প্রবন্ধ ।। প্রেমের আলোয় নজরুল ।। তন্দ্রা দাশগুপ্ত
ছবি - সংগৃহীত ।
প্রেমের আলোয় নজরুল
তন্দ্রা দাশগুপ্ত
কাজী নজরুল ইসলামকে অধিকাংশ মানুষ 'বিদ্রোহী কবি' হিসেবেই জানেন। কিন্তু এর ফলে বোধহয় তাঁর প্রতিভার সঠিক মূল্যায়ণ করা সম্ভব হয়নি। কারণ নজরুল শুধু বিদ্রোহী কবিই ছিলেন না, তিনি ছিলেন প্রেমের কবি। তাঁর সৃষ্টির এক পিঠে যদি থাকে বিদ্রোহ, অন্যপিঠেই তাহলে রয়েছে অমর প্রেমের বাণী। অগ্নিবীণার বিদ্রোহী কবি হলেও মানুষের হৃদয়ের চিরন্তন প্রেম-বিরহ, ব্যথা-বেদনা কবি ভুলে যাননি। তাঁর কাব্যের একদিকে শোনা যায় জঙ্গী দামামা, লড়াইয়ের মত্ত ভেরী----আর অন্য দিকে বাজে বেনুবীণার মধুর ঝঙ্কার, শ্যামের বাঁশরী, বুলবুলির গুঞ্জনে মশগুল গুল বাগিচায় সাকীর কন্ঠে হাফিজী গজল। নজরুলের 'দোলনচাঁপা', 'ছায়ানট', 'সিন্ধুহিল্লোল', 'চক্রবাক' প্রভৃতি কাব্যগ্রন্থে, অসংখ্য গানে এবং বিভিন্ন সাহিত্য সৃষ্টিতে সেই অনুভূতিই প্রতিফলিত হয়েছে।
নজরুল বারে বারে তাঁর বিদ্রোহী রোমান্টিক সত্ত্বার পরিচয় দিতে গিয়ে 'আমি' শব্দটি ব্যবহার করেছেন। এই 'আমি' একদিকে বিদ্রোহী---ধ্বংসের প্রবক্তা, অন্যদিকে এই 'আমি'র মধ্য দিয়েই তাঁর প্রেমিক সত্ত্বাটি সুস্পষ্ট হয়ে ওঠে। তাই কবির যথার্থ পরিচয় হল :
"মম একহাতে বাঁকা বাঁশের বাঁশরী
আর হাতে রণতূর্য।"
নজরুলের রোমান্টিক মন দৈনন্দিন জীবনের হাসিকান্না, আশা-নিরাশা, আর মিলন-বিরহের ভিতরেও আনন্দ, সৌন্দর্য আর মাধুর্য খুঁজে বেড়িয়েছে, জীবনকে সে ভোগ করতে চায়, এর তাৎপর্য আবিষ্কার করতে চায় না।
নজরুলের বহু কাব্য সাহিত্যের সৃষ্টিতেই রয়েছে নারী-প্রেমের প্রেরণা। 'সাম্যবাদী' কবিতায় তাঁর এই প্রেমিক মনটিই ফুটে উঠেছে :
"নারীর বিরহে নারীর মিলনে
নর পেল কবি-প্রাণ
যত কথা তার হইল কবিতা
শব্দ হইল গান।"
বাস্তব জীবনেও প্রেম-বিরহের আগুনই কবিকে অবিরাম দগ্ধ করেছে। আর তাই তাঁর অধিকাংশ কবিতাই সেই দগ্ধ হৃদয়ের বহিঃপ্রকাশ। অনেকের মতে, তাঁর প্রথমা স্ত্রী নার্গিসের বিরহ ব্যথা যদি তাঁর বুকে এত তীব্র আঘাত না করত, তাহলে তাঁর কাব্যের ধারা হয়ত সম্পূর্ণ অন্য খাতে প্রবাহিত হত। প্রিয়ার বিরহ ব্যথাই তাঁর লেখায় পরিষ্কার ফুটে উঠেছে :
"দূরের প্রিয়া পাইনি তোমায়
তাই এ কাঁদন রোল......."
