ভগীরথের জন্ম ও সমকাম
(পৌরাণিক ঘটনা অবলম্বনে )
সমর আচার্য্য
পতিত পাবনী সর্ব পাপ তাপ হারিণী পবিত্র মা গঙ্গা দেবীকে যে এই মর্তধামে আনয়ন করেছিলেন--
সেই মহাপূণ্যবান সগর বংশজাত দিলীপ পুত্র ভগীরথের জন্ম কাহিনী আমরা অনেকেই জানি।
বিশেষ কারণবশতঃ আবার একটু উল্লেখ করার ক্ষুদ্র প্রচেষ্টা করছি।
কপিল মুনির শাপে সগর রাজার ষাট হাজার সন্তান নিধনের পর অনেক খোঁজাখুঁজির পর যখন জানা গেল যে পরম করুণাময়ী মা গঙ্গাকে যদি এই মর্তে আনয়ন করা যায়, তবে তার পবিত্র স্পর্শে সগর বংশধররা মুক্তি লাভ করবে।
একে একে সবাই বংশানুক্রমিক ভাবে সেই চেষ্টা- ই করছিলেন। কিন্তু একে একে সবাই বিফল মনোরথ হয়ে মৃত্যু বরণ করলেন ।
রাজা দিলীপ অনেক চেষ্টা করলেন। কিন্তু তিনিও সফলকাম হলেন না । অপুত্রক অবস্থায় দুই রানীকে বিধবা করে তিনিও মৃত্যু বরণ করলেন। বংশে আর কেউ রইল না।
এদিকে ব্রহ্মা পড়লেন মহা বিপদে। এই সূর্য বংশেই স্বয়ং বিষ্ণু জন্মগ্রহন করবেন এমন ঘোষণা ইতিপূর্বেই হয়ে আছে । কি করা যায়, কি করা যায় এই চিন্তায় সবাই মিলে দেবাদিদেব ত্রিলোচনকে পাঠালেন মর্তে দুই রানীর কাছে । বৃষ পৃষ্ঠে আরোহন করে ত্রিপুরারি রানীদের সকাশে এসে বললেন, তোমাদের সুসন্তান লাভ হোক। রাণীদ্বয় আশ্চর্য হয়ে বললেন, এ কি বর দিলে ঠাকুর, আমরা যে বিধবা । স্বামী বিহনে কি করে আমরা সন্তান লাভ করবো?
পিনাক হস্ত তখন তাদের আস্বস্ত করে বললেন, তোমরা দুই নারীতে মিলে রতি করবে, তাতে তোমাদের একজন গর্ভবতী হবে । বলেই ত্রিলোচন অন্তর্ধান হলেন । শিবের বর পেয়ে দুই রানী খুবই আনন্দিত হলেন । তারপর তারা স্নানাদি সম্পন্ন করে ঘরে ফিরে এলেন । কিছুদিন পর দুজনেই ঋতুমতী হলেন । তারা মনের আনন্দে একে অপরের সাথে রতিক্রিয়ায় রত হলেন ।
সময় চলে সময়ের তালে । কিছুদিন পর তাদের মধ্যে একজন রানী অন্তসত্বা হয়ে পড়লেন । যথাসময়ে সেই রানী একটি পুত্র সন্তান প্রসব করলেন । কিন্তু একি, এ যে একখন্ড মাংস পিন্ড ! কেমন অদ্ভুত গলিত, ল্যাল্লেলে এক খন্ড মাংস পিন্ড কি করে পালন করবে তারা । লোকেই বা কি বলবে । তারা মহাদেবের উদ্দেশ্যে বলে উঠলেন, এ কেমন বর দিলে ঠাকুর । একে নিয়ে আমরা কি করব । তারপর ঐ মাংস পিন্ডটাকে সরযূ নদীতে ভাসিয়ে দেওয়া মনস্থ করে কাপড়ের আড়ালে ঢেকে সরযূ নদীর পথে রওনা হলেন ।
পথে বশিষ্ঠ মুনির সঙ্গে দেখা। তিনি সমস্ত কথা শুনে ধ্যানযোগে জানতে পারলেন ভবিষ্যতে কি হতে চলেছে । তাই তিনি রানীদের বললেন, একে নদীতে না ভাসিয়ে রাস্তায় ফেলে চলে যাও । কোন মহাপুরুষের কৃপায় যদি ওর মঙ্গল হয় । বশিষ্ঠের কথামতো রানীরা তাকে রাস্তায় শুইয়ে রেখে ঘরে ফিরে গেল ।
কতক্ষণ পর সেই রাস্তা দিয়ে অষ্টাবক্র মুনি সরযূ নদীতে স্নান করতে যাচ্ছিলেন । তার এঁকেবেঁকে চলা নিজের কাছেই কেমন লাগে । হঠাৎ তার নজরে পড়ল একটি অদ্ভুত আকৃতির শিশু তার দিকে কেমন ড্যাবড্যাব করে চেয়ে আছে । অষ্টাবক্র মুনি ভাবলেন, ছেলেটি কি তার দিকে উপহাসের দৃষ্টিতে চেয়ে আছে, নাকি ওর দৃষ্টিই ঐ রকম!
