সমীর কুমার দত্ত
এটা এমন একটা সময় যখন কি শহরে কি গ্রামে কোথাও বিদ্যুৎ ঢোকেনি। কেরোসিনের আলো, গ্যাস লাইট, জমিদার বাড়িতে ঝাড় লণ্ঠন ইত্যাদি আজকের বিদ্যুতের প্রক্সি দিতো । বাড়ি,ঘরদোর প্রজা স্বত্বর (আওসৎ) ছড়িয়ে ছিটিয়ে দূরে কোনখানে। ফলত লোক সংখ্যার ঘনত্ব আর কতো এবং সেহেতু ভূত প্রেতের উপদ্রব বড়ো একটা কম ছিলো না। এখানে সেরূপ এক ভূতুড়ে জমিদার বাড়ির আখ্যান বর্ণনা করা হয়েছে।
বাড়িটা দীর্ঘদিন পড়ে আছে ভূতুড়ে অবস্থায়। এক জমিদারের বাড়ি এটা। বাড়িটা সর্বদা লোকজনের আনাগোনা আর ঝি চাকরের কর্ম ব্যস্ততায় গম্ গম্ করতো । কিন্তু কি হলো, একবার জমিদার দর্পনারায়ণ ঘোষাল তার অপুর্ব সুন্দরী মেয়ে প্রেমাকে হিরণ্য নামের একটি ছেলের প্রতি প্রেমাকর্ষণের সম্ভাবনা দেখে গৃহবন্দী তথা নজরবন্দী করেন। এমন কি দিবালোকের মুখ পর্যন্ত দেখা বন্ধ। কিন্তু পাত্রস্থও করতে পারেন না কারণ তার আচরণে এক অস্বাভাবিকত্ব পরিলক্ষিত হয়। মাঝে মাঝে তার শ্মশান কালীর ভর হয়। তখন তার চেহারা বিভৎস্য হয়ে ওঠে। ভরে সে ওই বাড়ির সর্বনাশের কথাই বার বার বলে যা দর্পনারায়ণকে অসন্তুষ্ট ও চিন্তিত করে।
এই দর্পনারায়ণের কথা কি আর বলবো। দাম্ভিক, অত্যাচারি, ভয়ঙ্কর মানুষ ছিলেন এই দর্পনারায়ণ । জমিদার বাড়ির অনতিদূরে তারই এলাকাভূক্ত জমিতে ছিল তাঁর বিনোদনের নাচঘর। দালালরা এক একটা নৃত্যশিল্পী ও গজল গাইয়েকে ধরে এনে বিক্রি করে দিতো। চলতো সারারাত নাচ গান। ভোরের বেলায় তাঁর দেহরক্ষীরা ধরে ধরে নিয়ে এসে শুইয়ে দিতো ঘরে। তাঁর কথার একটু এদিক ওদিক হলে কিংবা কথার অবাধ্য হলে রক্ষা থাকতো না। গুম ঘরে হাত -পা-মুখ বেঁধে ফেলে রাখা হতো আর রাতের অন্ধকারে তাদের অচৈতন্য করে তারই প্রাচীর ঘেরা জমিতে সমাধিস্থ করা হতো। দুজন দেহরক্ষী ছাড়া কেউ টের পেতো না। তার ওপর বৃক্ষরোপন করা হতো। আর সেই বৃক্ষের এক একটা নামকরণ করা হতো সমাধিস্থ ব্যক্তির আচরণকে কেন্দ্র করে। এইভাবে কতজন যে তাঁর জমির নীচে শায়িত আছে কে জানে। এই সমস্ত কাজ করতো তাঁর দুই দেহ রক্ষী ষণ্ড আর অমর্ক।দৈত্যগুরু শুক্রাচার্যের দুই পুত্রের নামে নামকরণ করেন দর্পনারায়ণ স্বয়ং । তিনি হলেন দণ্ডদাতা আর ষণ্ড ও অমর্ক হলো ঘাতক বা জল্লাদ। আর ওই সমস্ত অপঘাত মৃত্যুর অশরীরী আত্মা ঘুরে বেড়ায় জমিদারের মহল্লায়।
