খাজুরাহো-এর পাথর এখানে কাব্যময়
জয়ন্তী রায়
মধ্যপ্রদেশের খাজুরাহো।ছোট্ট শহর।জেলা ছত্রপুর।সারা পৃথিবী খাজুরাহোকে জানে,তার আকর্ষণীয় মন্দিরগুলির জন্যে। সেই দেখার ইচ্ছেতেই আজ বেরিয়ে পড়া। সময়টা,দু -হাজার বাইশের পূজার মাসটা। বাহন বোম্বে মেল। চলা শুরু, অরিন্দম বসে নেই। সহজ পথে চলার, পথ নির্দেশ দিচ্ছে। কলকাতা, বারাণসী, এলাহাবাদ অর্থাৎ পূর্বভারত থেকে যাতাযাতে সাতনা হয়ে চলার সুবিধা। আর দিল্লী,আগ্রা,গোয়ালিয়র অর্থাৎ উত্তর,দক্ষিণ,পশ্চিম ভারতীয়দের উচিত হবে ঝাঁসি হয়ে চলা। এলাহাবাদ মোম্বাই রেলপথে সাতনা স্টেশন।কলকাতা থেকে সাতনার দূরত্ব 991 কিলোমিটার। ট্রেনে রাত -দিন কাটলো নানা গল্পে, বারবার উঠে আসছে খাজুরাহের কথা। অবশেষে সাতনা স্টেশনে ট্রেন থামলো। আমার মন ময়ূরের মত নাচছে। বহু আকাঙ্ক্ষিত আমার খাজুরাহো।সাতনা স্টেশনের বাইরে ট্যাক্সি পেলাম।এগিয়ে চললো গাড়ি। সাতনা খাজুরাহের দূরত্ব 117 কিলোমিটার।পথ শোভা অপূর্ব।অণুক্ষণ চোখ আমার ট্যাক্সির জানলার বাইরে।অরিন্দম,মেয়ে শিল্পীও দেখছে প্রকৃতির রূপ।ড্রাইভার ভাই বছর পঞ্চাশের বিনোদ,রাষ্ট্রীয় ভাষায় খাজুরাহের গল্প শুরু করলো।দোভাষীর কাজ করছে অরিন্দম। ভাই -এর পুরোপুরি কথা না বুঝলেও হু হা করছি।বুদ্ধিমান ভাই আমার রাষ্ট্রীয় ভাষার দক্ষতা বুঝেছে।তার মুখে শুরু হয়েছে এবার আধো আধো আমার ভাষা।
দিদি,খাজুরাহের এই ছোট্ট শহরে যে সব মন্দির আছে যা ভারতবর্ষের কোথাও নেই। এই মন্দিরগুলো তৈরি হয়েছে 950 থেকে 1050 শতাব্দির মধ্যে। চান্দেলাদের শাসনকালে। প্রতিটি চান্দেলা বংশের রাজা সিংহাসনে বসার পর একটি করে মন্দির গড়েন।
আট গেটের প্রচীরে ঘেরা 257 মিটার উঁচু খাজুরাহো ছিলো তন্ত্রের উপাসক চান্দেলা রাজপুত রাজাদের রাজধানী।মন্দিরগুলি তিনটি অঞ্চলে বিভক্ত।পশ্চিম,পুর্ব,দক্ষিণ।তবে পশ্চিমগোষ্ঠীর মন্দিরগুলির খ্যাতি বেশি।তাই পর্যটকেরা ঘুরতে এলে পশ্চিম দিকটিকে পছন্দ করে।ঘর বাড়ি, হোটেল, বাজার, ব্যাঙ্ক,টুরিস্ট অফিস সবই পশ্চিমে।বাস স্ট্যান্ড পশ্চিমদিকে মন্দির থেকে এক কিলোমিটার দূরে।বোঝাতে পারলাম।আপনারাই ঠিক করুন কোথায় থাকবেন। অরিন্দম বলে-তুমিই নিয়ে চলো।হোটেল দেখে নেবো।
গাড়ি চলছে ।আমি ডুব দিয়েছি ভাবনার সাগরে। খাজুরাহের ইতিহাস মনের দরজায় উঁকি দিচ্ছে।মন্দিরের উৎস কাহিনীর,সুন্দর গল্প সব।
বারাণসীর রাজপুরোহিত হেমরাজের কন্যা হেমবতী (হেতম্বী) ছিলেন বাল্যবিধবা।এক জ্যোৎস্নালোকিত রাতে হেমবতী পদ্মপুকুরে স্নান করছিলেন।চাঁদ তাকে দেখতে পেয়ে তার রূপে মুগ্ধ, চঞ্চল হয়ে পড়েন।তাকে পাওয়ার জন্য।তাই মনুষ্য রূপ ধরে পৃথিবীতে নেমে আসেন।হেমবতীর সাথে দৈহিক প্রেমে লিপ্ত হন।গর্ভবতী হন হেমবতী।এবারে অশান্ত মন হেমবতীর। এখন কি করবেন।চিন্তিত।চাঁদ তাকে নিশ্চিত করেন। বলেন-খাজুরাহোতে গিয়ে তুমি সন্তানের জন্ম দাও।পৃথিবীতে তোমার যে সন্তান আসবে, বড় হয়ে বিশাল খ্যাতনামা রাজা হবে।
