আসগার আলি মণ্ডল
তৃপ্তির মনে শান্তি নেই।সব সময় নিজের ঘরে শুয়ে বসে থাকে।পৃথিবীটা ওর কাছে খুব ছোট হয়ে গেছে।মা-বাবা মাঝে মাঝে সাহস যোগান।বলেন-তৃপ্তি মনটাকে শক্ত কর।অতিথকে ভুলে যা।আর পাঁচটা মেয়ের মতো নিজের পায়ে দাঁড়াতে হবে।এসব কথা শুনেই তৃপ্তি কাঁদতে থাকে।মা বলেন-কাঁদুক,কাঁদলে তবেই মনটা একটু হালকা হবে।
তৃপ্তির বাবা একটি দোকানে দৈনিক মজুরিতে কাজ করেন।খুব কষ্টে মেয়েকে লেখাপড়া শিখিয়েছেন।এক মেয়ে এক ছেলে।তৃপ্তিই বড়ো।তৃপ্তিকে নিয়ে বাবার অনেক স্বপ্ন ছিলো।চাকরি করবে,বড়ো ঘরে বিয়ে হবে।সুখে থাকবে।কিন্তু বাবার স্বপ্ন আজ স্বপ্নই রয়ে গেল।সবার অলক্ষে বাবা এসব কথা ভাবেন আর চোখের জল ফেলেন।
আজকে সারাটাদিন মেঘলা আকাশ।মাঝে মাঝে মসুল ধারায় বৃষ্টি হচ্ছে।গভীর নিম্নচাপ।দিন চারেকের আগে কাটবে না।সন্ধ্যার সময় কিছুক্ষণ বৃষ্টি থামলেও আবার মসুল ধারায় আরম্ভ হলো।বৃষ্টির শব্দের সঙ্গে তালে তাল মিলিয়ে ব্যাঙেরাও ডেকে চলেছে।রাত অনেক হয়ে গেছে তৃপ্তির চোখে ঘুম আসছে না।হঠাৎ করেই ছ'মাস আগে ঘটে যাওয়া বৃষ্টির সেই রাতের কথা মনে পড়ে গেল।একা টিউশান পড়িয়ে ফিরছিলো।দূর্যোগপূর্ণ আবহওয়া।মাঝে মাঝে ঝোড়ো হাওয়ার দাপট চলছিলো।পথ ঘাট নির্জন।ঝোপে ঝাড়ে ঝিঁ ঝিঁ পোকা নাগাড়ে ডেকে চলেছে।এমন সময় চারজন মাতাল পথ আগলে দাঁড়ালো।পরিচয় না থাকলেও মুখ চেনা।ওদের সম্মান দিয়ে পথ ছাড়তে বলেও কোন কাজ হলো না।হিংস্র পশুর মতো তারা ঝাঁপিয়ে পড়েছিলো আমার উপর।অনেক চিৎকার চেঁচামেচির পরেও নিজেকে রক্ষা করতে পারেনি।সতীত্ব হরন করে পথের ধারে ফেলে দিয়েছিলো।
জ্ঞান ফিরতেই খেয়াল হলো হাসপাতালের বেডে শুয়ে আছি।সারা শরীরে অসহ্য যন্ত্রণা।বিভিন্ন জায়গায় ক্ষতস্থান থেকে তখনও রক্ত চুঁইয়ে বের হচ্ছিলো।বাকশক্তি প্রায় হারিয়ে গিয়েছিল।চোখ মেলতেই চারিদিকটা আবছা।বেডের চারপাশে কারা দাঁড়িয়ে ছিলো তাও বোঝার মতো উপাই ছিলো না।সুস্থ হয়ে বাড়ি ফিরতে দশ দিন সময় লেগেছিলো।গ্রামের প্রতিটা মানুষ জেনে ছিলো আমি ধর্ষিতা।লজ্জায় বাবা মায়ের উঁচু মাথা হেঁট হয়ে গিয়েছিলো।ধর্ষকরা এখন জেলে।আইন ওদের শাস্তি দেবে।এই সব ভাবতে ভাবতে এক সময় তৃপ্তি ঘুমিয়ে পড়লো।
তৃপ্তির বাবা-মায়ের চিন্তার শেষ নেই।মেয়ে কয়েকটি নরখাদক-পিশাচ দ্বারা ধর্ষিতা।তবুও একটা বিয়ের ব্যবস্থা করতে হবে।অনেক ঘটকের কাছেই ছুটে গেছেন কেউ আশার কথা শোনাতে পারেননি।বরং মুচকি হেসে পাশ কাটিয়ে চলে গেছেন।
