ছবিঋন- ইন্টারনেট
রূপনগরের কথা
মিঠুন মুখার্জী
আজ থেকে কয়েকশো বছর আগের ঘটনা। রূপনগর নামের এক রাজ্যের এক রাজপুত্রকে চুরি করে নিয়ে গিয়েছিল সুন্দরী নামের এক ডাইনি। রাজপুত্রের বয়স তখন ছিল পাঁচ বছর। বাবা বিক্রম গুপ্ত খুব প্রতাপশালী রাজা ছিলেন। তাঁর ভয়ে সমগ্র রূপনগর ভীত হয়ে থাকতো। রানী চিত্রলেখা দুইপুত্র সন্তানের জন্ম দিয়েছিলেন। একজনের নাম রেখেছিলেন শিবম গুপ্ত ও অন্যজনের নাম দীপন গুপ্ত। যমজ সন্তান জন্ম দিয়েছিলেন তিনি। একদা প্রতাপশালী রাজা সুন্দরী ডাইনির ভ্রাতা বীর তক্ষক ও মা পুন্ডরীকে হত্যা করেছিলেন। তাই মা ও দাদার হত্যার প্রতিশোধ নিতে সুন্দরী ডাইনি শিবম গুপ্তকে রাজা প্রাসাদে না থাকার সময় চুরি করে আনে। তার আদব কায়দায় তাকে মানুষ করে। সে মানুষের সন্তান হলেও ডাইনির পালনে তার বেশিরভাগ আচরণ ভুলে যায়। এদিকে রানী চিত্রলেখা শিবম গুপ্তকে না পেয়ে শোকে পাথরের ন্যায় হয়ে যান। দীপন গুপ্তের প্রতি তাঁর তেমন নজর পড়ে না। ওকে দেখাশোনার জন্য রাজা লোক রাখেন। মায়ের স্নেহ থেকে বঞ্চিত হন দুইজন কুমারই।
দেখতে দেখতে আরও পনের বছর অতিক্রান্ত হয়ে যায়। সময়ের সাথে সাথে অনেক কিছুই পাল্টে যায়। শিবম গুপ্ত ও দীপন গুপ্ত যৌবনকালে পদার্পণ করেন। এদিকে সুন্দরী ডাইনি শিবম গুপ্তকে দিয়েই রাজা বিক্রম গুপ্তকে হত্যার ছক কষে। শিবম নিজের বংশ পরিচয় ভুলে যান। সুন্দরীকেই তাঁর মা বলে মনে করেন।
ডাইনি তার আসল রূপ কখনো শিবম গুপ্তকে দেখায় নি। তার চোখ দুটো লাল টকটকে, হাতে পায়ে বড় বড় নখ, চুলগুলো শাড়ির মতো মাটিতে লুটিয়ে থাকে, দাঁত গুলো বড় বড়। রক্ত পান করতে খুবই পছন্দ করে এই ডাইনি। অসহায় গরীব মানুষ ও পশুপাখির রক্ত অনেক পান করেছে সে। শিবম গুপ্তের রক্তও সে পান করত, যদি না তাঁর বাবাকে মারার উদ্দেশ্য ডাইনির না থাকতো। বিক্রম গুপ্তের পরাক্রমের কাছে সুন্দরী ডাইনি বহুবার হেরে গিয়েছে। তাইতো বুদ্ধি করে শিবম গুপ্তকে লালন-পালন করেছে।
শিবম গুপ্তের মনে এত বছর ধরে বিক্রম গুপ্তের প্রতি গভীর বিদ্বেষ তৈরি করে সুন্দরী ডাইনি। তাঁর সামনে মায়া কান্না করে সবসময় সুন্দরী তার মা ও ভাই হত্যার গল্প শোনায়। তাদের শিবম গুপ্তের মামা ও দাদী বলে পরিচয় দেয়। শিবম প্রতিশোধ নেওয়ার জন্য রাগে-ক্ষোভে উত্তেজিত হয়ে ওঠে। তাঁর মধ্যে বিক্রম গুপ্তের প্রতি বিদ্বেষ ও ক্রোধ দেখে সুন্দরী ডাইনি মনে মনে খুব আনন্দ পায়।