হেমবতী চাঁদের কথায় বারাণসী ত্যাগ করে খাজুরাহে আসেন।সন্তান হলো হেমবতীর।সন্তানের নাম রাখলেন চন্দ্রবর্মন।সেই থেকেই চান্দেলা রাজবংশের শুরু।আসলে চন্দ্রের ভবিষ্যৎবাণী, এসব মন্দির প্রতিষ্ঠা হলে হেমবতী পাপ মুক্ত হবে। তাছাড়া স্বপ্নে দেখা মায়ের মিনতি রক্ষার্থে চন্দ্রবর্মনের হাতে শুরু হয়ে বংশের নানা রাজার শাসন কালে শতাধিক বছর ধরে বেলেপাথরে ইন্দো-আর্য স্হাপত্যে 85টি মন্দির গড়ে ওঠে খাজুরাহে।অতীতের কর্ণাবতী নদী।যা আজকের কেন নদী।তার তীরেই চান্দেলাদের রাজত্ব।
এই মুহূর্তে আর একটি মিথ মনের আয়নায় ভেসে উঠলো।হেতম্বী কালিঞ্জর রাজ্যের রাজ ব্রাহ্মণ মনিরামের কন্যা। তিনি বালবিধবা।মনিরাম একদিন ভুলবশত রাজাকে অমাবস্যার রাতকে পূর্ণিমা বলেন।এটাই অপরাধ।হেতম্বী পিতার ভুল কথার জন্য পিতার সম্মান রক্ষার্থে চন্দ্রদেবের কাছে সাহায্য চান।পিতার যাতে মুক্তি হয়।কিন্ত চন্দ্র সে কথায় কান না দিয়ে হেতম্বীর রূপে মুগ্ধ ।তার সাথে দৈহিক প্রেমে লিপ্ত হন।পরিণতি গর্ভবতী হেতম্বী।এদিকে মনিরাম তার কথা জানতে পেরে নিজের অভিশাপে নিজেই পাথরে পরিণত হন।এরপর হেতম্বীর পুত্র সন্তান হয়।তার নাম রাখেন চন্দ্রতেয়।মন্দিরের কাহিনী কাল্পনিক হোক আর বাস্তবিকই হোক চান্দেলা রাজবংশ ছিল। তবে কাহিনী দর্শণীয় স্হানকে আর্কষণীয় করে।
অরিন্দমের ডাকে ভাবনা সরলো - নন্দিতা খাজুরাহোতে আমরা অটোতেই ঘুরবো।প্রথমে পূর্ব,দক্ষিণ দেখবো।তারপর পশ্চিম।অরিন্দম কথা রাখতেই বিনোদ ভাই বলে -আপনারা মনোরম সময় ঘুরতে এসেছেন।আগস্ট থেকে মার্চ ঘোরার উপযুক্ত সময়।এখানে গ্রীষ্ম, বর্ষার আধিক্য বেশী। গ্রীষ্মে তাপমাত্রা 42 ডিগ্রি থেকে 21 ডিগ্রি সেলসিয়াস,শীতে 27 ডিগ্রি থেকে 4 ডিগ্রি সেলসিয়াস ওঠানামা করে।মশার আধিক্য আছে।
হঠাৎ ভাই উচ্চস্বর কমিয়ে নীচু স্বরে ফিসফিস করছে - দিদি,হেমবতী আর চন্দ্রদেবের কাম ও প্রেমের নিদর্শন হিসেবেই খাজুরাহের মন্দিরগুলি গড়ে উঠেছে।মন্দিরের গা জুড়ে যৌনতা আর কামের ছবি। রাজশিল্পীরা মন্দিরের কঠিন পাথরের গায়ে ফুটিয়ে তুলেছে অদ্ভূত সব নকশা। বেশীটাই দেব -দেবীদের মিলন মুহূর্ত। প্রাচীনকালে ভারতীয় সংস্কৃতিতে মিলনের দৃশ্য কখনই অশ্লীল মনে করতো না। এসব ছিল আনন্দ প্রাচুয্য।
তাই খাজুরাহো উপাধি পেয়েছে ' টেম্পেল অফ লাভ'। আর ইউনেস্কো 1982-সালে 15ই অক্টোবর ওয়াল্ড হেরিটেজের মর্যাদা দিয়েছে।
আমি মনোযোগ সরিয়ে বলি -ভাই,তোমার কাছে আর একবার শুনে ভালো লাগলো।
দিদি -ওখানে দেখবেন বিদেশী পর্যটকই বেশী।মন্দিরের শিল্প খুটিয়ে দেখছে। জানেন,শিল্পী তার সৃষ্টিতে এতটাই মগ্ন থাকে তার চোখে অন্য দৃষ্টি থাকে না।সাধারণ মানুষের যা থাকে।
আমি বলি - কথাটি একদম খাঁটি। তুমি গাইডের ভূমিকায় বেশ প্রশংসনীয়।
ভাই খুশিতে বলে -খাজুরাহোই আমার রুটি- রুজি।বেঁচে থাকার মন্ত্র।প্রায় ত্রিশটা বছর একাজ করছি। কত পর্যটকদের নিয়ে আসা যাওয়া। বিভিন্ন ভাষাভাষীর সাহচর্য পাই।শিখছি অনেক দিয়েছি আমিও।যতটুকু জানি।
নন্দিতা,ভাই ঠিকই বলেছে।দেয়া আর নেয়া।বুঝলে।জানো,অনেকের উৎসাহ থাকে কোনো স্হানের বা মন্দিরের ইতিহাস জানার। এখন দেখছি তোমায় এই নেশায় পেয়েছে।অবশ্য চাক্ষুষ না দেখলে ঠিক এসব লেখা যায় না।তাছাড়া, ইতিহাস উদ্ধারের নেশা ঐতিহাসিকদের। স্বাভাবিক।1022 খ্রিষ্টাব্দে ঐতিহাসিক আবু রিয়ান তার বিবরিণীতে খাজুরাহের কথা যেমন আছে।তেমনি 1342 খ্রিষ্টাব্দে বিশ্ববিখ্যাত মরক্কোর পর্যটক ইবন বতুতা ভারতে থাকার সময় তাঁর ভারত ভ্রমণের ইতিকথায় উঠে এসেছে কাজারা -র মন্দিরের কথা।