নিবেদিতার রোজনামচা
দীপক পাল
ট্রেন থেকে দমদম জংশন স্টেশনের দু'নম্বর প্লাটফর্মে নেমে নিবেদিতা প্ল্যাটফর্মের পেছন দিক দিয়ে নেমে দুদিকে সন্তর্পণে তাকিয়ে পটাপট লাইনগুলো টপকে সিঁড়ি দিয়ে নেমে কালী মন্দিরের পাশ দিয়ে যেতে যেতে অভ্যাস মতো ডান হাতটা কপালে ঠেকিয়ে নিলো।
দাঁড়িয়ে মা কালীর উদ্দেশ্যে দুহাত জড়ো করে বিড়বিড় করলো। তারপর ছোট মেয়ের কথা চিন্তা করে চলার গতি বাড়িয়ে দিলো। মেয়েকে একটা ভালো ইস্কুলে ক্লাস ওয়ানে ভর্তি করে দেওয়া হয়েছে এবারে। আজ তার দ্বিতীয় দিন। তাড়াতাড়ি স্কুল ছুটি হয়ে যাওয়াতে সেও বাড়ি ফিরেছে নিবেদিতা ছেলেকে নিয়ে বেরোবার আগে। ছেলে অরিজিতও মেয়ে তিতলির স্কুলেই পড়তো ক্লাস ফোর পর্য্যন্ত। এবারে অরিজিতকে রহরা রামকৃষ্ণ মিশনে ভর্তি করা হয়েছে। এখানে অ্যাডমিশন টেস্টে ও চতুর্থ স্থান পেয়েছে। এতে নিবেদিতার একটু গর্বও হয়েছে। হবে নাইবা কেনো। সারা পশ্চিমবঙ্গ থেকে কম ছাত্র তো পরীক্ষা দেয়নি। তাদের মধ্যে চতুর্থ হওয়া গর্বের ব্যাপার বৈকি। আজ ক্লাসের তৃতীয় দিন। আবার বিকেলে আনতে যেতে হবে। 'অরু তুই বাবা আমার কোনো কারণে আসতে দেরী হলে এই সামনের বেঞ্চে একটু বসিস কেমন? আমাকে এসে যেনো খুঁজতে না হয়। ' এই কথাটা অরুকে বলে এসেছে। অরুর বাবার তো একদমই ইচ্ছে ছিলনা এখানে অরুকে ভর্তি করার। কারণ ছেলের কষ্ট হবে ভীষন। এত ছোট বাচ্চাকে ডেইলি প্যাসেঞ্জারি করতে হবে বলে। ট্রেনে উঠতে নামতে যদি কিছু হয়। বেশির ভাগ লোকের কোনো
কান্ড জ্ঞ্যান নেই। ঠেলাঠেলিতে যদি পরে যায়। তখন কি হবে। নিবেদিতা একরকম জোর করেই অরুকে এখানে ভর্তি করিয়েছে। এখন সে বুঝতে পারছে কি কষ্ট। কষ্টতো তারও হচ্ছে। চারজনের সংসার সামলে অরুকে স্কুলে দিয়ে আসা আবার নিয়ে আসা এটা কি করে সম্ভব দিনের পর দিন। আবার এদিকে বাড়ি থেকে স্টেশন আর ওদিকে স্টেশন থেকে মিশন যেতে অনেকটা রাস্তা হাঁটতে হয়। এর একটা বিকল্প ব্যবস্থা করতেই হবে। এইসব ভাবতে ভাবতে বাড়ির কাছে এসে গেলো। কলিং বেল এখনো লাগানো হয় নি তাই করা নাড়ল, কিন্তু কোনো সাড়া নেই।
' তিতলি তিতলি ' বলে দুবার ডাকতেই শাশুরিমার ঘরের জানলায় খাটের ওপর তিতলিকে দেখা গেলো। সে বলে, -' মা, ঠাম্মি অনেক পটি করে বাথরুমেও শুয়ে আছে আর উঠতে পারছে না। আমি ঠাম্মিকে তুলতে পারছি না।
-' সেকিরে এখন কি হবে? আমি এখন ঘরে ঢুকবো কি করে?' ভয়ে নিবেদিতার মুখটা শুকিয়ে যায়। সকালে তো শাশুরিমাকে একবারই পটি করতে দেখেছে সে। কিন্তু সে এখন ঘরে ঢুকবে কী করে। পাড়ায় এখন পুরুষেরা সব অফিস কাছারিতে বেরিয়ে গেছে। কাউকেই পাওয়া যাবে না এখন। ওদিকে তিতলি চিৎকার করে বলে আবার,-' মা তুমি ওখানে দাঁড়াও আমি দরজা খুলছি।'
-' তুই কি করে দরজা খুলবি ? ছিটকিনি যে ওপরে। খিলটা কি দেওয়া?'