পনেরো বছর পরেও এখানে নার্গিস কবির স্মৃতিতে উজ্জ্বল। নার্গিসের প্রচন্ড জ্বরের সময় কবির তৃষিত দুটি হাত তাঁর প্রিয়ার সুন্দর তপ্ত কপাল স্পর্শ করতে পেরেছিল। তখন তাঁর চোখে ছিল জল, হাতে ছিল সেবা করার আকুল স্পৃহা, অন্তরে ছিল বিধাতার চরণে প্রিয়ার আরোগ্যলাভের জন্য কাতর মিনতি। এক দুর্দমনীয় প্রেমের জোয়ার সেদিন তাঁর হৃদয়ে এসেছিল, যে স্মৃতি মহাকালও মুছে ফেলতে পারেনি।
বৈষ্ণব কাব্য ও রবীন্দ্রনাথের প্রেমের কবিতার প্রভাব থাকা সত্ত্বেও নজরুলের প্রেমের কবিতা স্বতন্ত্রতায় উজ্জ্বল। কাব্যে তাঁর উত্তপ্ত আবেগ চরম উন্মাদনার রূপ নিয়েছে। বস্তুত দেবেন সেনের রূপ ও রস চেতনা, অক্ষয় বড়ালের রোমান্টিক আদর্শবাদ, আর গোবিন্দদাসের বলিষ্ঠ দেহবাদের মিশ্রণে তৈরি নজরুলের প্রেমকাব্য বাংলা সাহিত্যের এক উজ্জ্বল নতুন অধ্যায়। নজরুলের প্রেম মোহিতলালের মত গভীরতাসম্পন্ন, নানা রঙে রাঙানো এবং তীব্র গতিযুক্ত না হলেও ব্যক্তিগত অভিজ্ঞতার যন্ত্রণায় তা অনেক বেশি বেদনাবিধুর, আবেগভরা ও প্রাণবন্ত। তাঁর প্রেমের প্রকাশ মূলত জীবনমুখী ও দৈহিক হলেও, দেহাতীতের ব্যঞ্জনাও তাতে অনুপস্থিত নয়।
'অগ্নিবীণা'য় কবির অন্তরে যে প্রেমের পিপাসা অতৃপ্ত রয়ে গিয়েছিল, তাঁর দ্বিতীয় কাব্যগ্রন্থ 'দোলনচাঁপা'য় ঘটেছে তারই অসামান্য প্রকাশ। এই বইটি সম্পর্কে ১৯২৪ সালের শ্রাবণ মাসে 'বঙ্গবাণী'তে বলা হয়েছিল :
"সামরিক কবির প্রেমের উল্লাস তাঁহার
সামরিক উচ্ছ্বাসের মতই ঝড়ের
হাওয়ায় বহিয়াছে ।"
'পূজারিণী' কবিতায় পূজারিণীর সাথে তাঁর প্রেমের বর্ণনায় কবি দুজনের জন্ম-জন্মান্তরের মিলন-বিরহ, আশা-নিরাশা, মান-অভিমান প্রভৃতি ফুটিয়ে তুলেছেন। প্রেয়সীকে পূজারিণী রূপে কল্পনায় এখানে প্রেমের একটি পবিত্র রূপ ফুটে উঠেছে :
"বিজয়িনী নহ তুমি -- নহ ভিখারিণী,
তুমি দেবী চিরশুদ্ধা তাপস-কুমারী,
তুমি মম চিরপূজারিণী।"
কিন্তু প্রেমের ক্ষেত্রে ব্যক্তিগত জীবনে এক নারীর ছলনায় ক্ষুব্ধ হওয়ায় প্রেমিকার পূজারিণী মূর্তিকে মাঝে মাঝে ছলনাময়ী বলে কবির সংশয় জাগে এবং তার একনিষ্ঠ প্রেমকেও মিথ্যে মনে হয় :
"যে পূজা পূজিনি আমি স্রষ্টা ভগবানে,
যারে দিনু সেই পূজা সে-ই আজি প্রতারণা হানে।"
কবির মতে প্রেমিকার বাস মানুষের মনেই। তাকে নিজের মনের মাধুরী মিশিয়ে সৃষ্টি করতে হয়। তাইতো কবি বলেছেন :
"নাইবা পেলাম আমার গলায় তোমার গলার হার
তোমায় আমি করব সৃজন -- এ মোর অহঙ্কার।"
নজরুলের 'অবেলার ডাক' কবিতাটিতেও এক বিরহী নারী-হৃদয়ের গভীর অনুভূতির প্রতিফলন ঘটেছে। কবি এখানে প্রেমের অমোঘ শক্তিতে বিশ্বাসী। তিনি বিশ্বাস রাখেন, প্রেমিক-প্রেমিকা পরস্পরের থেকে হারিয়ে গেলেও প্রেমের শক্তিতে তাদের মিলন ঘটবেই। ইংরেজ কবি শেলীর বিখ্যাত 'দি সেনসেটিভ প্ল্যান্ট' কবিতাতেও প্রেমের এই অমরত্ব খুঁজে পাওয়া যায়।
'শেষ প্রার্থনা' কবিতায় প্রেমিক নজরুল প্রেমিকার বিদায় লগ্নে, এই জন্মেই সমস্ত দুঃখ-কষ্টের অবসান ঘটিয়ে পরজন্মের আনন্দময় প্রেমের আবাহন কামনা করেছেন---ইহজীবনে যে মিলন পূর্ণতা পেল না, পরজীবনে তা যেন চোখের জলে শুদ্ধ হয়ে সফল হয় :
" আজি চোখের জলে প্রার্থনা মোর শেষ
বরষের শেষে,
যেন এমনি কাটে আসছে জনম তোমায়
ভালবেসে .......