তার বিবরণীতে মন্দিরগুলিতে সে সময় বিগ্রহ ছিল।শুধু ইবন বতুতা নন।641 খ্রিষ্টাব্দে হিউয়েন সাং বা জুয়াং ঝাং যখন এখানে এসেছেন তখন এখানে বৌদ্ধ মঠ ছিল।তবে খাজুরাহের মন্দিরগুলি হিন্দু আর জৈন ধর্মের স্হাপত্য।নাগারা ঘরানায় তৈরি মন্দিরগুলির বৈশিষ্ট্য হল এর গঠনশৈলির।প্রতিটি মন্দিরের অন্যতম অংশ অর্ধমন্ডব, মন্ডব,মহামন্ডব, অন্তরাল, গর্ভগৃহ আর প্রদক্ষিণ। প্রতিটি মন্দিরের গর্ভগৃহ তৈরি হয়েছে গ্র্যানাইটে।আর নানা রঙের বেলে পাথরে তৈরি মন্দির। গোলাপি রঙের আধিক্য বেশি।
এবার শোনো,খাজুরাহো নামের উৎস।খাজুরাহোতে বিপুল সংখ্যায় খেজুর গাছ ছিল। এই খেজুর গাছ থেকেই শহরের নামকরণ।অন্য মতে শহরের প্রতিটি তোরণদ্বারে খেজুর গাছ থাকায় শহরের নাম হয়েছে খেজুর বাহিকা।সংস্কৃত শব্দ 'খর্জুরবাহো' থেকেই নাকি এর নামকরণ। 'খর্জুর 'এখানে বৃশ্চিক আর 'খর্জুরবাহো' এখানে মহাদেব।নন্দিতা বোঝাতে পারলাম।জানো, খাজুরাহোকে সুবর্ণযুগের শহর বলে। তবে ইবন বতুতার বিবরণীতে সেকালের যাহুতি রাজার (আজকের বুন্দেলখন্ড) রাজধানী ছিল খাজুরাহোতে।আর এই রাজাদের হাতেই মন্দির গড়ে উঠেছে মাহেবা, কালীঞ্জর, আজাইগড়, দুধাই, চাঁদপুর, মদনপুর, দেওগড়ে।এইসব মন্দিরগুলি নিয়ে ইতিসাসে নানা কথা আছে। কিন্তু লোকের মুখে মুখে আজও চলে আসছে চান্দেলা বংশের রাজারাই খাজুরাহের মন্দিগুলির নির্মাতা।বোঝাতে পারলাম।
আমি নীরব।গাড়ি চলছে।আমার মনের কুঠুরিতে উঁকি মারছে সেই ইতিহাস।চন্দ্রবর্মণের সময় থেকে খাজুরাহোতে মন্দির গড়া। শতাধিক বছর ধরে প্রত্যেক রাজা মন্দির গড়লেও রাজা যশোবর্মণের হাতে মন্দিরের সংখ্যাধিক্য ঘটে।মন্দিরে প্রধান্য পেয়েছে সৃষ্টি রক্ষার দেবতা বিষ্ণু।সৃষ্টি দেবতা শিব। পারিষদবর্গ সহ দেবতারা হাজির। ত্রয়োদশ থেকে অষ্টাদশ শতাব্দীর মধ্যবর্তী সময়ে মুসলিম রাজবংশের শাসনকালে মন্দিরগুলি লোকচক্ষুর অন্তরালে চলে যায়। ফলে ধীরে ধীরে জল জঙ্গলে মাটিচাঁপা পড়ে মন্দিরগুলি নষ্ট হতে থাকে।মন্দিরগুলির গরিমা হারিয়ে গেলেও তার স্মৃতি জেগে থাকে স্হানীয় বাসিন্দাদের লোক পরম্পরার স্মৃতিতে।তাদের কাছে শুনেই খেজুর গাছের আড়ালে মন্দিরের কাছে হাজির হয়েছিলেন ব্রিটিশ জরিপকর্মী টি.এস.বার্ট। ফলে 1819 -এ এই স্হান আবিষ্কার হয়। 1923 -তে সেখানে খনন করে লোকসমক্ষে আসে মন্দিরগুলি। নাগারা শৈলীর মন্দির স্হাপত্যের অন্যতম নিদর্শণ খাজুরাহের এই মন্দিরাজির। কিন্তু আদিরস ধর্মস্হানের গায়ে কেনো? গবেষকদের বহু মত। অনেকে বলেন - তান্ত্রিক সাধনার প্রভাব পড়েছে ভাস্কর্যে। আবার অনেকে বলেন - সেই সময় আদিরস বা কাজের প্রকাশ কোনোটাই সমাজের চোখে নিষিদ্ধ ছিল না।
বিনোদ ভাই -এর ডাকে ভাবনার কুঠুরি থেকে বেরোলাম।
ভাই বলে -দিদি,আমরা এসে পড়েছি।এখানেই পছন্দ মত হোটেল পাবেন।
আমরা গাড়ি থেকে লাগেজ নিয়ে চাতালে দাঁড়ালাম।পরিচ্ছন্ন চাতাল। বিদেশীদের আধিক্য দেখে মনে হচ্ছিল আমরা বিদেশে এসেছি বুঝি।ভাইকে দক্ষিণা দিয়ে,আমরা হোটেলের পথ ধরলাম। খুব সহজেই পরিচ্ছন্ন হোটেল পেলাম।সময় গড়াচ্ছে। সন্ধ্যা, রাত্রি এলো।বিশ্রাম প্রয়োজন। রাত নটায় নৈশ্য আহার সেরে ঘুমাতে গেলাম।
