বিস্তারিত জানতে ছবিতে ক্লিক করুন :

গল্প ।। ফাঁকি ।। চন্দন চক্রবর্তী


ছবিঋণ - ইন্টারনেট।
 

ফাঁকি

চন্দন চক্রবর্তী



শহরের শেষ প্রান্তে খেলার মাঠ।  তারপরেই যত দূর চোখ যায়,দিগন্ত জুড়ে ধানের ক্ষেত।  নতুন নতুন ফ্লাট বাড়ি ক্রমশ ফাঁকা জমি গ্রাস করছে !  এখানে কোন ফ্ল্যাটের বাসিন্দা সুবীর সেন নির্ঝঞ্ঝাট মানুষ,অবসর জীবন।  প্রাইভেট কোম্পানিতে চাকরি করতেন। রাত-দিন অফিসে খেটেছেন,পার্টিতে, মিটিংয়ে এটেন্ড করেছেন,পদোন্নতির কারণে।  দেশ বিদেশে ঘুরে,ধাপে ধাপে কোম্পানির ডাইরেক্টরও হয়েছিলেন।  বিনিময়ে সামাজিকতা ভুলে,আত্মীয় পরিজনকে দূরে রেখে তাকে জীবন কাটাতে হয়েছে।


সুবীর সেন, সকাল বিকেল হাঁটতে বের হন।  সারাজীবন ব্যস্ত থাকায়, চারিপাশে তাকাতে পারেন নি, আজকাল যেন হাঁটতে গিয়ে বেশ অনুভব করেন!  মাঠে কিশোর ছেলেরা ফুটবল খেলছে,দাঁড়িয়ে দেখেন।  মাঠের ধারে কঁচি কাঁচাদের খেলা দেখেন।  ওদের মুখের আধো বোল শোনেন।  বেশ লাগে।  ফেলে আসা দিনে আবার ফিরে যেতে ইচ্ছা করে !


দিন কয়েক পরে, এক প্রেমিক যুগলকে মাঠের কোনায় বসে আলাপচারিতায় মগ্ন দেখে তার শরীরে শিহরণ খেলে গেল।  না এমন ঘটনা তার জীবনে আসে নি।  ছাত্রজীবনে প্রেমে পড়েছিলেন!  পড়ার চাপে বেশি দূর এগোতে পারেন নি।  বাড়ি থেকে বিয়ের চাপ দিলে সেটাও তিনি কাটিয়ে দিয়েছেন।  তাছাড়া দেশের নানা স্থানে ছিলেন,বিদেশে পাড়ি দিয়েছেন,কাজেই এসব নিয়ে ভাবারই সময় পান নি!

 

হাঁটতে বেরিয়ে আজকে তারই সমবয়সী এক ভদ্রলোককে দেখলেন একটি ছোট্ট মেয়েকে নিয়ে,সম্ভবত নাতনী,মাঠের ধারে ছোঁয়াছুঁয়ি খেলতে।  ভদ্রলোক মিছি মিছি চোখ বুজে মেয়েটার দিকে দৌড়াচ্ছেন,আর বাচ্চাটা খিল খিল করে হাসতে হাসতে আনন্দে দৌড়চ্ছে।  বুকের ভেতরটা হু হু করে উঠলো!

 

সুবীর সেন আজ আর হাঁটতে বের হন নি।  শরীর ম্যাজ ম্যাজ করছে,মনটাও ভালো নেই।  এক কাপ চা নিয়ে ডুবে গেলেন জীবনের খাতায়।  সারাজীবনে কোটি কোটি টাকা রোজগার করেছেন।   লক্ষ মুখের গুড মর্নিং,গুড নাইট শুনেছেন।  অধস্তন যারা,তাদের নকল সমীহ পেয়েছেন!  কিন্তু,তার যা কিছু পাওয়া,সবটাই অফিসের চার দেওয়ালের ভেতর!  বিনিময়ে নিজের সর্বস্ব হারিয়েছেন!  বছরের পর বছর পড়াশুনা করে, দেশ বিদেশে ঘুরে জ্ঞান অর্জন করেও এতবড় ফাঁকিটা ধরতে তার সারাটা জীবন লেগে গেল ! 


সোজাসুজি ফ্লাটে একটা গান বাজছে, " স্বপ্ন পারের ডাক শুনেছি,জেগে তাইতো ভাবি।  কেউ কখনো খুঁজে কি পায় স্বপ্ন লোকের চাবি "।  গানটা রবীন্দ্র সংগীতই হবে।  শুনতে শুনতে মনে হল,তবে কি তিনি স্বপ্নের ঘোরেই এতকাল কাটালেন!  বিদেশে থাকতে, বাবার মৃত্যু সংবাদ পেয়ে দেশে এসেছিলেন আর এসেছিলেন মায়ের মৃত্যু সংবাদ পেয়ে।   দাদার ক্যান্সার হয়েছে খবর পেয়ে কিছু টাকা পাঠিয়ে কর্তব্য সেরেছেন।  পরে মৃত্যু সংবাদ পেয়েও আসেননি।  এছাড়া দেশ থেকে কতবার কত চিঠি গেছে।  কোনটা খুলে পড়েছেন,কোনটা খুলেও দেখেননি, উত্তরও দেননি।  দেশে ফিরে এসেও তো কারো সঙ্গে যোগাযোগ রাখলেন না!  হ্যাঁ এখন ভীষণ কষ্ট হচ্ছে।  হঠাৎ মাথায় স্কুলের পাঠ্য থেকে একটা লাইন মাথায় এলো," সকলের তরে সকলে আমরা প্রত্যেকে আমরা পরের তরে"।  লাইনটার ওপরে ভাব সম্প্রসারণ লিখে স্কুলে তার খুব সুনাম হয়েছিল।


সুবীর সেনের এক সহপাঠী বন্ধু অনাথ শিশুদের নিয়ে একটা হোম চালান।  দুই একবার অর্থ সাহায্যের জন্য তার কাছে এসেছিলেন।  প্রতিবারই তাকে খালি হাতে ফিরিয়ে দিয়েছেন।  ফোনটা তুলে বন্ধুকে জানালেন তিনি আগামীকাল সকালে তার হোমে যাচ্ছেন।

 ------------------------------



গ্রাম :  প্রীতিনগর, পোস্ট অফিস: প্রীতিনগর, থানা : রানাঘাট, জেলা : নদীয়া। 

Post a Comment

0 Comments
* Please Don't Spam Here. All the Comments are Reviewed by Admin.