-' না, ঠামমি ছিটকিনি দিয়ে দিয়েছে।'
-' তাহলে তুই ছিটকিনি কি করে খুলবি?'
-' আমি পারবো মা। ড্রেসিং টেবিলের টুলটা নিয়ে যাবো।'
-' না সোনা, ওই টুলটা খুব ভারী। ওটা নিয়ে নামতে গেলে
তুই সিঁড়িগুলো দেখতে পাবি না একদম। তাই ওটা নিয়ে নামতে গেলে তুই সিঁড়ি থেকে একদম নিচে গড়িয়ে পরবি তখন আমি কি করবো। আমি তখন তোকে দেখতে পাবো না ধরতেও পারবো না। খুব বিপদ হবে তখন।'
ভয়ে কাঁপছে নিবেদিতার শরীর। অসহায় ভাবে এদিক ওদিক তাকালো কিন্তু কাউকেই দেখা যাচ্ছে না। তিতলিকেও আর জানলায় দেখা যাচ্ছে না। সমূহ একটা বিপদের গন্ধ পাচ্ছে যেনো। চেঁচিয়ে ডাকল, ' তিতলি ' ।
দরজার গায়ে কি যেনো একটা শব্দ হলো না? তারপরেই ভেতর থেকে ছিটকিনি খোলার আওয়াজ পাওয়া গেলো।আশার আলো দেখছে নিবেদিতা। দরজা ঠেলতে সাহস পাচ্ছে না। কি জানি তিতলি কি অবস্থায় আছে। টুল সরানোর আওয়াজ আর তারপরেই দরজা খুলে গেলো।
-' মা আমি দরজা খুলেছি। আমি পেরেছি ওই টুল দিয়ে।'
-' আরে, কি করে পারলি তুই? আমিতো ভাবতেই পারছি না একদম।' নিবেদিতা মেয়েকে কোলে তুলে নিলো। চুমায় চুমায় ভরিয়ে দিলো মেয়েকে।
-' তুই ওই ভারী টুলটা নিয়ে সিঁড়ি দিয়ে নামলি কি করে? ওটা বুকে করে ধরলে তো সিঁড়িগুলো দেখতে না পাওয়াই সম্ভব। তারপর ওখানে জুতোর বাক্স একটা।'
-' আমি পা টিপে টিপে দেওয়াল ঘেঁসে নেমেছি। আর জুতোর বক্সের কাছে টুলটাকে নামিয়ে ছিলাম। তারপর আবার দেওয়াল ঘেঁষে ঘেঁষে পা টিপে টিপে নেমেছি।'
-' তুই যে আমায় কি বিপদ থেকে রক্ষা করেছিস তা তুই আরো বড়ো হলে বুঝবি।'
-' মা ঠাকুমা বাথরুমে শুয়ে আছে।'
-' চল চল ওপরে তাড়াতাড়ি।'
ওপরে উঠে তড়িঘড়ি বাথরুমে যেতেই নিবেদিতা হতবাক হয়ে যায়। দুর্গন্ধে বাথরুমে ঢোকার উপায় নেই। কিন্তু উপায় নেই ভেবে তো বসে থাকলে চলবেনা। ভেতরে গিয়ে আগেই Flushটা টেনে দিল। তারপর শাশুড়ি মাকে উঠিয়ে ভালো করে জল ঢেলে দিলো। তিনি কাঁপতে কাঁপতে নিজে কোনোমতে কাপড়টা নিচে ফেলে দিয়ে নিবেদিতার ঢেলে দেওয়া জলে পরিষ্কার হলেন। সাবান ভালো করে নিবেদিতা লাগিয়ে দেওয়ায় উনি স্নান করতে করতে কাপড়টা কোনোমতে সাবান দিয়ে থুবিয়ে দিলেন।নিবেদিতা তাকে কাচা কাপড় পরিয়ে দিয়ে ধরে ধরে এনে ঘরে শুইয়ে দিলো। শাশুড়ির শরীরটা বেশ গরম লাগলো।
