গালিবের জন্য কিছুটা সময়
অনিন্দ্য পাল
তোমার যদি বিশ্বাস থাকে
ঈশ্বর তোমার প্রার্থনা মঞ্জুর করবেন,
তাহলে কিছুই চেয়ো না,
যদি চাও, শুধুমাত্র একটি হৃদয় প্রার্থনা কোরো-
যার কোনো ভয় নেই, লক্ষ্য নেই এবং কামনাও নেই।
গালিব ( অনুবাদ: মণিভূষণ ভট্টাচার্য)
প্রকৃত কবির চাওয়া তো এমনটাই হবার কথা। কবিরা বস্তুজগতের কামনা করেন না, একটা নির্মল হৃদয় কবির সবচেয়ে মুল্যবান সম্পদ। গালিবের এই গজলটিও সেই হৃদয়বৃত্তিকেই প্রকাশ করে। পার্থিব বস্তু জগৎ আর শরীরী চাওয়া পাওয়া তাঁর প্রার্থনা নয়, কামনাহীন নির্ভিক হৃদয় চান তিনি।
মীর্জা আসাদুল্লাহ খান গালিব ফারসি ভাষাতেই লিখেছেন বেশি। ২০- ২১ বছর বয়স পর্যন্ত তিনি লিখেছেন উর্দুতে। আর ওই স্বল্প পরিসরে লেখা উর্দু কবিতায় তিনি পেয়েছেন শ্রেষ্ঠত্বের আসন। গালিব অনেক আঙ্গিকে কবিতা লিখেছেন। যেমন, কাসিদা, মসনবি, রুবাই, গজল, তবে গজল ছিল তাঁর প্রিয়। গজল মূলত প্রেমের কবিতা। গজল অনেকটা স্বাধীন কবিতা। গজলের শের বা সুখনের কোনো ধরাবাঁধা নিয়ম যেমন নেই, তেমনি এই শের গুলোর কোনো অর্থগত পারম্পর্য থাকতেই হবে এমন কোনো বাধ্যবাধকতাও নেই। থাকতেও পারে, নাও থাকতে পারে। গজলের প্রথম দুটো চরণে অন্ত্যমিল থাকবে, পরবর্তী শেরের দ্বিতীয় চরণ সেই মিলকে অনুসরণ করে চলবে। চরণের শেষে থাকবে দ্বৈতমিল। প্রথমটাকে বলা হয় কাফিয়া, দ্বিতীয়টা হল রদিফ।
আজীবন অর্থসংকটে ভোগা, খানিক বোহেমিয়ান এই কবি তাঁর নিজস্ব লিখন শৈলীর অনবদ্যতায় স্বতন্ত্র। উর্দু এবং ফারসি শব্দের এক রাজকীয় ভান্ডার গড়ে তুলেছিলেন নিজের কবিতা এবং গজলের জন্য। সমসাময়িক উর্দু কবিতায় গালিবকৃত পরীক্ষা-নীরিক্ষা, উর্দু কবিতাকে অন্য মাত্রা দিয়েছিল। প্রতীকের ব্যবহার এবং নান্দনিকতার সৃষ্টিও গালিবকে সমকালীন কবিদের থেকে স্বতন্ত্র করেছিল। তাঁর নিজের কবিতায়,
"হৈঁ ঔর ভী দুনিয়া মেঁ সুখনবর বহুত অচ্ছে,
কহতে হৈঁ কি গালিব কা হৈ আন্দাজ-ই বয়াঁ ঔর"
অর্থাৎ, দুনিয়ায় ভালো কবি অনেকেই আছেন, কিন্তু লোকে বলে গালিবের বলার ঢংটাই আলাদা। গালিব সেই সময়কার প্রচলিত কাব্যরীতির গণ্ডীর বাইরে না গিয়েও অসামান্য দক্ষতায় সবাইকে ছাপিয়ে যাওয়া এক কাব্যশৈলী তৈরি করতে পেরেছিলেন। এক চিরন্তন দর্শন গালিবের অনুভূতির স্বাতন্ত্র থেকে প্রকাশ পেয়েছে কবিতা, গজলের শরীর ধরে। সেই মোহময়ী, পেলব সৌন্দর্যের ছটায় আমরা আজও মুগ্ধ হয়ে চলেছি। যেমন,
"ওহ্শতে আতেসে দিলসে শবে তনহাঈমে
সুরতে দুদ রহা সায়া গুরেজাঁ মুঝসে।"
অর্থাৎ গালিব বলছেন
" বিজনরাতে আগুনভরা হৃদয় দেখে উন্মাদনায়
ছায়া আমার ধোঁয়ার মত আমায় দেখে এড়িয়ে যায়।"
আবার, অন্য একটি গজলে বলেন -
