শাশ্বত বোস
দিল্লী রোডের ধারে "উমাঙ্গ কাঁটা" নামের বহুকাল বন্ধ হয়ে পরে থাকা দোকানটা পেরিয়েই, থেমে গেল গাড়িটা। বেশ কিছুক্ষন ধরেই ইঞ্জিনে একটা ভাইব্রেশন পাচ্ছিল অর্ণাভ, সাথে একটানা একটা বিচ্ছিরি ঘড়ঘড়ে আওয়াজ| ব্রেকে পা দিয়ে ক্লাচে চাপ দিলে একটু যেন হড়কাচ্ছিলও গাড়িটা| জায়গাটা অর্ণাভ ছোট থেকে দেখে আসছে, অনেক আগে এইখানটাতে বড় বড় লরিগুলো দাঁড়িয়ে মাল ওজন করাত| বিশেষ করে কয়লা,বালি,পাথর কিংবা সেইসব মালের গাড়ি যেগুলো থেকে রাস্তায় কিছুটা মাল পরে গিয়ে ওজনে গরমিলের সম্ভাবনা থাকে| ট্রাক মালিকেরা সেইসব লরিগুলোকে এখানটায় দাঁড় করিয়ে ওজন করাত| এই চত্ত্বরে এই একটাই কাঁটা মেশিন ছিল, প্রায় ৮০ কিলো, ১০০ কিলোর আস্ত এক একটা লোডেড পাঞ্জাব ট্রাককে এখানে কাঁটায় চড়িয়ে ওজন করাতে দেখেছে ও| এখন সব বন্ধ| বিকেল শেষ হয়ে সন্ধের অন্ধকারটা নামছে সবে| সকাল থেকেই আজ ভ্যাপসা গরম, আকাশে পাতলা মেঘ এসে দিনের বেলাতেই প্রায় ৪০ ডিগ্রী অনুভব হয়েছে| এখন এখানে গ্যারেজ কোথায় পাওয়া যাবে? মাথায় একরাশ চিন্তা আর চোখে মুখে বিচ্ছিরি বিরক্তি নিয়ে গাড়ি থেকে নেমে পড়ল অর্ণাভ| দূরের বাঁশঝাড়টার ভেতর দিয়ে একটা সরু পথ দেখা যাচ্ছে| ভাগ্যিস অসুবিধে বুঝে গাড়িটাকে সাইড ঘেঁষে দাঁড় করিয়েছিল ও, না হলে রাস্তার মাঝখানে আজ গাড়ি নিয়ে বসে থাকতে হত| গাড়িটা লক করে আশপাশ একটু পায়চারি করে দেখল অর্ণাভ| নাহ, শুধু ঝিঝি পোকার ডাক, এঁদো পানায় জন্মানো ডাঁশ মশার গান আর একটা হালকা হিমভাব ছাড়া কিচ্ছু নেই জায়গাটাতে| রাস্তাটার পাশে কিছুদূর নেমে গেলে একটা নালা পরে| ওটা পেরোলেই একটা সরু মেঠো জমির পথ, বাঁশঝাড়ের ভেতর দিয়ে গ্রামের ভেতর ঢুকে গেছে| প্যান্টটা টেনে একটু গোটাবার চেষ্টা করলো অর্ণাভ| যদি গ্রামের ভেতর গিয়ে কোন জনমানবের দেখা পাওয়া যায়, আজ কার মুখ দেখেই যে বেরিয়েছিল! পৃথা বাড়ি ছেড়ে চলে যাবার পর থেকেই জীবনের শ্রী চলে গিয়েছে অর্ণাভর| তার এখন দিন রাতের ঠিক নেই| আজ ছুটির দিন দেখে গাড়ি নিয়ে বেরিয়েছিল কাছে পিঠে একটু ঘুরে আসার জন্য| গাড়িটা কদিন ধরেই প্রব্লেম দিচ্ছিল| গাড়ির এয়ার কন্ডিশনারটাও কাজ দিচ্ছে না ঠিক করে, তাই এই প্রচন্ড গরমেও এসি অফ করে জানলার কাঁচ নামিয়ে গাড়ি চালিয়েছে অর্ণাভ| হাজার কাজের চাপ আর মাথাভর্তি গিজগিজে চিন্তায় গাড়িটায় কাজ করাতে ভুলেই গেছিল ও, আর তার ফল হাতেনাতে|
