গল্প ।। নীতিহীনতার নান্দনিকতা ।। রানা জামান
নীতিহীনতার নান্দনিকতা
রানা জামান
ভয় ও আতঙ্কে রাত কাটে ওদের। রাত কি কাটতে চায়? প্রত্যেকটি রাত মনে হয় ওদের কাছে বছরের চেয়েও দীর্ঘ। দিনও একই রকমে কাটলেও আতঙ্কটা কম লাগে। কাজের লোকগুলো পালাক্রমে রাত জাগে। ভয় প্রতিপক্ষের, ভয় পুলিশ নামের সরকারি লাঠিয়াল বাহিনীর। প্রতিপক্ষ মানে সরকারি দলের পাণ্ডা বাহিনী। তিন শ' মামলার হিসাব রাখতে পেরেছে। আরো কতগুলো মামলা দায়ের করা আছে থানায়, বলতে পারবে না। অধিকাংশ মামলা অস্ত্র ও মাদকদ্রব্যের; পুলিশের কাজে বাঁধা প্রদান ও সরকারি সম্পত্তি ভাংচুরের মামলাও আছে! আছে গায়েবি মামলাও!
বিরোধী দলকে রাস্তায় দাঁড়াতেই দিচ্ছে না সরকারের খাকি পোশাকের পেটোয়া বাহিনী। ২০১৪ খৃস্টাব্দের সাধারণ নির্বাচনটা বিরোধীদল বিহীন হওয়ায় দিনেই সিল মেরেছে এবং ২০১৮ খৃষ্টাব্দের নির্বাচনে সিল মেরেছে রাতে। নির্বাচন কমিশনসহ সরকারি সকল সংস্থা সরকার টিকিয়ে রাখার অঙ্গ সংগঠনে পরিণত হয়েছে।এভাবে দেশের সরকার কর্তৃত্ববাদী সরকারে পরিণত হয়েছে; এখন যেকোনোভাবে সামনের নির্বাচনটাও জিততে চায়। সেকারণে বিরোধী দল কোনো সমাবেশের ঘোষণা দিলে ঐদিন সকল যান চলাচল বন্ধ করে দেয়া হয় এবং শুরু হয় পুলিশের তল্লাশি। একাজে পুলিশকে সহায়তা করে সরকারি দলের বিভিন্ন সংগঠনের পাণ্ডারা। এতো কড়াকড়ির মধ্যেও কর্মীরা দুই/তিন দিন আগে হতে হেঁটে সমাবেশে যোগ দিতে আসতে থাকে এবং সাথে আনা চিড়ামুড়ি খেয়ে প্লাটফর্মে বা অলিগলির পাশে শুয়ে কাটিয়ে দেয় রাত। এতো প্রতিবন্ধকতা প্রদান সত্ত্বেও বিভাগীয় শহরগুলোর সমাবেশের ঈর্ষনীয় সাফল্য সরকারকে ফেলে দেয় দুশ্চিন্তায়। সামনের সাধারণ নির্বাচনের আগে দাবি মানতে সরকারকে বাধ্য করার জন্য সেপ্টেম্বর মাসে রাজধানীতে মহাসমাবেশের ডাক দিয়েছে বিরোধী দলগুলো।
শুরু হয়ে গেলো ধরপাকড় ও গায়েবি মামলা দেয়া। শাব্বির হোসেন গা ঢাকা দিয়েছেন। তিনি প্রধান বিরোধী দলের একজন অন্যতম সহ-সভাপতি। দুবার মন্ত্রী ছিলেন। কোথায় আত্মগোপন করেছেন, কেউ জানে না- এমনকি স্ত্রী-সন্তানেরাও। দুই ছেলে জার্মানীতে লেখাপড়া করছে। মেয়েটা স্বামীসহ নাগরিকত্ব পেয়েছে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের। দেশে আছেন পৌঢ়া স্ত্রী আকলিমা হোসেন; আর কয়েকজন দরিদ্র আত্মীয়, যারা অর্থের বিনিময়ে ওঁদের সঙ্গ দিয়ে যাচ্ছে। রাতে আড়িপাতা প্রবল থাকায় শাব্বির হোসেন দিনের একটা নির্দিষ্ট সময়ে কথা বলেন স্ত্রীর সাথে।
রাত দুটোয় প্রচণ্ড হৈচৈ-এ ঘুম ভাংলো আকলিমা হোসেনের। সুফিয়া খাতুন জানালো: পুলিশ কথা বলতে চাচ্ছে। আকলিমা হোসেন গায়ে একটা চাদর জড়িয়ে বেরিয়ে এলেন বাইরে। শেয়ালবাড়ি থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা ইন্সপেক্টর জহির, সাথে একগাদা কনস্টেবল। জিজ্ঞেস করলেন, এতো রাতে আমাকে এরেস্ট করতে এসেছেন?