সুন্দরী ডাইনি রাজপুত্র শিবম গুপ্তের বাস্তব হিতাহিত জ্ঞান জাদু শক্তির দ্বারা হরণ করেছিল। নিজে টিয়া পাখির রূপ ধারণ করে মাঝে মাঝে রাজা বিক্রম গুপ্তের প্রাসাদে যেত। তাঁদের হালচালের উপর নজর রাখত। রূপনগরের বাইরের এক পাহাড়ের গুহায় এতদিন গা ঢাকা দিয়ে ছিল এই ডাইনি। তবে খাবার জোগাড় করার ক্ষেত্রে কোন অসুবিধা হয়নি তার। রূপনগরের কিছু কিছু প্রজাদের প্রাণে মেরে ফেলার ভয় দেখিয়ে খাদ্য সামগ্রী হরণ করে নিয়ে যেত। দিতে অস্বীকার করলে প্রজাদের হত্যা করে রক্ত পান করত।
সুন্দরী ডাইনির এই ফন্দি কয়েক বছর আগে থেকে দুইজন অপরূপ সুন্দরী পরী লক্ষ করছিলেন। এদের একজনের নাম মীনাক্ষী ও অন্যজনের নাম শ্রীদেবী। তাঁরা রাজা বিক্রম গুপ্তের পরিবারের উপর খুবই কৃতজ্ঞ ছিলেন। একবার এক ভয়ঙ্কর বিপদের হাত থেকে রাজা তাদের দুই পরীকেই রক্ষা করেছিলেন। সেই থেকে রূপনগরের যে কোনো বিপদের তদারকি করেন এই দুজন পরী।
একদিন যখন সুন্দরী ডাইনি টিয়া পাখির ছদ্মবেশ ধারণ করে রাজবাড়ীতে গিয়েছিল, তখন এই দুজন অসাধারণ সুন্দরী পরী সেই পাহাড়ের গুহায় আসেন এবং তাদের জাদুর লাঠি দিয়ে শিবম গুপ্তের উপরে থাকা জাদু শক্তির অবসান ঘটান। মীনাক্ষী তাঁর বংশ পরিচয় থেকে শুরু করে সমস্ত ঘটনা খুলে বলেন। শ্রীদেবীও মীনাক্ষীর কথাকে সমর্থন করেন। মীনাক্ষী সুন্দরী ডাইনির উদ্দেশ্যের কথা রাজপুত্র শিবম গুপ্তকে খুলে বলেন। রাজপুত্র বুঝতে পারেন তিনি তাঁর জন্মদাতার সঙ্গে সংগ্রামে লিপ্ত হতে যাচ্ছিলেন। এরপর পরী দুজনের সহযোগিতায় শিবম গুপ্ত নিজ রাজপ্রাসাদে ফিরে আসেন। শিবম গুপ্তের চুরি হয়ে যাওয়া ঘটনা থেকে শুরু করে এতদিন কোথায় ছিলেন, কি করছিলেন--- সব ঘটনাটি রাজা বিক্রম গুপ্তের কাছে তুলে ধরেন পরী দুজন। রাজা হারিয়ে যাওয়া সন্তানকে খুঁজে পেয়ে আনন্দে কেঁদে ফেলেন। পরী দুজনকে খুবই কৃতজ্ঞতা জানান। সুন্দরী ডাইনিকে উপযুক্ত শাস্তি দেবেন বলে মনে মনে সিদ্ধান্ত নেন। রানী একযুগ পর শিবম গুপ্তকে ফিরে পেয়ে আস্তে আস্তে স্বাভাবিক জীবনে ফিরে আসেন।
এদিকে গুহায় ফিরে এসে ডাইনি রাজপুত্র শিবম গুপ্তকে না দেখতে পেয়ে জাদু শক্তির দ্বারা বুঝতে পারেন সবকিছু। চোখের সামনে পুরো বিষয়টা ভেসে ওঠে তার। রাজা বিক্রম গুপ্ত সৈন্য-সামন্ত নিয়ে পরী দুজনের সহযোগিতায় সেই গুহায় আসেন। পরীরা তাদের জাদুর লাঠির দ্বারা রাজাদের খুব সহজেই সেখানে নিয়ে আসেন। সুন্দরী ডাইনি তখন গুহাটিতেই ছিল। তার জাদু শক্তির কারণে রাজারা বারবার চেষ্টা করেও তাকে মারতে পারেন নি। মীনাক্ষী