"বে-তলব্ দেঁ তো মজা উসমেঁ সিওয়া মিলতা হ্যায়
ওহ্ গদা জিসকো নহ্ হো খুয়ে সওয়াল অচ্ছা হ্যায়।"
অর্থাৎ, "না চাহিলে যাহা পাওয়া যায় তার কদরই আলাদা -
সবচেয়ে ভালো ফকির - যে কিছু চাইতে পারে না।"
মূলত প্রেমের কাব্যের জন্য গালিবের সমাদর। সেই সময় নারীদের সঙ্গে পুরুষের সরাসরি মেলামেশা, বিশেষত কুমারী মেয়েদের সঙ্গে কোন বাইরের পুরুষের কথা বলাও একরকম নিষেধের বেড়াজালে আবদ্ধ ছিল। একমাত্র "মুক্ত নারী" বা "তওয়ায়েফ", যাদের পরিবার বন্ধন ছিল না, শুধু ছিল নিজ নিজ মহল, তাদেরকেই শুধু নিবেদন করা যেত প্রেম। অর্থাৎ এইরকম একটা কড়া বিধিনিষেধের পাথর চেপে বসা সমাজের মধ্যে থেকেও গালিব তাঁর কবিতাকে একটা অন্য মাত্রায় পৌঁছে দিতে পেরেছিলেন।
তিনি লিখেছিলেন, "ইশক পর জোর নহী হৈ য়হ ওয়হ আতিশ, গালিব
কি লগায়ে, ন লগে, ঔর বুঝায়ে ন বনে। "
অর্থাৎ, "প্রেমের উপর জোর খাটে না গালিব। এ এমন আগুন যা জ্বালতে গেলেও জ্বলে না, নেভাতে গেলেও নেভে না।"
এই পংক্তিমালা তো চিরকালীন প্রেমের সর্বজন বিদিত রহস্যকেই নতুন আঙ্গিকে প্রকাশ করেছে। আবার আর একটি কবিতায় তিনি বলেন,
"মুহব্বত মেঁ নহী হৈ ফর্ক জীনে ঔর মরনেকা
উসীকো দেখকর জীতে হৈঁ জিস কাফির পর দম নিকলে।"
অর্থাৎ, "ভালোবাসায় বাঁচা আর মরার কোনো তফাৎ নেই। যে সর্বনাশীর জন্য প্রাণ যায় তাকে দেখেই বাঁচি।" গালিব প্রেমের অনুধাবন নতুনভাবে উপস্থাপন করতে চেয়েছিলেন। তিনি এখানে যে কাফির শব্দটি ব্যবহার করেছেন, তার উদ্দেশ্যে কিন্তু বিধর্মী বোঝানো নয়, এখানে কাফির শব্দটি তার জন্য প্রযোজ্য যে কিনা প্রেমের ধর্ম মানে না। প্রেমেই তিনি জীবনের স্বাদ খুঁজেছিলেন। তাই লেখেন,
"ইশক্ নে তবীয়ত সে জীস্ত কা মজা পায়া,
দর্দ কী দওয়া পাঈ দর্দ বেদওয়া পায়া। " -- অর্থাৎ প্রেমেই জীবনের আনন্দের স্বাদ পেলাম। বেদনার ওষুধ যেমন পেলাম, যাতে ওষুধ কাজে আসে না এমন বেদনাও পেলাম। এই বেদনাও প্রেমের পুরস্কার।
প্রেমে আঘাত আছে, আছে দুঃখ। গালিবের গজল তা এড়িয়ে যায়নি। তিনি লিখেছেন -
" য়া রব ন সমঝে হৈঁ ন নমঝেঙ্গে মেরী বাত,
দে ঔর দিল উনকো জো ন দে মুঝকো জবাঁ ঔর।"
অর্থাৎ, প্রভু, সে যদি না-ই বোঝে না বুঝল, যদি আমাকে তেমন ভাষা না দাও, তাহলে তাকে অন্য একটি হৃদয় দাও। প্রেমিক তো কাঁদবেই, সে জন্য লিখেছেন -
"দিল হী তো হৈ ন সঙ্গ্ ও খিশৎ দর্দ সে ভর ন আয়ে ক্যোঁ,
রোয়েঙ্গে হম হজার বার কোঈ হমে সতায়ে ক্যোঁ।"
অর্থাৎ, এ তো হৃদয়ই, ইঁটপাথর তো নয়, তবে তা বেদনায় ভরে উঠবে না কেন? আমি হাজার বার কাঁদব, অনর্থক আমার সমালোচনা করে কী হবে? তাঁর গজলে এরকম অজস্র মণিমুক্তা ছড়িয়ে আছে।
অসাধারণ জীবনবোধ গালিবের গজল এবং ব্যক্তি জীবনের অন্যতম বৈশিষ্ট্য ছিল। একটা গজলে তিনি বলেন,
