ভাগ্যচক্র
সুচন্দ্রা বসু
আমি আমার ঘরে ফুল স্পীডে পাখার নীচে বসে মোবাইল ঘাঁটছি। কিছু দেখছি কিছু মিস করে যাচ্ছি।মনটা যেন ভেঙে গেছে। সব কাজই মূল্যহীন লাগছিল। ভালো লাগছিল না মোবাইল ঘাঁটতেও।
উদাস মনে ভেবে চলেছি ফেলে আসা মুহূর্তগুলোকে। বারবার কথাটা মনে ঘুরপাক খাচ্ছিল যে ঈশ্বর পরিকল্পিত পথেই আমরা চলেছি। তার ইচ্ছার বিরুদ্ধে আমাদের কোন ইচ্ছাই সফলতা পায় না।
এতোটাই আমি অমনোযোগী ডোরবেল কানে আসেনি। পাশের ঘরের দরজা খুলে বন্ধ করার শব্দটায় আমি মোবাইল থেকে মুখ তুলে দেখলাম তাপসী আমার ঘরে আসছে।আমি চেয়ার থেকে উঠে দাঁড়ালাম। তাপসী আমার কাছে এসে জড়িয়ে ধরে বলল, আমাদের ডিভোর্স হয়ে গেছে মনে হচ্ছে। এ কথা কেন বলছো? আমাদের কতদিন দেখা হয় না। গল্প হয় না। একসাথে ঘুরতে যাওয়া হয় না। ঘরের মধ্যেই নিজেকে বন্দী করে রেখেছ কেন? জানতেই এলাম।
মুখ তুলে ওর দিকে তাকাতেই বলল, ইস তুমি যে বুড়িয়ে গেছ দেখছি। এভাবে বুড়িয়ে ফেলছো কেন নিজেকে। আয়নায় দেখেছো নিজেকে?
আমি শুধু বললাম - সব তাঁরই ইচ্ছে।
তাপসী বলল - এ কথা মোটেই ঠিক নয়। তার ইচ্ছায় কিছুই হয় না।আমাদের ইচ্ছায় আমাদের জীবন গড়ে নিতে হয়। জীবনে ঝড় আসবেই। আর সেই ঝড় সামলে উঠে দাঁড়াতে হবে নতুন করে।
আমি বললাম- জানি , ঈশ্বরই দেখাবে সেইপথ।
- তবে আর কি! তুমি চোখ বুঁজে থাকলে, তিনি আর দেখাবেন কি করে? যাকগে তুমি কাল চলে এসো আমার বাড়িতে।আমি দেখাব।
আমি বললাম- মানে!
তাপসী বলল, কাল টি পার্টির আয়োজন করেছি। সন্ধ্যায় আমরা আবার আগের মতো জমিয়ে আড্ডায় বসবো।
- এখন তো বস। আমি চা করে আনি।
- মরা মনের ওষুধ বন্ধুই দিতে পারে, ভালবাসায়।
- তবে তুমি বলছো তুমি এখন আমার একমাত্র প্যারাসিটামল!
- হ্যাঁ গো। তোমার মনকে আমি সতেজ করে তুলব।
- আমি অনেকেরই প্যারাসিটামল।
পরদিন সন্ধ্যায় গেলাম ওদের বাড়ি। ভেজিটেবল চপ ডিমের ডেভিল প্লেটে সাজিয়ে টেবিলে রাখল। আমার দিকে তাকিয়ে বলল,মানুষের সমালোচনা করতে একটা মুখই যথেষ্ট, কিন্তু মানুষকে বুঝতে গেলে বা বিচার করতে গেলে প্রয়োজন মনের গভীরতা। মনের গভীরতা না থাকলে বিবেক ও মনুষ্যত্ব বিকাশ লাভ করে না। জানো ঘর পুরলে দেখে তো সবাই। মন পুড়লে দেখার চোখ নাই।
- ঠিকই বলেছো প্রতিটা মানুষ বাইরের চরিত্রটাই দেখে সবাই।
তাপসী বলল, শাশুড়ি কখনো মা হয় না। কথাটা কি সত্যি?
- কেন বল তো শাশুড়ি বৌমার মা হবে? তিনি কি তার জন্ম দিয়েছেন? তাকে কি তিনি মানুষ করেছেন? তার বেড়ে ওঠা পথ চলা কিছুই তিনি জানেন না।
- তবে কি বৌমার এই মায়ের আবদারটাই ভুল?
- আচ্ছা তুমিই বল কোন মেয়ের মা তার জামাইয়ের মা হতে পারবেন ?
- তবে তুমি বলছো একজন শাশুড়ি মা কেবল ভালো মানুষ হতে পারেন।শুভাকাঙ্ক্ষী গুরুজন, ভালো অভিবাবক হতে পারেন। ভালো সম্পর্ক রাখার জন্য ভালো মন দরকার।
আমি বললাম - জানো , সম্পর্ক গড়তে গিয়ে যদি সে সম্পর্ক অশান্তির হয় তবে সে সম্পর্ক না করাই ভালো। তা সে আত্মীয় হোক বা বন্ধু বা কাছের মানুষ। জীবনে খুব কম মানুষ থাকে যারা খাঁটি হয়।সেটা পাওয়া ভাগ্যের ব্যাপার।
- তুমি যাকে ভাগ্য বলছো,তা হল অভিমান আর অপূর্ণ ইচ্ছার সমাহার।সাথে থাকে বেদনা সমালোচনা হারিয়ে যায় স্বপ্ন রয়ে যায় কষ্ট সেই সাজানো স্বপ্ন ভাঙার।এটাই বাস্তব বলল তাপসী।
ওর কাকীমা মানসিক সমস্যার জন্য ওষুধ খেতেন।তিরিশ বছর বয়সী ছেলের ব্লাড ক্যান্সার ধরা পড়ায় তিনি আরও মানসিকভাবে ভেঙে পড়লেন। কাকা একা ছেলে ও স্ত্রীকে সামলাতে গিয়ে নিজেই চলে গেলেন পরপারে। কাকা বুঝতে পারছিলেন তিনি অসুস্থত।কিন্তু চিকিৎসকের কাছে যাওয়ার আগেই চলে গেলেন।
তাই এ কথা মানতেই হয়, যে ঈশ্বর পরিকল্পিত পথেই আমরা চলেছি।
তাপসী বলল, তা কেন হবে! মানুষের জীবনে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ মুহূর্ত হচ্ছে নিজের মনের সাথে যুদ্ধ করে সঠিক সময়ে সঠিক সিদ্ধান্ত নেওয়া। তাহলে ভাগ্যচক্র ঘুরে যেতে পারে।
==================
সুচন্দ্রা বসু
২৬৭/৫ জি.টি.রোড পানপাড়া
শ্রীরামপুর, হুগলি।