ইন্সপেক্টর জহির আকলিমা হোসেনের কাছে এসে ফিসফিসিয়ে বললেন, আগামীকাল দুপুর বারোটার মধ্যে পাঁচ লাখ টাকা না দিলে পুলিশের কাজে বাঁধা দেবার অভিযোগে আপনাকে এরেস্ট করবো মিসেস শাব্বির!
আকলিমা হোসেনকে কিছু বলার সুযোগ না দিয়ে ওসি জহির জিপে চড়ে চলে যেতে থাকলো। জিপটি আড়ালে চলে না যাওয়া পর্যন্ত তাকিয়ে রইলেন ওদিকে। আকলিমা হোসেন শয্যাকক্ষে ঢুকে দলের সভাপতিকে মোবাইল ফোনে ঘটনাটা জানালেন।
সভাপতি বললেন, আপনি কোনো চিন্তা করবেন না এটা নিয়ে ভাবি। আমি টাকা পাঠাবার ব্যবস্থা করছি।
আকলিমা হোসেন বললেন, এভাবে আর কতদিন ভাই? পরিস্থিতি কি আমাদের অনুকূলে আসবে না কোনোদিন?
অচিরেই হবে ভাবি। আমাদের বেশি কথা বলা ঠিক হবে না। তাহলে পুলিশ আমাকে ট্রেস করে ফেলবে!
আকলিমা হোসেন বড় ছেলে আবরার হোসেনকে ঘটনাটা জানালে আবরার উদ্বিগ্ন কণ্ঠে বললো, এখনো সময় আছে, তুমি আমেরিকা চলে আসো। আমি আগামীকালই টিকিটের ব্যবস্থা করছি।
আকলিমা হোসেন বিস্মিত হয়ে বললেন, কী বলছিস তুই আবরার! তোর বাবাকে এখানে একা রেখে তোর কাছে চলে আসবো?
আবরার উষ্মা প্রকাশ করে বললো, বাংলাদেশে গণতন্ত্রের কবর রচনা হয়ে গেছে! কর্তৃত্ববাদী সরকারের শাসন চলছে। এই অবস্থায় কোনো ইলেকশনে বিরোধী দল জিততে পারবে না। আব্বু কি তা বুঝতে পারছেন না? এরেস্ট হয়ে জেলে গেলে টিকতে পারবেন?
তুই দেখছি অনেক রাজনীতি বুঝে গেছিস! কোনো স্বৈরাচার আজীবন টিকে থাকতে পারে না। তোরা সুখে থাক। আমি তোদের আব্বুর সাথে আছি।
আকলিমা হোসেন খানিকটা রাগ করেই মোবাইল ফোনের লাইন কেটে রকিং চেয়ারে বসে দুলতে লাগলেন। দুলতে দুলতে একসময় গেলেন ঘুমিয়ে। পরদিন নির্দিষ্ট সময়ে শাব্বির হোসেন কল করলে আকলিমা হোসেন গত রাতে ঘটে যাওয়া ঘটনা বললেন।
শাব্বির হোসেন বললেন, আবরার ছেলেমানুষ। ওর কথা ধর্তব্যে নেবার দরকার নাই। আর লিডার ম্যানেজ করেছে। ওসি জহির তোমাকে আর বিরক্ত করবে না।
ইনফ্লুয়েন্স?
বিরোধী দলের নেতাদের কোনো ইনফ্লুয়েন্স নাই এখন।
তাহলে?
টাকা পাঠাতে হয়েছে। পট পরিবর্তনের পরে এইসব সরকার দলীয় লেসপেন্সারদের দেখে নেবো! সব লেসপেন্সারদের লিস্ট করা আছে।
কবে সেই সময় আসবে?
