Click the image to explore all Offers

ভ্রমণকাহিনি ।। ভ্রমণের আর একদিক ( দ্বিতীয় পর্ব ) ।। দীপক পাল

 

ছবিঋন- ইন্টারনেট

 ভ্রমণের আর একদিক  ( দ্বিতীয় পর্ব )

 দীপক পাল

                                                                        

         ভোর হতে দেরি তবুও আমরা পাঁচজন মালপত্র নিয়ে অন্ধকারের মধ্যে গৌড়িকুন্ডের হোটেল থেকে বেরোলাম। টিপ টিপ করে বৃষ্টি পড়ছে। যাব বদ্রিনাথ ভুখ হরতাল বাসে।  রাস্তায় পড়বে শোনপ্রয়াগ, গুপ্তকাশী, উখিমঠ, চোপ্তা, গোপেশ্বর, চামোলি, পিপলকোটি, জোশিমঠ, গোবিন্দঘাট পর্যায়ক্রমে। গোবিন্দঘাট পেরিয়ে গিয়ে বাস ডান দিকে ঘুরে চলতে চলতে এমন সব জায়গা দিয়ে যেতে শুরু করলো যা রীতিমতো ভয়ের। সরু রাস্তায় ছোট ছোট বাক নিয়ে গাড়ি উঠতে লাগলো এমন ভাবে যে বাঁকগুলো পেরোবার সময় দেখা যায় দুদিকেই গভীর খাদ। ভয়ে বুক কেঁপে ওঠে। একসময় বাস থামলো। আর এগোলো না। driver helper দুজন বাস থেকে নেমে গাড়ি পরীক্ষা করলো। জিজ্ঞেস করে জানলাম গাড়ির তেল ফুরিয়ে গেছে। বাসটাকে সাইড করে রাখতে হবে। পরের বাস অর্থাৎ শেষ বাসটার জন্য রাস্তা খোলা রাখতে হবে। রাস্তার ডান দিকে গভীর খাদ। আসতে আসতেই দেখেছি মোটর গাড়ি আর লরি একদম নিচে পড়ে আছে।
এত গভীর খাদ যে গাড়িগুলো খুব ছোট দেখাচ্ছে। সেই খাদের কিনারায় নাকি বাসটা ব্যাক করে রাখতে হবে। আমরা বাসের প্রায় সবাই বাস থেকে নেমে দাঁড়ালাম। পেছনের চাকার নিচে বড়ো পাথরের চাই ফেলে বাসটা সেখানে রাখলো। যারা ভিতরে ছিল যার বেশির ভাগই ছিল মহিলা। ভয়ে তারা চিৎকার করে উঠলো। বাস থামতেই তারা সব হুড়মুড় করে নেমে গেলো। কিন্তু এই
    জনমানবহীন প্রান্তরে প্রায় শেষ বিকালে খাদের দিক থেকে অতি কনকনে ঠান্ডা হাওয়া এসে প্রচন্ড কাঁপুনি দিয়ে যাচ্ছে। অতি নিস্তব্ধ পরিবেশ। একটা গাড়ি দেখে হেল্পার দুজন দৌড়ে গেলো যদি একটু তেল পাওয়া যায়। কিন্তু ফিরে  এলো হতাশ হয়ে। আবার অপেক্ষা।  কতক্ষণ কে জানে শেষ বাসটা এসে দাঁড়ালো। দু তিনজনকে নিতে পারে ওই বাসটা। আমাদের বাস থেকে একজন মাত্র মালপত্র নিয়ে উঠলো ওই বাসে। আমাদের বাস থেকে একজন হেলপার একটা বড়ো জার নিয়ে ওই বাসে ড্রাইভারের উল্টো দিকের গেট খুলে ভিতরে ঢুকে বন্ধ করার সাথে সাথে শেষ বাসটা ছেড়ে গেলো। এরপর নামলো সন্ধ্যা আর তার সাথে বাড়লো শীতের তীব্রতা।
