ক্ষমা নিছক শৌখিন পদার্থ নয়
সত্যেন্দ্রনাথ পাইন
তারিখ -- ১০ আশ্বিন ১৪১৫ বঙ্গাব্দ
মানুষে মানুষে যে বিবাদ তা কারণে অকারণে যেটাই হোক না কেন সেটা নিতান্তই মতভেদের ফলেই যে ঘটে তা নিশ্চিত। একজনের প্রতি আর একজনের বোঝা পড়া(understanding) থাকলে তার থেকে কোনো বিপর্য়য ঘটে না: বরং না থাকলে উল্টোটাই লক্ষ্য করা যায় ।
কেউ কেউ নিজেকে ছোট ভেবে অপরকে উঁচু আসনে বসিয়ে অপ্রয়োজনীয় দূরত্ব তৈরি করে, অযথা যখন তখন তুচ্ছ ব্যাপারে ক্ষমাপ্রার্থী হয়। এর ফলে সাময়িক বিবাদ মিটলেও আত্মিক তৃপ্তি মেলে না। ক্ষমা সুন্দর এই পৃথিবীতে ক্ষমা করার মত অধিকার হয়তোবা কোন মানুষের ই নেই। কেননা, ক্ষমা করতে পারেন কেবলমাত্র ঈশ্বর যিনি অনির্বচনীয় ব্রহ্মস্বরূপ। যে ভুল করে, দোষ করে, বা অন্যায় করে সে পাপী নয়। সে একটা তুচ্ছ মাধ্যম মাত্র। এই পৃথিবীতে কেউ তাকে মাধ্যম করে সেই অন্যায় কাজটা করিয়ে নিয়েছেন। অতএব সে শয়তান নয়, অপরাধীও নয়-- বুদ্ধি ভ্রংশ বলা যেতে পারে ।
আমাদের চিত্তে, মননে যে বুদ্ধি অজস্র পরিমানে জমা হচ্ছে তাকে বর্ণহীন করার প্রচেষ্টাকে অন্যায় , বাস্তব জ্ঞান হীন বলা বোধহয় উচিত হবে না।
কারণ, প্রত্যেকেরই প্রয়োজন আছে। ভুল করে ক্ষমা চাওয়ার মধ্যে যে অনুতপ্ত হৃদয়ের বিষাদময় অনুভূতির ব্যাপারটা বোঝানো হয় তা যদি নিছক ক্ষণিকের হয় তাহলে সেটা অমূলক বা মূল্যহীন। কারণ, সেই ভুল বা অন্যায় আবারো সে করে অনুতপ্ত না হতেও পারে। তাই ক্ষমা চাইতে হবে নিজের বিবেকের কাছে, অন্তরের স্থূল পর্দা সরিয়ে সূক্ষ্মতর মননের গভীরে।
ক্ষমা প্রার্থী কে আমরা যারা ক্ষমা ভিক্ষা দিই সেই ভিক্ষা দেবার অধিকার স্বোপার্জিত কিনা ক'জন ভেবে দেখি! হাটে বাজারে, অফিসে আদালতে যে অন্যায় কুকর্ম নিত্যদিন ঘটছে তার জন্যে কাউকে দায়ী না করে নিজের পবিত্রতা কে সংশোধন বা পরিমার্জন করাই মনে হয় যুক্তিযুক্ত ।
নিজেকে চিনলে, জানলে অপরকে চেনা বা জানা সহজ হবে। অপরের দুঃখে কষ্টে সমব্যথী হতে হলে নিজেকে পরিপূর্ণ বিকাশের পথে আত্মনিয়োগ না করলে চলবে না।
ভগবান এই বিশাল পৃথিবীতে যে বিরাট যজ্ঞ শালা নির্মাণ করেছেন তাতে আমরা এক একজন নিয়োজিত প্রাণ ।কর্ম করতে হবে। আপন বুদ্ধির বিচারে সর্বদা মনুষ্যত্বকে সময়মতো এগিয়ে নিয়ে যেতে হবে।
আগুনের সামনে কেউ ছুটছে, কেউ উত্তাপ নিচ্ছে, কেউ বই পড়ছে, কেউবা কলে কারখানায় লোহা, পিতল গালাই করছে, কেউ বা লুঠ, চুরি ডাকাতির মাল ভাগ বাটোয়ারা করছে। তবুও আগুন কোনো প্রতিক্রিয়া বা প্রতিবাদ করে না।। সে নিশ্চুপ নির্বাক। কিন্তু সেই আগুনের দাহিকা শক্তি অপরিমেয় সেটা আমরা সবাই জানি। মনের মধ্যে, হৃদয়ের দোরগোড়ায় যে আগুন তাকেও নিভতে দিলে চলবে না। তাই ক্ষমা চেয়ে আগুন নেভানোর চেয়ে "আমি প্রস্তুত" এই অঙ্গীকার করে আগুন জ্বালিয়ে রাখার প্রচেষ্টা চালিয়ে যেতে হবে ।পোশাকি পবিত্রতা খুলে সম্পূর্ণ ভাবে সম্যক রূপে পবিত্রতার বিকাশ সাধনে অগ্রণী হোয়ে ওঠাই বোধহয় বাঞ্ছনীয়।
