অন্যরকম
তপন মাইতি
দূরে বিশ নম্বরে জঙ্গল।পাশে বাদাবন সংলগ্ন খাল পাড় আর ধূ ধূ ফাঁকা মাঠ। ভর দুপুরে ভীষণ ব্যস্ত একটা কম্পমান ছায়া তীর তীর করে হাঁটে।অবিকল রুগ্ন শীর্ণ মানুষের মত।হাওয়া দিলে উড়ে যাওয়ার উপক্রম। লোকজনের মুখে অনেক শুনেছি।মধ্য রাতে কোকিল ডেকে ওঠে।সাঁঝের বেলা কচি ছেলে কেঁদে ওঠে।বিকেল বেলা শিয়াল ডেকে ওঠে।মানুষের গোঙানি শোনা যায়।অস্বাভাবিক বিকট আওয়াজ হয়।শ্মশানে মড়া নিয়ে যাওয়ার সময় কোন না কোন শ্মশান যাত্রীর মাথায় এক ফোঁটা তো বৃষ্টি পড়বেই পড়বে।কেউ কেউ হটকারিতার বশে কই কি আছে দেখব বলে যেই গেছে সে আর ফেরেনি।তার বউ বিধবা হয়ে বসে আছে।গোবরধন তাবড় তাগড়াই বুড়ো সে নাকি এক কোমর জলে পেছন উল্টে মরে পড়ে থাকে?কিছু না থাকলে এমন হয়?কিছু তো আছে এখানে?ওই জায়গাতে অনেক অলৌকিক ইতিহাস আছে। তাতে কোন সন্দেহ নেই।পাড়ায় প্রত্যেকে তা বিশ্বাস করে।এজন্য সচরাচর কেউ এখানে ঘেঁষতে সাহস পায় না।এখান থেকে গেলে কিংবা মনে পড়লে গা ছমছম করে।গায়ের সব রোম খাঁড়া হয়ে যায়। রহস্য আর মায়াবী বলে মনে হয়।যেন এই সুন্দর এই কুৎসিত।এই রোদ এই বৃষ্টি।খামখেয়ালি। কোন ঠিক ঠিকানা নেই।
মেনির চা দোকান।আজকের একটু বেশি ভিড়।পাড়ার প্রায় সব লোক আসে এখানে।এই দোকান থেকে সোজা তাকালে সে সুদূর ফাঁকা প্রান্তর যেখানে আটকে গেছে সেটাই বিশ নম্বরের জঙ্গল।এই জায়গাটা দেখলেই অমঙ্গল ভাবে অনেকেই।আবার অনেক মেয়ে বউ ট্রলার পার্টি জাল ছেঁড়া মাছ পেয়েছে। এত পেয়েছে যে ওখানে কিছু ফেলে দিয়ে বেছে বেছে নিয়ে আসতে হয়েছে।শুধু মাছ নয় মাছের সঙ্গে কাঁকড়া,মধু, মূল্যবান কাঠ নিয়ে দারুণ সংসার চালাচ্ছে অনেকেই তাদের কাছে এটা আবার মঙ্গলের।
যাইহোক মেনির চা দোকান। সেই খুঁটিতে হেলান দেওয়া।ছুঁচালো ধার মুখ। কাঁচা পাকা বেনিয়ম দাঁড়ি।পরিচর্যা করলে দারুণ দেখাবে।মুখে মানানসই কার্তিক গোঁফ।সুন্দর করে গোছানো কুঁচি করা পরিপাটি ধবধবে সাদা পোশাক। অল্পভাষী।এ ওর মুখে তাকায় ধীর স্থির নিঁখুত ভাবে।কোটরাগত চকচকে চোখ দুটোর বাজপাখির দৃষ্টি।একটু করে চা খায় আর পাশে লোকজনকে পা থেকে মাথা পর্যন্ত নিঁখুত ভাবে দেখে। গণ্ডগোল তর্ক বিতর্ক সমালোচনার খণ্ড যুদ্ধে নীরব সৈনিক একজন। কাউকে কিছুই বলতেন না।প্রভাস দোকানে এল তাল মিছরি আনতে।জওয়ান ছেলে মাত্র বিয়ে করেছে বছর দুয়েক হল।একটা ছেলে হয়েছে।সে খুব ছোট্ট। তার সর্দে-কাশি-জ্বরের জন্য দোকানে এসেছে।হঠাৎ অনেকক্ষণ তার মুখের দিকে স্থির দৃষ্টি নিক্ষেপ করে বললেন'এই শোন তোকে আমি চিনি না,জানি না,তুই আমার শত্রু ও না।তবু তোর মুখ দেখে মনে হল এই দুদিনের মধ্যে কোন বড়সড় বিপদ আসতে চলেছে।সাবধান!'প্রভাস হেয়ালি কিছুটা বিদ্রুপ সুরে বললেন কোথা থেকে আমার জ্যোতিষী এল রে। উনি মুখ দেখে সব বলে দেবেন!তাহলে দুনিয়াতে এত ডাক্তার থাকত না তোমার পায়ে পড়ে থাকত।আমি মরছি আমার জ্বালায় বলে চলে গেল প্রভাস। চা দোকানে আলোচনা মুখর হয়ে উঠল বলল কী ব্যাপার এই লোকটা কাউকে কিছু বলে না...প্রভাসের কি এমন দেখল যে এই কথা তার মুখের উপর বলে দিল।
ব্যাপার তো কিছু একটা আছেই।ঠিক দুদিনের শেষ ভোরে প্রভাসের বউ ডাকছে।দেখল কোন সাড়া নেই। মরে কাঠ।চারদিক সরগরম হয়ে গেল। প্রভাস আর আমাদের মধ্যে নেই।আর ঠিক সেইদিনই সেই লোকটা আসেনি চা দোকানে।চা দোকানে অনেকে ভাবেন এটা ওই লোকটার কারসাজি। পুলিশকে খরব দে?পুলিশকে নিয়ে খুঁজে খুঁজে বিশ নম্বর জঙ্গলের কাছে লোকটার বাড়িতে পৌঁছায়।দেখে তিনি খাতা কলম নিয়ে কী লিখছেন খুব মনোযোগে।পুলিশ এসে তার বাড়ি তল্লাশি করে পেলেন কয়েকটা খাতা কলম আর দৈনন্দিন জীবনে চলে যাওয়ার মত সামান্য চাল আলু শুকনো সব্জি।পুলিশ তাকে থানায় নিয়ে গেল।পাশের কিছু লোক তাকে ব্যঙ্গ করে বলছে কই আমার মুখ দেখে আপনার কি মনে হচ্ছে?খুব বিপদ!মড়াকে পোস্ট মোডেম করে জানা গেল প্রভাসের স্বাভাবিক মৃত্যু।লোকটার নাম কুমুদ দাস ছাড়া পেলেন।সকলেই ঘটনাটাকে যে যার মত করে ভেবে নিল।একদম অন্যরকম!একদম আলাদা!একদম অলৌকিক!
===========================
নামঃ তপন মাইতি
ঠিকানাঃ গ্রামঃ পশ্চিম দেবীপুর; পোঃ দেবীপুর; থানাঃ মৈপীঠ কোস্টাল;
জেলাঃ দঃ২৪পরগণা; পিন-৭৪৩৩৮৩; পশ্চিমবঙ্গ। ভারত।