুড় গাছ?তার প্রিয় বাসা!
এত সব ভাবনার ভিড়ে দিশেহারা কোকিল।মুখ তুলে তাকায় সে আকাশের দিকে।ঘন কালো মেঘ দ্রুত ঢেকে ফেলছে আকাশ।বিদ্যুৎ চমকানো শুরু হয়েছে এদিক সেদিক।সারা শরীর জোড়া কাঁপুনি অনুভব করে কোকিল।হয়ে পড়ে দিশাহীন।ডানার অবশিষ্ট জোরটুকুও যেন অদৃশ্য হয়ে যাচ্ছে তার।সেই সঙ্গে শুরু হয়েছে মেঘের গর্জন।আরম্ভ হয়েছে জোরালো হাওয়া।ঝরা পাতা আর ধুলোয় ঘোলাটে হয়ে যাচ্ছে চোখ।আঁধার ক্রমশঃ গাঢ় হয়ে উঠছে।দৃষ্টি ও অবরুদ্ধ হয়ে যাচ্ছে আস্তে আস্তে।সাহসে ভর করে ডানা মেলে কোকিল।আর ঠিক তখনই বৃষ্টি নামে ঝমঝমিয়ে।কাছাকাছি কোথাও নেমে আসে বাজ আকাশ চিরে।চোখ ধাঁধিয়ে যায় কোকিলের।কি করবে সে বুঝতে পারে না।তার ডানার গতিও যে ধীর থেকে ধীরতর হচ্ছে! বৃষ্টির বেগ একটু কমতেই শুরু হয়ে গেল তুমুল ঝড়।দুর্বল ডানা ব্যর্থ হয় কোকিলকে বাসামুখো এগিয়ে নিয়ে যেতে।শেষে কি সে জীবনটাই হারাবে?বাসামুখো পথের দিশা ও তো পাচ্ছে না সে!এমন আঁধারে কি করে সে বুঝবে কোন দিকে তার চেনা মাঠটা?প্রিয় পাকুড় গাছটাই বা সে ঠাহর করবে কি করে?আজ তার মৃত্যুই মনে হচ্ছে নিশ্চিত!ঝড়ের বেগ একটু কমলে বাড়ছে বৃষ্টির দাপট।মেঘের গর্জন আর চোখ আঁধার করা বিদ্যুৎ ঝলকে বাজের অবাধ পতন বাধ্য করে কোকিলকে ফিরে যেতে।ফিরে যেতে গৃহস্থ বাড়ির পিছনের ছোটো আম গাছটার ডালে।ঘরের আড়াল থাকায় গাছটায় ঝড়ের আঘাত খুবই কম।কিছুই করার ছিল না আর কোকিলের।জীবন বাঁচিয়ে রাতটুকু এই গছের ডালেই কাটিয়ে দিতে হবে তাকে দুরুদুরু বুকে।একটা সান্ত্বনা খুঁজে পায় সে কাককে অবলম্বন করে।এত দিনের বন্ধু সে।তার জিম্মায় রেখে এসেছে ছানাদের।অনাহারে থাকবে হয়তো তারা।কাকের ছানারা বেরুবে ডিম ফুটে।বলেছিল কাক।যদি তাই হয় সে তো আজ আর বেরুতে পারেনি খাবারের খোঁজে।এক দিনের অনাহারে বড় দুর্বল হয়ে পড়বে তার ছানারা।বেঁচে তো থাকবে।কাল সকালের মধ্যেই এই দুর্যোগ কেটে যাবে নিশ্চয়ই।দিনের আলোয় মাঠের হদিস পেতে অসুবিধা হওয়ার কথা নয়।সকালে বাসায় ফিরেই ছানাদের খাবার খাওয়াবে আগে।কাল নাহয় বেরই হবে না আর।কাককে সুযোগ করে দেবে খাবার যোগাড় করার।তার সদ্য ফোটা ছানাদের পাহারায় থাকবে সে নিজে।আজকের উপকারের প্রতিদান সে দেবে সুদে আসলে।রাতটা পার হওয়ার অপেক্ষায় কোকিল।ছোট্ট আম গাছটার ডালে আজ কাটবে তার ঘুম ছাড়া রাত।