চতুর্দিকে অসহনীয় ভয়াল নীরবতা। এই প্রচন্ড ঠান্ডায় টিকতে না পেরে খাদের একেবারে কিনারায় দাঁড়ান বাস খাদে পড়ে যাবার ভয় থাকা সত্বেও এক এক করে সবাই বাসে উঠে পড়ল। বসে বসে থেকে আর যখন পারা যাচ্ছে না তখন হঠাৎ নিচে দাঁড়ানো বাসের চালক হেলপার' রুকিয়ে, রুকিয়ে '.বলে চিৎকার করে পেছনের দিকে ছুটে গেলো। আমিও নেমে দাঁড়ালাম। একটা গাড়ি নিচের রাস্তা দিয়ে ওপরের দিকে আসছিল ওদের চিৎকার শুনে দাঁড়িয়ে পড়লো। কি কথা বার্তা হলো আমাদের বাসের হেল্পার দৌড়ে এসে একটা জার আর একটা রাবার পাইপ নিয়ে ছুটে গেলো ওই গাড়িটার দিকে। ওই গাড়িটা থেকে পাইপটার সাহায্যে কিছুটা তেল নিয়ে আবার ছুটে এসে তেলের ট্যাংকার খুলে তেলটা ঢাললো। চালকও ততক্ষণে এসে পড়ল। গাড়ি স্টার্ট দিয়ে রাস্তায় তুললো। বাসের সবাই একসাথে হাত জোড় করে বলে উঠলো ' জয় বাবা বদরীনাথ কি জয় ' বাস চলতে লাগলো।
            বদ্রিনাথ ঢোকার আগে একটা ব্রিজের ওপর শেষ বাসটাকে আসতে দেখা গেলো। নিশ্চই তেল নিয়ে আসছে। পাশাপাশি বাস দুটো দাঁড়িয়ে চালক দুজন কথা বলার পর আমাদের বাস আবার স্টার্ট দিল। বদরীনাথেও দেখি ঘোর অন্ধকার অর্থাৎ লোডশেডিং। ভাগ্য খারাপ। বাস থেকে নামলাম। কোনদিকে যাবো তাই ভাবছি। কিন্তু কিছুই তো দেখতে পাচ্ছিনা, বুঝতেও পাচ্ছিনা। কেউ সামনের দিকে যাচ্ছে কেউ আবার পেছনের দিকে যাচ্ছে। লাইন দিয়ে গাড়ি দাঁড়িয়ে আছে আলো নিভিয়ে। আমরা পেছন দিকেই হাঁটা শুরু করলাম গাড়িগুলোর পাশ দিয়ে।
অবশেষে পেলাম ডান দিকে বালানন্দ আশ্রম। মোমবাতি জ্বলছে। খোঁজ নিতেই সিঁড়ি দিয়ে ওপরে উঠে ডান দিকে মহারাজের কাছে যেতে বলা হলো আমাদের। আমরা তাই গেলাম। নমস্কার করে ভিতরে অসার অনুমতি চাইলাম। তিনি মেঝেতে পাটা গদিতে বসেছিলেন। আমাকেও সেখানে বসতে বললেন। আমি বসে দুদিনের জন্য থাকতে চাইলাম। তিনি বললেন একজন আসার কথা ছিল তিনি না আসায় সেই ঘর আপনার নামে বুক করে দিলাম। তিনি আমায় সই করিয়ে একটা চাবি তুলে দিলেন আমার হাতে। বললেন সিঁড়ির বাম দিকের শেষ