একদিন তৃপ্তির বাবার দূর সম্পর্কের এক আত্মীয় এলেন খুশির খবর নিয়ে।ছেলে ইঞ্জিনিয়ার।সব কিছু জেনেও তিনি তৃপ্তিকে বিয়ে করতে রাজি হয়েছেন।তবে ছেলে বিদেশে থাকেন।পনেরো দিনের ছুটি নিয়ে দেশে এসেছেন এরই মধ্যে বিয়ের কাজ মিটিয়ে বউ নিয়ে চলে যাবেন।তার আগে আগামীকাল ছেলে ও ছেলের বাবা-মা আসবেন মেয়ের সঙ্গে এবং আপনাদের সঙ্গে কিছু কথা বলতে।
এসব শুনে তৃপ্তির বাবার চোখে আনন্দের জল।তিনি বললেন-সব জেনে যদি কেউ আমার মেয়েকে গ্রহন করতে চান এর থেকে ভালো আর কিছু হয় না।
পরের দিন যথা সময়ে ওনারা উপস্থিত হলেন।সামান্য কিছু জলযোগের পর তৃপ্তির মা একটু সাজিয়ে তৃপ্তিকে সবার সামনে নিয়ে এলেন।মেয়ে দেখে কেউ কোন কথা বললেন না।ভয়ে ভয়ে তৃপ্তির বাবা-মা এক পাশে মাথা হেঁট করে দাঁড়িয়ে আছেন।সব নিরাবতা ভেঙে ছেলে বলে উঠলেন-আমি তৃপ্তির সঙ্গে একান্তে কিছু কথা বলতে চাই।যেটা সকলের উপস্থিতিতে বলা সম্ভব নয়।তৃপ্তির বাবার সম্মতি পেয়ে ওরা দু'জন পাশের ঘরে চলে গেলেন।তৃপ্তি মাথা হেঁট করে দাড়িয়ে আছে।হবু স্বামী বলতে লাগলেন-আমি সব কিছুই জেনে বুঝে আপনাকে বিয়ে করতে রাজি হয়েছি।আপনি অতিতকে ভুলে যান।অতিতকে আঁকড়ে রেখে বাঁচা খুব কঠিন।আমি আপনাকে সারা জীবন সুখে রাখার চেষ্টা করবো।সুবিধা-অসুবিধা সবসময় আমার সঙ্গে শেয়ার করবেন।খুব কম সময় হাতে নিয়ে এসেছি।বিয়ের পর আমরা বিদেশ চলে যাবো।আপনার কি কোন আপত্তি আছে ?
তৃপ্তি কান্না চেপে মৃদু স্বরে বললো-আপনার মতো মানুষ হয় না ! আপনি সব জেনে আমাকে গ্রহণ করতে রাজি হয়েছেন।এমন মানুষের সঙ্গে শেষ জীবনটা কাটবে এটা তো আমার কপাল। তবে আমি এখনও পড়তে চাই।সমাজের পিছিয়ে পড়া অবহেলিত মহিলাদের নিয়ে কাজ করতে চাই।আপনি কি সেই সুযোগটা আমাকে দেবেন ?
হবু স্বামী হেসে বললেন-এতে আমার পূর্ণ সমর্থন থাকবে।আপনার প্রেরণা হয়ে প্রতিটা ভালো কাজে আমি আপনার সঙ্গে থাকব ।
এক সপ্তাহের মধ্যেই বিয়ে মিটে গেলো।এবার বিদেশ যাবার পালা।তৃপ্তি সারাদিন শুধুই চোখের জল ফেললো।বিমান বন্দরে দুই বাবা-মাকে প্রণাম করে নব দম্পতি ভিতরে প্রবেশ করলেন।নির্দিষ্ট সময়ে বিমান মাটি ছেড়ে আকাশ পথে পাড়ি দিলো।দুটি পরিবার বাইরে দাঁড়িয়ে কান্না ভেজা চোখে ওদের যাত্রাপথের দিকে তাকিয়ে রইলেন।
==========================
আসগার আলি মণ্ডল
গ্রাম-খাসখামার
পোঃ-রামেশ্বর নগর
থানা-বাউড়িয়া
জেলা-হাওড়া