-' চুপ চাপ শুয়ে থাকুন, আমি ডাক্তার ডেকে আনছি।
তিতলি তুই ঠম্মির পাশে থাক আমি আসছি।'
যেতে যেতে নিবেদিতা ভাবতে লাগলো সকালে এত কাজের চাপে এদিকটা ঠিক খেয়াল করে নি সে। সঞ্জিত সকাল সাতটায় বাজার করে আনার পর সেই যে সে রান্নাঘরের কাজে ব্যস্ত হয়ে পড়লো। নিশ্বাস ফেলার একটুও সময় পায় নি। তবে হঠাত মনে পড়লো শাশুড়ি কিন্তু একবার রান্নাঘরে আসে, আজকে তো আসেনি। বাজার করে এসে সঞ্জিত খবরের কাগজ নিয়ে বসে। অন্যদিন তিতলি ঠিক সেই সময় সঞ্জিতের পাশে বসে ওর সাথে সমানে বকবক করে। যত কথা তার বাবার সাথে সেই সময়। কাগজটা সেই জন্য সঞ্জিতের পড়া হয় না। আজকে তো তিতলি ছিল না তাই একটু কাগজ পড়ায় মন দিয়েছিল। তারপর সাড়ে সাতটায় বাথরুমে ঢোকে কারণ এরপর অরুকে ঢুকতে হয়। তাই সেও কিছু টের পায়নি। সঞ্জিত বেরোবার ঠিক আগে তিতলি চলে আসে স্কুল ছুটি দিয়ে দেওয়ায়। তিতলি ও আরও দুজন নবীনের রিক্সায় যাতায়াত করে ইস্কুলে। সঞ্জিত তিতলির ইউনিফর্ম, জুতো মোজা খুলে অন্য জামা পরিয়ে দিয়ে সবার সাথে টা টা করে বেরিয়ে যায়। এরপর অরিজিৎ খেতে বসে। নিবেদিতা অরিজিতের সাথে তিতলিকেও বসিয়ে দিলো। শাশুড়ি মাকে রুটি তরকারি দিয়ে আসলো ওনার ঘরে। তারপর অরুর টিফিন গুছিয়ে দিলো। সে প্লেটে রুটি তরকারি নিয়ে ঘরে ঢুকে জামা কাপড় পরতে পরতে একটু খেয়ে নিয়ে অরুকে নিয়ে বেরিয়ে পড়লো। যাবার সময় শাশুড়িমাকে বলে গেলো,
-' তিতলিকে রেখে গেলাম আপনার কাছে। যদি পারেন নিচের দরজায় ছিটকিনি লাগিয়ে দেবেন।' আহা কেনো যে বলতে গিয়েছিল। আজ যদি বড়ো কোনো অঘটন ঘটে যেত? ডাক্তার দত্তকে সে ভালো রকম চেনে। তিনি ছোটবেলা থেকেই নিবেদিতার বাপের বাড়ির ডাক্তার।
তিনি এসে শাশুরিমাকে ভালো করে দেখলেন। বললেন,
-' সেরকম কিছু হয়নি। তুইতো ভয় পাচ্ছিস ছেলেকে আনতে যাবি কিন্তু এর মধ্যে যদি কিছু হয়। হবেনা। আমি একটা ইনজেকশন দিচ্ছি আর একটা প্রেসক্রিপশন লিখে দিচ্ছি, ফেরার সময় ওষুধগুলো নিয়ে আসিস তা তাহলেই হবে কেমন। আমি এখন আসি। তোকে যেতে হবে না আমার সাথে। এমনিতেই তোর সময় হয়না,চলি কেমন।' বলে ডাক্তার বাবু বেরিয়ে গেলেন।
