বাহন বিভ্রাট
মিঠুন মুখার্জী
কৈলাশে বসে দেবাদিদেব মহাদেব ধ্যানে মগ্ন।দেবী পার্বতী গৃহকাজে ব্যস্ত। গুড়ো গুড়ো বরফ পড়ছে। প্রচন্ড ঠান্ডা। কাঁপতে কাঁপতে গনেশ, কার্তিক, সরস্বতী ও লক্ষ্মী মা পার্বতীর কাছে এসে বলেন--- "মা মামা বাড়ি যাওয়ার সময় এসে গেছে, কখন যাব আমরা সকলে? মর্ত্যবাসী আমাদের বরণ করার জন্য উদগ্রীব হয়ে আছে।" গনেশ বলেন-- "মা এবার আমি সিংহের পিঠে চড়ে মামা বাড়ি যাব। সিংহের মতো বাহন পেলে সবাই আমাকে ভয় পাবে। ফলে খারাপ কথা বলার সাহস পাবে না।" কার্তিক মাকে বলেন --- "মা আমি প্রতিবারই ময়ূরের পিঠে চড়ে মামা বাড়ি যাই। একেবারে একঘেয়ে হয়ে গেছে। এবার আমি ইঁদুরের পিঠে চড়ে যাব। গনেশের ইঁদুর ইচ্ছে অনুযায়ী আকার পালটাতে পারে। খুব মজা হবে। আমার ময়ূরে এবার তুমি যাবে। ময়ূরের পিঠে বসে মহিষাসুরের মতো অপশক্তির বিনাশ করবে তুমি।" দেবী লক্ষ্মী মায়ের কাছে আবদার করে বলেন--- "এবার আমি সরস্বতীর রাজহাঁসের পিঠে চড়ে যাব। এবার মর্ত্যে যাওয়াটা একটু অন্যরকম হবে। খুবই মজা হবে। প্রতিবার একরকম ব্যাপারটি খুব একটা ভালো লাগে না।" দেবী সরস্বতী মা পার্বতীকে বলেন ---"হ্যা মা, আমিও তবে এবার লক্ষ্মীর প্যাঁচায় চড়ে দিদুনের বাড়ি যাব। দিদুনেরা আমাদের সবাইকে দেখে একেবারে অবাক হয়ে যাবে। হেসে গড়াগড়ি দেবে। আমরা সবাই হিমালয় দাদু ও মেনকা দিদুনের সামনে মুখ ঢেকে গেলে ওরা আমাদের চিন্তেই পারবে না। এই দৃশ্যটা চিন্তা করেই আমার খুব হাসি পাচ্ছে।" সবার কথা শেষ হলে মা পার্বতী বলেন---" ঠিক আছে তোদের যদি এমন ইচ্ছা হয় তাহলে তাই হবে। তবে শুধু বাহন পরিবর্তন করলেই হবে না। সঙ্গে সঙ্গে অস্ত্র-শস্ত্র ও বাদ্যযন্ত্রও পরিবর্তন করতে হবে। নতুবা তোমাদের দাদু-দিদুন ঠিক চিনে ফেলবেন। যাব তো মাত্র তিন-চার দিনের জন্য। তোমরা যদি তাদের এই বয়সে একটু আনন্দ দান করাতে চাও তা করো। আমি তোমাদের বাঁধা দেব না। তবে দেখো তোমাদের আচরনে আমার মা-বাবা যেন মনে আঘাত না পান। তোমাদের বাবা তো আমাদের আনতে যাবেন,তাকে বাঘের পিঠে করে যাওয়ার কথা আমি বলে দেব। তবে তোমাদের মনের ইচ্ছের কথা প্রত্যেকে একবার পিতা মহাদেবকে বলবে। তাতে তিনি খুশী হবেন।" মায়ের কথা শুনে সকলে বলেন ---"তাই হবে মা। আজ পর্যন্ত আমরা কোনো কাজ পিতাকে না জানিয়ে করি নি, এটাও করব না। আপনাদের দুজনের আনন্দই আমাদের আনন্দ।" এরপর তাঁরা সকলে মহাদেবের কাছে যান। মহাদেব তখন ধ্যান সমাপ্ত করে চোখ খুলে বসে ছিলেন। গনেশ বলেন ---"পিতা আপনার সঙ্গে আমারা চার ভাই-বোন কিছু বলতে চাই।" মহাদেব বলেন--"নির্দ্ধিধায় বলে ফেলো