ঘরটা। মহারাজকে সবাই প্রণাম করে বেরিয়ে এলাম ঘর থেকে। চাবি দিয়ে ঘরটা খুলে বেশ ভালো লাগলো। ড্রেস চেঞ্জ করে একটু আরাম করে বসলাম। ঘরে চারটে খাট বিছানা দুটো করে কম্বল। অ্যাটাচ বাথ। সব কিছু মোজাইক করা একদম নিচে থেকে ওপর পর্য্যন্ত। ঝক ঝকে পরিষ্কার। দরজায় ধাক্কা দিলো কেউ। দরজা খুলতেই সামনে দাঁড়ানো একজন ভদ্রলোক সাথে তার স্ত্রী  একটা ছোট মেয়ে / বছরের হবে। আমি জিজ্ঞাসু দৃষ্টিতে তার দিকে তাকাতেই তিনি নমস্কার করে বললেন,' বড়ো মুশকিলে পড়েছি দাদা, কোথাও জায়গা পাচ্ছিনা খালি আজকের রাতটির জন্য। এখানে মহারাজের সাথে দেখা করে খুব অনুনয় করতে উনি আপনার কথা বলেন। বললেন একটা ঘরই ছিল আমি ওনাকে দিয়েছি আপনি ওনাকে রিকোয়েষ্ট করে দেখুন যদি উনি রাজি থাকেন তবেই আপনাদের একটা থাকার ব্যবস্থা হবে। আমরা যমুনাত্রি গঙ্গোত্রী কেদার করে আজ এখানে এসেছি। আজ এখানে এক রাত থেকে খুব সকালে পুজো দিয়ে কাল ফিরে যাবো কলকাতা হরিদ্বার হয়ে ' কি আর করা ওনাকে নিয়ে মহারাজের কাছে গিয়ে বলতেই মহারাজ বললেন, ' দেখুন আপনারা পরস্পর সহযোগিতা করে এক রাত থাকতে পারেন কিনা। আমার কোনো আপত্তি নেই।' এরপর মহারাজের ঘর থেকে বেরিয়ে এলাম। ভদ্রলোককে বললাম আপনারা দুটো বিছানা ব্যবহার করতে পারেন। উনি আমার হাত ধরে বললেন, ' অনেক উপকার করলেন দাদা চিরকাল মনে থাকবে। এই রাতে এত ঠান্ডায় কোথায় যেতে হতো কেজানে।' ' কুন্ড কা পানি, কুন্ড কি পানি চাহিয়ে ' ভদ্রলোক দরজার কাছে গিয়ে পানিওয়ালাকে ডেকে বললো কাল ভোর চারটের সময় তিন বালতি কুণ্ডের গরম জল চাই, পারবে কিনা সে দিতে। সে রুমের নাম্বার কত বালতি জল নোট করে চলে গেলো। ওই ভদরালোকেরা আর আমরা নিচে গিয়ে
রাতের খাবার খেয়ে নিলাম। ইলেকট্রিক অনেক আগেই এসে গিয়েছিল। আমাদের অতিথিরা গুড নাইট বলে শুয়ে পড়লো। আর কিছুক্ষণ পরেই এমন ব্যাঘ্র গর্জন শুরু হলো- যা আমি কোনোদিন শুনিনি। মানুষের নাসিকা গর্জন যে এত জোর হতে পারে সেটা আমাদের কারো জানা ছিল না। তার ফলে একমাত্র একজনই ঘুমালো। আর আমরা প্রায় জেগেই কাটলাম সারা রাত। কারণ ভোর চারটায় উঠে ওদের স্নান পর্বও ছিল বেশ হৈ হৈ একটা ব্যাপার।

