ছবিঋণ- ইন্টারনেট।
স্বপ্নপূরণ
কবিরুল (রঞ্জিত মল্লিক)
"বাজলো তোমার আলোর........
....... ....... আজ প্রভাতে......."
দেখতে দেখতে পুজো চলে এল। দুর্গা পুজো আসলেই শরতের প্রকৃতি নব সাজে সেজে ওঠে। আকাশে নীল সাদা মেঘের ভেলাতে ভেসে আসে কাশের খোলা চিঠি, স্নিগ্ধ সমীরণে কাশের বনে বোহেমিয়ান শিহরণ, টলটলে দীঘির জলে শালুক শাপলার নাচন, সবুজের মখমলে শিউলি ফোটা ভোরের হলদে কমলা রোদের জলসা, নদীতে খেয়া পারাপার করা বাউল মাঝির ভাটিয়ালি সুর, আঁকা বাঁকা সুড়কির মেঠো জ্যামিতিতে গ্রাম্য বধূর আলতার বাটিক প্রিন্ট, মাঝে মাঝে ঢাকের মিষ্টি মল্লার। সব কিছুই যেন বলে দেয় মা উমা আসছেন।
পুজোর চারদিন চারিদিকে চন্দন নগরের ঝলমলে আলোর বাহার থাকলেও রায়গঞ্জের বিদ্রোহী মোরের পাশ দিয়ে বয়ে যাওয়া ছোট্ট গলিতে দোতলা বাড়িতে কোথাও যেন জমাট অন্ধকার। পুজো আসলেই গোটা বাড়িটাতে কেমন একটা পাহাড়ী খাড়া উপত্যকার নিস্তব্ধতা। শরতের সাদা নীল মেঘের বদলে শোকের টুকরো টুকরো ছেঁড়া ছেঁড়া মেঘের আনাগোনা।
শব্দগুলো ঐ বাড়িতে আজকাল বড্ড বেশী মৌনব্রত পালন করছে। জীবনের গল্পগুলো একটু একটু করে ফিকে হতে শুরু করেছে। এলোমেলো শব্দে জীবনের গল্পে গল্পকার কোথাও যেন একটা অসমাপ্তির পরিখা তৈরী করে চলেছে। গল্পটা শেষ হতে গিয়েও থমকে গেছে।
তবে এবারের সমীকরণটা একটু আলাদা। সান্যালবাড়িতে গল্পটা যেন সত্যি হতে চলেছে। স্বপ্নপূরণের গল্প.....। জোড়াতালি দেওয়া স্বপ্নটা একটু একটু করে যেন শরতের নীল মেঘের ক্যানভাসে বলাকার মতন ভেসে বেড়াচ্ছে...। একটা মোলায়েম উপন্যাস এলোমেলো শব্দে জীবনের গল্পে অনেক কিছু শিখিয়ে দিতে চায়। গল্পের সাদা-কালো অক্ষর ঠিকরে বেরিয়ে আসছে সার্থক স্বপ্নের বাস্তাবায়ন......।স্বপ্নের পিছনে দৌড়ের গতি, জেদের খিদেটা অনেক বেশী তীব্র আর সাবলীল।
ভোরের সোনামুগ রোদ্দুরটা জানলা দিয়ে গলে কপালে আছড়ে পড়তেই মায়ের শব্দ ভেসে আসল...
"কি রে উলু, আর কতক্ষণ ঘুমোবি?"
"হ্যাঁ মা, আজ একটু বেলা হয়ে গেল।"
"আজ না তোর কোথায় যেন যাবার ছিল? এই মেয়েকে নিয়ে আমি যে কি করব..."
"হ্যাঁ, একটু স্টেশনের দিকে যাব ভেবেছিলাম..."
স্নান সেরে ঘরে ঢুকেই মহালয়াটা চালিয়ে দিল। বীরেন্দ্রকৃষ্ণ ভদ্রের জলদগম্ভীর কণ্ঠস্বর শরতের পরিমণ্ডলে যেন বুকের ভিতরে লুকোনো "ভিসুভিয়াসে"র লাভা ছড়াচ্ছে। হিমোগ্লোবিনের চোরা স্রোতটা ধীরে ধীরে উথলে উঠছে।
"....আশ্বিনের শারদপ্রাতে.....
.......জেগে......
ধরণীর........"