তোমরা। ভয় পেও না একদম।" এরপর সবাই তাদের মনের ইচ্ছে একে একে পিতার কাছে প্রকাশ করেন। পিতা মহাদেব সবশুনে হেসে বলেন---"তোমাদের মনোবাসনার কথা আমি বুঝতে পেরেছি। কিন্তু একজনের বাহন অন্যজন নিলে সমস্যা হতে পারে। বাহনেরা এটা নাও মেনে নিতে পারে। তাদের সাথে কথা বলা খুবই প্রয়োজন। তোমরা কেন এমনটা করতে চাও তা সবাইকে বুঝিয়ে বলো। তারা নিজে থেকে রাজি থাকলে কোনো সমস্যাই থাকবে না। আর ইচ্ছে না থাকলে জোর করে নিয়ে গেলে যখন-তখন বাহনেরা ব্যাগরা মারতে পারে।" মহাদেবের কথা শুনে সকলে বুঝতে পারেন তাদের পিতা ঠিকই বলেছেন। মনে হলেই তো আমরা বাহন পরিবর্তন করতে পারি না। তবে বাহনদের সঙ্গে কথা বলেই দেখি তারা কি বলে। এরপর সকল বাহনদের একজায়গায় ডেকে মা পার্বতীর চার সন্তান তাদের বাহন পরিবর্তনের কথা তুলে ধরেন। পিতার কথা মতো তাদের এও বলেন কেন তারা বাহন পরিবর্তন করতে চান। বাহনেরা সব শুনে একে একে উত্তর দেয়। প্রথমে সিংহ বলে --- "আমি মা দুগ্গার বাহন। আজ পর্যন্ত আমার পিঠে অন্যকে বহন করি নি। মন চাইছে না মাকে বাদদিয়ে গজু দাদাকে নিতে। কিন্তু মারও যখন এক মত এবং তোমরা একটা উদ্দেশ্য নিয়ে এবার দিদুন বাড়ি যেতে চাও তখন যেতে হবে।" সিংহের বক্তব্য শেষ হলে ময়ূর বলে ----"আমার অসুবিধা নেই। কার্তিক দাদাকে যুগ যুগ ধরে বহন করে আমি খুশি। কিন্তু এবার আরও খুশি এই জন্য যে মা দুর্গা এবার আমার পিঠে চড়ে বাপের বাড়ি যাবেন। ভাবতেই পারছি না আমার গুরুত্ব মর্ত্যে আরও বেড়ে যাবে। এজন্য মা ও কার্তিক দাদার প্রতি আমি কৃতজ্ঞ।"এরপর রাজহংস ডানা মেলে বলে---" মা সরস্বতীর বাহন হয়ে আমি এতো বছর খুব সুখ ভোগ করেছি। মায়ের বাদ্যের ধ্বনিতে স্থির থাকতে পারি নি। ডানা মেলে আনন্দে লাফিয়েছি,নেচেছি অনেক জ্ঞান অর্জন করেছি। এবার দিদি লক্ষ্মীর বাহন হয়ে মামা বাড়ি যেতে হবে। জানিনা কীরকম অভিজ্ঞতা হবে। প্রাপ্তির ঝুলি শূন্য থাকবে, না ভড়া।" রাজহংসের বক্তব্য শেষে লক্ষ্মী পেঁচা বলে--- "আমার খুব মজা হচ্ছে সরস্বতী দিদির বাহন হতে। লক্ষ্মী দিদি ও সরস্বতী দিদি দুজনই আমার প্রিয়। আমি সরস্বতী দিদির বাহন হতে পেরে খুবই খুশি। আমার প্রাপ্তির ঝুলি সবসময় পূর্ণই থাকবে। কেউ আমার জন্য দুঃখিত হোক আমি চাই না। তাছাড়া পরের বার থেকে আবার লক্ষ্মী দিদির বাহন হয়েই তো মর্ত্যে আসবো।" এরপর মহাদেবের বাহন বাঘ বলে --- "আমি দেবাদিদেব মহাদেবের বাহন হয়ে মর্ত্যে যাব, এর থেকে আর বেশি কিই বা আমি পেতে পারি। আমি প্রভুকে পিঠে ধারন করার মতো সৌভাগ্য লাভ করব। আমার কোনো রকম আপত্তি নেই। নন্দীকেও আমার অসংখ্য ধন্যবাদ। তার ত্যাগের কারণেই আমি এই সুযোগ পেলাম। মা আমার অনুরোধ রেখেছেন। এই জন্য আমি মার কাছেও কৃতজ্ঞ।"