পর দিন ভোরের আলো ফুটতেই ডানা মেলে কোকিল।মাঝ রাতের পর শান্ত হয়ে গেছে চারদিক।ঝড় বৃষ্টির শেষে অবসন্ন কোকিল একটু ঝিমিয়ে পড়েছিল বোধ হয়।গৃহকর্তার হাঁকডাকে ঝিমুনি ছুটে গেছে তার।মনে পড়ে অভুক্ত ছানাদের কথা।রাতের প্রথম দিকের দুর্যোগের কথা।বুক কেঁপে ওঠে তার।ছানারা অক্ষত আছে তো?যত দ্রুত সম্ভব বাসায় ফিরতে হবে তাকে।ছানাগুলোকে যত তাড়াতাড়ি খাওয়াতে পারবে তত তাড়াতাড়ি তারা চাঙ্গা হয়ে উঠবে।অনুমানে নিশানা ঠিক করে নেয় কোকিল।কিছুক্ষণ নিশানা ধরে ওড়ার পর বোঝে তার অনুমান সঠিক।আকাশটায় এখনো ছেঁড়া মেঘের আনাগোনা।ফেলে আসা পথে বেশ কিছু গাছের ভাঙা ডাল মাটিতে পড়ে থাকতে দেখেছে কোকিল।তার বুকের কাঁপুনি বেড়ে যাচ্ছে ক্রমাগত।কি এক অজানা আতঙ্কে অস্থির হয়ে উঠছে সে।অবশিষ্ট জোর ডানায় জড়ো করে গতি বাড়ায় সে।ছানাদের দেখা না পাওয়া পর্যন্ত শান্ত হচ্ছে না তার মন।চারদিকেই যেন ছড়িয়ে রয়েছে অশুভ লক্ষণ।দীর্ঘ সময় টানা ওড়ার পর মাঠ-কিনারে পৌঁছায় কোকিল।দূর থেকে আবছা দেখতে পায় পাকুড় গাছটাকে।একটা স্বস্তির শ্বাস বেরিয়ে আসে তার বুক চিরে।পাকুড় গাছ লক্ষ্য করে এগুতে থাকে সে।কিছুটা এগুনোর পর পাকুড় গাছটা স্পষ্ট হয়ে ধরা দেয় তার চোখে ডালপালা সহ। কিন্তু---ওটা কি!গাছটার একটা মোটা ডাল পড়ে আছে যেন মাটিতে! রাতের ঝড়ে ভেঙে গেছে নাকি?ভাঙা ডালেই কি ছিল তার আর কাকের বাসা?বাসাগুলোর আর ছানাদের কি হাল হল তাহলে?পরক্ষণেই সান্ত্বনা খোঁজার চেষ্টা করে কোকিল।কাক বন্ধু তো ছিল বাসায়।যদি বাসা শুদ্ধ ডাল ভেঙেও পড়ে কাক যে ভাবেই হোক সামলে নিয়েছে।হয়তো তার কষ্ট হয়েছে বড় বেশি।তারও ছানারা ডিম ফুটে বেরিয়েছে।খিদেয় অবসন্ন ছিল সে।কিন্তু বন্ধুত্বের একটা মূল্য তো আছে।কাককে কম উপকার করেনি সে ফেলে আসা দিনগুলিতে।সে নিশ্চয়ই তার নিজের ছানাদের সঙ্গে বন্ধুর ছানাদেরও রক্ষা করেছে।অপেক্ষায় আছে তার পৌঁছানোর।হাজার হলেও সে ও তো মা হয়েছে কাল।ছানাদের জন্যে মায়ের আকুলতা সে-ই তো বুঝবে বেশি।