এবার নিবেদিতা অত্যন্ত দ্রুততার সাথে পরনের জামাকাপড় পাল্টে নিলো। এটাপরে একটু পরে বেরোবে ঠিক করলো। আগে মেয়েকে স্নান করিয়ে দিল। তারপর জামাকাপড় নিয়ে বাথরুমে ঢুকলো। শাশুরির কাপড় চোপড় আগে আরও একটু ভালো করে ধুয়ে বাইরে মেলে
দিয়ে আসলো। তারপর নিজেরটা ও তিতলির গুলো ধুয়ে একেবারে স্নান করে আসলো। শাশুরির জন্য থালায় ভাত নিয়ে সেটাকে ভালো করে চটকে তার ওপর আজ জ্যান্ত মাছের ঝোল হয়েছে, সেই ঝোল ভাতের ওপর ঢেলে দিয়ে ভালো করে মেখে পাশে মাছের টুকরোটা রেখে শাশুরির ঘরে ঢুকে তার মাথার পাশে রাখা ছোট টেবিলটায় রেখে বলল,
-' এবার উঠে এই মাছ ভাতটা ভালো করে চিবিয়ে খেয়ে নিন দেখবেন শরীরটা একটু ভালো লাগবে। আমি আর তিতলি এখন খেতে বসছি। কিছু লাগলে বলবেন।'
এবার মেয়েকে নিয়ে খেতে বসল। খেতে খেতে মেয়ের সাথে কথা বলতে লাগলো। এই আজকে স্কুলে কি হলো। খালি গল্প আর খেলা হয়েছে শুনে একটু হাসলো।
-' তাহলেতো আজ স্কুলে খুব মজাই হয়েছে। ভালো। আজ জানিস আমার একটুও বিশ্রাম হবে না। এখুনি আমায় খেয়ে দেয়ে বেরোতে হবে। একজন মহিলাকে দেখেছি কালকে মিশন স্কুল থেকে একটা ছেলেকে নিয়ে দম দম স্টেশনে নেমে সামনের ওভার ব্রিজে উঠতে। আর একটা ছেলেকে দেখেছি কয়েকটা ছেলেকে নিয়ে পেছন দিকের ওভার ব্রিজে উঠতে। ওই ওদের একজনকে যদি রাজি করাতে পারি অরুকে আনা নেওয়া করা তবে খুব উপকার হয়।
-' তখন কি হবে মা।'
-' তবে তোর সাথে অনেক সময় থাকতে পারবো। দুপুরে তোকে লেখাপড়া করাবো, হোম টাস্ক থাকলে করিয়ে দেব তারপর তোকে নিয়ে ঘুমাবো। দাদা স্কুল থেকে আসলে, টিফিন করে দাদার সাথে খেলা করবি বাকি বিকেলটায়।'
-' কি মজা হবে তাইনা মা? দাদা আসলে খেলা করবো।'
-' ঠিকই তো। খাওয়া হয়ে গেছে এবার ওঠ। হাত মুখটা ধুয়ে নে। আমি থালা বাসনগুলো সিনকে রেখে আসি।'
থালা বাটি গুলো সিনকে রেখে শাশুড়িমার খাওয়া থালা গ্লাসটা সিঙ্কে রেখে জায়গাগুলো মুছে হাতমুখ ধুয়ে ঘরে ঢুকলো। মেয়েকে বললো এই তালাটা এই ঘরে এই চাবিটা দিয়ে লাগাতে পারবি কিনা দেখ। ও সেটা লাগিয়ে এবং খুলে দেখালো। নিবেদিতা খুশি হলো।