ও শ্রীদেবীর জাদুশক্তির সঙ্গে ডাইনির জাদু শক্তির লড়াই হয়। মাঝে মাঝে ডাইনি অদৃশ্য হয়ে যায়, আবার দেখা যায়। এরপর ডাইনি টিয়া পাখির রূপ ধরে সেখান থেকে উড়ে যায়। উড়তে উড়তে রুপনগরের রাজপ্রাসাদে এসে আশ্রয় নেয়। এদিকে পরীদুজনও রাজাদের নিয়ে ডাইনির পিছু নেয়। রূপনগরের রাজপ্রাসাদে এসে তারাও উপস্থিত হন। ডাইনি জাদু শক্তির দ্বারা রানী চিত্রলেখাকে বিড়াল বানিয়ে দেয় ও দীপন গুপ্তকে ইঁদুর। শিবম গুপ্ত তখন ঘরে ছিলেন না।
শিবম গুপ্তকে সমগ্র রাজপ্রাসাদে খোঁজে ডাইনি। কিন্তু খুঁজে পায়না। খুব রেগে যায় সে। জাদু শক্তির দ্বারা ডাইনি টিয়াপাখি থেকে আসল রূপে ফিরে আসতে চায়। কিন্তু পারে না। অনেক চেষ্টা করে। কিন্তু ব্যর্থ হয়। ভালো করে তাকিয়ে দেখে তার সামনে দুজন পরী দাঁড়িয়ে আছেন। তারা দুজন জাদুর লাঠির মাধ্যমে ডাইনির জাদুশক্তিকে বেঁধে ফেলেছেন। চেষ্টা করেও সে আসল চেহারায় ফিরতে পারছে না। এরপর একটা খাঁচায় টিয়া পাখিটাকে পরীরা বন্দী করেন। সাধারন মানুষের যাতে কোনো ক্ষতি করতে না পারে, তাই খাঁচা শুদ্ধ ডাইনিটিকে সমুদ্রের মাঝের একটা ছোট্ট দ্বীপে রেখে আসার চিন্তা করেন পরীরা। এমন সময় সেখানে শিবম গুপ্তের আগমন ঘটে। শিবম গুপ্ত একমাত্র জানতেন এই ডাইনির মৃত্যুর রহস্য। যখন তিনি ডাইনির কাছে ছিলেন, তখন একদিন ঘুমের ঘোরে ডাইনি বলেছিল ---- "আমাকে কেউ মারতে পারবে না। আমার জীবন লুকিয়ে আছে টিয়ার মধ্যে।" শিবম গুপ্ত সব শুনে ফেলেছিলেন। জাদু শক্তির কারণে সে সব ভুলে গিয়েছিলেন। কিন্তু আজ টিয়াকে দেখে তার মনে পড়েছে। সেই রহস্য সকলের সামনে উন্মোচন করেন তিনি। এরপর রাজা বলেন---"ওকে বাঁচিয়ে রাখলে প্রজাদের আরো ক্ষতি করবে। তাই ওকে মেরে ফেলা উচিত।" এরপর শিবম গুপ্ত পিতার কোমর থেকে তলোয়ার বার করে খাঁচার মধ্যে থাকা টিয়ার পেটে ঢুকিয়ে দেন। টিয়াটি ছটপট করতে করতে মারা যায়। ডাইনির আসল রূপ ফিরে আসে এবং পুড়ে সেটি ছাই হয়ে যায়। ডাইনি মরে যাওয়ার সঙ্গে সঙ্গে রানী চিত্রলেখা ও রাজপুত্র দীপন গুপ্ত তাদের আসল চেহারায় ফিরে আসেন।
এরপর পরী দুজন রাজার অনুমতি নিয়ে তাদের রাজ্যে পাড়ি দেন। রাজা বিক্রম গুপ্ত রানী চিত্রলেখা ও দুই ছেলেকে নিয়ে সুখে শান্তিতে বাস করতে থাকেন। ছেলেদের বিয়ে দেওয়ার জন্য কন্যার সন্ধান করেন।
====================
মিঠুন মুখার্জী
C/o -- গোবিন্দ মুখার্জী
গ্ৰাম -- নবজীবন পল্লী
পোস্ট + থানা -- গোবরডাঙা
জেলা -- উত্তর ২৪ পরগনা