অষ্টাবক্র মুনি ক্ষমতায় নারায়ণের প্রায় সমান।
তিনি মনে মনে বললেল, হে বালক,যদি তুমি কৌতুক ছলে আমার দিকে তাকিয়ে থাকো তাহলে
এক্ষুনি তোমার দেহ বিনাশ হবে । আর যদি এই রকম দৃষ্টি তোমার সহজাত হয়, তাহলে তুমি আমার আশীর্বাদে দিব্য দেহ প্রাপ্ত হবে ।
মুহূর্তে মাংস পিণ্ডটি এক অপূর্ব দিব্য দেহধারী বালকে পরিণত হল । অষ্টাবক্র মুনি স্নান করতে নদীর দিকে রওনা দিলেন ।
বশিষ্ঠ মুনি বালকটিকে ওদের মায়েদের কাছে দিয়ে গেলেন । এমন দিব্যকান্তি পুত্র পেয়ে রানীরা আনন্দে উল্লসিত হয়ে উঠলেন ।
পুত্রের নাম রাখা হলো ভগীরথ । ভগে ভগে জন্ম বলে এই নামকরণ ।
তারপরের ঘটনা তো সর্ব জনবিদিত । ভগীরথের অসীম ধৈর্য্য এবং তপস্যার ফলস্বরূপ মা গঙ্গার মর্তে আগমন এবং সগর রাজার বংশধরদের মুক্তি লাভ ।
এখন প্রশ্ন, আমাদের পুরাণ, রামায়ণ, মহাভারতে যা যা তথাকথিত কাহিনী বা প্রযুক্তির উল্লেখ আছে তার সবটাই পরবর্তীতে বাস্তবে আবিষ্কৃত হয়েছে । আমরা দেখেছি নিয়োগ প্রথায় সন্তান লাভ,কুমারী মায়ের সন্তান হওয়া, পুস্পক রথ, আনবিক বোমা আবিষ্কার, দূরদর্শন, বেতার বাণী আরো অনেক কিছু । কিন্তু সমকাম এবং তার ফলে সন্তান উৎপাদন? এখনো এমন ঘটনা কোথাও ঘটেছে বলে জানা নেই।
তবে সমকাম যে পূর্বেও ছিল, ভগীরথের জন্ম কাহিনী- ই তার প্রকৃষ্ট প্রমান।
--------------------------------------------
তথ্যঋণ-
রামায়ণের আদি কান্ড। গঙ্গার জন্ম বিবরণ এবং মর্তলোকে সগরের গঙ্গা আনয়নের উপায় ও ভগীরথের জন্ম (পৃষ্ঠা ১৮--২০)
কৃত্তিবাসী রামায়ণ (গীতা প্রেস, গোরক্ষপুর )
----------------------------------------------------
রায়গঞ্জ, উত্তর দিনাজপুর