-' বেশ বেশ। আমি বেরিয়ে গেলে এই ঘরে তালা লাগিয়ে ঠম্মির ঘরে গিয়ে ভেতর থেকে খিল দিয়ে দিবি তারপর ঠামির পাশে শুয়ে পরবি। আমি না আসা পর্যন্ত কেউ ডাকলেও খুলবি না। কাল দেবু এসে সিঁড়িতে গ্রিল দেবে তখন আর কোনো ভয় থাকবে না, বুঝলি। আমি পাশের বাড়ির কাকিমাকে বলে যাবো এদিকটায় একটু নজরে রাখতে। কোন ভয় নেই।'
একটুখানি বসে নিবেদিতা আবার বেরোবার জন্য আস্তে আস্তে রেডী হতে লাগলো। রেডী হয়ে একবার শাশুড়ি মায়ের ঘরে ঢুকে দেখলেন তিনি ঘুমোচ্ছেন। না ডেকে বেরিয়ে এলো। মেয়ের মাথায় হাত বুলিয়ে গালে চুমু খেয়ে বলে, ' এবার আমি আসি কেমন। সাবধানে থাকবে। একটু ঘুমিয়ে নেবে। ' বেরিয়ে গেলো নিবেদিতা।
তিতলি দৌড়ে বারান্দায় গিয়ে দাঁড়ালো। নিবেদিতা নিচের দরজার পাল্লা দুটো এক করে জোরে টেনে দিল। বাইরের গ্রিলের গেটটা খুলে বেড়িয়ে গিয়ে গেটটা লাগাতেই ওপর থেকে তিতলি চেঁচিয়ে উঠলো,
-' টাটা মা, তাড়াতাড়ি আসবে।' নিবেদিতা ওপরে তাকাল
-' হ্যাঁ তাড়াতাড়ি আসবো। তুমি ঘরে তালা দিয়ে দাও।'
-' দিচ্ছি, তুমি যাও আমি দেখছি।
নিবেদিতা ' রুপা রুপা ' বলে ডাকতেই বারান্দায় রুপা কাকিমা এসে দাঁড়ালো। ' কি বৌদি '। নিবেদিতা বললো, ' আমি অরুকে স্কুল থেকে আনতে যাচ্ছি, তুমি বাড়িটার দিকে একটু খেয়াল কোর।'
-' আচ্ছা খেয়াল রাখবো, আপনি এগোন।' তারপর চোখ ফেরাতেই তিতলিকে দেখতে পেল।
-' কিরে তিতলি মা বেরোলো বলে কষ্ট হচ্ছে তোর?'
কোনো উত্তর না দিয়েই তিতলি দৌড়ে ঘরে ঢুকে গেলো।ঘর থেকে শুনতে পেল মা কাকিমাকে বলছে,
-' দেখেছো রুপা কিরকম অসভ্য মেয়ে। তোমার কথার কোনো উত্তর দিলনা। আমি ঘুরে আসি তখন দেখবো।'
-' আপনি যান তো বৌদি, ওইটুকু মেয়ে কি বোঝে।'
তিতলি বড়ো ঘরটায় তালা লাগিয়ে ঠাকুমার ঘরে ঢুকে ভিতর থেকে দরজা বন্ধ করে ঠাকুমার পাশে শুয়ে পড়লো। খেয়াল করলো ঠাকুমা ওর মাথায় হাত বুলিয়ে দিচ্ছে। অরিজিৎকে নিয়ে যখন ফিরলো দেখে দরজায় তালা লাগানো আর ছোট ঘরটা বন্ধ। কিন্তু খিল খোলার আওয়াজ পাওয়া গেলো। দেখে শাশুরিমা সামনে। তিতলি ঘুমোচ্ছে। অরু ঘরে ঢুকে ঠাকুমার দিকে তাকাল
-' কি ঠাকুমা তোমার নাকি শরীর খারাপ। এখন কেমন লাগছে তোমার?'
