গল্প ।। পাত্রী দেখতে যাওয়া ।। সুচন্দ্রা বসু
ছবি - সংগৃহীত
পাত্রী দেখতে যাওয়া
সুচন্দ্রা বসু
ফোনটা বাজছিল। ব্যাগ থেকে বের করে ধরেতে যাব কেটে গেল। চেক করে দেখলাম
ঝুমা বউদি ফোন করেছিল। ঝুমা বউদি আমার পিসতুতো বড় জা। আমি তাকে বড়দি বলে ডাকি। সঙ্গে সঙ্গে রিং ব্যাক করে বললাম, বড়দি, কপাল ভালো ট্রেনটা মিস্ করিনি। বাড়ি থেকে বেরোতে একটু দেরি হয়ে গেছে, তাই তোমার দেওর ভাবছিল ট্রেনটা হয়তো ধরতে পারব না, যাই হোক পেয়ে গেছি। এবার শান্তি পেলাম যে তোমরা আসছো।
খুব চিন্তা হচ্ছিল। ওদের বলে রেখেছি তোমরা আজ মেয়ে দেখতে আসবে।
তুমি তো তোমার দেওরকে জানো কথার খেলাপ সে করে না।
অনেক দিন পরে দুজনে ট্রেনে করে যাচ্ছি বেশ ভালো লাগছে, ভাবছিলাম জেনারেল কম্পার্টমেন্টেই উঠবো দুজনে। কিন্তু এতো ভীড় কত্তা হুকুম দিল পাশের কামড়ায় উঠছি তুমি লেডিসেই উঠে যাও, তাই লেডিসেই উঠলাম। লেডিস কামড়া ফাঁকা ছিল? কপাল খারাপ হলে যা হয় আর কি।
উঠে দেখি সব সিট ভর্তি, কিছুক্ষণ পর অতি কষ্টে ঠেলাঠেলি করে একটা সিট দখল করলাম।
বসার জায়গা পেয়েছো তাহলে। যাক একটু শান্তি। হকারদের ধাক্কা খেতে হবে না।
কিন্তু ঐ যে বলে না " কপালে না থাকলে ঘি, ঠকঠকালে হবে কি" সেই দশা আমার।
- কেন গো ?
বসার পর থেকেই আমার পাশের মহিলা বলেই চলেছে " একটু চেপে চেপে বসুন, একটু চেপে বসুন, আর এক জনের জায়গা হয়ে যাবে। এটা চার জনের সিট আমরা রোজ যাই আমরা জানি।" আরে যাদের ফড়িং এর মতো চেহারা তারা চারজন বসতে পারে আমি তো গায়ে গতরে খুব একটা কম নয় এখানে কি করে চার জন বসবে?
লেডিস কামড়ায় এসব হয়ে থাকে জানি গো।
কি বলব মেয়েদের মানসিকতা দেখে রাগে পা দুটো যাহোক করে সরিয়ে চেপে বসলাম।
জানো বড়দি মনে মনে ভাবছিলাম, পিছনে ফোঁড়া হতে এতো কষ্ট হয়নি কোনদিন।
শোন যেটা বলছিলাম চায়ের দোকানের নামটা মনে আছে তো।
ওই তো জগবন্ধু গুছাইত টি সেন্টার। চন্দন নগর স্টেশনে নেমে একটু এগিয়ে এলেই দেখতে পাবে দোকানটি। ট্রেন থেকে নেমে এই দোকানের চা না খেয়ে কেউ বাড়ি যায় না। দেখবে প্যাসেঞ্জারগুলো নেমেই ওই দোকানের দিকে ছুটছে। আচ্ছা সাবধানে এসো একটা ফোন আসছে বলে কেটে দিল।
তখন আমার অপর পাশে চলছিল পি এন পি সি, কার শাশুড়ি কি করেছে, কার বউ কার সঙ্গে পালালো, কার পাড়ার কোন মেয়ে কোন ছেলের সঙ্গে প্রেম করছে এইসব আর কি, বিরক্তিকর হলেও একেবারে বাস্তব যা নিত্য ঘটে চলেছে।