                                                                  

 



            সালটা মনে হয় ২০১০ কি ১১ সালের অক্টোবর। গুয়াহাটি থেকে তেজপুর এসেছি বাসে ভারতের প্রথম সূর্যোদয়ের দেশ অরুণাচল প্রদেশের তাওয়াং যাবার আশায়। সেখানে যেতে গেলে ঐ দেশের পারমিট লাগে। ফরম ফিলাপ করে আমাদের চারজনের ফটো লাগিয়ে শুভ ওর কলকাতার এক অফিসের বন্ধুকে যে নিজেই ওর কাছ থেকে চেয়ে নিয়েছিল ফর্মগুলো। সে বন্ধু আবার ছুটি নিয়ে নিজের দেশ তেজপুর গেছে আমাদের গুয়াহাটি যাবার আগেই। আমরা গুয়াহাটি পৌঁছে একটা হোটেলে উঠেছি। খবর পেয়ে শুভর সেই বন্ধু তার আবার আর এক বন্ধু যে গুয়াহাটি এসছিল ওই দিন তাকে দিয়ে পাঠিয়েছিল পার্মিটগুলো হোটেলে শুভর হাতে দেবার জন্য কি বন্ধুত্ব। আমাদের তাওয়াং যাওয়া সহজ হলো।
            পরের দিন সকালেই আমরা তেজপুর যাওয়ার বাসে উঠলাম। তেজপুর বাস স্ট্যান্ডের পাশেই একটা হোটেল ভাড়া নিয়ে হোটেলের মালিকের কাছে জেনে নিলাম তাওয়াং যাবার গাড়ির সন্ধান। হোটেল থেকে একটু দূরে তবে হাঁটার ডিসট্যানসের মধ্যে। সেখানে গিয়ে যা দেখলাম বা শুনলাম, কোনো গাড়ি যদি তাওয়াং থেকে ফেরে এবং সে গাড়ি যদি কাল আবার তাওয়াং যায় তবেই যাওয়া যেতে পারে। কারণ টুরিস্টরা সব / দিন টুর করার চুক্তি নিয়ে বেরোয়। তবুও দুটো টুরিস্ট অফিস দু ঘন্টা পরে এসে খোঁজ করতে বললো। কিছুটা সময় কাটাবার জন্য আমরা একটা অটো ভাড়া করে ইতিহাস সমৃদ্ধ অগ্নিগর দেখতে গেলাম। আড়াই ঘণ্টা পরে ফিরে এসে খোঁজ নিয়েও কোনো খবর পেলামনা। পাশেই চায়ের দোকানে চা টা খেয়ে আরও আধ ঘন্টা সময় কাটানোর পরেও কিছু সুরাহা হলো না। আর সময় নষ্ট না করে ভাবলাম অন্তত ভালুকপং পর্য্যন্ত যাই। জিয়া ভরলি নদীর তীরে হেঁটে পাখির কুজন শুনে একটা ভালো নার্সারি দেখে পরেরদিন তেজপুর ফিরবো। ভাগ্য হলে বমডিলাটা ঘুরে আসতে পারবো। কিন্তু ফেরার পথে সত্যি ভাগ্য ফিরলো। পরের দিন তাওয়াং যাবার গাড়ি পেয়ে গেলাম সেই টুরিস্ট অফিসে। গাড়ি আমাদের হোটেল থেকে ভোর পাঁচটায় তুলবে তারপর এখান থেকে বাকি লোকদের তুলে স্টার্ট দিয়ে তাওয়াং পৌঁছতে রাত সাতটা বেজে যাবে। আমি জিজ্ঞেস করলাম ওখানে থাকার জায়গা পাওয়া যাবে কিনা। উনি ড্রয়ার থেকে একটা ভিজিটিং কার্ড বার করে তার পেছন দিকে নিজের নাম লিখে আমার হাতে দিয়ে বললেন এখানে গিয়ে খোঁজ করতে। টাকা পয়সা দিয়ে কাগজ নিয়ে বেরিয়ে এলাম।
            পরদিন ভোর পাঁচটার আগেই গাড়ি এসে হাজির। আমরা রেডী ছিলাম। ড্রাইভেরকে বললাম, 'তাওয়াং থাকার জায়গা পাবতো? ' সে অবাক হয়ে আমার মুখের দিকে তাকিয়ে বলে, ' সেকি আপনারা হোটেল বুক না করেই তাওয়াং যাচ্ছেন মুশকিলে পড়বেন তো। টুরিস্ট অফিস থেকে দেওয়া কার্ডটা দেখালাম তাকে। সে বলে, ওসবের কোনো গ্যারেন্টি নেই। দাঁড়ান দেখছি। মোবাইল বার করে সে বার কয়েক চেষ্টা করার পর লাইন পেয়ে কথা বললো লাইনের ওপারে কে আছে তার সাথে। তারপর আমাকে একটা কাগজে হোটেলের নাম আর ফোন নাম্বারটা লিখে দিলো। বললো এটা যত্ন করে রেখে দিন। আপনাদের থ্রি বেডের একটা রুম পাওয়া গেছে।