-' দুর্বল লাগছে, মাথাটা তুলতে কষ্ট হচ্ছে। তুই বস।'
- ' মা তোমার জন্য ওষুধ এনেছে। সব ঠিক হয়ে যাবে।'
নিবেদিতা ঘরে ঢুকলো। জল আর ওষুধ নিয়ে।
-' মা এই ট্যাবলেটটা জল দিয়ে গিলে ফেলুন এখন, আর এই ট্যাবলেটটা চা খাওয়ার সময় মনে করে খাবেন। এই সব ওষুধগুলো টেবিলের ওপর রাখলাম।'
এই সব কথাবার্তা চলা কালীন তিতলির ঘুমটা ভাঙলো। উঠে বসলো। বালিশের তলা থেকে বড়ো ঘরের চাবিটা নিবেদিতার হাতে দিতে সে বড়ো ঘরে চলে গেল।
অরুও উঠছিল হঠাৎ তিতলির দিকে তাকিয়ে বললো,
-' এই তিতলি, তুই নিচের দরজাটা খোলার অসম্ভব এই কাজটা কিকরে করলিরে একটু বলবি? আমি হলে তো পারতাম না নিশ্চই।' তিতলি খাটের ওপরে দাঁড়িয়ে বলে,
-' জানিস দাদা ভাই আমিনা টুলটা এই ভাবে নিয়েছিলাম। তারপর দেওয়ালের গায়ে ঘষে ঘষে এক পা এক পা করে সিঁড়ি দিয়ে নেমেছি, তারপর জুতোর বাক্সটা আছে না সেখানে টুলটা নামিয়েছি। আমিতো দেখতে পাচ্ছিলাম না তাই টুলটা নামাতে গিয়ে আমি তখন পরে যাচ্ছিলাম, কিন্তু আমি পড়িনি। তারপর আবার টুলটা তুলে দেয়ালে গা ঘোষতে ঘোষতে নিচে নেমে দরজাটা খুলেছি। আমার হাতে তখন ব্যথা করছিল।'
-' ওরে বাসরে, তুইতো দুর্দান্ত কাজ করেছিস। তোর কি বুদ্ধি আর কি সাহস। এর জন্য তোর পুরস্কার নিশ্চিত প্রাপ্য। এই নে জেমসের প্যাকেট, মা দিয়েছে। আর এটা আমার, তোর বীরত্বের জন্য আমারও পাওনা হয়েছে। অবশ্য খালি তোর জন্য মা আর একটা পুরস্কার এনেছে।'
-' কিরে দাদাভাই?'
-' একটা বড়ো রং পেন্সিলের বাক্স।'
এমন সময় নিচে দরজা খোলার আওয়াজ আর তার সঙ্গে বাবার কণ্ঠস্বর শোনা গেলো।
-' তিতলি তিতলি, কোথায়।' তিতলি লাফ দিয়ে খাট থেকে নেমে দৌড়ে সিঁড়ির মাথায় গিয়ে বলে,
-' এই যে আমি। জানো বাবা ঠাম্মী বাথরুমে পটি করে পাশেই শুয়ে ছিল। নিচে দরজা বন্ধ ছিল। আমি ড্রেসিং টেবিলের টুলটা নিয়ে সিঁড়ি দিয়ে নেমে না দরজাটার ছিটকিনি খুলে দিলাম। তারপর ঠাম্মিকে ধরে তুলে স্নান করিয়ে দিলো তারপর ডাক্তার কাকুকে আমাদের ঘরে নিয়ে আসলো। ডাক্তার কাকু ঠম্মিকে একটা ইনজেকশন দিলো।'
জুতো মোজা খুলতে খুলতে সেটাকে ঠিক মত জায়গায় রাখতে রাখতে তিতলির কথা মনোযোগ দিয়ে শুনছিল। তিতলির পাশে অরিজিৎ দাঁড়িয়ে হাসছিল। তবুও সঞ্জিত অবাক হয়ে সিঁড়ি দিয়ে উঠে বললো,
-' বলিস কিরে, এত কিছু হয়ে গেছে? তুই যদি সিঁড়ি দিয়ে পড়ে যেতিস তবে কি হতো বল তো?' মা র ঘরে ঢুকে,
-' কিগো মা তিতলি কি বলছে।'
-' এখন ভালো আছিরে সঞ্জু। বৌমার বড়ো কষ্ট গেছে। এমনিতে তো রোজকারের যে ভীষণ কষ্ট হয় আজ এই আমার জন্য আরও অনেক কষ্ট হলো।'
বড়ো ঘর থেকে নিবেদিতা এসে এই ঘরে ঢুকলো।
-' কিরে অরু এখনো জামাকাপড় ছাড়িস নি? শিঘ্রী যা,জামা কাপড় পাল্টে হাত পা ধুয়ে আয়। তুমিও যাও, মা এখন অনেকটা স্ট্যাবল। আজকে জানো অনেক খবর আছে। খাওয়ার টেবিলে বলবো। মা আপনার খাবারটা এখানে একটুপরে দিয়ে যাচ্ছি।'
-' বৌমা আমার না কিছু খেতে ইচ্ছে করছে না।'
-' না অল্প কিছু খেতেই হবে। ট্যবলটটা খেতে হবেনা?'