ভোরে উঠে পরিচ্ছন্ন হয়ে প্রাতরাশ সেরে সকাল নটায় বেরিয়ে পড়লাম। রোগাটে ফর্সা বছর ত্রিশের ছেলেটি। নামটি গুঞ্জন।গাড়িতে যেমনটি হয় আমার মনের কুঠুরিতে শঙ্কু মহারাজ এসেছেন।ওনার সুন্দর কথা।বলছিলেন -আমরা ভ্রমণ করি কিন্তু এত ব্যস্ততায় কোন স্হানের কোন বিষয় নিখুঁত পর্যবেক্ষণ করি না। আজ আমি ওনার কথা স্মরণে রাখবো।খাজুরাহের মন্দিরগুলি নিখুঁত চোখে ধরবো।
অটো চলছে এবরো- খেবরো পথে। নিস্তব্ধতা সর্বত্র।আশপাশের ঘর -বাড়ি,দোকান -পাট বেশ বিবর্ণ। ভাই ঘাড় ঘুরিয়ে মাথা নাড়িয়ে গুণ গুণিয়ে চলছে। সজাগ দৃষ্টি আমাদের প্রতি।আমি কৌতূহলী মুখে চারধার দেখছি।
নিজস্বতা থামিয়ে গুঞ্জন বলে -কেমন দেখছেন দিদি,রূপসী খাজুরাহোকে।
ভাই, এত নির্জনতা কেনো? লোকজন দেখছি না যে।
দিদি,এদিকটা অবহেলিত। মন্দিরের রূপের তেমন জৌলুস নেই।প্রায় ভগ্ন। পর্যটকেরা পশ্চিমের মন্দিরের আকষর্ণেই আসে।অতুৎসাহীরাই এদিকটায় দেখতে আসে। তবে খাজুরাহের প্রকৃতির রূপ আছে।চারপাশ ঘিরে প্রাচীর হয়ে দাঁড়িয়ে আছে বিন্ধ্যপর্বত।তারই মাঝেই মহিষরঙা বেলে পাথরে গড়া খাজুরাহের মন্দিরাজি।পাথর এসেছে কুড়ি কিলোমিটার দূরে কেন নদী থেকে।তেরো বর্গকিলোমিটার এলাকা জুড়ে 85টি মন্দির ছিল।বর্তমানে সেগুলির মধ্যে মাত্র 22টি মন্দির আছে।এদের মধ্যে কয়েকটি আবার বিধ্বস্ত।তবুও বলবো ভালো।খাজুরাসো দর্শণে বিদেশীরাই বেশী আসেন। আমাদের দেশের পযর্টকেরা এদিকটা নিয়ে ভাবে না।তাই আসেন না। খাজুরাহের মন্দির মধ্যযুগীয় হিন্দু ও জৈন মন্দিরগুলির এক বৃহত্তম সমষ্টি।আর এই পূবের মন্দিরগুলো সূর্যোদয় থেকে সূর্যাস্ত খোলা থাকে। ভাই কথা রেখে অটো থামালো।
আমাদের চোখ আটকে গেলো স্তম্ভগুলির দিকে। মন্দিরটি বিধ্বস্ত। কিন্তু স্তম্ভগুলি যেন দৃষ্টি আকর্ষণ করছে। প্রবেশ পথটি অপরূপ খোদাই। বৈচিত্র্য আছে কারুকার্যে।প্রতিটি স্তম্ভের চারপাশে কীর্তিমুখ।মণিমুক্তোর মালা।ঝুলছে ঘন্টা।
ভাই বলে-এটাই ঘন্টা মন্দির।মহাবীর জননীর ষোলটি স্বপ্ন রূপ পেয়েছে। প্রবেশ পথে গরুড়ে উপবিষ্ট জৈন দেবতা যক্ষ।
এরপর ভাই নিয়ে এলো নয়শো খ্রিস্টাব্দের তৈরি ব্রহ্মা মন্দিরে। মন্দিরটি শিখর চুড়ো পিরামিড-এর মতো।ছোট্ট মন্দির।বিগ্রহ চতুর্মুখী ব্রহ্মার লিঙ্গমূর্তি।ভাই বলে-কেউ বলে এটি শিব মন্দির।কেউ বলে বিষ্ণু মন্দির।এরপর জাবারী মন্দিরে এলাম। ভাই বলে-জাওয়ার অর্থ বিষ্ণু। এখানে দেবতা চার বাহুর বিষ্ণু। আমরা দেখছি দেওয়াল জুড়ে ভাস্কর্য।স্বর্গের দেব -দেবী,পরী,স্তন্যদানরত মা,শিশু। নানা মিথুণ মূর্তি।ভাই ডাকছে -আপনারা আসুন,এখান থেকে দুশো মিটার উত্তরে বামুন মন্দিরে যাব। ত্রেতাযুগের দৈত্যরাজ বলির অত্যাচার থেকে দেবতাদের রক্ষার্থে বামন অবতার রূপে বিষ্ণুর আবির্ভাব। মন্দিরটি 1050 -1075 তে তৈরি। ভাই কথা রাখলো।আমরা সেখানে পৌঁছালাম। দেখছি লক্ষ্ণী -নারায়ণ,ব্রহ্মা,সরস্বতীর যুগল মূর্তি। স্বর্গ থেকে দেব -দেবীরা নামছেন। মন্দিরের স্তম্ভ চারটি আর সিলিং -এর কারুকার্য সুন্দর। মূল মন্দিরে উঁচু বামন অবতাররূপী চর্তুভুজ বিষ্ণু।দেখা হলো।চললাম আমরা এগারশো শতকের তৈরি আদিনাথ মন্দিরে। এখানে গর্ভগৃহে দেবতা কষ্টি পাথরের আদিনাথ। এবার দশ শতকের মধ্যভাগে তৈরি পাশ্বনাথ মন্দিরের দ্বারে পৌঁছাতেই সেই আশ্চর্য দৃশ্য চোখে ধরা দিল।
