হারান চন্দ্র মিস্ত্রী
এই মুহূর্তে বাঙালী হিসাবে রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরকে নিয়ে আমাদের কোনো কৌতূহল নেই। তাঁকে নিয়ে গর্ব করা আমাদের অভ্যাসে পরিণত হয়েছে। তাঁকে বুঝি বা না বুঝি, বইয়ের পাতায়, খবরের কাগজে, ক্লাসঘরের দেওয়ালে, অফিসে তাঁর ছবি দেখে গর্বে বুক ফুলে ওঠে বৈ কি! কিন্তু আমরা এখন এত ব্যস্ত, গভীরে গিয়ে তাঁকে জানবার সময় আমাদের নেই। আমাদের দেশ কতটা শক্তিশালী হয়েছে, কিভাবে চেষ্টা করলে আমরা আরো শক্তিশালী হতে পারব, আর্থিক বলশালী হতে ব্যক্তিগতভাবে আমার কী করণীয়, তাই নিয়ে আমরা চিন্তিত। রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর যে নবেল জয়ী হয়ে বিশ্বের দরবরে ভারতবর্ষের মাথা উঁচু করে দিয়েছিলেন সে কথা মানতে অনেকের অসুবিধা আছে।
তিনি শুধু বাঙালী নয় ভারতীয়দের শক্তিশালী করে গেছেন। গীতাঞ্জলি শুধু একটি মামুলি গানের বই ছিল না। গানের মধ্যে আছে অসীম কাব্যগুণ। একথা সত্য যে, তিনি আস্তিক ছিলেন। হয়তো সে কারণে তিনি ঈশ্বরের কাছে নিজেকে নিঃস্ব করে সবকিছু সঁপে দিতে চেয়েছেন এই কাব্যগ্রন্থে।
বিশ্বের জ্ঞানী মানুষদের কাছে সমাদৃত হয়েছে গীতাঞ্জলি।
আজকের সমাজে নানা ভণ্ডামীর মধ্যে ধর্মের ভন্ডামী বেশ শক্তি সঞ্চয় করেছে। তিনি ধার্মিক হয়েও যারা ধর্মের দোহাই দিয়ে মানুষের রক্ত নিয়ে হোলি খেলতে চেয়েছে তাদের তিনি স্বাগত জানাননি। বরং এদের চিনে রাখতে তিনি গর্জে উঠে লিখেছেন-
"সেদিন তাঁকে মেরেছিল যারা
ধর্মমন্দিরের ছায়ায় দাঁড়িয়ে,
তারাই আজ নূতন জন্ম নিল দলে দলে,
তারাই আজ ধর্মমন্দিরের বেদীর সামনে থেকে
পূজামন্ত্রের সুরে ডাকছে ঘাতক সৈন্যকে,
বলছে 'মারো মারো'।..."
ধর্ম কী বীভৎস হতে পারে তা তিনি জানতেন। বিষয়টি আজও সমানভাবে প্রাসঙ্গিক। সবচেয়ে বড় কথা হল, মানুষের চরম ক্ষুধা-তৃষ্ণা আছে, রোগ আছে, অন্ন-অর্থ নেই। চারিদিকে বিদ্যালয় আছে শিক্ষা নেই। মানুষ যথার্থ শিক্ষা পেলে সার্বিক উন্নয়ন হতো সমাজের। কাজের জন্য বেকারেরা হাহাকার করত না। কোটি কোটি শ্রমদিবস নষ্ট হতো না। দেশের কর্ণধারেরা চুরি করত না। শিক্ষাকে বাহন করে দেশবাসী উপার্জন করতে পারত।
রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর বলেছেন, "বিদ্যা সহজ, শিক্ষা কঠিন। বিদ্যা আবরণে আর শিক্ষা আচরণে।" বেশ- ভূষা, আভরণে কৃষ্টি সংস্কৃতির ছাপ থাকে। স্কুল, কলেজ ও বিশ্ববিদ্যালয়ের শংসাপত্র, যা রীতিমতো অর্জন করতে হয় - সেটি অর্জনকারীকে অধিক আলোকিত করে। তার থেকে মানুষকে বেশি আলোকিত করে শিক্ষা।
শিক্ষা হলো আচরণের পরিবর্তন। মানুষের আচরণ উন্নততর ও সমসাময়িক সমাজের সঙ্গে সামঞ্জস্যপূর্ণ হলে তা দেশ ও রাষ্ট্রের পক্ষে উপকার এবং আচরণকারীর কাছে মর্যাদার। কোন মানুষের আচরণে অবনতি হলে তা সমাজে বিপদ ডেকে আনে। সে নিজে বিপথগামী হয় এবং অন্যকে বিপথগামী করে। শিক্ষা না থাকলে মানুষের হিতাহিত জ্ঞান থাকে না। জীবন চালানোর জন্য ন্যুনতম শিক্ষা প্রয়োজন। হতে পারে সেটি লোকশিক্ষা।
রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর এত জোর দিয়েছিলেন যে শিক্ষাকে তিনি মানুষের অস্ত্বিত্বের একটা প্রধান অঙ্গ মনে করতেন। যার শিক্ষা যত উন্নত তার আচরণ তত উন্নত। তাকে মানুষ স্বাভাবিকভাবে চিনতে চায়, জানতে চায়। সাধারণ মানুষ তাকে অনুসরণ করে। শিক্ষা তার অন্ন, বস্ত্র ও বাসস্থানের অবলম্বন হয়ে ওঠে। শিক্ষা তার মর্যাদা এনে দেয়। সে কারণে রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর লিখেছেন,"সর্বোচ্চ শিক্ষা যা কেবল আমাদের তথ্য দেয় না বরং আমাদের জীবনকে সব অস্তিত্বের সাথে সামঞ্জস্য করে।"
রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর নিজের জীবনের অভিজ্ঞতাকে তুলে ধরেছেন মানুষের কাছে। সেই সঙ্গে তাঁর ছিল অসাধারণ দূরদর্শিতা। তাঁর লেখনী থেকে যা বেরিয়েছে তা আজও প্রাসঙ্গিক। সুতরাং, শুধু তাঁর নাম শুনলে বাঙালী সমাজের অগ্রগতি হবে না। তাঁর গান, কবিতা, প্রবন্ধ, উপন্যাস পড়তে হবে। রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরকে নিয়ে রীতিমত চর্চা করতে হবে। সারা বিশ্ব যাকে নিয়ে চর্চা করে জ্ঞান অর্জনের জন্য, বাঙালী তার রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরকে কেন জানতে চাইবে না?
------------------------------------------