সেপ্টেম্বরে ঢাকার মহাসমাবেশ থেকেই কিছু একটা হয়ে যেতে পারে। ঢাকা অচল করে দেবার প্ল্যান আছে আমাদের।
আবেগের বশে শাব্বির হোসেনের এই মন্তব্য-ই কাল হলো বিরোধী দলের। আড়ি পাতা থাকায় সরকারের বিভিন্ন গোয়েন্দা সংস্থা প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নিতে শুরু করলো। বিরোধী দলগুলো সরকারের এই পদক্ষেপের কিছুই আন্দাজ করতে পারলো না।
আজ ঢাকায় বিরোধী দলের মহাসমাবেশের দিন। বরাবরের মতো তিন দিন পূর্ব হতে সরকারি অঘোষিত ধর্মঘট চলছে সকল প্রকার যানবাহনের। ঢাকা থেকে ছেড়ে গেলেও কোনো রেলগাড়ি, বাস বা জাহাজ বিভিন্ন জেলা থেকে ঢাকায় ঢুকছে না। ঢাকায় ঢোকার প্রবেশপথগুলোয় চলছে পুলিশের তল্লাশি, মোবাইল ফোন চেকিং। সাথে চললো বিরোধী দলের নেতা ও সমর্থকদের বাড়ি বাড়ি তল্লাশি করে গণগ্রেফতার। ছেলেকে না পেয়ে বাবা বা ভাইকে তুলে নিয়ে আসছে; বাবাকে না পেয়ে ছেলেকে তুলে নিয়ে আসছে; এমনকি কিশোর বা বালক পুত্রকে তুলে নিয়ে আসছে। পুলিশের এই বর্বর কাজে সহায়তা করছে সরকারের ছাত্র সংগঠনের সন্ত্রাসীরা। এতো অত্যাচার ও অনাচার সরকার-বিরোধী সমর্থকদের ঢাক আসা ঠেকাতে পারলো না।
নির্ধারিত দিনে সকাল হতে চারিদিক থেকে পিপীলিকার মতো সমর্থকরা আসতে থাকলো সভাস্থলে। কোনো শ্লোগান নেই, কারো হাতে কোনো প্ল্যাকার্ড নেই; নিরব পদযাত্রা। সভাস্থল ছাড়িয়ে ঢাকার অলিগলি লোকে লোকারণ্য হয়ে গেলো। প্রত্যাশার চেয়ে লোক সমাগম হয়ে গেলো অ-নে-ক বেশি। সরকার ও সরকারি দলের নেতাদের শুরু হলো হৃতকম্প। পুলিশের উচ্চ পর্যায়ের কর্মকর্তাগণ সবকিছু সামলে নেয়া হবে মর্মে আশ্বস্ত করে যাচ্ছে। ওদিকে মধ্যম পর্যায়ের নেতা-নেত্রীরা জ্বালাময়ী বক্তব্য প্রদান করে যাচ্ছে। ওদের বক্তব্য শোনে মনে হবে এই সভা শেষ হবার আগেই সরকারের পতন ঘটে যাবে! শীর্ষ পর্যায়ের নেতা-নেত্রীরা মঞ্চে আসতে শুরু করেছেন। মুহুর্মুহু শ্লোগানের মাধ্যমে সভাপতিকে বরণ করা হলো সভামঞ্চে। সবাই অধীর আগ্রহে অপেক্ষা করছে সভাপতির বক্তব্যে শোনার জন্য। বিপ্লবী সভাপতি আতিক রব্বানী ডায়াসের সামনে এসে ডানহাতের তর্জনী ও মধ্যম আঙুলে ভি বানিয়ে প্রদর্শন করলে বি-শা-ল জনসভার নেতা-কর্মীরা শ্লোগানের সাথে সাথে হাততালি দিতে থাকলো। হাততালি শেষ হবার আগেই সভাস্থলের পশ্চিম-উত্তর কোণে প্রথমে হৈচৈ এবং সাথে টিয়ার শেল বিস্ফোরিত হতে থাকলো। কাঁদানে গ্যাসের ধোঁয়া সহ্য করতে না পেরে দর্শকশ্রোতারা সভাস্থল ছাড়তে শুরু