আর কোনো কথা নেই। সবাই ঘর থেকে বেরোল।নিবেদিতা রান্নাঘরে ঢুকলো। একটু পরে গরম গরম লুচি আর বেগুন ভাজা টেবিলে নিয়ে আসলো নিবেদিতা। শাশুড়ি মার খাবারটা ওনার ঘরেই দিয়েছে। বললো,
-' পদ্ম এসে যাওয়ায় লুচি আর বেগুন ভাজাটা চটপট হয়ে গেলো। ও বেললো আমি ভাজলাম। যাইহোক আজ যেমন প্রথম পর্বটা খারাপ গেলো তেমনি দ্বিতীয় পর্বে একটা ভালো খবর আছে।' সঞ্জিত বললো,
-' খবরটা কি শুনি?'
-' অরুকে মিশনে নিয়ে যাবার জন্য একজনের সাথে কথা হয়েছে। ছেলেটির নাম শ্যাম। ওরা তিন ভাই। বড়ো ভাই ছোট খাটো একটা কাজ করে আর বাড়িতে মায়ের সাথে হাতে হাতে রান্নার কাজে সহায়তা করে। বাজারটাও করে। আর ছোট দু ভাই মিশনের ছেলেদের আনা নেওয়া
করে দম দম স্টেশন থেকে। ছাত্রগুলো সব স্টেশনের ওপারের, খালি অরু এপারের। তাই অরুকে দম দম স্টেশনের এক নম্বর প্লাটফর্মে শ্যামের হাতে তুলে দিতে হবে। শ্যামের ওপরের ভাইও দুটো ছেলে নিয়ে এসে একটাকে ওর ভাইয়ের হাতে তুলে দেয় আর একটাকে ব্যারাকপুরের রামকৃষ্ণ মিশনের স্কুলে পৌঁছে দেয় আবার বিকালে স্কুল থেকে এনে ওকে বাড়িতে পৌঁছে দেয়। অরুকে আমাদের বিকালে দম দম স্টেশনের চার নাম্বার প্ল্যাটফর্ম থেকে নিয়ে আসতে হবে।'
-' বাহ্ এটা তো দারুন একটা খবর। ওর সাথে পাকা কথা হয়ে গেছে কি?' সঞ্জিত জিজ্ঞেস করে।
-' একদম। কাল রবিবার সকালে ও মানে শ্যাম আমাদের বাড়িতে আসবে বলেছে। তোমার সাথে কথা বলতে আর বাড়িটাকে আর বাড়িতে আসার রাস্তাটাকে ভালো করে চিনে নিতে।'
-' কেনো ওতো আমাদের বাড়ি থেকে আনা নেওয়া করবে না।'
-' তবু ওরা চিনে রাখে। যদি কখনো প্রয়োজন পরে।'
-' আচ্ছা আচ্ছা। কথাটাতো সত্যি।'
পরদিন সকালে একটু দেরী করে বাজারে গেলো সঞ্জিত। অন্য দিনের তুলনায় একটু বেশি সময় নিয়ে বাজার করলো। রবিবারের বাজার আনতে সঞ্জিত একটু দেরিই করে। বাজারটা রেখে হাতপা ধুয়ে খবরের কাগজ নিয়ে বসলো। সবে চায়ের কাপে চুমুক দিয়েছে এমন সময় দরজায় করা নারার আওয়াজ। সঞ্জিত জানলার কাছে মুখ বাড়িয়ে বললো,
-' কে, দরজা খোলা আছে ওপরে আসুন।' সিঁড়িতে এক জোড়া পায়ের উঠে আসার শব্দ। সঞ্জিত সিঁড়ির গোড়ায় এসে জগগেস করে কে আপনি?'
-' আমি শ্যাম।'
-০-০-০-০-০-০-০-০-০-
Address:-
---------
Dipak Kumar Paul,
DTC Southern Heights,
Block-8, Flat-1B,
Diamond Harbour Road,
Kolkata - 700104.