    ভাগ্য ভালো আপনাদের। গাড়িটাকে টুরিস্ট অফিসের কাছে নিয়ে যেতেই গারিটা পুরোপুরি ভরে গেলো। গাড়ির চালকও পাল্টে গেলো। আগের ড্রাইভার ছিল বাঙালি, মনে হয় অরুনাচলপ্রদেশের লোক। ওকে জিজ্ঞেস করলাম কটায় পৌঁছবে গাড়ি। বলে,'.আট বাজ জায়গা ' পাকাপাকি থাকার ব্যবস্থা না হওয়ায় কিছুটা শঙ্কিত থাকলাম। দুপুর একটায় বমডিলা পৌঁছলাম রাস্তায় আমরা লাঞ্চ করে নিয়েছিলাম। কিন্তু মোবাইলে তাওয়াং এর হোটেলে যোগাযোগ করতে পারিনি। এখানে ড্রাইভার তার সাথী নেমে কোথায় গেলো কে জানে।
    আসার নাম নেই। বমডিলায় আছে বিরাট মিলিটারি ব্যারাক। মিলিটারির গাড়ি রাস্তায় ভর্তি। তাই বেশ জ্যাম। ড্রাইভার আসতেই শুভ বললো তাকে হোটেলের নাম্বারে ফোন করে দিতে। ছেলেটি তার পকেট থেকে মোবাইল বার করে ওই নাম্বারে ফোন করে শুভকে দিল। শুভ কথা বলা শুরু করতে না করতেই কেটে গেল। বিরক্ত হয়ে বলে ' দূর কথা বলতেই পারলাম না। তবে মনে হলো যেনো একটা রুম বুক করা হয়েছে। সেটা আমাদের জন্য কিনা ঠিক বোঝা গেলো না ' কি আর করা। 
            বিকালের সূর্যের আলো এসে পড়েছে চারিদিকে পাহাড়ের গায়ে ডানদিকের খেতে চাষীরা কাজ করছে। সব মিলিয়ে মনোমুগ্ধকর এক চলন্ত দৃশ্যপট। এরপর আরো সুন্দর দৃশ্য কাছে এলো। সেলা লেক, এক অতি সুন্দর অসাধারণ বিশাল লেক। বিভিন্ন রঙের খেলা চলেছে এই লেকে। গাড়ি ক্রমশ উঠতে থাকলো। সেলা গিরিবর্তের উপর দিয়ে যখন গাড়ি চলছিল তখন ভয় ভয় করছিল। বসে ছিলাম কাঠ হয়ে। এত উঁচু দিয়ে যাচ্ছিলাম যে আশেপাশের পাহাড়গুলোর মাথা আমাদের রাস্তার নিচে দেখা যাচ্ছিল। সাদা সাদা মেঘগুলো পায়ের নিচে। আমাদের গাড়ি যেনো মেঘের ওপর দিয়ে যাচ্ছে। গাড়ির যাত্রীরা বোধ হয় সবাই এই জন্যই ঘুমিয়ে পড়েছে। বেশির ভাগ মানুষই ব্যবসাদার তাই তাদের এই পথে চলতেই হয়। শুভর হঠাৎ ঘুম ভাঙলো। আমি বললাম, ' একবার বাইরে দেখ কি বিপজ্জনক ভাবে চলেছি আমরা। একবার বাম দিকের জানলা আর একবার ডান দিকের জানলার বাইরে দৃষ্টি ছুঁড়ে দিয়ে আমাকে বললো, ' বাবা, তুমিও ঘুমিয়ে পরো, বাইরে আর তাকিয়ে থেকো না ' কথাটা বলে সে আবার ঘুমিয়ে পড়ল। আমি কিন্তু আর ঘুমোতে পারিনি। আমরা জং পৌঁছলাম সন্ধ্যে টার পরে।
    ড্রাইভার বললো আপনারা সব ডিনার করে নিন, পথে আর কোথাও কিছু পাবেননা। অনেকেই নেমে রেস্টুরেন্টে খাওয়ার অর্ডার দিয়ে দিলো। আমাদের কেউ এখন ডিনার করতে চাইলনা। আমরা অল্প কিছু খেয়ে চা খেয়ে নিলাম। তারপর একে একে সবাই গাড়িতে উঠলেও ড্রাইভারের আসনের কেউই সহজে উঠলো না। মনে মনে অধৈর্য হয়ে গেলাম। এই ড্রাইভারটা একদম আজব। পথে ওদের চেনা একটি মেয়ে উঠে ওদের দুজনের মাঝে গিয়ে বসে আর সমানে ড্রাইভারের সাথে গল্প করতে করতে চলেছে। তাছাড়া ঘন ঘন ফোনে কথা বলছে ড্রাইভার।