যেন খন্ড মিলন পূর্ণ করে নতুন জীবন এসে।"
কবির 'চাঁদনী রাতে' কবিতার মূল সুরেও রয়েছে ব্যক্তিপ্রেমের মিষ্টি ব্যঞ্জনা। নতুন বর-বধূর বাসর ঘরের সলজ্জ প্রথম আলাপের মতই প্রেমের বিষয়টিকে তিনি আকাশ, তারা, ফুল, রাত্রি, জ্যোৎস্না প্রভৃতির মাধ্যমে ফুটিয়ে তুলেছেন :
" সাতাশ তারার ফুল তোড়া হাতে
আকাশ নিশুতি রাতে
গোপনে আসিয়া তারা পালঙ্কে
শুইল প্রিয়ার সাথে। "
'দোলনচাঁপা'র মধ্যে নজরুলের প্রেম জীবনের যে সুর আরম্ভ, 'ছায়ানটে'র মধ্যে সেই সুর আরো পরিণতি লাভ করেছে। আর এই বইয়ের প্রথম কবিতা 'বিজয়িনী'র মধ্যে শুধু 'ছায়ানটে'র মূল সুরই ফুটে ওঠেনি, নজরুলের প্রেমিক মনের প্রকৃত চেহারাও এখানে ধরা পড়েছে। ১৯২১ সালের শেষদিকে বাংলাদেশের কুমিল্লায় বীরেন্দ্রকুমার সেনগুপ্তের বাড়িতে থাকাকালীন নজরুল 'বিজয়িনী' কবিতাটি লেখেন। বীরেন্দ্রকুমারের জ্যাঠতুতো বোন প্রমীলা তথা আশালতার সাথে নজরুলের ছিল প্রেমের সম্পর্ক--পরে যা বিবাহের পরিণতি লাভ করে। তাই 'বিজয়িনী' কবিতাটিতে কবির ব্যক্তিগত প্রেম জীবনের ছায়া পড়েছে--এটা মনে করা যেতেই পারে। 'বিজয়িনী' কবিতাটি পড়লে বোঝা যাবে, নজরুলের জীবনের মত কাব্যসৃষ্টিতেও প্রেমই ছিল মুখ্য উপাদান। আর এই প্রেমলাভের জন্যই তাঁর প্রচন্ড বিদ্রোহ। প্রিয়াকে পেয়ে আনন্দের আতিশয্যে যৌবনের কবি তাই সাধারণ মানুষের মত প্রিয়ার কাছে প্রেম প্রার্থনা করেননি---বরং প্রিয়ার চরণে নিজেকে অর্পণ করার মাধ্যমে প্রেম নিবেদন করে অসাধারণ হয়ে উঠেছেন। এইভাবে এক বিরাট প্রেমরাজ্যের অধীশ্বর হয়ে কবি প্রিয়ার কানে কানে গোপনে বলেছেন :
"হে মোর রাণী !