নালাটা পেরোনোর সময় বরফ ঘরের একটা ঠান্ডা হাওয়া যেন কামড় বসালো অর্ণাভর গায়ে| অনেক ছোটবেলায় গ্রামের বাড়ি থেকে মাছ ধরে ফেরার পথে একবার ঠিক এই হাওয়াটাই যেন ওর পিছু নিয়েছিল| রাস্তাটাও অনেকটা এরকম ছিল না? এইরকম বাঁশ ঝাড়ের ভেতর দিয়েই তো এক হাতে মাছ আর অন্য হাতে হুইল ছিপ নিয়ে ফিরছিল ও| হঠাৎ করে ছেলেবেলার একটা ঝলক যেন ওর চোখের সামনে ভেসে উঠলো| ছোটদিদা বলতো "হইন্ধ্যার ফথে বাঁশের বাগান ডিঙাইয়া মাছ লইয়া ফিরবানা বাপ, ওগো নজর লাগে"| অর্ণাভ বুঝতে পারে ওর গায়ের লোমগুলো যেন সব খাঁড়া হয়ে যাচ্ছে আস্তে আস্তে| নালাটা পেরিয়ে জুতোটা পায়ে দিয়ে নেয় অর্ণাভ| দূর থেকে একটা আলো ভেসে আসছে, তাড়াতাড়ি পা চালায় সেদিকে| একটা চায়ের ঠেক| সামনে টিমটিম করে একটা বাল্ব ঝুলছে| একপাশে স্টোভে জল ফুটছে, রেডিওয় হিন্দি গান বাজছে| মাটির দেওয়ালে ঝোলানো ঘড়িতে সময় দেখল অর্ণাভ, ৬ টা বাজতে এখনো ১০ মিনিট বাকি| প্রাকবর্ষার সন্ধেয় গুমোট গরমে বেশ ঘেমে গেছে ও, এতক্ষন নিজে সেটা লক্ষ করেনি | পরনের নীল পাঞ্জাবিটার খুট দিয়ে নিজের চশমাটা একবার মুছে নিয়ে, দোকানের বাইরের বেঞ্চিতে বসে পরে অর্ণাভ| পাশেই একটি বহুল প্রচলিত খাবার ডেলিভারি সংস্থার বাইক দাঁড়িয়ে আছে| রাইডার অন্যদিকের বেঞ্চে বসে অন্যমনস্ক হয়ে কি যেন ভাবছে!! আবছা অন্ধকারে তার মুখটা ভাল করে দেখা যাচ্ছেনা| শুধু বোঝা যাচ্ছে মাঝে মাঝে হাতের চায়ের কাপ টা সে বেঞ্চের উপর রাখছে, আবার কিছুক্ষন পর হাতে নিয়ে চুমুক দিচ্ছে| তার পিছনের দিকের বেঞ্চিতে একটা বেশ মোটাসোটা পাঞ্জাবী ড্রাইভার হাত পা ছড়িয়ে শুয়ে আছে| তার শরীরের অর্ধেকটা বেঞ্চির বাইরে বেরিয়ে আছে|
"যাক বাঁচা গেল! এই সর্দারজীর থেকে কিছু তো একটা হেল্প পাওয়া যাবে!!"
হাফ ছেড়ে নিশ্বাস নিল অর্ণাভ| কিন্তু আসার পথে কোন লরী তো দেখতে পেল না ও! গাড়ির চিন্তায় খেয়াল করেনি হয়তো! এতক্ষন দোকান মালিকের দিকে চোখ যায়নি ওর| বেঁটে মতন চেহারার পাতলা গোছের লোক, কপালে গোসাঁই তিলক| গলার গামছা দিয়ে মাঝে মাঝে কপালের ঘাম মুছছে| স্টোভের গনগনে ফুটন্ত দুধে চা পাতা ফেলে ঢাকনিটা চাপা দিয়ে দিল লোকটা| পাশের উনুনে তখন মামলেট ভাজা হচ্ছে| ভাজা পিঁয়াজ, ডিমের কুসুম আর কুচি আদা মিলিয়ে ছোটবেলার একটা গন্ধ নাকে ভেসে এল অর্ণাভর| সে সরাসরি লোকটাকে জিজ্ঞেস করল, "দাদা এককাপ চা হবে?" লোকটা হাতের ঈশারাতে অর্ণাভকে বসতে বললো| অনেকক্ষন ধরেই বেশ খিদে পেয়েছে অর্ণাভর| এতক্ষন সেটা খেয়াল হয়নি| এখন চোখের সামনে খাবার দেখে খিদেটা যেন বহুগুণ বেড়ে গেছে| পেটের নাড়িগোলানো সেই খিদের কাছে গাড়িটার চিন্তা চাপাই পরে গেল অর্ণাভর মনে| লোকটা একটা কানা ভাঙা কাপে করে, কিছুক্ষণের ভেতর এক কাপ চা আর দুটো বিসকুট এনে অর্ণাভর পাশে রাখলো| মিহিসুরে জিজ্ঞেস করলো, "আর কিছু খাবেন বাবু? আমার এই দোকান তো আপনাদেরই সেবার জন্ন্যি|"
"একটা ডিম পাউরুটি হবে?"