সোনালী চুল, মাথায় বড় টুপি, দুধ সাদা রঙ,বছর ত্রিশের মেয়েটি। হাতে ধরা মোটা বই।একবার বই -এ চোখ রাখছে পর মহূর্তে দেওয়ালে চোখ রাখছে। বইটি তার গাইড। ভাস্কর্য দেখে তার চোখ মুখে অপার বিস্ময়। মুখে সিগ্ধ হাসি ফোঁটা।মনে হচ্ছিল উদিত সূর্যের দেশের মেয়েটি। ভাই আমাদের বলে - দেখুন দিদি,ওনারা রকমই। শেষটা দেখে ছাড়বেন। এই দেখুন সাইকেল ওটাই ওদের যান।সারা খাজুরাহো ঘুরবে এই যানে।মেয়েটির কথা রেখে, ভাই মন্দিরের কথায় ফিরলো।পার্শ্বনাথ মন্দির জৈন মন্দিরগুলির মধ্যে বৃহত্তম।সুন্দরতমও। হিন্দু মন্দিরের আদলে গড়া এটি শিখরধর্মী পার্শ্বনাথ।1860 -এ গর্ভগৃহে আদিনাথের বদলে নতুন মূর্তি হয়েছে কালো মর্মরে পার্শ্বনাথ।এই মন্দির অতীতে ছিল হিন্দুদের তৈরি। পরবর্তীকালে জৈন হয় সংগঠকেরা।ভাস্কর্যে তাই হিন্দু,জৈন দেব -দেবী আছেন। ব্রহ্মা, বিষ্ণু, কাম,শিব পার্বতীর যুগল মূর্তি। দাড়ি মুখে স্বর্গের দেবতা, পত্রলেখা, এক পতির দুই সতী,কাটা তুলছে সুর- সুন্দরী।আমরা খুটিয়ে দেখছি।প্রতিটি মূর্তি যেন প্রাণবন্ত।ভাই বলে -এবার দক্ষিণে যাব দিদি।গল্প মুখে অটোতেই পথ ধরলাম।নীরব ছিল ভাই।ওকে বলি -তোমার কথা মিললো না।আমার বেশ ভালো লেগেছে মন্দিরগুলো।
যাক্,দিদি, ভালো লেগেছে, এটা জেনেও শান্তি।আমার এই পূর্বেই বাড়ি।অটো চলছে।ভাই বলছে। দিদি- দক্ষিণীতেও দর্শক কম।শুধু উৎসাহীরা আসেন।দুটি মন্দির আছে।দুলাদেও,চতোর্ভুজ।দুলাদেও অর্থ নববধূ।পূর্বমুখী এই শিব মন্দির পাঁচ ভাগে গড়ে উঠেছে।ভাই থামলো। আমরা পৌঁছালাম।দুলাদেও মন্দিরে দক্ষিণী ছাপ। স্হাপত্য ভাস্কর্য, কাভিং অনবদ্য। তোরণ দ্বারে গঙ্গা,যমুনা অষ্টবসু, যমরাজ। মন্দিরদ্বারে ব্রহ্মা,বিষ্ণু,মহেশ্বর।মন্দিরের গায়ে মিথুণ মূর্তির বৈচিত্র্য রূপ দেখে বিস্মৃত আমি। অসাধারণ শিল্প।অপলক ছিলাম।ডাকটা কানে এলো -নন্দিতা দেখবে এসো?মগ্নতা ভেঙে ছুটলাম ওর কাছে।মন্দিরের গর্ভগৃহে উঁকি দিতেই দেখছি মা সরস্বতীকে। প্রণাম সারলাম।ভাই বলে-চান্দেল রাজাদের গড়া শেষ মন্দির এই দুলাদেও।
আমি বলি -সে যুগের শিল্প,শিল্পের ভাবনা অকল্পনীয়।
নন্দিতা -এখানে এলে বলে শিল্পকর্ম দেখলে। ফিরে সবাইকে বলবো।দেখে আসুন,খাজুরাহো -এর মন্দিরগুলো।
আমরা এবার দক্ষিণের চতুর্ভুজ মন্দিরের দ্বারে পৌঁছালাম। মন্দিরে বিষ্ণুর রূপের বৈচিত্র্য।পা থেকে কোমর পযর্ন্ত কৃষ্ণ।কোমর থেকে মাথা অবধি নারায়ণ।মাথার মুকুটে শিব। ধ্যানমগ্ন।এসব শিল্প ভাবনায় ভাবিত আমি।অরিন্দম ডাকছে -নন্দিতা, মনে পড়ছে খাজুরাহোতে আসবার আগে অনেকেই মুচকি হেসেছিল।কত কথা।ওসব আবার দেখতে যায় নাকি?মধ্যপ্রদেশে বহু দর্শণীয় স্হান আছে।তবু এলাম।যাক্ শিল্পীর সৃষ্টিকে তো মনে ধরলাম।চাক্ষুষ দর্শণ।এসব দেখার চোখ,অন্তদৃষ্টি থাকতে হবে।