কানের আর দোষ কি ভিড়ের ভিতর সেই ওদের
কথাই শুনতে পায়। কিন্তু চোখ টানে হকার।
এমনিতেই লেডিসকম্পার্টমেন্টে ভালোই ভিড় হয়। তারপর আবার জেনারেল কম্পার্টমেন্টের থেকে লেডিস কম্পার্টমেন্টে হকার বেশিই ওঠে। আর এখানে কি না পাওয়া যায় , গোড়ালি ঘসার ব্রাশ থেকে আরাম্ভ করে স্কচব্রাইট, কস্টিউম জুয়েলারি, কুর্তি, শাড়ি, চিরুনি সব পাওয়া যায়, যেন পুরো নিউমার্কেটটা ঘেঁটে চলেছি এখানে।
তার মধ্যে আমার সামনে এক এলোকেশী মামনি এক প্লেট আলু কাবলি নিয়ে এসে দাঁড়ালো।আপন মনে খেয়ে চলছে।আর জানলা দিয়ে আসা হাওয়ায় তার সব চুল এসে আমার মুখে পড়ছে, শেষে বাধ্য হয়েই বললাম " এই যে মামনি তোমার নিজের চুল নিজের দায়িত্বে রাখো।" মেয়েটি আমার দিকে কটমট করে তাকিয়ে চুলটা সরিয়ে নিল।
দেখলাম আলুকাবলিঅলা ভিড় ঠেলে আমাদের দিকেই এলো। অনেকে নিচ্ছে দেখে
আমারও মনটা খাই খাই করে উঠল। অনেক দিন খাওয়া হয় না তাই তাকে দেখে আমি একপ্লেট নিলাম। তখনই আমার সামনের সিটে
বসা একটা বাচ্চা ছেলে তার মায়ের কাছে বায়না ধরল আলু কাবলি খাবে। তার মা তো কিছুতেই কিনে দেবে না,আর সেও ছাড়বে না। তার মা যত বলছে ট্রেনে এসব খায় না, ওটা পচা আলু দিয়ে তৈরি, পচা গন্ধ ছাড়ছে।এরপর ছেলেটিকে তার মা কিনে দিল কি,না বলতে পারব না। আমি জানলা দিয়ে প্লেট ফেলে গেটের সামনে গিয়ে দাঁড়ালাম, সেখানেও কি শান্তি আছে? পিছন থেকে বলেই চলেছে " দিদি আপনি কি নামবেন? আচ্ছা জ্বালা নামব
বলেই তো গেটের সামনে এগিয়ে আসা।কানে
শুনতে পাচ্ছি আগলা স্টেশন চন্দননগর। গতি থামিয়ে স্টেশনে ঢুকল ট্রেন। থামতেই নেমে পড়লাম প্ল্যাটফর্মে। খুঁজতে থাকি আমার কত্তাটিকে। কাছে আসতেই বললাম উফ্ আর কোনদিন লেডিস কম্পার্টমেন্টে উঠবো না।
ঠিক আছে এখন চলো চায়ের দোকানের দিকে।
আগে একটু চা পান করে নেব। তারপর ওদের
বাড়ি যাব।
দূর থেকেই দেখা যাচ্ছিল ভীড়। একটু কাছে আসতেই দোকানের নামটা চোখে পড়ল।
এটাই সেই চায়ের দোকান। বিশেষ
কাউকে জিজ্ঞেস করতে হয়নি যে চায়ের দোকানটা কোথায়। চা খাওয়ার জন্য এতো ভীড় এই দেখলাম। সেখানে দাঁড়াতেই বুঝতে পারলাম এরা সব রোজের খোদ্দের। চা নিতে এগিয়ে গেলাম হাত বাড়িয়ে চা নিতে গিয়ে দেখলাম সে আমার পরিচিত।
ভীড় থাকায় বিশেষ কথা বলা আর হয়নি।
বলল এখানে কোথায়?