দুর্গাপূজোয় বাবার সঙ্গে জমিদারের বাড়িতে ঢাক বাজাতে এসে হিরণ্য জমিদারের একমাত্র কন্যা প্রেমার প্রেমে পড়ে যায়। যদিও প্রেমার দিক থেকেই সাড়া মেলে।নইলে দরিদ্র,নিম্ন জাতির সন্তান হয়ে হিরণ্য সাহস পাবে জমিদার বাড়ির সুন্দরী মেয়েকে প্রেম নিবেদন করতে। চামারের ঘরের সুদর্শন হিরণ্যকে দেখে ও তার বাজনা শুনে প্রেমা মোহিত হয়ে যায়। জানি না এই ঢাক বাজানোর সঙ্গে প্রেমার ভর হওয়ার কোন সম্পর্ক আছে কিনা । পূজো চলা কালীন ঠাকুরের দিকে চোখ না রেখে হিরণ্যর দিকে সমানে তাকিয়ে থাকে।হিরণ্যর চোখও তখন সুন্দরী প্রেমার দিকে। কেউ কারোর দিক থেকে চোখ সরাতে পারে না। হিরণ্য ও প্রেমার পূর্ব জন্মের কোন ধর্মীয় যোগাযোগ না থাকলে এ প্রেম সংঘটিত হওয়া অসম্ভব। জমিদারের এমন সুন্দরী মেয়ে নাহলে নিম্ন জাতির দরিদ্র সন্তানের প্রতি প্রেমাকর্ষণ অসম্ভব। হিরণ্য খুব অনুপ্রাণিত হয়ে ঢাক বাজাতে থাকে আর প্রেমা মুগ্ধ হয়ে তা দেখতে ও শুনতে থাকে। বাজনার তালে তালে তার হৃদয় নেচে ওঠে। কারণে -অকারণে, স্বপনে, জাগরণে হিরণ্যর মুখ ভেসে ওঠে তার মনের আয়নায়।
সবার চোখকে ফাঁকি দিয়ে যখন এই দৃষ্টি বিনিময় চলতে থাকে,তখন কারোর না কারোর চোখকে ফাঁকি দেওয়া যায়নি। এই কারোর মানে বাড়ির এক কিঙ্করী অর্থাৎ চাকরাণীর চোখে পড়ে যায়। সে ভালো করে নিরীক্ষণ করে। তারপর একদিন প্রেমাকে হিরণ্যর হাতে এক টুকরো কাগজ দিতে দেখে। অর্থাৎ প্রেমা হিরণ্যকে প্রেমপত্র দেয় এবং মাঝে মাঝে সবার দৃষ্টি এড়িয়ে স্থানে- অস্থানে, সময়ে -অসময়ে , বাক্যালাপ চালাতে থাকে। তখনই ঢাক বাদক ছেলেটি বলে, "আপনি বড়লোক। আমার মতো গরিব, নীচ জাতির ছেলের সঙ্গে জীবন জুড়তে চান কেন ? আপনার কতো বড়ো বাড়িতে, কতো ভালো ছেলের সঙ্গে বিয়ে হবে। তবে কেন আপনি আমার পেছনে পড়ে গেলেন?
—জানি না কেন। আমার বাবা আমার বিয়ে দেবেন না।
—বিয়ে দেবেন না? কেন?
—সে আমি বলতে পারবো না।
—কেন ? বলতে না চাইলে বলবেন না। তবে আপনার নাম?
—প্রেমা ঘোষাল।আর আপনার?
—আমার নাম হিরণ্য। হিরণ্য রাম।
—রাম? ' রাম ' টাইটেল হয়?
—আমরা ঢাকি ,নিম্ন জাতির। আমরা খুব গরীব, দিনমজুরি করে আমাদের জীবন চলে। উৎসব অনুষ্ঠানে আমরা ঢাক বাজাতে বেরিয়ে পড়ি।আমি নাইট কলেজে পড়ি বিনা বেতনে। আমার স্বপ্ন আছে।পাশ করে চাকরি করবো। আপনি এখন যান।কেউ দেখে ফেললে মুস্কিল হবে। এইরূপ কিছু কথাবার্তা হয় তাদের মধ্যে।
ঢাকির ছেলের হাতে চিঠির মতো কিছু দিতে দেখে ওই কাজের মহিলা একসময় গিন্নিমাকে বললো, "গিন্নিমা, ছোট মুখে তো বড়ো কথা কওয়া হয়। যদি অভয় দেন তো একটা কথা বলি। "গিন্নিমা বললেন, "কি বলবে বলো ।"
—বলছিনু কি — ঢাকির ছেলেটা ঠায় প্রেমা দিদিমণির মুখের দিকে ড্যাব ড্যাব তাকিয়ে ছিল।আর প্রেমা দিদিমণিও ছেলেটার মুখের দিকে তাকিয়ে ছিলো ।
—আ---মলো যা ,তাতে হলো কি ?