পাকুড় গাছের কাছে পৌঁছে অবস্থা দেখে বুঝে বেশ মুষড়ে পড়ে কোকিল।আশেপাশে কোথাও কাকের চিহ্ন নেই।ভালো করে নিরিক্ষণ করে বোঝে ভাঙা ডালটাতেই ছিল তার আর কাকের বাসা।মাটিতে নেমে আসে কোকিল।চিরিদিকে তাকিয়ে বুকের ধুকপুকুনি বহুগুণ বেড়ে যায় তার।তার আর কাকের সযত্ন শ্রমে গড়া সাধের বাসাদুটো পড়ে আছে একটু দূরে।দুটো বাসার মাঝে কয়েক হাতের ব্যবধান।ডাকাডাকি করেও কাকের কোনো সাড়া মেলে না।তাহলে তার ও নিজের ছানাদের কি ঝড়ের শুরেতে কোনো নিরাপদ জায়গায় নিয়ে গেছে কাক?কিন্তু কোথায় নিয়ে যেতে পারে? যেখানেই যাক,সে তো জানে আমি দিনের আলোয় ফিরবই বাসায়।নতুন ঠিকানার হদিস তো দিতে হবে তাকেই।তাহলে কি সে আসবে এখানে কিছুক্ষণের মধ্যেই?অপেক্ষা করতে হবে তাকে।আর কোনো বিকল্প নেই। ধীর পায়ে কোকিল ঘুরে দেখতে থাকে ভাঙা ডালটাকে।কয়েক বছরের বাস এই ডালে।মায়া পড়ে গেছে তার উপর।তার এই পরিণতি বড় কষ্ট দেয় কোকিলের মনে।হঠাৎ একটু দূরে কিছু একটার উপর চোখ আটকে যায় কোকিলের।ধড়াস করে ওঠে তার বুক।দ্রুত কাছে গিয়ে দেখে তারই একটি ছানা।ঠোঁট দিয়ে নাড়াচাড়া করে বোঝে মারা গেছে ছানাটা।কিন্তু আর দুটো কোথায়?খুঁজতে থাকে কোকিল।বেশি সময় খুঁজতে হয় না।প্রথমটির দু'পাশে একটু দূরে দূরে পড়ে আছে মৃত অন্য ছানাদুটো।যন্ত্রনায় চৌচির হয়ে যাওয়া বুকের রক্তক্ষরণ চেপে রেখে সে আঁতিপাতি খোঁজ করতে থাকে কাক আর তার ছানাদের।বহুক্ষণের খোঁজাখুঁজিতেও তাদের দেখা পায় না।তারা যেন ঝড়ের সঙ্গেই অদৃশ্য হয়ে গেছে চোখের নাগাল থেকে।
বুকের যন্ত্রনা আর ভাবনার ভার অস্থিরকরে তোলে কোকিলকে।পরিস্থিতি বিবেচনা করে একটা বিষয় বদ্ধমূল হতে থাকে তার মনে।কাক নিশ্চয়ই ঝড়ের অবস্থা বুঝে তার ছানাদেরই কেবল সরিয়ে নিয়ে গেছে কোনো নিরাপদ জায়গায়।যদি তাই হয়,এত দিনের বন্ধুত্বের কোনো দামই নেই তার কাছে?বন্ধুত্বের মোড়কে কাক কি একটা শয়তান?ক্রোধ জেগে উঠতে থাকে কোকিলের মনে।তার ভাবনা যদি সত্যি হয় তাহলে কাককে সে ছেড়ে দেবে না।প্রতিশোধ নেবে।চরম প্রতিশোধ।গভীর যন্ত্রনা আর ছানাদের স্মৃতি ছাড়া কিছুই তো নেই তার এখন।পিছুটানহীন,বাসাশূন্য কোকিল সিদ্ধান্ত নেয় তন্ন তন্ন করেই খুঁজতে হবে কাককে।যদি সত্যিই সে কোনো নিরাপদ আশ্রয়ে তার ছানাদের সরিয়ে নিয়ে গিয়ে থাকে তাহলে খোঁজ সে পাবেই।আজ হোক বা কাল।কাক আর তার ছানাদের হদিস যদি সে পায় একবার তাহলে সর্বনাশ করেই ছাড়বে কাকের।তাতে তার জীবন যদি চলে যায় যাবে।বেঁচে এখন আর হবেটা কি?যাদের জন্যে বাঁচা তারাই যখন নেই----!