তোমার কাছে হার মানি আজ শেষে,
আমার বিজয় কেতন লুটায় তোমার চরণতলে এসে।" প্রসঙ্গত উল্লেখ্য, মানবিক প্রেমকে কেন্দ্র করেই যে মুক্তিযোদ্ধার চিন্তা, কর্ম, সংগ্রাম সবকিছু আবর্তিত হয়, এই অনুভব ও ধারণাটি নজরুলের মতই তুরস্কের বিদ্রোহী কবি নাজিম হিকমত-ও তাঁর 'লেটারস ফ্রম প্রিজন' কবিতায় চমৎকার ভাবে বলেছেন।
'ছায়ানটে'রই 'চৈতিহাওয়া' কবিতায় আবার কবিকন্ঠে শোনা গেছে ছন্দের অসাধারণ বিষাদক্লিষ্ট সুর। প্রিয়া হারিয়ে যাওয়ায় তিনি মর্মাহত। এক বসন্তে তাঁর সাথে প্রিয়ার পরিচয় হয়েছিল, আজ আর এক বসন্ত কেঁদে চলে যায়, তবুও প্রিয়ার দেখা নেই।
'নিশীথ প্রীতম', 'অবেলায়', 'বিদায় বেলায়' প্রভৃতি বহু কবিতাতেই নজরুল প্রেমের বিচিত্র রূপ ফুটিয়ে তুলেছেন। 'দুলুর অভিসার' কবিতাটিতেও কবি প্রেমের চাপল্য ও অস্থিরতাকে সূক্ষ্ম রেখার এঁকেছেন, যেখানে বৈষ্ণব সাহিত্যের অভিসারমূলক কবিতার প্রভাব দেখা যায়। তাঁর 'গোপনপ্রিয়া' কবিতাটিতেও বেজে উঠেছে প্রিয়া বিরহের রাগিণী। কবি কিছু পাবার প্রত্যাশা না করেই আজীবন তাঁর প্রিয়াকে শুধু প্রেমদান করে যেতে চান :
" শিল্পী আমি , আমি কবি
তুমি আমার আঁকা ছবি
আমার লেখা কাব্য তুমি, আমার রচা গান,
চাইবো নাকো পরাণ ভরে করে যাব দান।"
বিষণ্ণ ব্যথার করুণ রাগিণী নজরুলের প্রেমের কবিতার অন্যতম বৈশিষ্ট্য। 'চক্রবাক', 'তোমাকে পড়িছে মনে' প্রভৃতি এর চমৎকার উদাহরণ। প্রেমের কবি এখানে তাঁর প্রিয়াকে খুঁজে বেড়িয়েছেন প্রকৃতির মধ্যে। তাঁর 'নীলপরী' কবিতায় মাঠঘাট, আকাশ-বাতাস, নদী, বনজঙ্গল, সর্বত্রই তিনি প্রকৃতি-প্রিয়ার অস্তিত্বকে অনুভব করেছেন। প্রকৃতির বৈচিত্র্যময় দৃশ্যের মধ্যে প্রেম সম্পর্কে কবির উপলব্ধিই 'স্তব্ধ বাদল' কবিতাটির মূল বিষয়। 'আশা' ও 'সন্ধ্যাতারা' কবিতাদুটির মধ্যেও কবি তাঁর প্রেমকে প্রকৃতির সাথে একাত্মতার বন্ধনে বেঁধেছেন :
"এই যে নিতুই আসা--যাওয়া
এমন করুণ মলিন চাওয়া
কার তরে হায় আকাশ--বঁধূ
তুমিও কি প্রিয় হারা।"
শেলীর মতই নজরুলও সারা বিশ্বজগতে প্রেমের ব্যাপ্তি অনুভব করেছেন :
"তরুলতা, পশু,পাখি, সকলের কামনার সাথে
আমার কামনা জাগে, আমি বসি বিশ্ব-কামনাতে।"
প্রেমিক নজরুলের ধারণা, আনন্দের মাধ্যমে প্রেমের আসল চেহারা প্রকাশ পায়না। তাই তিনি বিরহের গভীরে প্রেমের ধ্যান করতে আগ্রহী। 'বাদল রাতের পাখি' কবিতায় তিনি পাখিকে বিরহলোকে উড়ে যেতে বলেছেন। খোলা জানালাপথে কবি শুনতে পেয়েছেন গাছের শাখা যেন মর্মরিত হয়ে উঠেছে "পিউ কাঁটা পিউ কাঁহা" বলে। 'কর্ণফুলী' কবিতাটিতেও শোনা গেছে একই বিষণ্ণ প্রেমের সুর। এখানে কবি কর্ণফুলীকে তাঁর প্রিয়ার সাথে এক করে ফেলেছেন :
"তুমি কি পদ্মা হারানো গোমতী
ভুলে যাওয়া ভাগীরথী
তুমি কি আমার বুকের তলার
প্রেয়সী অশ্রুমতী ?"