    একবার বলেছিলেম তাতে উত্তর দিয়েছিল ' কুছ নেই হোগা ' মেয়েটাও বললো ওর নাকি সব রাস্তা মুখস্থ। ভাবি, যতই মুখস্থ হোক অন্ধকারে যে কোনো সময় একটু মাত্র ভুলের খেসারত দিতে হবে সবাইকে। যাত্রীরা সব কাঠ হয়ে বসে আছে, না হয় ঘুমাচ্ছে।
            রাত সাড়ে আটটা নাগাদ গাড়ি তাওয়াং এসে পৌঁছলো। আমরা আর পেছনে বসা একজন বাঙালি ব্যবসায়ী বাদে সবাই নেমে গেলো। একজন জ্যাকেট পরিহিত ভদরলোক উঠে ড্রাইভারের পাশে গিয়ে বসে গল্প জুড়ে দিল। ড্রাইভার আমাকে হোটেলের নাম জিজ্ঞেস করলো। আমি হোটেলের নাম বললাম। শুনে জ্যাকেট পরিহিত লোকটি বললো, ওই নামেত কোনো হোটেল নেই, ওইনামে একটা গ্যারেজ আছে। ওর ঠিক আগে একটা নতুন হোটেল হয়েছে। ওটা দেখা যেতে পারে। ড্রাইভার বললো, ' ওই হোটেলের মালিককে তো আমি চিনি ভালো রকম ' গাড়ি চলতেই থাকলো। এটা ম্যাল বলা যায়। ঠিক ম্যাল এর রাস্তার মোরে একটা ছোট মনাস্টি তাও স্বয়ং সম্পূর্ণ নয়। রাস্তার দুপাশে ছোট বড়ো দোকান শোরুমগুলো দেখলে বোঝা যায় যে কতটা জমজমাট ম্যাল এখন সব বন্ধ। জ্যাকেট পড়া লোকটা নেমে গেলো বাইবাই করে। একটু পরেই গাড়িটা দাঁড়ালো। ড্রাইভার আমাদের বসতে বলে নামলো। আমি দেখলাম সামনে বাম দিকে একটা সাইনবোর্ড তাতে লেখা সেই নাম যা আমাকে তেজপুরের ড্রাইভার লিখে দিয়েছিল একটা  ছোট কাগজে। এদিকে এই গাড়ির ড্রাইভার পেছন দিকে গিয়ে একটা বাড়ির সদর দরজায় ধাক্কা মেরে কি একটা নাম ধরে ডাকছে। রাত নটাতেই কি রকম নিস্তব্ধ। ড্রাইভারের হাঁক ডাক আর জোরে জোরে দরজায় ধাক্কা এই নিস্তব্ধতা খান খান হয়ে যাচ্ছে। পেছনে বসা বাঙালি ভদ্রলোক আমাকে বললেন, ' আপনিতো মশাই পৌঁছে গেলেন। আমার পৌঁছতে এখনো প্রায় একঘন্টা লাগবে।চীনের বর্ডার আমার  বাড়ি থেকে বেশিদূর না ' আমি বললাম, ' বলেন কি চিনা সেনা ঢুকলে তো আপনারা প্রথমেই ওদের সামনে পরবেন '  ' কি করবো বলুন, তবে তেজপুরে আমাদের আরও একটা দোকান আছে। আমি আর ছেলে পাল্টা পাল্টি করে থাকি ' এদিকে ড্রাইভার আর একজন ছেলেকে নিয়ে এলো। ছেলেটি বলল, ' চলুন, আপনাদের ঘর রেডী' নামলাম আমরা। দুজনে মিলে আমাদের জিনিসপত্র গুলো নিয়ে বাড়ির ভিতরে ঢোকালো। ড্রাইভার বিদায় জানালো। ছেলেটি দরজা বন্ধ করে সিঁড়ি দিয়ে আমাদের নিয়ে একটা ঘরের মধ্যে ঢুকলো।, বললো, ' দেখুন পছন্দ হয় কিনা। অবশ্য পছন্দ না হলেও এখন আর কোনো উপায় নেই। কি বলুন '? আমি হাসলাম। সত্যি কোনো উপায় নেই।
            রুমটা মোটামুটি খারাপ না। পাশা পাশি দুটো খাট জোড়া করে বিছানা পাতা, এছাড়া আরো একটা সিঙ্গেল খাটে বিছানা পাতা। ডবল কম্বল। অ্যাটাচ বাথ। একটা বড়ো রুম হিটার থেকে গনগনে আঁচ উঠছে। সত্যি এত বড়ো রুম হিটার হয় আমার জানা ছিল না। ছেলেটি বলে, ' চলুন এবার অফিস রুমেদাদা আপনার জন্য অপেক্ষা করছে। এত ঠাণ্ডা যে কাঁপুনি ধরে যাচ্ছে। যেতে হলো তবু অফিস রুমে। নমস্কার করে ঘরে ঢুকলাম। দুই ভাই এই হোটেলটা চালায়। ভীষণ ভালো ব্যবহার এই দুই ভাইয়ের। দুদিনের জন্য বুক করলাম। টাকা পয়সা মিটিয়ে জিজ্ঞেস করলাম বড়ো ভাইকে, ' এত দূরে এসে হোটেল করলেন কেনো '?  