বললাম মেয়ে দেখতে চড়ক ডাঙায় যাব।
ও আমাদের পাড়ায়? কাদের বাড়ি?
মিত্রদের বাড়ি।
ওদের বাড়িতে মেয়ে কোথায়?
মিত্রদার শ্যালিকা ওর ননদের মেয়েকে নিয়ে এখানে আসবে।
কোথায় থাকে ননদ?
শ্যালিকার ননদ ব্যাঙ্গালোরে থাকে।
আচ্ছা আসি। ফোনে কথা হবে বলে একটা রিকশায় উঠে রওনা হলাম দাদার বাড়ির দিকে।
আমাদের দেরি হচ্ছে দেখে বাড়ির দরজায় দাঁড়িয়ে ছিল দাদা। আমাদের দেখেই বলল ট্রেন তো অনেকক্ষণ ঢুকে পড়েছে। চায়ের দোকান খুঁজে পাওনি। না না ওই চায়ের দোকানের মেয়েটির সাথে কথা বলতে গিয়ে দেরি।
কি বলছিল সে ?
বহুদিন পরে দেখা হল।
মানে?
কলেজে পড়তাম একসাথে। তারপর আর
দেখা হয়নি দুজনের কারোর সাথে। এক হাতে চা আর মুখে সাথী তুই! কেমন আছিস এইটুকুই সেরে ফোন নম্বর রাখলাম দুজনেই দুজনের।
ওই মেয়েটিই তো চায়ের দোকানটিকে চালায়।ওই দোকান থেকেই ওদের সংসার চলে।
সত্যি সুন্দর চা বানায়। আমরা খেয়ে টেস্ট করলাম।
ভিতরে গিয়ে বসলাম। পাত্রী দেখলাম। গায়ের রঙ ফর্সা মুখশ্রী ভালো। তবে কতটা স্মার্ট বুঝতে
পারিনি। বললাম উপস্থিত বুদ্ধি এবং স্মার্ট মেয়েই ছেলের পছন্দ। ঘোমটা টেনে ঘরে বসা
বউ তার চলবে না। ঘরে বাইরে সবদিক সামলাতে পারবে এমন মেয়েই পছন্দ। দাদা মেয়েটিকে জিজ্ঞেস করল কি রে পারবি সবদিক সামলাতে?
মেয়েটি মাথা নীচু করে বসেছিল।
তারপর সকলে নানা গল্পে ভেসে গেলাম। কথায় কথায় জানতে পারলাম সাথীর বরের প্রমোটিং-এর ব্যবসা। উঠবো উঠবো করছি হঠাৎই একটা ভয়ঙ্কর বিকট শব্দে চারদিক কেঁপে উঠল। রাস্তায় হৈচৈ শুরু। চা দোকানে বোম পড়েছে। জগুদা খুন।
দাদা বাইরে বেড়িয়ে খবর নিয়ে আসে যে জগবন্ধু গুছাইত টি সেন্টারে বোম পড়েছে। এক ভ্যান পুলিশ এসে তদন্ত শুরু করেছে। রাস্তা শুনশান হয়ে গেছে।
সময় বাড়ছে আমাদের ফিরতে হবে। দোকানপাঠ বন্ধ হয়ে যাচ্ছে। পরিস্থিতি আয়ত্তে আসতেই দেরি না করে বেড়িয়ে পড়লাম দুজনে। রিকশাঅলারা স্টেশনের দিকে যেতে চাইছিল না। ওদের বাড়ি থেকে স্টেশনের দূরত্ব খুব বেশি নয় বলেই আমরা হেঁটে স্টেশনের দিকে এগিয়ে গেলাম।
রাস্তায় তখন পুলিশ ছড়িয়ে ছিটিয়ে ছিল পাহাড়ায়। ফেরার সময় ভাবছিলাম শুধু সাথীর কথা। রাস্তার লাইট পোস্টের আলোতে দেখলাম সাথীর সাজানো জগবন্ধু টি সেন্টারের বিধস্ত দশা।
--------------------------------------