—শুধু কি তাই। চিঠি দেছে গো ।
—তুমি নিজের চোখে দেখেছো?
—তবে আর বলছি কি। আমি নিজের চক্ষে দেখেছি। সাবধান হও ,না হলে মুশকিল হবে।
গিন্নি মনে মনে ভাবলেন—ঝিয়ের জাত, কথাটা পাঁচ কান করবে। তাই বললেন, "ঠিক আছে, ঠিক আছে ,আমি দেখবো এখন। কথাটা কাকেও বলবে না। আর মনে মনে বললেন , মেয়েরও গলায় দড়ি। আর ছেলে খুঁজে পেলে না। ওই যে কথায় বলে না —যার সঙ্গে যার মজে মন/ কি বা হাড়ি, কি বা ডোম ।
—না না ,আমি বলবুনি।
গিন্নিমা কর্তাকে কথাটা জানালেন। সেই থেকে পূজোর দালানে প্রেমাকে আর দেখা যায়নি। বাবা তাকে নজর বন্দী করেদিলেন । ঘটনা ঘটে গেলে ঢি ঢি পড়ে যাবে।
দশমী কেটে গেলে হিরণ্য ও তার বাবা তাদের প্রাপ্য সরকারবাবুর কাছ থেকে টাকা পয়সা বুঝে নিয়ে বিদায় নিলো। বিদায় লগ্নে হিরণ্য চারপাশটা দেখে নিলো কিন্তু প্রেমাকে দেখা গেলো না।
হিরণ্য তার বাড়ির কাউকেও এমনকি কোন বন্ধুকেও ঘুণাক্ষরে জানতে দেয় নি। প্রেমা তাকে জানাতে বারণ করে ছিলো। তাই সে নির্বাক ছিলো । অনেক দিন কেটে যাবার পর হিরণ্য কাউকে কিছু না বলে প্রেমাকে দেখতে জমিদার বাড়িতে এসে হাজির হলো।প্রেমার প্রেমপত্র পেয়ে হিরণ্য প্রেমাকে ভালোবেসে ফেলেছে।ভালো তো বাসবেই। জমিদারের সুন্দরী মেয়েকে না ভালোবেসে কেউ পারে। এমন আহাম্মুখ কেউ আছে নাকি?
তাকে ভুলতে পারছে না। প্রেমা প্রেমপত্র দিয়ে যেন গর্হিত কাজ করে ফেলেছে গো ! বুভুক্ষুকে খাদ্যভাণ্ডারের হদিশ দিয়েছে। সে হানা না দিয়ে ছাড়বে। বামন চাঁদ দেখলে সে চাঁদ পাবার জন্য হাত তো বাড়াবেই। হিরণ্য কিছুটা বেপরোয়া হয়ে জমিদার বাড়ির গেট দিয়ে সোজা বৈঠকখানায় এসে হাজির। তাকে দেখে জমিদার দর্পনারায়ণের আর জানতে বাকি রইলো না হিরণ্যর জমিদার বাড়িতে আসার উদ্দেশ্য। বললেন, " তুমি ঢাক বাজাতে এসেছিলে না? আজ আবার কি মনে করে?" এখন তো কোন উৎসব নেই।
—আমি আপনার মেয়ে প্রেমাকে ভালোবাসি।
—বটে !
বলে ও প্রেমার চিঠি জমিদারকে দেখালো । "এই দেখুন আপনার মেয়ের চিঠি ।"
চিঠি পড়ে জমিদার বাবু বললেন, " তো?"