সম্মতিসূচক মাথা নেড়ে লোকটা ফের দোকানের ভেতর ঢুকে গেল| সামনের অন্ধকার বেঞ্চে শুয়ে থাকা ড্রাইভারের ঘুম যেন আর ভাঙ্গেনা কিছুতেই| ওকে কি ঠেলে তুলে জিজ্ঞেস করবে অর্ণাভ, গাড়িটার ব্যাপারে ও কিছু সাহায্য করতে পারবে কিনা? ডেলিভারি বয়টিরও চা খাওয়া যেন আর শেষ হচ্ছে না| সময় যেন হঠাৎ থমকে গেছে| সন্ধের অন্ধকারটা ঘন চাদরে ঢেকে ফেলছে চারপাশ| সেই চাদরের গায়ে যেন ক্ষুধার্ত প্রহরের উল্কি আঁকা| প্রহেলিকাময় এই জগৎটা যেন একটা প্রকান্ড কৃষ্ণকায় বিমূঢ়তায় নিজেকে মুড়ে নিচ্ছে ধীরে ধীরে| এমনটা অর্ণাভ আগে কখনো দেখেনি বা অনুভব করেনি| উল্টোদিকের বেঞ্চের ডেলিভারি বয় কিংবা পাঞ্জাবি সর্দারকে এখন আর দেখা যায়না ভালোভাবে| দোকানীটা অর্ণাভর সামনে ডিম পাউরুটির প্লেটটা রেখে আচমকা প্রশ্ন করে, "বাবু কি নাড়াইল যাসসিলেন নাকি? আপনারে আমি দেইখেই চিনসি| তা বাবু গাড়িখান বিগড়ইলো বুঝি? তা সন্ধে ছয়টা বাজবার আগে এইখানে এমনটা সক্কলেরই হয়, ওই ওদেরও হইসিল|" নিজের সরু লিকলিকে আঙ্গুল দিয়ে দোকানী উল্টো দিকের বেঞ্চের দিকে নির্দেশ করে| মিশমিশে কালো অন্ধকারে আর কাউকে দেখতে পায়না অর্ণাভ| কাঁটার মত বিদ্যুতের চমক খেলে যায় ওর সারা শরীরে| এই লোকটা এতো কথা জানলো কিভাবে? ওতো এখানে আসা অবধি কাউকে কিছু বলেনি! মুখের চা আর খাবারটা ফেলে দিয়ে প্রচন্ড চাপা অস্বস্তিতে উঠে পরে অর্ণাভ| একটা নির্বাক ভয় ক্রমশঃ নিজের আস্তিন গুটিয়ে ওর শিরদাঁড়া বেয়ে নেমে যায় নিচের দিকে| সোজা গাড়ির দিকে হাঁটা লাগায় ও| শুধু আসবার সময় পকেট থেকে একটা ১০০ টাকার নোট বার করে, দোকানের বেদীতে সার করে রাখা বিস্কুটের কৌটোগুলোর মাথায় রেখে আসার সময় দেওয়াল ঘড়িটার দিকে চোখ পড়তে চমকে ওঠে| ঘড়িটায় তখনও ৬টা বাজতে ১০ মিনিট বাকি! একি করে সম্ভব! ঘড়িটা খারাপ নাকি? অন্ধকারে নিজের হাতঘড়িটাও ঠাহর করতে পারে না ঠিক করে| পোড়া মবিল, পিত্তিগলা মাছের আঁশ আর পচা ডিমের কুসুমের গন্ধ মেশানো একটা দুর্গন্ধ অর্ণাভর নাকে মুখে ঢুকে গা গুলিয়ে দেয়| নালাটা পেরিয়ে কোনোমতে হাইরোডে উঠে মাথা নীচু করে হাঁপাতে থাকে ও| আসবার সময় পথটা হয়তো ছুটেই পার করেছে| বুকের বাঁ দিকটায় কদিন ধরেই একটা চিনচিনে ব্যাথা হচ্ছে, তার সঙ্গে অসহ্য ঘাম দেয় প্রায় সর্বসময়|
