আমাদের সত্যজিৎ রায়
তীর্থঙ্কর সুমিত
চির অমর বাঙালির বিশ শতকের শ্রেষ্ঠ চালচ্চিত্র নির্মাতাদের মধ্যে এক অন্যতম বহুমুখী প্রতিভাবান ব্যক্তি সত্যজিৎ রায়। একাধারে তিনি বাঙালির গর্ব। সুকুমার রায়ের পুত্র ও উপেন্দ্র কিশোর রায়ের পৌত্র সৃষ্টিশীল পরিবারে কলকাতায় ২ রা মে ১৯২১ সালে তিনি জন্মগ্রহণ করেন।মাত্র তিন বছর বয়েসে পিতৃ বিয়োগ হওয়ার পর মা সূপ্রভা দেবী বহু কষ্টে তাঁকে বড় করে তোলেন। শৈশব শিক্ষার পর প্রেসিডেন্সী কলেজে অর্থনীতি নিয়ে পড়তে যান। মা এর ইচ্ছাতে তিনি শান্তিনিকেতনে গিয়ে প্রচ্যের শিল্পের প্রতি আকৃষ্ট হন। ভালোবেসেছেন চিত্র শিল্পি নান্দলাল বসু ও বিনোদ বিহারী মুখোপাধ্যায় র কাছে শিল্পকলা বিষয় জ্ঞান অর্জন করেন।
সাহিত্য কর্মে নজর কেড়েছেন চলচ্চিত্রকার সত্যজিৎ রায়। বিজ্ঞানী প্রফেসর শঙ্কু ও গোয়েন্দা ফেলুদা তাঁর জনপ্রিয় চরিত্রসৃষ্টি। প্রফেসর শঙ্কুর বৈজ্ঞানিক কাল্পনিক কাহিনীগুলো ডায়রির আকারে লেখা, যে ডায়েরি বিজ্ঞানীটির রহস্যময় অন্তধানের পর খুঁজে পাওয়া যায়। তাঁর ফেলুদার নানান গল্পে জটায়ু ও তার ভাই তোপসে গল্পে বর্ণনাকারী সত্যজিৎ রায়ের ছোটগল্পগুলোর মধ্যে উল্লেখযোগ্য হলো ---
এক ডজন গপ্পো, একের পিঠে দুই ইত্যাদি ইত্যাদি।
তিনি তাঁর ছোটবেলার কাহিনী নিয়ে রচনা করেছেন যখন ছোট ছিলাম। এছাড়া চলচ্চিত্রর ওপর লেখা তাঁর প্রবন্ধের সংকলনগুলি হলো আওয়ার ফিল্মস, দেয়ার ফিল্মস বিষয় চলচ্চিত্র একেই বলে শুটিং প্রভৃতি। বিষয় চলচ্চিত্রের বইটিতে চলচ্চিত্রর নানা বিষয় সত্যজিতের ব্যক্তিগত উদঘটিত হয়েছে। তিনি ছড়া লেখায় পারদর্শী ছিলেন " তোড়ায় বাঁধা ঘোড়ার ডিম " নামে একটি ছড়ার বই ও লেখেন।
চলচ্চিত্র জগতে এক অসাধারণ প্রতিভার নাম সত্যজিৎ রায় চলচ্চিত্রের ও সংগীতের পরিচালনার অসাধারণ নৈপুণ্যতাকে স্মারণীয় করে রেখেছে। রবিশঙ্কর বেলায়েত খান ও আলী আকবর খানের সাহচর্য তাঁকে চলচ্চিত্রে সংগীত পরিচালনা ও নির্বাচনে সাহায্য করেছিল।
সত্যজিৎ রায়ের কর্মজীবন একজন বানিজ্যিক চিত্রকর হিসাবে শুরু হলেও প্রথমে কলকাতায় ফরাসী চলচ্চিত্র নির্মাতা জঁ রনোয়ার -এর সাথে সাক্ষাৎ ও পরে লন্ডনে ইতালীয় চলচ্চিত্র 'বাইসাইকেল চোর ' (লাদ্রিদি বিচিক্ল্যেও )দেখার পর চলচ্চিত্র নির্মাণে উদ্বুদ্ধ হন।