—আমি ওর সঙ্গে দেখা করতে চাই ।
—আমি চাই না।
—আমি ওর মুখ থেকে সেটা শুনতে চাই।
—শোনাচ্ছি ।
জমিদার দর্পনারায়ণ ভীষণ বদরাগী মানুষ। তাঁর মুখের ওপর কথা বলার সাহস কারো হয় না। এতক্ষণ ওর সাহসটা দেখে যাচ্ছিলেন। ঠাণ্ডা মাথায় বললেন, " ওরে কে কোথায় আছিস?"
দৌড়ে এলো ষণ্ড আর অমর্ক।
" হুজুর কিছু বলবেন? "
" দরজা জানলা বন্ধ কর।"
—কেন বাবু?
—"ওঃ যা বলছি কর।
—" জি হুজুর।
—"ওকে পিছমোড়া করে বাঁধ। আর মুখে একটা প্লাস্টার টেপ মেরে দে । যেমনটি বলা, তেমনটি কাজ। ষণ্ড আর অমর্ক ভাবলো," ব্যাটার বরাতে আজ কি আছে কে জানে! "
দর্পনারায়ণ হান্টার চাইলেন। ওর ওপর হান্টার চালাতে চালাতে বলতে লাগলেন, " বামন হয়ে চাঁদে হাত বাড়ানো! ভিখারি চামারের ঔদ্ধত্য কতো! ঢাক বাজাতে এসে জমিদারের মেয়ের সঙ্গে প্রেম করা! এতো বড়ো সাহস আমার মুখের ওপর বলে কিনা আপনার মেয়েকে ভালোবাসি । চাবুকে তার দেহ ক্ষত বিক্ষত হতে লাগলো। তবুও তিনি থামেন না।
ষণ্ড আর অমর্ক বলতে লাগলো, "কর্তা বাবু, এবার ছেড়ে দ্যান, আপনার শরীর খারাপ হবে। অনেক হয়েছে!"
ছেলেটি নিস্তেজ হয়ে এলে বললেন, " যা নিয়ে যা, আমার নজরের সামনে থেকে সরিয়ে নিয়ে গুম ঘরে ফেলে রেখে দিগে যা। যেন কেউ দেখতে না পায়।অন্ধকার নেমে এলে ক্লোরোফর্ম শুঁকিয়ে মাটির তলায় পুঁতে দিবি আর ওর ওপর একটা গাছ বসিয়ে চারপাশটা সিমেন্ট করে দিবি। ব্যাটার ছেলে বুঝুক মৃত্যু যন্ত্রনা কাকে বলে। গাছের গায়ে লিখে দিবি 'বামন ' । ওরা ঘাড় নেড়ে প্রহৃত ছেলেটিকে লুকিয়ে নিয়ে গিয়ে গুম ঘরে রাখলো। তারপরে যন্ত্রনায় গোঙানো ছেলেটিকে রাতের অন্ধকারে ক্লোরোফর্ম শুঁকিয়ে অজ্ঞান করে গর্ত খুঁড়ে মাটির তলায় শুইয়ে মাটি চাপা দিয়ে দিলো। দুঃখ প্রকাশ করে বললো, " মাপ করো বাবা, আমাদের কোন দোষ নেই। আমরা জমিদারের আজ্ঞাবহ মাত্র । তারপর মাটির ওপর একটা গাছ বসিয়ে চারপাশটা সিমেন্ট করে দিলো। গাছের গায়ে 'বামন' কথাটা লিখে টাঙিয়ে দিলো।
এদিকে হিরণ্যকে খুঁজে না পেয়ে হিরণ্যর বাবা ঘুরতে ঘুরতে জমিদার বাড়িতে এসে হাজির।
জমিদার জিজ্ঞাসা করলেন, " কি মনে করে? এখন তো কোন উৎসব নেই। "
—আমার ছেলেকে কোথাও পাওয়া যাচ্ছে না তো তাই ভাবলাম যদি এখানে আসে ।
—কি সূত্রে আসবে? তুমি নিশ্চয়ই কিছু জানো। বাজনা তো অনেক জায়গায় বাজাও, পরে আবার সেখানে যাও ছেলেকে খুঁজতে। নাকি এটা থানা? থানায় গিয়ে এফ আই আর করো,যাও নাহলে চাবগে পিঠের ছাল তুলে নেবো।
