পৌষ পার্বণ : বাঙালির পিঠে - পুলির দিন
মিঠুন মুখার্জী
ভোজনরসিক বাঙালির কাছে শীতকালটা খুবই প্রিয়। এই সময় খেয়ে মজা, শুয়ে মজা। তবে শীতকালে মানুষের জীবন একটু আলসে প্রকৃতির হয়। বিছানা ছাড়তে চান না অনেকে। পৌষ-মাঘ এই দুই মাস নিয়ে বাঙালির শীতকাল। শীতকালের বিভিন্ন উৎসবের মধ্যে পৌষমাসের শেষদিন অর্থাৎ পৌষসংক্রান্তির দিন প্রতিটি পাড়ার ঘরে ঘরে পিঠে খাওয়ার ধুম লেগে যায়। প্রাচীন কাল থেকেই বাঙালিরা এই উৎসব পালন করে আসছে। অগ্ৰাহায়ণ মাসে নতুন চাল উঠলে সেই চালের গুঁড়ো দিয়ে প্রথম নবান্ন উৎসব পালন করা হয়। তারপরই এই পৌষ পার্বণ । গৃহস্থ বধূরা ভোরবেলা ঘুম থেকে উঠে সারা উঠোন গোবর দিয়ে লেপে তুলসীর মঞ্চের সামনে পিঠের আকারে আল্পনা দেন। সারা পাড়ায় একটি উৎসবের আমেজ থাকে ওইদিন। দেবতার উদ্দেশ্যে প্রথম পিঠেকে অর্পণ করা হয়। এই শীতেই বাজারে পাওয়া যায় বিভিন্ন রকমের সুস্বাদু গুড়। খেজুরের রস জ্বালিয়ে এই গুড় প্রস্তুত করা হয়। খাঁটি পাটালি ও নলেন গুড়ের গন্ধে প্রতিটি বাঙালির জ্বিভে জল চলে আসে।
বাড়ির মা-বউরাই মূলত পিঠে তৈরি করার কাজে ব্যস্ত থাকেন। পুরুষেরা সমস্তকিছু জোগাড় করে দেন ও মেয়েরা বিভিন্ন রকমের সুস্বাদু পিঠে তৈরি করেন। বাঙালিরা যেসমস্ত পিঠে তৈরি করেন তারমধ্যে বিশেষ উল্লেখযোগ্য হল --- পুলি পিঠে, কাস্তেপোড়া, পাটিসাপটা, ভাজাপুলি , তেলের পিঠে, রাঙালুর পিঠে, গোকুল পিঠে, ফুলঝুড়ি, ধুপি পিঠা, নকশি পিঠা, মালাই পিঠা, মালপোয়া, পাকন পিঠা, ঝাল পিঠা ইত্যাদি। বাংলাদেশে শতাধিক ধরনের পিঠার প্রচলন রয়েছে। নারকেল, চালের গুড়ো , সন্দেশ, দুধ ও গুড় দিয়ে এই সকল পিঠে তৈরি করা হয়। প্রত্যেকটি পিঠেই খেতে খুবই সুস্বাদু। উপকরণ ও তৈরির উপর পিঠের স্বাদ ভালো-খারাপ নির্ভর করে। ওই দিন অনেক বাড়িতে অতিথির আগমন ঘটে। তারাও এই আনন্দে সামিল হয়।
বাংলা ভাষায় লেখা কৃত্তিবাসী রামায়ণ, অন্নদামঙ্গল, ধর্মমঙ্গল, মনসামঙ্গল, চৈতন্য চরিতামৃত ইত্যাদি কাব্য এবং মৈমনসিংহ গীতিকায় কাজল রেখা গল্পকথনের সূত্র ধরে আনুমানিক ৫০০ বছর আগেও বাঙালির খাদ্য সংস্কৃতিতে পিঠার জনপ্রিয়তার উল্লেখ পাওয়া যায়। পিঠা-পায়েসকে নিয়ে গ্রামাঞ্চলের বিভিন্ন স্থানে এখনো অসংখ্য গান, কবিতা ও ছড়া প্রচলিত আছে। পিঠাকে ঘিরে 'পল্লী মায়ের কোল' কবিতায় বিখ্যাত কবি বেগম সুফিয়া কামাল লিখেছেন, 'পৌষ পার্বণে পিঠা খেতে বসি খুশীতে বিষম খেয়ে/আরও উল্লাস বাড়িয়াছে মনে মায়ের বকুনি পেয়ে।'
পিঠা-পুলি আমাদের লোকজ ও নান্দনিক সংস্কৃতিরই প্রকাশ। আমাদের হাজারো সমস্যা সত্ত্বেও গ্রামবাংলায় এসব পিঠা-পার্বণের আনন্দ-উদ্দীপনা এখনো মুছে যায়নি। পিঠা-পার্বণের এ আনন্দ ও ঐতিহ্য যুগ যুগ টিকে থাকুক বাংলার ঘরে ঘরে।
=====================================
মিঠুন মুখার্জী
C/O-- গোবিন্দ মুখার্জী
গ্ৰাম : নবজীবন পল্লী
পোস্ট+থানা -- গোবরডাঙা
জেলা -- উত্তর ২৪ পরগণা