তাঁর প্রথম চলচ্চিত্র পথের পাঁচালী ১৯৫৫ সালে। ১১ টি আন্তর্জাতিক পুরস্কার লাভ করে। তাঁর পথের পাঁচালী, অপরাজিত ১৯৬৫ অপুর সংসার ১৯৫৯ একত্রে অপু ত্রয়ী তাঁর জীবনের শ্রেষ্ঠ সাহিত্য কর্ম রূপে স্বীকৃত। ছোটোদের জন্য ও তিনি সমানোপযোগী। ছোটদের উপযোগী চলচ্চিত্র গুপী গাইন বাঘা বাইন। সত্যজিৎ তার পিতামহ উপেন্দ্র কিশোরের লেখা একটি গল্পের ভিত্তিতে সঙ্গীতধর্মী রূপকথা নির্মাণ করেন।
গায়ক গুপী ও ঢোল বাদক বাঘা ভূতের রাজার তিন বর পেয়ে ভ্রমণে বেরিয়ে পড়ে ও দুই প্রতিবেশী রাজার মধ্যে আসন্ন যুদ্ধ থামানোর চেষ্টা করে।
গোয়েন্দা কাহিনীর ওপর ভিত্তি করে সোনার কেল্লা ও জয়বাবা ফেলুনাথ ছবি দুটি তিনি নির্মাণ করেন। প্রেমাদের গল্প অবলম্বনে সদগতি হিন্দি ছবি ও নির্মাণ করেন যাতে অস্পৃশ্যতার স্বরূপ চিত্রায়িত হয়েছে। ভারতবর্ষে জরুরি অবস্থার প্রেক্ষিতে তিনি নির্মাণ করেন 'হীরক রাজার দেশে '।
হিন্দুসমাজের বিভিন্ন কুসংস্কারের অবলম্বনে সৃষ্টি করেছেন---
'দেবী 'এরপর কাঞ্জনজজ্ঞা, মহানগর, তিনকন্যা, চারুলতা, অভিযান, কাপুরুষ ও মহাপুরুষের মত ও চলচ্চিত্র নির্মাণ করেছেন।
উপমহাদেশের চালচ্চিত্রকে এক অভিন্নমাত্রা দিয়েছিলেন সত্যজিৎ রায়।২০০৪ সালে বিবিসির জরিপে সর্বকালের সর্বশ্রেষ্ঠ বাঙালি তালিকায় ১৩ তম স্থান লাভ করেছিলেন তিনি।
১৯৪৭ সালে সত্যজিৎ রায় ও চিদানান্দ দাসগুপ্ত কলকাতায় ফিল্ম সোসাইটি প্রতিষ্ঠা করেন।
অন্যতম পুরস্কার ছিল চলচ্চিত্র উৎসবে পাওয়া 'বেস্ট হিউম্যান ডকুমেন্ট 'পুরস্কার। সত্যজিৎ রায়ের উল্লেখযোগ্য কাজের মধ্যে
১) তিন কন্যা - ১৯৬১
২) চারুলতা -১৯৬৪
৩) নায়ক - ১৯৬৬
৪) প্রতিদ্বন্দ্বী -১৯৭০
৫) সীমাবদ্ধ -১৯৭১
৬) জনঅরণ্য - ১৯৭৫
৭) গণশত্রু -১৯৮৯
৮) শাখাপ্রশাখা -১৯৯০
৯) আগুন - ১৯৯১
বাংলা চলচিত্রের বাইরে ও তিনি কাজ করেছেন।১৯৭৭ সালে ' শতরন্ঞ্জ কি খিলাড়ি ' নামের হিন্দিও উর্দু সংলাপ নির্ভর একটি চলচ্চিত্র নির্মাণ করেন। পরবর্তীতে আবার প্রেমচাঁদের গল্পের ওপর ভিত্তি করেও হিন্দি ছবি তৈরী করেন। সিনেমার নাম 'সদগতি '।
সত্যজিৎ রায়ের ১০ টি উক্তি যা শুধু চলচ্চিত্র নির্মাণের ক্ষেত্রেই নয়, পাশাপাশি নিজের ব্যক্তিগত জীবনেও মেনে চলতেন --