কাগজের ফুলকে ময়লা ধুয়ে ফুলদানিতে সাজিয়ে রাখতে হয় কিন্তু বাগিচার ফুলের মলিনতা প্রকৃতি নিজ হাতেই পরিষ্কার করে নেয়। যাঁরা প্রবণতায়, ব্যক্তিত্বে কাগজের ফুল তাঁদেরকেই সমাজের পঙ্কিলতা জড়িয়ে ধরে। আর যাঁরা উদ্যমে, মনুষ্যত্বে আন্তরিক তাঁরা অপবিত্রতা বশতঃ মলিন হলেও সাময়িক। সমাজ ই তার আপন প্রয়োজনে সেটাকে সাফ করে নেয়।
সমাজের সংকীর্ণতা সুকুমার পবিত্রতা কে নষ্ট করে। ভগবান এই পৃথিবীকে মনুষ্যের পরিপূর্ণ বিকাশের ক্ষেত্র হিসেবে বেছে নিয়েছেন। তাই জীবস্বভাবের বৈচিত্র্য বিচিত্রতা হারিয়ে কখনও অনাবশ্যকভাবে কাঁদে ও কাঁদায়।
তাছাড়া, মানুষের ভেতরে একরকম সৌন্দর্য আছে, যেটা খুবই সূক্ষ্ম। সেই সূক্ষ্মতার অস্তিত্বে কুৎসিত কদর্য ভাব ম্রিয়মাণ হয়ে পড়ে নাকি! যেটা সুন্দর মানবমন তাকেই বরণ করে নেয়-- আর তাতেই সুখ, তৃপ্তি ও আনন্দ। কোনো পরিশ্রমের বা অধ্যাবসায়ের প্রয়োজন পড়ে না প্রয়োজন হয় তাকে সুন্দরভাবে সুচারুভাবে
লালন করার, প্রয়োগ করার পদ্ধতি আহরণ করার। এটাই একপ্রকার শিল্প বা Art. বুদ্ধিজীবীদের যে শিল্প তার থেকে বিশেষ ভাবে উল্লেখযোগ্য হলো মানুষের মনে যে শিল্প চর্চিত হয় সেটাই। বিশেষরূপে বৈচিত্র্যময়। বুদ্ধীজীবীদের শিল্প প্রথা ও প্রকরণে ব্যাকরণসম্মত হলেও কল্পনাশ্রিত বলা চলে। বাস্তব সেখানে কারিগর হয়েও নতুনভাবে বিশিষ্টতা আনতে পারেনা বোধহয়। তাই বিশিষ্টতা আনতে নতুন করে সাহিত্যের নবজীবনের লক্ষ্মণ দেখতে হবে। তাই ক্ষমার্হ বলে আপাত সুন্দর জীবন নিকেতনের সম্মুখে দাঁড়িয়ে বলা চলে আমি নিষ্পাপ । বা তাকে ইন্দ্রিয় মিশ্রিত শৌখিন পদার্থ হিসেবেই গন্য করা চলে।
কোনো মানুষ জীবিকা নির্বাহের জন্য "ক্ষমা" কথাটা বারবার ব্যবহার করতে পারেন। তিনি ক্ষমা চেয়ে জীবিকা কে জীবনের ভিত্তি করেই সৌন্দর্যের লীলাভূমি প্রতিষ্ঠা করতে পারবেন কি? না। রঙ্ যেখানে ফিকে সেখানে কিছুটা পরে রঙীন করলেও সেই রঙ ফিকে হবার সম্ভাবনাই বেশি হয়। ক্ষমাদাতা বা ক্ষমাপ্রার্থী দুজনেই অনাবশ্যক হয়ে মুখথুবড়ে পড়েন। সমাজের মূলে কুঠারাঘাত করে বলেই দায়বদ্ধ হয়ে পড়ে । তাই ক্ষমা র কোনো মূল্য থাকে না।
ব্যক্তি জীবনে ও সমাজ জীবনে দয়া মমতা, স্নেহ প্রেম ক্ষমা মানুষের মননে আপন অস্তিত্বে অত্যন্ত সুন্দর বলেই তাকে যথেচ্ছভাবে ব্যবহার না করাই মনে হয় শ্রেয় তাতে তার মাহাত্ম বর্জিত হবার সম্ভবনা খুবই সূক্ষ্ম বা কম। আপন প্রবৃত্তির পরিবর্তন না হলে ক্ষমা প্রার্থনা করে Excuse, Apology চেয়ে কিংবা Please জুড়ে বা Dear বলে সম্বোধন করে নিজের উদ্দেশ্য সফল হতে পারে। পৃথিবীর তাতে এতটুকু কল্যাণ হয় না। বরং সুপ্ত পাশবিকতা আবার জাগ্রত হয়ে সমস্ত বিকাশটাকেই ধ্বংসস্তূপে পরিণত করতে পারে ।
তাই ক্ষমা যে নিছক সৌন্দর্য বৃত্তি বা শৌখিন পদার্থ নয় সেটাই প্রত্যেক মানুষের মনে বিবেচনায় আনতে হবে বৈকি। সমুদ্রের তীরে দাঁড়িয়ে দূরে দৃষ্টি দিলে উপলব্ধি হবে মনুষ্যত্বকে সময়মতো এগিয়ে নিয়ে যেতে মনুষ্যত্বকে প্রাধান্য দিতে হবে।
তাছাড়া জানি--" উত্তমের বিনয় স্বাভাবিক, অধমের বিনয় দায়ে পড়িয়া" । আর এরূপ দায় মানেই তো দুঃসহ এবং অসহ্য । তাই না!!!!
========================