উত্তর শুনে আমি আরো অবাক হয়ে গেলাম। আমার স্ত্রীও ছিল পেছনে। আজ আর ওদের নাম  মনে নেই আমার। এই দুই ভাইয়ের আগে হোটেল ছিল মিজোরামে। খুব ভালো চলতো তখন হোটেলটা ওখানে। কিন্তু  মিজো জঙ্গীরা বড়ো ভাইকে কিডন্যাপ করে চোখ বেঁধে জঙ্গলে নিয়ে যায়। তারপর তিন মাস আটকে রাখে তাকে জঙ্গলে। কয়েক লক্ষ টাকা দিয়ে ছাড়া পায়। শরীর আর মন একেবারে ভেঙে যায় তখন। কিন্তু বসে থেকে কোনো লাভ নেই ভেবে এখানে এসে ছোট করে আবার হোটেল ব্যবসা শুরু করে। এখন ব্যবসাটা দাঁড়িয়ে যায় ভালো ভাবে। দুটো গাড়ির অর্ডারও দিয়ে রেখেছে। পরশু বড়ো ভাই যাবে গুয়াহাটিতে একটা গাড়ি আনতে। অন্যগাড়িটা বোধহয় পাবে  তার পরের সপ্তাহে। ফিরে এলাম রুমে। কিছুক্ষণ পরে গরম ভাত আর দুরকম তরকরি নিয়েএলো ছোট ভাই সঙ্গে আর একজনের সাহায্যে আমাদের জন্যে। টেবিলে গুছিয়ে রেখে বলে,' আপনারা খান আমি একটু পরে আসছি।' সত্যি এসেছিল সারে দশটা পর্য্যন্ত গল্প করলো অনেক। আমার ছেলেমেয়েকে ভাই বোন বলে সম্মধন করছিল।
            পরদিন সকালবেলা শুভ আর মামনিকে নিয়ে ফেরার টিকেট কাটতে গেলাম আর ছবি তুলতে। কিন্তু বাসতো দূরের কথা কোনো টুরিং অফিস থেকেই ফেরার টিকিট পেলাম না। সেইদিন ছিল মঙ্গলবার এবং এই সপ্তাহে ফেরার কিছু উপায় দেখলাম না। হোটেলে ফিরে এসে ছোট ভাইকে বললাম, ' খুব বিপদে পড়েছি। ফ্লাইট আমাদের গুয়াহাটি থেকে রবিবার, এদিকে এখান থেকে বেরোবার কোনো উপায় দেখছিনা ' বললো, ' এই জন্যই আমাদের গাড়ির দরকার আমাদের কাস্টমারদের জন্য। ঠিক আছে আপনারা স্নান করে ব্রেকফাস্ট করে লোকাল টুরে বেরিয়ে পড়ুন। আমি বাজারে যাচ্ছি তার সাথে আপনাদের ফেরার একটা ব্যবস্থা করতে পারি কিনা দেখি ' ব্রেকফাস্ট করে সবাই মিলে বেরোতে যাচ্ছি এমন সময় ছোট ভাই এসে খবর দিলো। ' আপনাদের চারজনের বমদিলা পর্য্যন্ত যাবার একটা ব্যবস্থা করেছি কাল সকালে। ওখানে একদিন থেকে পরের দিন চলে যাবেন তেজপুর। এই নিন ঠিকানা এখানে এখুনি আমার কথা বলে কালকের জন্য গাড়িটা বুক করে নিন। ওখানে লোকাল টুরের জন্য গাড়ি পেয়ে যাবেন।
            পরের দিন আমাদের গাড়ি ছাড়লো সকল নটায়। জং পর্য্যন্ত যেতে যেতে বুঝলাম যে সেদিন তাওয়াং আসার সময় আমাদের গাড়ির বাম দিকের চাকা প্রায় সব সময়ই খাদের ধারে ছিল। বিকাল তিনটায় বমডিলায় পৌঁছলাম। নেমে খুব ভালো লাগলো। যাদের গাড়ি তাদের