১)সবচেয়ে মূল্যবান ও একমাত্র সমাধান গুলো মানুষ নিজেই খুঁজে বের করতে পারে।
২)যখন আমি কোনো মৌলিক গল্প লিখি, তখন এমন ব্যক্তিদের নিয়ে লিখি যাদের আমি ব্যক্তিগত ভাবে চিনি এবং এমন পরিস্থিতি র কথা লিখি যার সঙ্গে আমি পরিচিত। আমি উনিশ শতকের কোনো গল্প লিখিনা।
৩)চিত্রনাট্য লেখার অভ্যাসকে আমি শখে পরিণত করেছি। আমি খুঁজে বের করতাম কোন গল্পটি চলচিত্রের জন্যই তৈরী হয়েছে এবং আমি সেই গল্পটি নিজস্ব ঢঙে লিখতাম, এরপর আসল গল্পের সঙ্গে তুলনা করতাম।
৪)আসলে, সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ন হলো একটা শুভ সমাপ্তির। যাই হোক, শুভ সমাপ্তির আগে যদি বিষাদময় পরিস্থিতি এবং চমক সৃষ্টি করতে পারেন তাহলে বিষয়টা আরও ভালো কাজ করে।
৫)ডোমিনোস ওমনিয়াম মেজিস্টার, এর অর্থ হলো ঈশ্বর সব কিছুর আধিপতি।
৬)যখন আপনার গল্পে নতুন কোনও চরিত্রের আবির্ভাব ঘটবে, তখন অবশ্যই তার চেহারা ও পোশাকের বিস্তারিত বর্ণনা দেবেন। আপনি যদি সেটা না করেন তাহলে পাঠক নিজের মতো করে চিন্তা করে নেবে, যেটা পরবর্তীতে আপনার বর্ণনার সঙ্গে না ও মিলতে পারে।
৭)আমি অনুভব করি যে, নায়কের ছাঁচে থাকা মানুষের তুলনায় রাস্তায় থাকা একটি সাধারণ মানুষকে বিষয় হিসাবে পরীক্ষা নিরীক্ষা করা অনেক বেশি চেলেঞ্জিং। তাঁদের আংশিক অন্ধকার, অস্পষ্ট শব্দগুলোই আমি ধরতে চাই, আবিষ্কার করতে চাই।
৮) সিনেমায় চারিত্রিক বৈশিষ্ট সূচক গুনগুলোই মানুষের মনের অন্তরঙ্গ বিষয় ধরতে ও যোগাযোগ ঘটাতে সক্ষম।
৯)পরিচালকই একমাত্র ব্যক্তি যিনি ভালোভাবে জানেন যে চলচ্চিত্রটি কোন বিষয়কে কেন্দ্র করে তৈরী হচ্ছে।
১০)আবহ সঙ্গীতের ধারণা দিনে দিনে বেশ পরিবর্তিত হচ্ছে। এখন যতটা পারা যায় কমই ব্যবহার করার চেষ্টা করুন।
সত্যজিৎ রায় প্রসঙ্গে বিশ্বখ্যাত নির্মাতা আকিরা কুরোসাওয়ার বলেছেন ---
"সত্যজিতের চলচ্চিত্র না দেখা আর পৃথিবীতে বাস করে চন্দ্র - সূর্য না দেখা একই কথা।"
বাংলার গর্ব এবং কৃতি সন্তান সত্যজিৎ রায়ের জীবনাবসান ঘটে ১৯৯২ সালে ২৩ শে এপ্রিল। তিনি তাঁর জীবনের নানান কাজের মাধ্যমে পৃথিবীর বহু মানুষকে উদ্বুদ্ধ করে গেছেন। তিনি আজও অমর।
ছবি - সংগৃহীত।
------------------------------------
তীর্থঙ্কর সুমিত
মানকুণ্ডু, হুগলী
পিন - 712139