করলো। দাঙ্গা পুলিশ, রেব, ও বিডিআর-এর সম্মিলিত বাহিনী সাউন্ড গ্রেনেড ছুড়তে ছুড়তে এগিয়ে আসতে থাকলো মঞ্চের দিকে। কাঁদানে গ্যাসের ধোঁয়া ও সাউন্ড গ্রেনেডের শব্দ সহ্য করতে না পেরে নেতা-নেত্রীগণ মঞ্চ ত্যাগ করলেও কেউ পালিয়ে যেতে পারলেন না। সভাপতি আতিক রব্বানী সহ শীর্ষ পর্যায়ের সকল নেতা-নেত্রী গ্রেফতার হলেন; সহসভাপতি শাব্বির হোসেনও। সভাস্থল থেকে দুই কিলোমিটার দূরে অবস্থিত উচ্চ পর্যায়ের এক সরকারি কর্ককর্তার সংস্কারাধীন সরকারি শূণ্য বাংলো আক্রমণ, পোড়ানো ও নাশকতার অভিযোগে গ্রেফতার করা হলো ওঁদের; পরিকল্পিতভাবে সরকারি দলের পাণ্ডাদের দ্বারা এক পুলিশ কনস্টবলকে নির্মমভাবে হত্যার অভিযোগও আনা হলো ওঁদের বিরুদ্ধে। মারমুখো পুলিশ বাহিনী ও সরকারি দলের পাণ্ডাদের দ্বারা বিরোধী দলের কয়েকজন কর্মী খুন হলেও এই ঘটনার কোনো সংবাদ হলো না। সারাদেশ জুড়ে রাতভর চললো ধড়-পাকড়; কয়েক হাজার নেতাকর্মীকে গ্রেফতার করা হলো গায়েবি মামলায়। পরদিন আদালতে হাজির করা হলে জামিন না-মঞ্জুর করে পাঠিয়ে দেয়া হলো জেলখানায়।কোনো কর্মসূচী ঘোষণা ছাড়াই বিরোধী দলের মহাসমাবেশ পণ্ড হয়ে যাওয়ার সরকারের মাঝে ফিরে এলো স্বস্থি।
এই ঘটনায় আকলিমা হোসেন খুব হতাশ হলেন। এমনটা হতে পারে তা কখনো ভাবেন নি।
সাধারণ নির্বাচনের তফসিল ঘোষণার পরপরই সরকারের পৃষ্ঠপোষকতায় কয়েকটি কিংস পার্টি গঠন করা হলো বিশ্বে বহুদলের অংশগ্রহণ দেখানোর জন্য। সরকারি দল এবং কিংস পার্টিগুলোর মধ্যে কৃত্রিম উৎসবের আমেজ সৃষ্টি করে প্রার্থী বাছাই ও নমিনেশন প্রদানের কার্যক্রম চলতে লাগলো।
নির্বাচন কমিশনে মনোনয়নপত্র দাখিলের শেষ তারিখের রাতের এক সংবাদে ভীষণরকম টাসকি খেলেন আকলিমা হোসেন: বিরোধী দলের সহসভাপতি শাব্বির হোসেন সরকারি দলে যোগদান করেছেন এবং ঢাকার একটি আসনের মনোনয়ন লাভ করেছেন; আশা করছেন আগামীকাল নির্বাচন কমিশনে মনোনয়নপত্র দাখিলের সময় শেষ হবার আগেই সাজাপ্রাপ্ত সকল মামলার সাজা মহামান্য রাষ্ট্রপতি কর্তৃক ক্ষমা পেয়ে যাবেন এবং অন্যান্য মামলাগুলোরও জামিন পাবেন।
আকলিমা হোসেন স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেলে মুচকি হেসে মনে মনে বললেন: রাজনীতিতে সত্যই নীতি বলতে কিছু নেই!
=========================
ঠিকানা:
রানা জামান
ঠিকানা: আনিলা টাওয়ার
বাড়ি#১৮-১৯; সড়ক#৩; ব্লক#আই;
বড়বাগ(ন্যাশনাল হার্ট ফাউন্ডেশন হাসপাতালের পেছনে) মিরপুর-২;
ঢাকা-১২১৬; বাংলাদেশ