অফিসে গিয়ে আগামী কাল তেজপুর যাবার কোনো গাড়ি আছে কিনা খোঁজ করলাম। শুনলাম তিনদিনের মধ্যে নেই। বললো বিকালে একটা বাস আসে এখানে সে যায় রোজ। আর সময় নস্ট না করে রাতটা কাটাবার জন্য একটু ওপরের দিকে উঠতে হলো। হোটেল ঠিক করে আবার বেরিয়ে আবার সেই জায়গায় গিয়ে একটা রেস্টুরেন্টে ঢুকে বেশ আরাম করে বসে কিছু খাবারের অর্ডার দিলাম। এই জায়গাটা বমদিলার প্রাণকেন্দ্র। হাঁটতে বেশ লাগে। রেস্টুরেন্টে ফেরার কোনো খবর দিতে পারলো না। অনেক চেষ্টা করেও কোনো সুরাহা হলো না। ঠিক  করলাম কাল ভোরে হোটেল থেকে বেরিয়ে বাস স্ট্যান্ড যাবো। যতটুকু যেতে পারি ভেঙ্গে ভেঙে যেতে চেষ্টা করব। চুপচাপ বসে থাকলে হবে না। রাতে একটা বাঙালি হোটেলে রাতের খাবার খেয়ে সেখানে একজনের কাছ থেকে একটা অটোর ড্রাইভারের মোবাইল নম্বর পেয়ে শুভ ফোন করলো তাকে। সে ভোর সারে চারটেয় আসবে বলে কোথায় দাঁড়াতে হবে সেটাও বললো। সেটাহোটেলের পাশেই। হোটেলে ঢুকে ম্যানেজারকে কাল ভোর চারটেয় সদর খুলে দিতে বললাম।
            পরদিন সকালে রেডী হয়ে মালপত্র নিয়ে নিচে এসে দেখি সদর বন্ধ আর কেউ নেই আশেপাশে। এত বড় হোটেল কোথাও কাউকে খুঁজে পাচ্ছি না। এর মধ্যে দেবদূতের মতো বাইরে এক ভদ্রলোক চাবি হাতে এসে দাঁড়ালো। আমাদের দেখে যেনো অবাক হলো। চাবি দিয়ে বড় কাঁচের দরজা খুলে সামনে দাড়ালো। কাগজপত্র দেখাতেই সরে দাঁড়ালেন। আমরা নির্দিষ্ট জায়গাতে গিয়ে দাঁড়ালাম। অটো আসতে তাতে উঠে বসলাম। অটো জোরে নিচে নামতে লাগলো। বাস স্ট্যান্ড বেশ দুর। নেমে কাউন্টারে ছুটলাম। তিন চারজন দাঁড়িয়ে আছে লাইন দিয়ে। আমি লাইন দিয়ে সামনের নোটিশ পড়তেই অবাক হলাম। কারণ গুয়াহাটির বাস প্রতি বৃহস্পতিবার সকাল ছটায় ছাড়বে। সবার মুখে হাসি ফুটলো। আজকেই তো বৃহসপাতিবার আবার তেজপুর যেতে হবেনা সোজা যাবে গুয়াহাটি। টিকিট কেটে বেরোতে বেরোতে বাস এসে গেল। স্ট্যান্ডে ড্রাইভার ভদ্রলোক নেমেই আমার হাত ধরে বললো, ' গুয়াহাটি যাবেন তো, মালপত্র বাসে তুলে দিয়ে সবাই মিলে চা খেয়ে নিন। ওই দোকানের চা টা ভালো। বাস ছাড়ল ঠিক ছয়টায়। বেশ নির্বিঘ্নে যাচ্ছিল বাসটা কিন্তু ভালুকপং এর কয়েক কিলোমিটার আগে একটা বাঁকে ঘুরতে গিয়ে সশব্দে মারলো ধাক্কা পাহাড়ের গায়। সামনে পেছনে গাড়ির লাইন পরে গেলো। ঘণ্টা খানেকের পরে মিলিটারির গাড়ি আসলো যন্ত্রপাতি নিয়ে। দামাদ্দাম মেরে পাথর কেটে বাসটাকে বার করে আনল।তারপর আস্তে আস্তে জ্যাম কেটে বাস চলতে লাগলো।

                        =======================

বিশেষ দ্রষ্টব্য:-  গত মে মাসের নস্টালজিয়া সংখ্যার কথা কাহিনীতেমার প্রথম পর্বের ' ভ্রমনের আর এক দিক ' লেখাটায় বারানসি ভ্রমণ ভুলক্রমে ১৯৯২ পরিবর্তে ১৯৭২ লিখেছিলাম। এই ভুলের জন্য আমি ক্ষমা প্রার্থী।

                                                                                                                                                               দীপক পাল। 

==============
Dipak Kumar Paul,
DTC Southern Heights,
Block-8, Flat-1B,
Diamond Harbour Road,
Kolkata-700104.



Post a Comment

0 Comments
* Please Don't Spam Here. All the Comments are Reviewed by Admin.