বিস্তারিত জানতে ছবিতে ক্লিক করুন :

গদ্য ।। রম্যরচনা (দ্বিতীয় পর্ব) ।। রনেশ রায়

 


 



প্রথম  পর্বের লেখার  প্রেক্ষাপটে নিচে আমার একটা কবিতায় রম্যরচনায় ভাবের গভীরতাকে হালকা মজলিসের ছলে বুনে তোলার চেষ্টা করেছি এই পর্বের শুরুতে:


যদি 

যদি তোমার সঙ্গে চলি

সবাই বলে, চললি কোথা !

ওটা যে কানা গলি।

 

যদি তোমায় কিছু বলি

সবাই বলে, বললি কাকে !

ওটা যে কালা কলি।


যদি তোমার হাত ধরি

সবাই বলে, ধরলি কাকে ?

ওটা যে বদের ধাড়ি ।


যদি তোমার প্রেমে মজি 

সবাই বলে, মজলি কোথায়!

ওকেই তো সবাই খুঁজি।


যদি তোমায় দিই মান 

সবাই বলে, দিলি কাকে!

ওটা যে অপাত্রে দান ।


যদি তোমার কথা শুনি 

সবাই বলে শুনিস না

ওটা যে বোকা গাধা 

বাস্তবটা কিছুই  বোঝে না।


যদি তোমায় ডাকি কাছে

সবাই বলে, ডাকিসনারে

যদি কামড়ে দেয় পাছে।


যদি তোমায় বরি গোড়ের মালায়

তৎক্ষণাৎ তা শুকিয়ে যায়

গড়াই আমি ধুলায়।


তবু আমি তোমায় বলে যাই

যে যাই বলুক

আমি তোমার সাথেই বাই

শুকোক না সে মালা

আমার তোমার সঙ্গেই ঠাঁই।








 রম্য গল্প 


এই  ওই সেই 


নাম আমার বিদ্রুপ মিত্র। কেন যে বাবা মা এ নাম দিয়েছিলেন এখনও বুঝি নি। পঞ্জিকা মতে নক্ষত্রের অবস্থানে হয়তো জন্মলগ্নটা পছন্দের ছিল না।  হয়ত  বুঝেছিলেন আমার জীবনটা আমাকে সারাজীবন বিদ্রুপ করে যাবে। অথবা অন্যেকে বিদ্রুপ করা  আমার  স্বভাব হয়ে যাবে  বা উভয়ই। অনেকের মতে হয়েছেও  তাই। জন্মলগ্নে লেখা ছিল। কী আর করা যাবে। থাক সে কথা।  নামে কিছু আসে যায় না। ওটা তো নামই, একেবারে বেচারা। তার মানে দিয়ে  কী হবে। কতজনের নাম তো সরব। কিন্তু তারা সারা জীবন  নীরব থেকে যায়। সাত চড়েও টু করে না। 


আমার একটা মুদ্রাদোষ আছে। পরিচিত কাউকে দেখলেই জিজ্ঞাস করি কেমন আছ বা আছেন ? জানি উত্তর পাব এই ভালো বা একরকম। কিন্তু এই এইটা কী কেমন বুঝি না। নিজেরই বিরম্বনা বাড়ে। সত্যি বলতে কী নিজেই যেখানে বুঝি না কেমন আছি সেখানে অন্যকে এ ধরনের প্রশ্ন করা কেন? এই কেনর উত্তর নেই। তবু আমি প্রশ্ন করি। এই সেদিন পাড়ারই পরিচিত একজন। নাম বুদ্ধ সরকার। ছেলে মেয়ে নিয়ে ভালই থাকেন। অভাব খুব একটা নেই। চলে যায়। মেয়ের বিয়ে হয়ে গেছে। ছেলে বিদেশে। এখন বাড়িতে দুজনে। তবে ছেলের মোটা মাইনে। তাই হয়তো আরও ভালো আছেন। সেটাই যেন আমার জানার সুপ্ত ইচ্ছে। তাই অযাচিত এই জিজ্ঞাসা। উনি আমার  প্রশ্নের উত্তরে বললেন:


ওই  ভালো  আছি আর  কী ! বুঝলাম বিরক্ত হয়েছেন।


অনেকদিন হয়েছে। বুদ্ধবাবুর সঙ্গে দেখাশোনা নেই। উনি ছেলের ওখানে মধ্যে মধ্যে বিদেশে যান। আমার অবস্থা তথই বচ। ছেলে ভিন প্রদেশে ভালো চাকুরী পেয়ে । আমাকে ওখানে গিয়ে থাকতে হয়। এখানকার পাট প্রায় চুকে গেছে। তাও মাস পাঁচ ছয় এখানে আসি কিছুটা শিকড়ের টানে। নিজের যা আছে আর ছেলে মেয়ের  দৌলতে ভালো আছি।খাওয়া পরার অভাব নেই। এই বয়সে বিরাট খরচে ভালো চিকিৎসা সবই। সে দিক থেকে আমিও বুদ্ধবাবুর সমপর্যায়ের। ভালো থাকা মানুষজনের মধ্যে একজন। আর এই ভালো থাকাটা আমাকে ভাবায়। ভালোর তল খুঁজে পাই না। নিরুপদ্রব জীবন, যখন যেটা দরকার পাই। পাই বললে ভুল হবে, তার থেকে যথেষ্ট বেশী পাই। আর ভালো থাকা শুরু করলে আরও ভালো থাকতে চাই। সেটাও যেন একধরনের বিরম্বনা।আর ছেলে তো আমার  নামের প্রতি সুবিচার করেই চলে। আমার জীবন  বিশ্বাসকে বিদ্রুপ করে  বলে  তুমি  তো পুঁজিবাদী জীবনে অভ্যস্ত হয়ে যাচ্ছে অস্বীকার করতে পারি  না 


বুদ্ধবাবুর সঙ্গে অনেকদিন পর দেখা। উনি তার মানে এখন এখানে। জানতে চাই কদিন থাকবেন। উনারও আমাকে একই কথা। জানলাম এখন এখানে থাকবেন। তারপর পরস্পরে অনেক কথা। জানলাম ছেলে বিদেশে স্থায়ী বাসিন্দা হয়েছে। ওখানকার মেয়েকে বিয়ে করেছে। বুদ্ধবাবুকে স্থায়ীভাবে স্ত্রীকে নিয়ে চলে যেতে বলেছে। তাতে ওরও সুবিধে। ছেলের বউও চাকুরী করে। তাই নাতিকে দেখাশুনা তাকে নিয়ে সময় কাটানো। মন্দ নয়। উনার স্ত্রীর এতে আপত্তি নেই। কিন্তু বুদ্ধবাবু যেন দোনামনা।উনার দোনামনায় আমার নামটা যেন আমাকে উস্কে দেয়। আমি বলেই বসি:


ওখানে থাকলে তো ভালই থাকবেন। আমিও  যেমন থাকি। এই বয়সে ওদের যেমন আমাদের দরকার তেমনি আমাদেরও ওদের দরকার। তাতে ভালই থাকতে পারি। বিশেষ করে করে বিদেশের জীবন যাপন সে  তো স্বপ্ন ! কজনের সুযোগ  হয়? আপনি  তো ভাগ্যবান ।


বুঝি আমাকে বিদ্রুপ তাড়া করেছে। আবার এক বিড়ম্বনা। উনি হয়তো দুঃখ  পেলেন। কথাটা উনার লাগতে পারে কিন্তু এবার দেখলাম  আগের বারের  মত বিরক্তি নেই । টানতে টানতে আমাকে নিয়ে গেলেন কাছেই চায়ের  দোকানে, মুখে  হাসি ।


চায়ের দোকানে আমরা মুখোমুখি। বুদ্ধবাবু বক্তা আর আমি যেন শ্রোতা।এই বুদ্ধবাবুকে আমি আগে কখনও এরকম প্রাণোচ্ছল দেখিনি। মুখ হাসিতে উপচে পড়ছে কথায় যেন ফোয়ারা। উনি শুরু করলেন:


এই এই হলো ভালো থাকা। পরস্পর পরস্পরের মুখোমুখি বসে মন খুলে নিজের ভাষায় কথা বলা------


আমার মুখে কথা নেই। কেমন যেন বোবা হয়ে যাই। 

===========================

লেখক - রনেশ রায়

  

Post a Comment

0 Comments
* Please Don't Spam Here. All the Comments are Reviewed by Admin.