কবির প্রেমিক হৃদয়ের এক বিচিত্র ভাব প্রকাশ পেয়েছে 'গানের আড়াল' কবিতায়। কবির গান বহু লোককে আনন্দ দিলেও তা তাদের অন্তরের সামগ্রী হয়ে ওঠে না। তাই নজরুলের আকাঙ্খা, তিনি যেন তাঁর গানের ভেতর দিয়ে প্রেমিকার হৃদয়ের কাছে পৌঁছাতে পারেন :
"ভোলো মোর গান, কি হবে লইয়া এইটুকু পরিচয়
আমি শুধু তব কন্ঠের হার, হৃদয়ের কেউ নয়।
জানায়ো আমারে, যদি আসে দিন, এইটুকু শুধু যাচি
কন্ঠ পারায়ে হয়েছি তোমার হৃদয়ের কাছাকাছি।"
বর্ষায় প্রিয়া বিরহকে বৈষ্ণব কবিদের মতই 'বাদলদিনে' কবিতায় নজরুল চমৎকার ফুটিয়ে তুলেছেন। এখানে রবীন্দ্র-প্রভাবও যথেষ্ট :
" বিদরে হিয়া মম
বিদেশে প্রিয়তম
এ জনু পাখি সম
বরিষা জর জর। "
বিভিন্ন সাহিত্য সৃষ্টিতে নজরুল বলতে চেয়েছেন যে, নারী ছাড়া পুরুষ অসম্পূর্ণ। তাজমহল সুন্দর ও রমণীয় এ-জন্যই, যে তার ভেতরে আছে মমতাজের ভালোবাসা। নজরুল তাই নিজেও তাঁর কাব্যের কথা বলতে গিয়ে তাঁর প্রিয়ার কাছে আত্মসমর্পণ করে তার প্রেরণা ও সহযোগিতার কথা অসঙ্কোচে স্বীকার করে নিয়েছেন :
"বিশ্বে যা কিছু মহান সৃষ্টি চির কল্যাণকর,
অর্ধেক তার করিয়াছে নারী, অর্ধেক তার নর।"
অথবা----
"তুমি আমায় ভালোবাসো, তাই তো আমি কবি,
আমার এ রূপ-- সে যে তোমার ভালোবাসার ছবি।"
নজরুল ধীরে ধীরে যুদ্ধ-সাজ ত্যাগ করে প্রেমিকে রূপান্তরিত হয়েছেন। যৌবনদীপ্তিতে ঝলসে ওঠার পর একসময় তিনি ঘরমুখী হয়ে চিরদিনের প্রেয়সীর সাথে মিলিত হতে চেয়েছেন। যৌবনে প্রিয়াই মানুষের শ্রেষ্ঠ বান্ধবী। অথচ সেই রঙিন দিনগুলিতে কবি তাঁর প্রিয়াকে কাছে না পাওয়ায় তাঁর আশঙ্কা, হয়ত প্রিয়ার সাথে দেখা হবার আগেই তাঁর জীবনদীপ নিভে যেতে পারে। তাই তিনি প্রিয়ার জন্য নিজের হৃদয়েও শত কান্নার শব্দ শুনতে পান :
" আরও কতদিন বাকী ?
বক্ষে পাওয়ার আগে বুঝি হায়
নিভে যায় মোর আঁখি। "
'আশা' কবিতাটিতে দেখা যায়, কবির মতে প্রেমিকার প্রেম তখনই মহত্বপ্রাপ্ত হয়, যখন তার কাছে কলঙ্কী ও বিপথগামী প্রেমিকও ক্ষমা পায়। 'হোলি' কবিতাটিতেও প্রেমের চাপল্য ও মুখরতার মাত্রাতিরিক্ত প্রকাশ ঘটেছে। শ্যাম এখানে বৃন্দাবনের কৃষ্ণ নন, তিনি সাধারণ মানবিক প্রেমের ব্যক্তিমূর্তি।
নজরুল প্রেমের অমরতায় বিশ্বাসী। তবে প্রেমের ক্ষেত্রে তাঁর মধ্যে আপাত বৈপরীত্য প্রকাশ পেয়েছে। কখনও কবি দেহাত্মক কামনায় আকুল :
"তোমারে করিব পান,অ-নামিকা,শত কামনায়,
ভৃঙ্গারে, গেলাসে কভু, কভু পেয়ালায়।"
কোথাও আবার তাঁর প্রেম পরশ পাথরের মত জীবন কে সুন্দর করে তোলে। তখন কামনামুক্ত জীবন পুরনো স্মৃতি ও বিরহের দীপ্তিতে উজ্জ্বল হয়ে ওঠে :
" সুন্দর কঠিন তুমি পরশ পাথর
তোমার পরশ লভি হইনু সুন্দর। "
আসলে একদিকে অতিন্দ্রীয় সৌন্দর্যচেতনা, অন্যদিকে মূর্তিমতী নারী---এই দুয়ের বিরোধ-মিলনে নজরুলের কবি মানসে এক বিচিত্র আবর্ত সৃষ্টি হয়েছে।
নিপীড়িত, অসহায় মানুষের প্রতি নজরুলের ছিল গভীর দরদ আর সহানুভূতি। একদিন এক কুলির প্রতি জনৈক সাহেবের হীন ব্যবহার দেখে তিনি খুব আঘাত পেয়ে লিখেছিলেন :
" দেখিনু সেদিন রেলে
কুলি বলে এক বাবুসাব তারে ঠেলে দিল
নীচে ফেলে---
চোখ ফেটে এল জল
এমনি করে কি জগৎ জুড়িয়া
মার খাবে দুর্বল ? "
সমাজের চোখে ঘৃণার পাত্রী পতিতা নারীদেরও কবির প্রেমিক মন 'অশুচি' মনে করেন নি। তাই তাদের উদ্দেশ্যে কবি বলেছেন :
" নাই হলে সতী, তবু তো তোমরা মাতা ভগিনীরই জাতি..."