জমিদার দর্পনারায়ণ জানেন তাঁর মেয়ের একটা অস্বাভাবিকত্ব আছে। কোথাও বিয়ে দিলে কিছুদিন পর বসিয়ে দিয়ে যাবে।এ তো দুরারোগ্য ব্যাধির মতো। ডাক্তার দেখিয়ে সারানো যাবে না। কতো যাগযজ্ঞ করে তো কিছু হলো না।
হতভাগাটা বিয়ে করলে খাওয়াতে না পেরে তাঁর মেয়েকে ঘরে বসিয়ে পয়সা কামাতো আর তাঁর কাছ থেকে জমিদারির ভাগ চাইতে আসতো।
প্রেমাকে দিনের পর দিন অন্ধকারে বন্দী করে রাখার ফলে আর হিরণ্যর সঙ্গে দেখা না হওয়ার জন্য ও ভেঙে পড়েছিলো । ও এই ভোগের চার দেওয়াল থেকে মুক্তি চেয়েছিলো। ও জানতো,ওর বিয়ে কোনদিনই হবে না। তাইতো একটা গরীবের ছেলের হাত ধরে পালাতে চেয়েছিলো একটু মুক্ত বাতাস প্রাণভরে নিতে। তাই ও একদিন নিজেকে শেষ করতে চেয়ে গলায় দড়ি দিয়ে ওই বদ্ধ ঘরে ঝুলে পড়লো। লোক লজ্জার ভয়ে ওই একই ভাবে মাটিতে সমাধিস্থ করে দিতে বললেন তাঁর মেয়েকে। সবার চোখের সামনে দিয়ে মেয়ের লাশ নিয়ে যাবে পুলিশ —এতে তাঁর পরিবারের মর্যাদা হানি হবে, তাই এই নির্দেশ। আর পুলিশ হলো জমিদারের আজ্ঞাবহ। সুতরাং জমিদার নিজের বংশ মর্যাদা রক্ষার জন্য যা মনে করেন,তাই করেন। পুলিশ তাতে বাধা দিতে আসে না। তাদের যা প্রাপ্য তা তারা পেয়ে যায়।তা ছাড়া জমিদারকে চটিয়ে কী লাভ।
মাঝখানে একটা বিরাট দিঘি আছে। দিঘির মধ্যস্থলে আছে জলটুঙ্গি মানে গৃহ, যা দর্পনারায়ণের গ্রীষ্মকালীন বাসগৃহ । দিঘির চারপাশে বাউন্ডারি প্রাচীর সংলগ্ন বরাবর বৃক্ষের সারি,যা দিঘিকে তথা জমিদার বাড়ির এলাকাকে পরিবেষ্ঠিত করে আছে। অর্থাৎ বৃক্ষশ্রেণীই হলো জমিদার বাড়ির লক্ষণরেখা। প্রত্যেকটি বৃক্ষের একটি করে নামকরণ করা হয়েছে।যেমন হিরণ্যর সমাধি বৃক্ষের নাম 'বামন' । অর্থাৎ বামন হয়ে চাঁদে হাত বাড়িয়ে ছিলো।প্রেমার সমাধি বৃক্ষের নাম 'নিম্নগামী' । অর্থাৎ যে হিরণ্য নামক দরিদ্র চামারকে বিয়ে করতে যাচ্ছিল। আবার কারোর নাম 'অবাধ্য ' অর্থাৎ কথার অবাধ্য হয়ে মৃত্যু বরণ করেছিলো ইত্যাদি। এইভাবে জমিদার নিজের বাড়িকে সমাধিক্ষেত্র করে তুলেছিলেন।
এরপর শুরু হলো ভৌতিক উপদ্রব। জমিদারের বিশ্বস্ত দেহরক্ষী ষণ্ড মারা গেলো অজানা কোন রোগে। অপরজনের মৃত্যু হলো রক্তবমি করে। এরা দুজনেই ছিলো প্রেমা,হিরণ্য, কয়েকজন নর্তকী ও গজল গাইয়ের মৃত্যুর ও সমাধিস্থ হওয়ার সাক্ষী। কখনও কখনও এমন ঝড় বয়ে যেতো সঙ্গে উষ্ণ বাতাস যার জেরে সব উলট পালট হয়ে যেতো। জমিদারের এলাকার বাইরেটা তখন নিস্তব্ধ থাকতো। রাত্রি একটা দুটোর পর থেকে গোঙানি, কান্না , অট্টহাসি, মেঝেতে চাকা গড়ানোর শব্দ, তবলা, ঘুঙুরের আওয়াজ কিংবা 'জ্বলে গেলো,' ' পুড়ে গেলো' ইত্যাদি শব্দ শোনা যেতো।