"ইয়ে কহাঁ-কী দোস্তী হ্যায় কেহ্ বনে হ্যাঁয় দোস্ত নাসেহ্?" অর্থাৎ, বন্ধু যদি উপদেষ্টা হয়ে উপদেশ দেন তাহলে সে কী রকম বন্ধুত্ব? গালিব কিন্তু দুঃখবাদী ছিলেন না। তিনি বরং দুঃখ উপভোগের কথা বলেছেন। তাঁর গজলে পাওয়া যায়, দুঃখ যদি আহার্য হয়ে ওঠে তবেই জীবনের পুষ্টি। এই জীবনবোধ থেকেই তো বলতে পারেন কবি, দুঃখ যখন সহ্যের সীমা অতিক্রম করে তখনই তৃপ্তি। দুঃখকে অবজ্ঞা কোরো না, দুঃখ যদি স্ফুলিঙ্গ হত, পাথরকে বিদীর্ণ করে তার স্পন্দিত বুকটা দেখিয়ে দিত। জীবন তাঁর কাছে ছিল অনির্দিষ্ট। তাই তিনি বলেছেন,
"রও মেঁ হৈ রখ্শ্-ই-উমর, কঁহা দেখিয়ে থমে
ন হাথ বাগ পর হৈ ন পা হৈ রকাব মেঁ।"
অর্থাৎ জীবনের ঘোড়াটা ছুটে চলেছে। কে জানে কোথায় গিয়ে থামবে। লাগামে নেই হাত, পা নেই রেকাবে।
গালিব প্রথমদিকে বেদিলের ফারসি রচনাশৈলীকে উর্দুতে প্রয়োগ করার চেষ্টা করেছিলেন। তিনি বেদিলকে যে অনেক উচ্চাসনে বসিয়েছিলেন তা বোঝা যায় এই পংক্তিমালা থেকে,
"আমার বিমুগ্ধতা এত আবেগ সমৃদ্ধ যে
আমি বেদিলের প্রতিভা অঙ্কিত করতে পারি না,
এক বিন্দু জল কী করে মহাসমুদ্র বাহিত
পরমানন্দকে উন্মোচিত করতে পারে?"
গালিব কবিতায় পরীক্ষা-নীরিক্ষা করেছেন। ফলতঃ কখনও সেই ফসল অত্যন্ত সরল হয়ে পড়েছে, আবার কখনও তা আমাদের সামনে এক অভূতপূর্ব জগতের সৌন্দর্য বিলাসিতার পানশালা উন্মোচন করেছে,-
" সৌন্দর্যের বিদ্যুৎ ঝলক আমার দৃষ্টিকে গ্রাস করেছে,
শুধু চোখের পাতাগুলি অবশিষ্ট আছে ,
চাপা আগুনের পল্লবের মতো পুড়ে যাওয়া
অগ্নিশিখায় অগ্নিশিখার ধ্বংসাবশেষ।"
এক অদ্ভুত এবং পবিত্র মানবিক উপলব্ধি। কবি সৌন্দর্যের কাঙাল। অথচ এই সৌন্দর্যের কষাঘাতেই তিনি আর অন্য কিছু দেখতে পারছেন না। এই ভাবনার দ্যোতনা আমাদেরকে অন্য এক উদাস জগতে নিয়ে ফেলতে চায়, যেখানে যান্ত্রিকতা, স্বার্থপরতা, সংকীর্ণতার কোনও স্থান নেই। যেখানে আছে শুধু আবেগ, উপলব্ধি এবং অনুভূতি। আর আছে কবির চোখ, যে চোখ শুধু সৌন্দর্য দেখে না, সৌন্দর্যের আগুনে পুড়েও যেতে পারে।
আবার অনেক ক্ষেত্রে গালিবকে দুর্বোধ্য এবং দুর্গম ভাবনার জন্য দায়ী করা হয়। যদিও গালিব নিজেই কবিতায় দুর্গমতার পক্ষপাতী ছিলেন। সমকালীন রাজ কবি জৌক-কে গালিব নিজের সমকক্ষ মনে করতেন না। নিজেকে তিনি সময়ের চেয়ে এগিয়ে রাখতে বেশি ভালোবাসতেন।
"হুঁ গরমীয়ে নিশাৎ -এ তসৌঅর নগমা সনজ্
ম্যয়ঁ আন্দলিব-এ গুলশান -এ না আফরিদা হুঁ।" অর্থাৎ, কল্পনার এই খুশির তাপে গেয়ে চলেছি গান, যে কাননের পাখি আমি, অজাত আজও সেই বাগান।