নজরুল যৌবনের কবি, আর প্রেমের মহোত্তম প্রকাশ ঘটে যৌবনেই। যুবক বয়সে লেখা 'বিদ্রোহী' কবিতায় কবি তাই বিদ্রোহের গান গাইলেও সেখানে জীবনের মহোত্তর অনুভূতি প্রেমের নম্রমধুর প্রকাশও না ঘটে পারেনি :
"আমি অভিমানী চির ক্ষুব্ধ হিয়ার
কাতরতা ব্যথা সুনিবিড়
চিত চুম্বন চোর কম্পন আমি থরথর থর
প্রথম পরশ কুমারীর
আমি গোপন প্রিয়ার চকিত চাহনি
'ছল করে দেখা অনুক্ষণ
আমি চপল মেয়ের ভালবাসা
তার কাঁকন চুড়ির কনকন।"
এখানেই কবি প্রেমিক হৃদয়ের আত্মপরিচয় ঘোষণা করেছেন :
" আমি বন্ধনহারা কুমারীর বেণী
তন্বী নয়নে বহ্নি
আমি ষোড়শীর হৃদি সরসিজ প্রেম
উদ্দাম আমি ধন্যি। "
'বিদ্রোহী' কবিতায় সর্বগ্রাহী বিদ্রোহ ঘোষণা করতে গিয়ে নজরুল হঠাৎই লাজনম্র, অভিমানভীরু কিশোরীর কান্নাভেজা ভালবাসার ছোঁয়ায় আত্মহারা হয়েছেন। আর তারপরেই কবিকন্ঠে শোনা গেছে মর্মান্তিক বিরহের কথা :
" শিউলী ঢাকা মোর সমাধি
পড়বে মনে , উঠবে কাঁদি
বুকের মালা করবে জ্বালা
চোখের জলে সেদিন বালা
মুখের হাসি ঘুচবে
বুঝবে সেদিন বুঝবে। "
এক সাহিত্যিক বন্ধুর বাড়ি গিয়ে সেখানে জানালার পাশে একসারি সুপুরি গাছ দেখে প্রেমিক নজরুলের মনে হল তাঁর মানসপ্রিয়া বুঝি নিজেই সেখানে উপস্থিত। ব্যথা, অশ্রু, অভিমান সবকিছু মিশিয়ে রঙেরূপে নানা ভঙ্গীতে কবি তাদের সাজালেন। সাধারণ সুপুরি গাছের সারিকেও কবির সৃষ্টি এক নৈর্ব্যক্তিক সুরলোকে পৌঁছে দিয়েছে :
" চমকিয়া জাগি ললাটে আমার
কাহার নিঃশ্বাস লাগে ?
কে করে ব্যাজন তপ্ত ললাটে
কে মোর শিয়রে জাগে ?
জেগে দেখি, মোর বাতায়ন-পাশে
জাগিছে স্বপনচারী
নিশীথ রাতের বন্ধু আমার
গুবাক তরুর সারি।"
নজরুলের গানেও রয়েছে দৈনন্দিন জীবনের ছোট ছোট হাসি-কান্না, প্রেম-ভালবাসা আর মিলন-বিচ্ছেদ। কবির ব্যক্তিগত জীবনের ছায়াও পড়েছে বহু গানে। কবিতার ক্ষেত্রে নজরুল যদিও বা কিছুটা বক্তব্য ভারাক্রান্ত হয়ে থাকেন, গানের ক্ষেত্রে তাঁর প্রেম একেবারেই তত্ত্বভারহীন---ভাব, আবেগ, যন্ত্রণা, মান-অভিমান, তৃষ্ণা, জ্বালা ও ঈর্ষার এক মেশানো চেহারা। কোথাও অসীম বা অনন্তের আকুতি নেই। প্রকৃতি এখানে মুক্তির সুর শোনায় নি, হৃদয়ের তালে তাল মিলিয়েছে। বাংলার বেল, যুঁই, রজনীগন্ধা, শেফালীর সাথে তিনি হাস্নুহানা আর গোলাপের বাগান বসিয়েছেন। আর এই ফুলে ভরা প্রেমের রসেই তাঁর মনের অভিসার। তা বেদনায় বিষণ্ণ হলেও এটাই নজরুলগীতির মূল বিষয়বস্তু। 'পূবের হাওয়া' কাব্যগ্রন্থের প্রথম কবিতা 'মরমী' একটি অসাধারণ প্রেমের গান। এখানে কবি বলেছেন, মনকে বাইরে বাঁধতে গেলে ভেতরকার ক্ষত বেড়েই চলে। উভয়ের মর্মব্যথা শুধু পরস্পরেই বুঝতে পারে, অন্য কেউ তা অনুভব করতে পারে না। "শাওন রাতে যদি স্মরণে আসে মোরে", "অঞ্জলি লহ মোর সঙ্গীতে" প্রভৃতি গানে কবি সুরে ও কথায় প্রেমের এক মায়াময় জগৎ সৃষ্টি করেছেন। প্রেমের গানে নজরুলের ব্যথাতুর কোমল আকুতি শোনা গেছে :