কিছুদিন পর জমিদার গিন্নি সিঁড়ির ওপর থেকে হঠাৎ পড়ে গিয়ে জ্ঞান হারান। দুদিন কোন জ্ঞান ছিল না। দুদিন পর যখন জ্ঞান ফিরলো তখন তিনি বললেন যে কেউ তাঁকে পিছন থেকে ঠেলে ফেলে দিয়েছে। তারপর থেকে তিনি শয্যাশায়ী হয়ে যান। কিছুদিন পর তাঁর মৃত্যু হয়। স্ত্রীর মৃত্যুর পর এক আত্মীয় এসে ছিলেন জমিদারকে দেখাশোনা করবার জন্য। তিনি একদিন গভীর রাতে হঠাৎ ঘুম ভেঙে যেতে শুনতে পেলেন—
সিঁড়ি দিয়ে উপরে উঠে আসা পায়ের শব্দ।শব্দটা তাঁর ঘরের কাছে এসে থেমে যায়। তিনি ঘেমে নেয়ে একশা। গলা শুকিয়ে কাঠ। কেউ এসে গলাটা সজোরে চেপে ধরেছে।তারপর তিনি জ্ঞান হারান। পরদিন তাঁর গলায় স্পষ্ট আঙুলের দাগ ছিলো। তিনি আর থাকতে চাইলেন না। বললেন, "আমি এ ভূতের বাড়িতে থাকতে পারবো না।"বলে তিনি বিদায় নিলেন।শেষে এক ধুরন্ধর সম্পত্তি আত্মসাৎ করতে সাহস দেখিয়ে জমিদারকে দেখাশোনা করতে এলো। সে প্রথম রাতে জমিদারকে মুখে বালিশ চাপা দিয়ে মারতে গিয়ে দেখলো জমিদার মুমূর্ষু। হাঁ করে 'জল' 'জল ' বলছেন।জল না দিয়ে ওই আত্মীয় জমিদারকে গলা টিপে মারতে গেলে জমিদার তার হাতের কব্জিটা চেপে ধরলেন। সে হাত আর ছাড়ানো যায় নি।কারণ জমিদার ততক্ষণে মারা গেছেন। তারপর কি হলো জানা নেই।অতৃপ্ত আত্মারা তাকে ছাড়েনি নিশ্চয়ই।
এভাবে ওই অভিশাপগ্রস্ত জমিদার বাড়িতে মৃত্যু মিছিল চলতে লাগলো । রাতে অশরীরী আত্মার ছায়ামূর্তি আবার কখনও কখনও ভর দুপুরেও ঘুরে বেড়াতো । তারপর একদিন ঐ বাগান বাড়ি ভূতুড়ে বাড়িতে পরিণত হলো। ওই ভূতুড়ে বাড়ির আশেপাশে কেউ ঘেঁষতো না।দীর্ঘদিন ভূতুড়ে অবস্থায় পড়ে থাকতে দেখে একদিন ডাকাতের আস্তানা হয়ে উঠলো। সন্ধ্যার পর ডাকাতেরা বের হতো আর ভোর রাতে ফিরতো। ভূতের উপদ্রব অগ্রাহ্য করে তারা ঐ স্থানে পড়ে রইলো যদিও তাদের ভয়ে গা ছম্ ছম্ করতো ।কারণ এ রকম একটা আস্তানা তারা হাত ছাড়া করতে চাইনি।ডাকাতির মালপত্র ঐ বাড়িতে জমা করতো। কিন্তু একদিন ওরা ভোর রাতে জঙ্গল ভেদ করে বাড়ির মধ্যে যেই প্রবেশ করেছে গোটা বাড়ির অর্ধাংশ ওদের মাথায় ভেঙে পড়লো। এখানে যে মানুষ চাপা পড়ে আছে তা কেউ জানতে পারলো না। সেই থেকে ধ্বংসাবশেষ অবস্থায় পড়ে রইলো ভূতুড়ে বাড়ি নামে।
==========================
Samir Kumar Dutta
Bally, Howrah