ছানাদের মৃতদেহ পিছনে ফেলে ডানা মেলে কোকিল হাওয়ায়।গণ্ডি কাটতে থাকে শূন্যে বৃত্তাকারে।বৃত্তের পরিধি ক্রমশঃ বড় হতে থাকে। দৃষ্টি কিন্তু তার মাটিতে।ছোটো ঝোপঝাড়ে।বেশ কিছুক্ষণের ওড়াউড়িতে যন্ত্রনা শুরু হয়ে যায় তার ডানায়।বুকের আর ডানার যন্ত্রনা দিকবিদিক জ্ঞানশূন্য করে তোলে তাকে।বেড়ে যায় তার জিদ।কাক যদি বেঁচে থাকে তাহলে তাকে সে খুঁজে বের করবেই।মরার আগে ছানাদের মৃত্যুর শোধ-----!হঠাৎ কোকিলের দৃষ্টি আটকে যায় অদূরের একটা ঝোপের কিনারে।উপর থেকেই ভালো করে দেখতে থাকে সে।একটা কাকই তো একটা সদ্য ফোটা ছানা দু'পায়ে আঁকড়ে উড়ে যাওয়ার চেষ্টা করছে।দ্রুত ঝোপের উল্টো দিক থেকে একটু দূরে নিঃশব্দে নেমে আসে কোকিল।এ ঘটনা চোখে পড়ে না কাকের।সে তার একটা ছানা দু'পায়ে আঁকড়ে উড়াল দেয় পুব মুখো।বিস্ময় বিস্ফোরিত চোখে কোকিল দেখে এই কাকটিই তো তার-----!ঠাণ্ডা মাথায় ভাবতে থাকে কোকিল।শয়তানটা তাহলে গত রাতের ঝড়ে এই ঝোপের মধ্যেই আশ্রয় নিয়েছিল ছানাদের এনে! কিন্তু তার তো তিনটে ছানা ফোটার কথা।একটা নিয়ে গেল সে এখন।অন্য দুটো কি আগেই নিয়ে গেছে সে তার নতুন আশ্রয়ে? না কি ------দুটো ছানা এখনো ঝোপের মধ্যেই? না কি---একটাই----!ধীর পায়ে এগোয় কোকিল ঝোপের দিকে।কাছে এসে ঝোপের মধ্যে তাকাতেই দেখতে পায় কাকের অবশিষ্ট ছানাদুটোকে।সময় নষ্ট করে না কোকিল।ঝোপে ঢুকে ঠোঁটের আঘাতে আঘাতে মেরে ফেলে সে দুটোকে।বুকের যন্ত্রনা কিছুটা কমে।কিন্তু আর একটা তো এখনো বেঁচে! কোথায় নিয়ে গেল তাকে কাক?দেখতে হবে।দ্রুত ঝোপের উল্টোদিকে গা ঢাকা দিয়ে অপেক্ষা করতে থাকে কোকিল।বেশিক্ষণ অপেক্ষা করতে হয় না তাকে।কাককে দূর থেকে উড়ে আসতে দেখে সে।ঝোপের ভেত খসখস শব্দে সচকিত হয় কোকিল।দেখে-- একটা বনবেড়াল কাকের মৃত ছানা দুটোকে মুখে নিয়ে বেরিয়ে যাচ্ছে ঝোপ থেকে।ভালোই হল---ভাবতে থাকে কোকিল।শয়তান কাকটা জানতেই পারবে না তার ছানাদের আমি মেরেছি।ভাববে বনবেড়াল হয়তো----!
কাকও বনবেড়ালকে দেখতে পায়। দেখতে পায় তার ছানা দুটো বনবেড়ালের মুখে।হায়-----!
যন্ত্রনা-বিদ্ধ হা-হুতোশ করা ছাড়া আর যে কিছুই করার নেই কাকের।বনবেড়ালের সঙ্গে এঁটে ওঠা তার কম্মো নয়।তবে কি কৃতকর্মের ফল পেল সে? বন্ধুত্ব হত্যার----!একটা ছানাকে সে সরাতে পেরেছে যথা সময়ে।এই যা সান্ত্বনা।দেরি হলে রাক্ষসটার কামড়ে----!