" আমার গহীন জলের নদী
আমি তোমার আশায় রইলাম ভেসে জনম অবধি।"
বুলবুল পাখি প্রেমিকের প্রতীক, আর যে গুল বা গোলাপ ফুল বর্ণোজ্জ্বল সৌন্দর্যের অধিকারিণী, সে হল প্রেমিকার প্রতীক। একটি চিত্রকল্পের সাহায্যে পারস্যের কবিরা ব্যর্থ প্রেমের ভাবটি ফুটিয়ে তুলতেন। সেটি হল, গোলাপের কাঁটার আঘাতে বুলবুলের বুক রক্তাক্ত হয় কিন্তু গোলাপকে পাবার আশা পূরণ হয় না। নজরুলের গানে-গজলেও এই অপূর্ণ প্রেম অসাধারণ কাব্যরূপ লাভ করেছে :
" বুলবুলি নীরব নার্গিস বনে,
ঝরা বন গোলাপের বিলাপ শোনে। "
কিংবা----
" গুল বাগিচার বুলবুলি আমি
রঙিন প্রেমের গাই গজল। "
নজরুলের বিখ্যাত গজল "করুণ কেন অরুণ আঁখি"-র মধ্যেও প্রেম আর বেদনা মিলেমিশে আছে। 'স্কাইলার্ক' সম্পর্কে চিরকালের রোমান্টিক কবি শেলীর ছায়াই যেন এখানে ফুটে উঠেছে নজরুলের গানে। তাঁর গজলের দেহে ও মনে যেন প্রেমিকের কান্না গুমরে গুমরে উঠেছে। মানুষের ট্র্যাজেডি-তাড়িত অন্তরের ব্যথা ও বেদনা থেকে শব্দ গেঁথে গেঁথেই নজরুল তৈরি করেছেন তাঁর তুলনাহীন প্রেমের ইমারত।
বাংলাদেশের প্রেমের গান প্রধানত দেহ থেকে দেহাতীতের পথে এগিয়েছে। কিন্তু নজরুলের গানে মার্জিত ভঙ্গীতেই যুগধর্মসম্মত দেহবাদ প্রতিফলিত হয়েছে। তাঁর গানে বিরহের অশ্রুই হয়ে উঠেছে প্রেমের মণিমুক্তো। এ-প্রসঙ্গে "মুসাফির মোছ রে আঁখিজল", "পাষাণের ভাঙালে ঘুম কে তুমি সুরের ছোঁয়ায়" প্রভৃতি গান উল্লেখযোগ্য।
নজরুলের একাধিক ছোট গল্পেও তাঁর প্রেমিক মনের পরিচয় পাওয়া যায়। 'বাদল বরিষণে', 'ঘুমের ঘোরে', 'অতৃপ্ত কামনা', 'রাজবন্দীর চিঠি' এইসব গল্পগুলির মধ্যে তাঁর কবিসুলভ মনের বিরহকাতর অশ্রুসিক্ত প্রেমের স্মৃতিমন্থনের কাহিনী লেখা আছে। উচ্ছ্বাসের কিছুটা আতিশয্য থাকলেও গল্পগুলিতে প্রেমিক হৃদয়ের সূক্ষ্ম মনস্তস্ত্ব, আবেগ ও অনুভূতিপ্রবণ মনের সুস্পষ্ট অস্তিত্ব ধরা পড়েছে। ঘটনার ঘনঘটার অভাব সেখানে অনেকটাই পূরণ করে দিয়েছে কবির কবিত্বময় তীব্র ইন্দ্রিয়ানুভূতি। 'রিক্তের বেদন' এবং ' শিউলিমালা' গল্প দুটিতেও প্রেমিক হৃদয়ের সূক্ষ্ম অনুভূতিগুলি নজরুলের লেখনীতে কাব্যময় হয়ে উঠেছে। বিরহী প্রেমের সান্ত্বনা ও আকাঙ্খা তাদের রহস্যময় গভীরতা নিয়ে এখানে হাজির হয়েছে। 'অগ্নিগিরি' গল্পে দেখা যায়, নূরজাহানের প্রেমের স্পর্শে সবুরের ঘুমিয়ে থাকা পৌরুষ জেগে উঠেছে। নজরুলের বাস্তব জীবনই প্রতিফলিত হয়েছে এই কাহিনীতে। কবির জীবনে যে প্রেম এসেছিল, তার আভাস তিনি দিয়েছিলেন তাঁর 'ব্যথার দান' গল্প-গ্রন্থের উৎসর্গ অংশে। এটি তিনি উৎসর্গ করেছিলেন এক নাম-না-নেওয়া কিশোরীকে :