মহালয়া শুনতে শুনতে উলু বিভোর হয়ে গিয়েছিল। চোখ তুলে ছবিটার দিকে তাকাতেই চোখের কোণ বেয়ে যেন পূর্ণিমার ভরা কোটাল নেমে এল। কোটালের দামাল, বাঁধভাঙা স্রোতে ভাসতে ভাসতে স্মৃতির ছোট্ট ডিঙিটা একটা স্টেজের সামনে এসে দাঁড়াল। ডিঙি নৌকার মাঝির ছেঁড়া, ফাটা, ঘামে ভেজা লুঙ্গিতে যেন স্বপ্নপূরণের গন্ধ লেপ্টে আছে...।
স্টেজে মহিষাসুরমর্দিনী চলছে। একটি মেয়ে অসাধারণ নাচছে। নাচের প্রতিটি পদে, দেহ বিভঙ্গে তার আত্মা মিশে গেছে। নাচে এতটাই ডুবে গেছে যে, সে নিজেই নাচতে নাচতে আজ অন্য জগতে। সবাই মন্ত্রমুগ্ধের মতন তার নাচ দেখছে, আর হাততালি দিচ্ছে। নাচ শেষ হতেই সকলে ঘিরে ধরে তাকে প্রশংসার বন্যাতে ভাসিয়ে দিল।
"আসাধারণ হয়েছে তোমার নৃত্য!"
"বহু দিন পরে আবার তোমাকে এইভাবে পেলাম...."
"কি যে বলেন..."
"আজ তুমি সকলকে মুগ্ধ করে দিয়েছ।"
"না না আসলে...."
কথা শেষ হয়না। চোখের কোণ বেয়ে নামছে রায়মঙ্গলের নোনা জোয়ার। জোয়ারের দুর্দম স্রোতে স্বপ্নের ডিঙিটা দুলে দুলে উঠছে।
"আজ তোমার নৃত্যকলা দেখে আমরা সত্যিই ভাষাহীন..."
"আর যা দেখলাম, এর কোন ডেফিনিশন হয় না..."
"দেখুন, এইভাবে বলবেন না। সবটাই ভগবান আর আপনাদের আশীর্বাদ।"
"একটা ভাল প্ল্যাটফর্ম তোমার জন্যে অতি শীঘ্র অপেক্ষা করে আছে।"
"প্রেসকে খবর দেওয়া হয়েছে। একটু পরেই উনারা এসে পড়বেন।"
কথাগুলো শুনছে বিনম্র শ্রদ্ধায় মাথা নামিয়ে। দুচোখের জোয়ারে কোটালের আগ্রাসী আস্ফালন ঝরে ঝরে পড়ছে। স্বপ্নের পারদ ততই চড়ছে।
ওটাই ছিল তার শেষ অনুষ্ঠান। তারপরে আর সেইভাবে অনুষ্ঠান করা হয় নি। স্টেজের সামনে দাঁড়ানো মেয়েটি সেদিন কি দেখেছিল কে জানে। অবাক বিস্ময়ে চেয়ে চেয়ে দেখছিল নৃত্যকলা। হয়ত ওর মনের গভীরের বীজতলাতে কোন এক স্বপ্নের বীজ রোপিত হচ্ছিল। যা একদিন বিশাল দেবদারু গাছ হয়ে...
সেই শুরু। শুরু হল স্বপ্নের পথ চলা। একটু একটু করে নাচের জগতে পা রাখা।নিজের এক পা দু পা করে এগোন। স্বপ্নপূরণের ছোট্ট ডিঙিটাকে জেদ আর লড়াইয়ের স্রোতে চালিত হয়ে ভাসিয়ে দেওয়া...।
তারপর এল ভয়ঙ্কর কালো সেইদিন। একটা অভিসম্পাত নেমে এল। তারপরেই সব শেষ। জীবনের সাবলীল ছন্দটাই যেন পাল্টে যেতে বসল। তবু হাল ছাড়েনি। দাঁতে দাঁত চেপে লড়াই চালিয়ে গিয়েছিল।
ভাবতে ভাবতে স্মৃতির আটলান্টিকে গা ডুবিয়ে মণি, মুক্তো খুঁজতে খুঁজতে কোথায় যেন হারিয়ে গিয়েছিল। বৌদির ডাকে সম্বিৎ ফিরল।
"আজ এত সেজেগুজে..."
"না এমনি..."
"...এমনি বললে শুনব না। আমার রায়বাঘিনী ননদের সাজ দেখেই বোঝা যাচ্ছে..."
"ধুস...! কি যে বল বৌদি..."
"কোন স্পেশাল কিছু..."
"আসলে আজ একটা..."
"হমম..! এইবার বুঝেছি..."