অদ্ভুত এক আত্মবিশ্বাস এবং পরিহাসবোধ ছিল তাঁর। চিরকালীন আর্থিক অনটনে জর্জরিত, মাত্র ১৩ বছর বয়সে বিবাহিত এবং সাত-সাতটি সন্তান জন্মেও সবকটি মারা যাবার পরেও ভেঙে গুঁড়িয়ে যাননি। সমস্ত রকমের দুর্যোগ, এমনকি ঋণখেলাপি হওয়ায় কারাবাসও করতে হয়েছিল, তবু তিনি ভবিতব্যের কাছে হেরে যাননি। এসেছিলেন কলকাতাতেও। ফিরোজপুর ঝিরিকা লোহারুর জমিদারি থেকে ভাতা বাড়ানোর জন্য কলকাতায় এসেছিলেন। সিমলাস্ট্রিটে আলী সওদাগরের হাবেলিতে দশ টাকা ভাড়ায় ছিলেন। কলকাতায় এসে মাদ্রাসা আলিয়ার রবিবারের মুশায়েরাতে একটি গজল পড়েন। এই গজলে তিনি "জদাঈ" শব্দটি ব্যবহার করেন যার জন্য একটু বিতর্ক তৈরি হয়েছিল। তবে সেখানে উপস্থিত ইরাণের রাষ্ট্রদূত এই শব্দের ব্যবহার সমর্থন করেন এবং পূর্বতন ফারসি কবিদের উদাহরণ দিয়ে গালিবকে সম্মানিত করেন। কলকাতার প্রেমে পড়ে গেছিলেন গালিব। এক বন্ধুকে লিখেছিলেন, "গেরস্ত না হলে আমি সব ছেড়েছুড়ে কলকাতাতেই থেকে যেতাম।"
আজীবন ছিলেন সুরাসক্ত। তবে নিজের স্বাধীনতা এবং মর্যাদার প্রশ্নে মাথা নোয়াননি কখনও। ১৮৪২ খ্রিস্টাব্দে দিল্লি কলেজের শিক্ষকতা গ্রহণ করেননি টমসন সাহেবের অসৌজন্য প্রকাশের জন্য। আবার কেউ একজন তাঁকে প্রস্তাব দিয়েছিলেন লখনউ এর নবাব হায়দারের কর্মচারী আঘা মীরের স্তুতি করে শের লিখতে, তাতে তাঁর কিছু অর্থাগম হতে পারে। কিন্তু গালিব তো গালিব-ই। অর্থের কাছে আত্মসম্মান বিক্রি করেননি।
ধ্রুপদী সাহিত্য এবং উর্দু ও ফারসি কবিতা সম্পর্কে তাঁর জ্ঞান ছিল অসাধারন। ১৮৬৩ খ্রিস্টাব্দে বৃটিশ সরকার তাঁকে উত্তরীয় দিয়ে সম্মান দেন। এই বছরই তাঁর উর্দু কবিতা সংগ্রহ "দীওয়ান-এ-গালিব" প্রকাশ পায়।
জীবনে অজস্র অপমান, দুঃখ, আর্থিক অনটন, সন্তানের মৃত্যু সয়েছিলেন। তবুও সমস্ত প্রতিকূলতাকে নীলকণ্ঠের বিষ পানের মত করে আত্তীকরণ করে নিয়েছিলেন। সমস্ত দুঃখের মধ্যেই খুঁজে নিয়েছিলেন বাঁচার উপাদান -- কাব্য।
"কহুঁ কিসসে ম্যায় কে ক্যা হ্যায়, শব-এ-গম বুরি বলা হ্যায়
মুঝে ক্যা বুরা থা মরনা, অগর একবার হোতা"
অর্থাৎ, কাকে বোঝাই, ব্যাথায় ঢাকা রাতগুলো কী ভারী
খারাপ তো নয় মৃত্যু, যদি সে একটিবার হত।
একটিবারই এসেছিল কি? গালিব মৃত্যুকে শারীরিক গণ্ডিতে আবদ্ধ রাখেননি। তাই একবার শব্দটি এখানে বুঝিয়ে দেয় মৃত্যু রোজকার শ্বাস প্রশ্বাসের মত আমাদেরকে দখল করে থাকে। তবে শারীরিক ভাবে তিনি চলে গেলেন ১৮৬৯ সালে ১৫ই ফেব্রুয়ারি। রেখে গেলেন এক পবিত্র এবং অনন্য অনুভূতির অসীম সমুদ্র, আমরা আজও যার পাড়েই দাঁড়িয়ে আছি হয়ত, গভীরে পৌঁছাতে পারিনি।
-------------------------------
অনিন্দ্য পাল
প্রজত্নে -- বিশ্বনাথ পাল
গ্রাম -- জাফরপুর
পোঃ-- চম্পাহাটিি
থানা -- সোনারপুর
জেলা -- দক্ষিণ চব্বিশ পরগনা
পশ্চিমবঙ্গ, ভারত।