"মানসী আমার। মাথার কাঁটা চেয়েছিলুম
বলে ক্ষমা করোনি, তাই বুকের কাঁটা দিয়ে
প্রায়শ্চিত্ত করলুম।"
১৯৪১ সালের ১৬ই মার্চ বনগ্রামে সাহিত্য সম্মেলনে সভাপতিত্ব করতে গিয়ে নজরুল বলেন :
".......আমার এই পরম মধুময় অস্তিত্বে
প্রেম শক্তিতে আত্মসমর্পণ করে আমি
বেঁচে গেছি , আমার অনন্ত জীবন কে
ফিরে পেয়েছি। "
আপাতদৃষ্টিতে উগ্র সর্বনাশা, অগ্নিবর্ষী কবি নজরুলের একটি প্রেমিক মন রয়েছে----সেখানে ষড় ঋতুর পট পরিবর্তন হয় পাখির ডাকে, রাখালিয়া বাঁশীর সুরে, কিশোরীর নুপূরের ছন্দে,
নদীর কলগানে আর চাঁদের আলোয়। কবি মানুষের মনের অতল গভীরে নেমে অনুভূতির কোমল স্তরগুলিতে রূপের তুলি বুলিয়ে সম্মোহিত করেছেন, প্রখর করে তুলেছেন ব্যথা বেদনা, প্রীতি-ভালবাসা আর মান-অভিমানের সূক্ষ্ম অনুভূতিগুলিকে।
নজরুলের প্রেম ভাবনায় বৈষ্ণব কবিদের ও রবীন্দ্রনাথের যথেষ্ট প্রভাব পড়েছে। কিন্তু বৈষ্ণব কবিদের প্রেম যেখানে অপার্থিব ও পরিশুদ্ধ আর রবীন্দ্রনাথের প্রেম যেখানে আধ্যাত্মিক চেতনায় উদ্ভাসিত, নজরুলের প্রেম সেখানে অনেক বেশি লৌকিক ও জীবন্ত।
নজরুলের প্রেমিক সত্ত্বা সৃষ্টির মূলে রয়েছে ঊনবিংশ শতাব্দির নবজাগরণের প্রত্যক্ষ প্রভাব। নারীর সমানাধিকার ও স্বাধীন সত্ত্বা সম্পর্কে ধারণা
নবজাগরণের সময়েই জন্ম নেয়। সমাজ সচেতন নজরুল তাই বলেছেন :
" আমার চক্ষে পুরুষ-রমণী কোন ভেদাভেদ নাই।"
প্রেমের কবিতায় নজরুল যে ভাষা ও সুরকে প্রকাশ করেছিলেন তা পরবর্তীকালের কবি ও কবিতাকে যথেষ্ট প্রভাবিত করেছিল। প্রেমের যে কাতরতা রবীন্দ্রোত্তর বাংলা কবিতার অন্যতম সুর, তার সার্থক রূপায়ণের জন্য আধুনিক বাংলা কবিতা নজরুলের কাছে চিরঋণী। তাঁর প্রেম ভাবনার মূলে রয়েছে একদিকে ব্রাউনিং, হাফিজ, ওমর খৈয়ামের মত বিদেশী কবিদের প্রভাব, অপরদিকে বাংলার বৈষ্ণব ও শাক্ত কবিতার ঐতিহ্যের অবদান। নজরুলের প্রেমের আকাঙ্খা বাস্তব জীবনের সুরা ও সাকীর উষ্ণ আকর্ষণ অতিক্রম করে অনন্ত জীবনের মধ্যে ছড়িয়ে পড়েছে।
রণক্লান্ত প্রেমিক কবি আজ চিরনিদ্রিত। কিন্তু তিনি নিশ্চিতভাবে আমাদের কাছেই আছেন, তিনি আছেন গানে, কাব্যে আছেন, রয়েছেন প্রেমে ও বিরহে এবং তিনি আমাদের মানসলোকে চিরকাল অমর হয়ে থাকবেন। কবিকে তাই কবির ভাষাতেই প্রণাম জানাই :
" তোমার সৃষ্টি মৃত্যুহীন
হে ধরণীর নীল দুলাল
তব সামগান ধূলামাটির
রবে অমর নিত্যকাল । "
----------------------------------------