বাহনরা সবাই তাদের মতামত জানালে মা পার্বতীর সন্তানেরা খুবই খুশি হন। মামা বাড়ি যাওয়ার তর আর সয় না। কারন এবার তাদের যাত্রা অন্যান্য বছরের তুলনায় সম্পূর্ণ আলাদা ও মজাদার। দেখতে দেখতে দেবীপক্ষের সময় চলে আসে। ঘরে ঘরে মহালয়া শ্রবণ করে সকলে। মা পার্বতী তাঁর সন্তানদের সঙ্গে নিয়ে বাপের বাড়ি যাত্রা করেন। পূর্ব পরিকল্পনা অনুযায়ী সকলে তাদের বাহন,অস্ত্র ও বাদ্যযন্ত্র ধারণ করে মর্ত্যে গমন করেন। প্রত্যেকে তাদের মুখ একটা কাপড়ে ঢেকে হিমালয় ও মেনকার গৃহে প্রবেশ করেন। দেবী পার্বতীর মা মেনকা কারোকে চিনে উঠতে পারেন না । ময়ূরের পিঠে বসা দেবী দুর্গার দিকে তাকিয়ে তিনি কিছুতেই বুঝে উঠতে পারেন না কে সে। কার্তিক তো এভাবে আসবে না। সকলের মুখ ঢাকা দেখে মেনকা বলেন---"তোদের এরকম ভাবে আসার কারণ আমি বুঝতে পেরেছি। তোরা আমাদের চমকে দিতে চাস। তাহলে এবার আমাদের অনেক ভেবে চিন্তে তোদের নির্বাচন করতে হবে। মজা করার বুদ্ধিটা বেশ ভালো।" দিদুন মেনকা অনেকক্ষণ পরখ করে মনে মনে ভাবেন---"বাহন সবাই পাল্টেছে বুঝতে পারছি,বাদ্যযন্ত্র ও অস্ত্র-শস্ত্র কী পাল্টেছে না একই আছে।" শারীরিক গঠন দেখে তিনি তাদের চেনার চেষ্টা করেন। এরপর কিছুটা অনুমান করে সিংহের উপর বসে থাকা দেবতাকে দিদুন মেনকা গনেশ বলে ডেকে ওঠেন। তারপর পেঁচাকে দেখে লক্ষ্মী ও রাজহংসকে দেখে সরস্বতী বলে ডেকে ওঠেন। মৈনাক সামনে এগিয়ে এসে ভালো করে পরখ করে বলে-- " না না মা, তোমার বুঝতে ভুল হচ্ছে। তোমার বয়েস হয়েছে,খালি চোখে তুমি সেভাবে দেখতে পাও না, আমি বলছি কে কোনটা? দিদি ও দিদির ছেলে-মেয়ে মনে হচ্ছে এবছর আমাদের সঙ্গে মজা করতে চায়। আমার তো খুব আনন্দ হচ্ছে। " এরপর মৈনাক ভালোকরে সকলকে দেখে এক এক করে সঠিকটা বলেই দেয়। সে বলে-- "সিংহের পিঠে বসে আছে আমার প্রিয় ভাগিনা মহোদর। ওর উদর দেখেই ওকে আমি চিনেছি। তাহলে ছেলেদের মধ্যে বাকি থাকে আমার পরাক্রমি ভাগিনা কার্তিক। সে বসে আছে গনেশের বাহন ইঁদুরের পিঠে। বাহন - অস্ত্র ও বাদ্যযন্ত্র সবই দেখছি পরিবর্তন করেছ তোমরা। আমি যদি ভুল না বলে থাকি তবে সরস্বতীর হাসের উপর বীনা নিয়ে বসে আছে আমার খুবই আদরের ভাগিনী লক্ষ্মী আর লক্ষ্মীর পেঁচার উপর বসে আছে সরস্বতী। তাহলে বাকি থাকে আমার দিদি পার্বতী। সে ময়ূরের উপর বসে আমাদের বিচক্ষণতার পরীক্ষা নিচ্ছেন। আমার তোমাদের সকলকে এভাবে বাহন পাল্টাতে দেখে খুবই হাসি পাচ্ছে।" এদিকে মৈনাক সব ঠিক বলে দেওয়ায় দেবী দুর্গা ও তার সন্তানেরা