ঘড়ির কাটা একটা।উদরের ডাক এসেছে।অটোতে কুড়ি মিনিটেই পৌঁছালাম পশ্চিমের মন্দিরের দ্বারে।মধ্যাহ্ন ভোজ সারা হলো সেখানেই এক হোটেলে।চাতালে গাছের ছায়ায় বিশ্রাম কিছুটা সময়।গুঞ্জন চলে গেছে।শিল্পী খেলছে।আমি ভাবনার তরীতে বসলাম।এই মুহূর্তে আমি ঢুকে পড়েছি পশ্চিমের মন্দিরগুলিতে।শাস্ত্রীয় দৃষ্টিকোন থেকে গুরুত্বপূর্ণ চৌষট্টি যোগীর মন্দির।সৌন্দর্য্যে অনন্য কান্ডারীয় মহাদেব মন্দির।কিন্তু যে মন্দিরটির টানে পর্যটকেরা, ফটোগ্রফার, আধুনিক মদর্গবী নবীন আসে সেটি লক্ষ্ণণ মন্দির।লক্ষ্ণণ মন্দির নির্মাণ কালে এক লেখকের উপন্যাস 'খাজুরাহো সুন্দরী'।লেখক বাস্তব চিত্র দেখিয়েছেন।মন্দিরের গায়ে সুর- সুন্দরী,মিথুণ মূর্তি নির্মাণের জন্য ভাস্করের মডেল নিয়ে আসতো দাস বাজার থেকে।কনৌজে বিশাল দাস বাজার ছিল।বিভিন্ন রাজ্য থেকে ক্রীতদাসীরা হাজির হতো।সর্বাঙ্গসুন্দর অর্থাৎ অতুলনীয় দেহসৌষ্ঠবের অধিকারিণী নারীদের তুলে আনতো।তারা মন্দির থেকে যাতে পালাতে না পারে পাহারায় থাকতো সেনাদল। নারীদের বাছাই পর্ব চলতো। তাদের মধ্যে এক পরমা সুন্দরী মিত্রাবৃন্দার সাথে আলাপ হয় সেনাদলের প্রধান রাহিলের।মূর্তি বা মন্দির গড়া নয় রাহিল দেখেছিল এক রক্তাক্ষয়ী নাটক।মন্দির নগরীর প্রধান পুরোহিত অনুদেব, প্রধান ভাস্কর চিত্রবান, দাসীদের কলানৈপুণ্য শেখানো, শাসন করায় নিয়োজিত বৃহন্নলা বিকর্ণী বৃদ্ধ ভাস্কর মাহবা এরা মানবনারীর যোনীলোভী কৃষ্ণ বানরের দল।এরা প্রত্যেকেই দাবার ঘুঁটির মত সুন্দরীদের নাড়াচাড়া করতো।ভাবনা টুটে গেলো অরিন্দমের ডাকে -নন্দিতা,তিনটে বাজে।চলো।চোখে জল কেনো?
লজ্জা পেলাম।সত্যি বলতে পারলাম না। নীরবে পশ্চিমের মন্দিরের প্রবেশদ্বারের কাছে পৌঁছালাম।টিকিট কেটে ভেতরে ঢুকতেই যত্নে সাজানো বাগানটি চোখে পড়লো।সবুজায়নের ফাঁকে ফাঁকে ছড়িয়ে আছে মন্দিরাজি।বিদশী পর্যটকদের ভিড়।পশ্চিমের মন্দির দর্শণের জন্য আমাদের গাইড নিতে হলো।গাইডের মুখে তিন ভাষা।আনন্দ হচ্ছিল।চলছে,বলছে।আমরা শুনছি।ভাই নিয়ে এলো যশোবর্মণের তৈরি লক্ষ্ণণ মন্দিরের কাছে।মুহূর্তে আমার চোখে ভেসে উঠলো 'খাজুরাহো সুন্দরী' উপন্যাসটি।ভাই বলেই চলছে।খাজুরাহের মন্দিরগুলিতে কামসূত্রের বিষয়গুলি দেখানো হয়েছে। অনেকের মতে চন্দ্রদেবতা আর হেতম্বীর যৌন মিলনকে স্বর্গীয় বিবেচনা করে স্বর্গের দেবতাদের যৌন আকাঙ্ক্ষাকে ফুটিয়ে তোলা হয়েছে।প্রচলিত গল্প,চন্দ্রের সাথে সহবাসে হেতম্বী ভুগছিলেন। তাঁর পাপাঙ্খলনের জন্যই নাকি চান্দেল রাজ চন্দ্রবর্মণ কামমূর্তি খচিত মন্দির করেন চন্দ্রদেবের নির্দেশে।এই মূর্তিগুলি সবই দেব দেবীদের উদ্দেশ্যে নির্মিত।এই মন্দিরের ইতিহাসের আড়ালে অন্য আর এক রহস্যপূর্ণ কাহিনী আছে।যে মন্দির নির্মাণ হয়েছিল কারও পাপ মোচনের জন্যে সেই মন্দির আবার অভিশপ্ত। এমনি একটি লোককথা শোনা যায় এই অঞ্চলের মানুষের মুখে। আমার হাঁ মুখ ক্রমশ বড় হচ্ছে। ভাই থামেনি। অভিশপ্ত কাহিনী জুড়লো।
খাজুরাহো গ্রামে কোনো এক সময়ে এক সাধু এসেছিলেন। একদিন সাধু তার নিজস্ব কাজে বাইরে গিয়েছিলেন।শিষ্যদের গ্রামে রেখে যান। কোনো কারণে তার শিষ্যরা অসুস্হ হয়ে পড়লে তাদের সাহায্যের জন্যে কোনো গ্রামবাসী এগিয়ে আসেনি।সাধু ফিরে গ্রামের মানুষদের অভিশাপ দেন। পাষাণ হৃদয়ের গ্রামবাসী তোরাও পাষাণ হয়ে থাকবি।চিরদিন। মন্দিরের গায়ে নাকি তাদেরই এই মূর্তিগুলি।তবে গ্রামের একমাত্র মেয়ে সাধুর অসুস্হ শিষ্যদের সাহায্য করেছিল।সাধু আশির্বাদ করে তাকে বলছিল,গ্রাম ছেড়ে চলে যেতে।মেয়েটি সাধুর কথা অমান্য করেই গ্রামে থেকে গিয়েছিল।ফলে সাধুর অভিশাপে সেও পাষাণ হয়।খাজুরাহোতে তারও পাষাণ মূর্তি আজও আছে।