ক্যালেণ্ডারের একটা একটা করে লাল, সাদা, কালো চৌকো ঘর টপকে পুজো চলে এসেছে। পুজোর পরই উল্কির স্টেজ শো। তাই নিজেকে নিয়ে ভীষণ ব্যস্ত। একদম দম ফেলার সময় নেই।
সপ্তমী, অষ্টমী, নবমী, দশমী যেন ফুরুৎ করে উড়ে চলে গেল। আজ কোজাগরী পূর্ণিমা।চাঁদের অহংকার গুঁড়ো গুঁড়ো হয়ে নামছে। "সিত্রাং"য়ের নিম্নচাপের মতন। স্বপ্নপূরণের ঘোড়া ছুটছে টগবগিয়ে। ঘোড়ার খুরের গতিতে যেন চেঙ্গিজ খানের ঔদ্ধত্য.....। শরীর থেকে ক্ষরিত হচ্ছে একস্ট্রা অ্যাড্রিনালিন।
আজ উল্কি থার্ড জেণ্ডারদের নিয়ে রায়গঞ্জের বিদ্রোহী মোরের কাছে এক অডিটোরিয়ামে একক এবং সমবেত নৃত্যের আয়োজন করেছে। কেউই ভাবতে পারেনি ওদের নিয়ে এত ভাল অনুষ্ঠান করা যায়।
সকলেই বেশ প্রশংসা করেছে। একটা নতুন পথ যেন তৈরী করল ও। ওর বেশ মনে আছে ভাইজি অসাধারণ নাচ করতে করতে একদিন থ্যালাসেমিয়ার বলি হয়ে স্টেজেই লুটিয়ে পড়েছিল।
ভাইজি থ্যালাসেমিয়া রোগীদের নিয়ে ওয়ার্কশপ করত। ও চলে গেলে কাজ থেমে থাকেনি। একটা স্বপ্ন যেন খুব অল্প বয়স থেকে দানা বাঁধছিল বুকের গভীর অলিন্দে।থার্ড জেণ্ডারদের নিয়ে কিছু একটা করার তীব্র বাসনা। তারই জাল বোনা শুরু তখন থেকেই। নিজের জীবনদর্শন দিয়েও সবটা অনুভব করেছে।
এক একটা ক্লাসের উঁচু ধাপগুলো পেরোবার সময় সমাজের বিভিন্ন কোণ থেকে ভেসে আসা বিদ্রূপ, টিটকিরি নিজের অপরিসীম জেদ, হিমোগ্লোবিনকে চাঙ্গা করে তুলেছিল। স্বপ্ন গড়ার লক্ষ্যে লড়াইয়ের রসদটা ঐ সময় থেকেই জোগান হচ্ছিল।
উল্কি অবশেষে পেরেছে ঘাম রক্ত এক করে তার তিল তিল করে গড়ে তোলা স্বপ্নের ইমারতকে বাস্তবে রূপ দিতে। মা উমা দু হাত তুলে আশীর্বাদ করেছেন। সামনে এগিয়ে চলার আরও শক্তি, অনুপ্রেরণা জুগিয়েছেন।
নিজের লজ্জা,সংকোচকে বুড়ো আঙুল দেখিয়ে উল্কি নাচটা ভালভাবে রপ্ত করেছিল। আর থার্ড জেণ্ডারদের নিয়ে কাজ করাও শুরু করল। যাতে সমাজের বুকে একটা মোলায়েম ম্যাসেজ দিয়ে জোরালো ধাক্কা দেওয়া যায়।
উল্কি নিজেও ছিল সমকামী। বড় হবার সাথে সাথে সব কিছু উপলব্ধি করতে শিখল। ছোট থেকেই জমানো কষ্ট, ব্যথার ফিক্সড্ ডিপোজিটটা ভাঙতে ভাঙতে এগিয়ে চলতে শুরু করেছিল। দুচোখে তখন নবীন স্বপ্নের রামধনু। তাই সত্যিই একটা ম্যাসেজ দিতে চেয়েছিল সমাজে। তাই তো...
নাচ অনেক আগেই শেষ হয়েছে। নাচের ঘুঙুরগুলো যেন এলোমেলো শব্দ হয়ে এক নতুন জীবনের গল্প লিখছে। স্বপ্ন পূরণের গল্প।
উল্কির দু চোখে তখন নোনাপানির উল্কাপাত। দু চোখের বুড়িগঙ্গার অশান্ত জোয়ারে স্বপ্নের নৌকাটা তরতরিয়ে ছুটছে...। চাঁদের রূপোলী অহংকারে তা আরও পবিত্র দেখাচ্ছে। বাইরে মাইকে তখন বাজছে...
"দুর্গে দুর্গে দুর্গতিনাশিনী....
........ ........ মহিষাসুরমর্দিনী......"
Address: 85, Kalibari Road, Nalta
Near Air Port Auto Stand
PO: Italgachha
Kolkata -28
North 24 Parganas