রোডের ওপর ওর গাড়িটাকে ঘিরে একটা ছোটখাট জটলা তৈরী হয়ে গেছে তখন| আশপাশের গ্রাম থেকে স্থানীয় লোকজন বেরিয়ে এসে ওর গাড়িটাকে ঘিরে ভিড় করে দাঁড়িয়ে আছে| টিপটিপ বৃষ্টি শুরু হয়েছে, আশেপাশের গাছের পাতায় বৃষ্টির জলের শব্দ, কাছেই কোনো মৌচাকে মৌমাছির একটানা ভোঁ ভোঁ আর লোকজনের চাপা গুঞ্জন মিশে তখন তৈরী করেছে এক ধ্রুপদী শব্দব্রম্ভ| এরই মাঝে কয়েকটা কথা ছিটকে কানে এসে লাগে অর্ণাভর, "আজ আবার হইলো, এই নিয়ে পরপর তিন হপ্তায় তিনতিনটে কেস ঘটি গেল! পেত্থম হপ্তায় ট্রাকের ডেরাইভারটা মোলো, তার পরের হপ্তায় খাবার ডেলিভারি করে ছেলেটা আর আজ ইনি!"
"আহা রে, বয়সখান তো বেশী হয় নাই রে এনার, বাড়িতে বৌ বাচ্চা আসে বোধহয়!"
ততক্ষণে একজন ডাক্তার গাড়িটার পাইলট সিটের দরজাটা খুলে, চালকের আসনের দিকে ঝুঁকে পরে দেহটার ডানহাতের কব্জিটাকে নিজের হাতে নিয়ে, পালস মাপার চেষ্টা করছেন| বেশ কিছুক্ষন দেখার পর মাথা নেড়ে পিছনে দাঁড়ানো পুলিশ অফিসারটিকে বললেন, "নাহ আর কিছু করার নেই, গাড়ি চালাতে চালাতেই হার্ট ফেল করেছে, কোনভাবে গাড়িটাকে দাঁড় করাতে পেরেছিল, হয়তো গাড়ি থেকে বেরোবার চেষ্টাও করেছিল, বাট টাইম পায়নি| অটোপ্সি রিপোর্ট টা পেলে আরো ভালো ভাবে বোঝা যাবে|"
বৃষ্টির তোরটা বাড়ে, দমবন্ধ করা গরমের পর এরকম একটা বৃষ্টিতে কতদিন অর্ণাভ আর পৃথা ভিজতে চেয়েছে একসাথে| ফলস ৪৯৮, ৩০৭, ৩২৪, DV act, জেল কাস্টডি, পাল্টা ডিভোর্স কেস, সব যন্ত্রণার হাত থেকে অবশেষে ঘাম দিয়ে মুক্তি! গাড়ির পাইলট সিটে অর্ণাভর নিথর দেহটাও ভিজছে সমানে| এতক্ষন ঘামে ভিজেছে, এবার কালনিদ্রার এই বৃষ্টিটা ওর সব গ্লানি ধুয়ে মুছে দেবে| আচমকা উল্টো দিক থেকে আসা একটা ট্রাকের আলোয় অর্ণাভ দেখে, ওর ডান হাতের টাইটানের রিস্ট ওয়াচে তখন ঠিক সন্ধে ৬টা বাজছে| দোকানী তাহলে ঠিক কথাই বলেছিল!
============================
শাশ্বত বোস
পেশা সফটওয়্যার ইঞ্জিনিয়ার
৩২/৩১, ডাক্তার বাগান লেন
পোস্ট- মল্লিকপাড়া
শ্রীরামপুর,হুগলী