দিদি,এরকম প্রচলিত গল্প অনেক আছে। সন্ধ্যা নামলে খাজুরাহের মন্দিরের কাছে গ্রামবাসীরা কেউ আসে না।পাষাণ হয়ে যাওয়ার ভয়ে।কথা রাখলো ভাই।আমি মন্দিরের গায়ে শিল্পকর্ম দেখছি। মন্দিরের সিলিং -এ লতা,পাতা ফুল, আল্পনার অপূর্ব কাজ। দেওয়ালের গায়ে রণসাজে সেনাদল,যুদ্ধসাজে শিকারী,জীব -জন্তু,অপ্সরা পরিবৃত স্বর্গের দেবতা। মিথুণ মূর্তি। গর্ভগৃহে ত্রিনয়ন আর চতুভুর্জের দেবতা বিষ্ণু।শিল্পের নানা বৈচিত্র্য। আমি মুগ্ধ।এরপর লক্ষ্ণী মন্দিরে আমরা উপস্হিত হলাম।ভাই বলে-আতীতে বিষ্ণুর বাহন গরুড় ছিলেন মন্দিরে।এরপর নয়শো খ্রিষ্টাব্দের তৈরি বরাহ মন্দির দেখা হলো।এখানেও গল্প আছে।মহর্ষ্যি কাশ্যপ আর দিতির পুত্র হিরণ্যাক্ষ ব্রহ্মার বলে বলীয়ান হয়ে পৃথিবী চুরি কে পাতালে যান নিজ ভবনে।দেবতাদের বিভ্রান্ত করতে প্রতিরূপ গড়ে এক হাজার ইঁদুর ছাড়ে হিরণ্যাক্ষ। খুঁজে না পেয়ে দিশেহারা দেবতারা ত্রিভুবনের অধীশ্বর বিষ্ণুর স্মরণ নিতে বরাহ রূপ ধারণ করে মাটি খুঁড়ে হিরণ্যাক্ষকে বধ করে পৃথিবী উদ্ধার করেন বিষ্ণু।মন্দিরের কাহিনী তো থাকবেই। এরপর আমরা এলাম কান্ডারীয় মহাদেব মন্দিরে। 31 মিটার উঁচু শিখরওয়ালা এই মন্দির। মহারাজ বিদ্যাধরের আমলে তৈরি। সালটা 1017 থেকে 1029 -এর মধ্যে। মন্দিরের প্রবেশদ্বারে তোরণ রূপী ফুলের মালা। পাথর কুঁদে তৈরি। মন্দিরের গায়ে উড়ন্ত দেব -দেবী। কামুখ,অপ্সরা,লতাপাতা, সুর- সুন্দরী, শাদূর্ল জীবজন্তু। নারীর বিভিন্ন বেশ। মিথুণ, বীরভদ্র, গণেশ ছাড়াও সপ্তমাতৃকারা মূর্ত হয়েছেন। গাইড ভাই বলে-ব্রিটিশ প্রত্নতত্ববিদ কানিংহামের গণনায় মন্দিরের ভিতরে 226 টি আর মন্দিরের বাইরে 646টি মূর্তি রয়েছে। কষ্টি পাথরের দেবতা শিব গর্ভগৃহে। মূর্তির উচ্চতা এক মিটারের মত। ভারতের সুবর্ণযুগের এক নিখুঁত দলিলের প্রতিচ্ছবির রূপ পেয়েছে নিখুঁত ভাস্কর্যে। পশ্চিমের সবচেয়ে বড় মন্দির এটি। কথা রেখে ভাই চললো।পিছু নিলাম আমরা।আমরা এগারো শতকের দেবতাহীন মহাদেব মন্দিরে পৌঁছালাম। দেখছি মন্দিটি বিধ্বস্ত।এখানে চান্দেল রাজাদের অতীত বিক্রম খালি হাতে সিংহকে সোহাক করছেন। সেটিকে মূর্তি করে ধরে রিখা হয়েছে পাথরে।অপলক আমি।ভাই মগ্নতা ভাঙলো। বলে ঐতিহাসিকদের মতে এইটি নাকি চান্দেলা রাজবংশের প্রতীক।এরপর দেখা হলো ঢঙ্র পুত্র গন্ডদেবের পিরিয়ডধর্মী জগদম্বীর মন্দির। মূল দেবতা বিষ্ণু।সঙ্গী তার শার্দূল। আছে পার্বতী, কালো রঙের কালী জগদম্বী গর্ভগৃহে যমরিজ পদ্মহাতে কালো রঙের ধনদৌলতের অধিষ্ঠাত্রী দেবী লক্ষ্ণী জগদম্বী।ভাই এবার নিয়ে এসেছে চিত্রগুপ্ত অর্থাৎ সূর্য মন্দিরে। গর্ভগৃহে মূল দেবতা সাত ঘোড়ায় টানা রথে পদ্ম হাতে সূর্যদেব।এরপর বিশ্বনাথ মন্দির দেখা হলো।গর্ভগৃহে বিশ্বনাথ নয় আছে শিবমূর্তী। উত্তরে প্রবেশদ্বারে জোড়া সিংহ।দক্ষিণে পধবেশ পথজোড়া হাতি।পাহারারত।গর্ভগৃহে পার্বতী।মকরবাহিনী দেবী গঙ্গা।অতীতে বিষ্ণু ছিল।লর্ড মতাঙ্গেশ্বর মন্দিটিও ভালো। ভাই দেখালো চৌষাট যোগিনী মন্দির।মন্দিরে ধ্বংসের দেবী কালী যোগিনী রূপে পূজা পেতেন অতীতে। 64 জন যোগিনী দেবী সেবায় নিযুক্ত ছিলেন। গর্ভগৃহে আছে ব্রাহ্মণী মহেশ্বরী মহিষমর্দিনী।