সকলে মুখের কাপড় সরিয়ে উচ্চস্বরে হেসে ওঠেন। গনেশ বলেন--- "মামা তুমি তো খুব বিচক্ষণ। কী সুন্দর আমাদের সবাইকে ধরে ফেললে। এই আনন্দটুকু প্রাপ্তির জন্য আমরা বাহন পাল্টে এখানে আসার পরিকল্পনা করেছি।" কার্তিক হাসির সহিত বলেন --- " আমার খুব মজা হয়েছে যে দিদুন আমাদের ঠিক মতো বুঝতে না পেরে উল্টো-পাল্টা সন্দেহ করছিল। পিতা কোন বাহনে এবার আমাদের নিতে আসবেন আপনারা কেউ ভাবতেও পারবেন না। এটা গোপনই থাক।"
এরপর সকলে বাহন থেকে নেমে যান। মা পার্বতী অনেক দিন পর মাকে কাছে পেয়ে চোখের জল আটকে রাখতে পারেন না। মা মেনকার দুচোখ জলে ভরে যায়। মা ও মেয়ে দুজন দুজনকে আলিঙ্গন করেন। সকলের উপস্থিতিতে চারটি দিন মামা বাড়ি সরগরম হয়ে ওঠে। ইঁদুর কখনো গনেশের ভুঁড়ির উপর উঠে ঘুমিয়ে থাকে। রাজহংস কখনো সরস্বতীর পাশে গিয়ে ঘুমিয়ে থাকে। ময়ূরের পিঠে চড়ে কার্তিক ঘুড়তে বেরিয়ে যায়। সিংহ ও পেঁচা নিজেদের মধ্যে খুনসুটি করতে থাকে। মা পার্বতী ঘুমিয়ে স্বপ্ন দেখেন ---- " মর্ত্যবাসী তাঁর আরাধনায় মেতে উঠেছে। ঢাক - কাঁসর ও ঘন্টা বাজছে। হাজার হাজার মানুষ অঞ্জলি দিচ্ছেন। তাঁর কাছে প্রার্থনা করছে। চোখের জলে মনের দুঃখ ব্যক্ত করছে। তিনি সকলকে আশীর্বাদ করছেন। হঠাৎ একটা মন্ডপে কোথা থেকে একটা মহিষ ছুটে আসে। তার পেট চিরে মহিষাসুরের আবির্ভাব হয়। ভক্তরা ভয় পেয়ে যে যেদিকে পারে পালিয়ে যায়।মা পার্বতী ত্রিশূল দিয়ে মহিষাসুরের বিনাশ করেন। সিংহ মহিষটার গালে এক থাবা বসিয়ে দেয়।" গনেশ এসে মা পার্বতীকে ডাকায় তাঁর ঘুম ভেঙে যায়। তিনটি দিন হাসি ঠাট্টার মধ্যে দিয়ে কেটে যায়। দশমীর দিন সকাল বেলা বাঘের পিঠে মহাদেবের আবির্ভাব ঘটে শ্বশুর বাড়িতে। মেনকা ও মৈনাক মহাদেবের বাহন দেখে অবাক হয়ে যান। প্রতিবারের মতো এবার আর নন্দী আসে নি। মেয়ে ও নাতি-নাতনিদের যেতে দিতে হিমালয় পত্নী মেনকার মন চায় না। কিন্তু নিয়ম তো ভাঙা যায় না। মহাদেবের উপর একরাশ অভিমান করেন তিনি। তাঁর দুচোখেও বারিধারা দেখা যায়। আবার একবছর অপেক্ষা--এই চিন্তা করে তাঁর মন ভারাক্রান্ত হয়ে যায়। বাঙালির ঘরে ঘরে মা-মেয়ের নিবিড় স্নেহের সম্পর্ক ভোলার নয়। মা পার্বতী ও তাঁর সন্তানদের সঙ্গে নিয়ে দেবাদিদেব মহাদেব কৈলাশের উদ্দশ্যে যাত্রা করেন। প্রত্যেকে নিজ নিজ বাহনের পিঠে চড়ে ছেড়ে যাওয়ার যন্ত্রনা বুকে নিয়ে কৈলাশে পাড়ি দেন।
======================
মিঠুন মুখার্জী
C/O-- গোবিন্দ মুখার্জী
গ্ৰাম : নবজীবন পল্লী
পোস্ট+থানা -- গোবরডাঙা
জেলা -- উত্তর ২৪ পরগণা
পিন-- 743252
মোবাইল+হোয়াটসঅ্যাপ: 9614555989