মৃত ছানাদের শোক বুকে চেপে ফিরতি পথ ধরে কাক। দ্রুত ফিরে যেতে চায় নতুন আশ্রয়ে।সেখানে তার ছানাটা বড় ক্ষুধার্ত।সে ঠিক আছে কি না দেখে বেরুতে হবে তাকে খাবারের খোঁজে।দূর থেকে তাকে অনুসরণ করে কোকিল অতি সন্তর্পনে।কাকের চোখে ধরা পড়ে না এটা।মাঠের পুব প্রান্তে গ্রমের রাস্তার পাশের একটা শ্যাওড়া গাছের ডালে নেমে আসে কাক।দেখতে পায় কোকিল।কিছুটা দূরে নেমে আসে সে ও।উলু-ঘাসের ছোটো ঝোপে সেঁধিয়ে যায় সে।লক্ষ্য রাখে কাকের দিকে।কয়েক দণ্ড পরে ডানা মেলে কাক আকাশে।উড়ে যায় মাঠের অভ্যন্তরের দিকে।ঝোপ থেকে বেরিয়ে আসে কোকিল।পৌঁছোয় শ্যাওড়া গাছের ডালে।দেখে--একটা অসম্পূর্ণ বাসায় কাকের ছানাটা নড়াচড়া করছে।সকালে কোনো মতে তৈরি করেছে এটা কাক।ঠোঁটের এক খোঁচায় বাসাটা রাস্তায় ফেলে দেয় কোকিল ছানাশুদ্ধ।সদ্য ফোটা ছানা উঁচু থেকে পড়ে যাওয়ার আঘাতে প্রান হারায় অল্পক্ষণেই।ছানাটার মৃত্যু নিশ্চিত হতেই উড়াল দিতে যায় কোকিল।আর তখনই কিছু পোকামাকড় মুখে নিয়ে ফিরে আসে কাক তার নতুন আবাসে।কোকিলকে দেখে ফেলে কাক।দেখে--তার অসম্পূর্ণ বাসা রাস্তায় পড়ে।পাশে পড়ে তার মৃত ছানাটা।সবকিছুই জলের মতো পরিষ্কার হয়ে যায় কাকের কাছে।প্রবল যন্ত্রনায় সে আক্রমন করে কোকিলকে।তৈরিই ছিল কোকিল। তিব্র প্রতিআক্রমণে প্রতিহত করে সে কাকের আক্রমণ।কাক ও ছাড়ার পাত্র নয়।বেশ কিছুক্ষণ চলে তাদের এই অদৃশ্যপূর্ব লড়াই।তার পর বিদ্রুপের হাসি হেসে কোকিল বলে---আমার ছানাদের তোর জিম্মায় রেখে গতকাল আমি বেরিয়েছিলাম।প্রবল ঝড়বৃষ্টিতে দিক ভুলে বাসায় ফিরতে পারিনি রাতে।তোর ছানাদের তুই বাঁচাতে পারলি।আমার ছানাগুলো বাঁচানোর চেষ্টাই করলি না।না কি তুই-ই মেরেছিস তাদের? তোর ছানাগুলোর মৃত্যু নিশ্চিত করে আমার ছানাদের অকাল মৃত্যুর প্রতিশোধ নিলাম।তোর আগের ছানাদুটোর মৃত্যু বনবেড়াল নয় আমার হাতেই হয়েছে।এটাকে মাটিতে ফেলে দিয়ে মৃত্যূ নিশ্চিত করেছি।এত দিনের বন্ধুত্ব; এত সাহায্যের কোনো দাম যখন তুই দিলি না তখন এটাই তোর প্রাপ্য।ছানাদের হারিয়ে মায়ের বুকে কেমন হাহাকার জেগে ওঠে হাড়ে হাড়ে বুঝবি তুই এখন।আর শুনে রাখ---দায়িত্ব নিয়েও আমার ছানাদের রক্ষা করিস নি তুই।তার শোধ একবারে শেষ হবে না।এখন থেকে আমি আর বাসা বেঁধে ডিম পাড়ব না।ডিম থেকে ছানা ফোটাব না।তোর বাসাতেই তোর অজান্তে ডিম পেড়ে যাব।তাদের জন্ম দিবি তুই তোর ছানা ভেবে।বড় ও করবি তুই।না হলে সন্দেহের বশে আমার ডিম ভেবে নিজের ডিমও তুই নষ্ট করে দিবি।তোরও ছানা হবে না কোনো দিন।এই প্রতিশোধ চলতে থাকবে যুগ যুগ ধরে
দ্রুত ডানা মেলে কোকিল আকাশে।চোখের পলকে অদৃশ্য হয়ে যায়।হতাশায়, যন্ত্রনার তিব্রতায় স্থবিরের মতো বসে থাকে কাক শ্যাওড়া ডালে।মৃত ছানাটার দিকে তাকিয়ে থাকে বড় করুন দৃষ্টিতে।
-------------------------
উত্তর 24 পরগণা।