লালা কুঁয়া মহাদেব আজ বিধ্বস্ত।এরপর প্রতাপেশ্বর মন্দিরের সামনে দাঁড়াতে হলো।দিদি,বলতে লজ্জা নেই,কিছু কথা আছে।খাজুরাহো-এর মন্দিরগুলিতে দশ ভাগ যৌনমূর্তী। মিলনরত এই ভাস্কর্যগুলো বোঝায় হিন্দু সম্প্রদায়ের বিশ্বাসের কথা। যৌনতি অপবিত্র নয়। লজ্জা শয়। যোন ক্রিয়া থেকেই বংশবিস্তার হয়। বিশ্বকে পরিচালিত করে যে শক্তি সেই মানব পৃথিবীতে আসে। তাই সেই সময় এই প্রক্রিয়া তাদের কাছে পবিত্র।ঐশ্বরিক,পূজনীয়।ইএ মন্দির তৈরি হয়েছে কার নির্দেশে।এই নিয়ে নানা কথা।কেউ বলে-চন্দ্রদেবের আদেশে চন্দ্রবর্মণ মন্দির গড়েছেন।কেউ বলছেন মায়ের আদেশ।যাই হোকচন্দ্রবর্মণ মানুষের প্রেম আবেগ জীবনের চিত্র তুলে ধরতে খাজুরাহো-এর মন্দির গড়েছেন।এটাই শেষ কথা।হিন্দুদের চারটি জীবনের লক্ষ্য।ধর্ম অর্থ কাম মোক্ষ।ভাই একটু নীরব থেকে আবার অন্য কথা ধরে।খাজুরাহো-এর প্রতিটা মন্দির একটা উঁচু চাতালের উপর গড়া।একে জাগতি বলে।জাগতি থেকে মেঝে পযর্ন্ত উঁচু অংশকে অধিষ্ঠান বলে। ভূমি থেকে অধিষ্ঠান পযর্ন্ত সিঁড়ির ধাপকে চন্দ্রশিলা বলে। এখানে কিছু মন্দিরে প্রদক্ষিণ চলে। প্রতিটি মন্দির পূর্ব থেকে পশ্চিমে বিস্তৃত। শুধু চৌষটি যোগিনীর মন্দির ব্যতিক্রম। মন্দীরগুলি পূর্বমুখী প্রবেশ পথ।দিদি খাজুরাহোতে ডান্স ফেস্টিভ্যাল -এর বিশ্বজোড়া খ্যাতি প্রতিবছর ফ্রেবুয়ারিতে এই উৎসব হয়।অপূর্ব আয়োজন।একবার আসুন।
আমি বলি -ইচ্ছে থাকলো।
ভাই আনন্দমুখে চললো।আমরা মন্দিরের কাছ থেকে বেরিয়ে উদ্যানের ছাটা ঘাসের উপর বসলাম। শিল্পী আপন খেয়ালে খেলছে।অরিন্দম তৃষ্ণা মিটিয়ে বলে-কি হলো এত চুপচাপ।মন ভরেনি।
আমি মুখ তুলে বলি-জানো,কোথায় যেন পড়েছি।এখন মনে পড়ছে না।মন্দিরের নগ্ন মূর্তিগুলি শিল্পীদের কল্পনায় নয়। সব রক্ত মাংসের মানুষ। জীবন্ত মডেল সামনে রেখে নির্মাণ করতো শিল্পীরা।শিল্পের অধিকার শিল্পীর ছিল না।সেসব নির্দেশ ছিল রাজা স্বযং,বাস্তুকার,রাজপুরোহিতের।মন্দির নির্মাণ কাজে যুক্ত ভাস্কর মজুরদের বন্দীজীবন কাটাতে হতো।নারীসঙ্গ থেকে বঞ্চিত। দীর্ঘদিন ধরে নারীসঙ্গহীন ভাস্কর মজুরের দল মন্দির গাত্রে তারা ছেনি হাতুরের মাধ্যমে এসব মূর্তি গড়ে তৃপ্তি পেতো।
নন্দিতা,কাজের সমালোচনা থাকবে।ওসব ভেবে লাভ নেই।তবে গজনীর সুলতান মাহমুদ এসেছিল মন্দির লুন্ঠনের উদ্দেশ্য।
কি আর বলি অরিন্দম।কার কি উদ্দেশ্য।চলো আমাদের মূল উদ্দেশ্যে চলি এবার।
এখন সন্ধ্যা সাতটা। আমরা লাইট অ্যান্ড সাউন্ডের মঞ্চে বসলাম।দর্শকাসনে বিদেশীদের মুখ বেশী। শুরু হলো গুরু গম্ভীর সুরে। ভাষ্যপাঠে বলিউডের মেগাস্টার অমিতাভ বচ্চন মহাশয়। চান্দেলা রাজ কাহিনী বলছে। আলো জ্বলছে নিভছে ছুটছে।আমাদেরও চোখ সেই খেলায় ছুটছে।জীবন্ত হয়ে উঠছে কাহিনী। অদ্ভূত এই সৃষ্টি। এই উদ্ভাবনীর সৃষ্টি কর্তাকে শ্রদ্ধা জানাতেই হয়।সুন্দর মুহূর্তে কিছুটা সময় কাটলো।শো শেষ।ফিরছি আনন্দ মুখে।কথা ছিল আমার অরিন্দম, এক লেখকের কথা। ভ্রমণের নানা মুখ। কেউ দেখে কেউ দেখে না। ভ্রমণে মনন চক্ষু উপলব্ধি সংবেদন প্রয়োজন।
নন্দিতা ঠিক বলেছো। এখন দেখাই যাক।ফিরে গিয়ে খাজুরাহো কি মূর্তিতে উঠে আসে তোমার কলমে।
============