ভ্রমণসঙ্গী বনাম জীবনসঙ্গিনী
সমীর কুমার দত্ত
সেদিন হঠাৎ দেবার কথা মনে পড়লো। বেশ আসছিল খাওয়া দাওয়া, গল্প গুজব করে দিন কাটতো। তিন চার বছরের মধ্যে ও আমাদের সংসারের একজন হয়ে উঠেছিল। তারপর যে কি হলো, আর আসছে না ক'দিন হলো।
দেবা মানে দেবাজ্ঞন মুখার্জ্জী। তিন কূলে কেউ নেই। নেই কোন পিছু টান। সরকারী চাকুরে। একটা মেসে থাকে। ওর রয়েছে ভ্রমণের প্রতি তীব্র আকর্ষণ। আয়ের অধিকাংশ অর্থ ওর ভ্রমণে ব্যয় হয়ে যায়।
আমি মানে ইন্দ্র একটা সওদাগরী অফিসে চাকরি করি। মা, বিবাহযোগ্যা এক বোন ও স্কুলে পড়া এক ভাই নিয়ে আমাদের সংসার। অতিকষ্টে জমানো টাকা থেকে সবাইকে নিয়ে পুরী বেড়াতে গিয়ে দেবার সঙ্গে পরিচয়। দেবা সবার সঙ্গে মিশতে জানে। খুবই প্রাণোচ্ছল, খোলামেলা প্রকৃতির। আছে পরকে আপন করার এক অসীম ক্ষমতা। সেই হিসেবেই আমাদের বাড়ীতে ওর অবাধ যাওয়া আসা। তারপর থেকে ভ্রমণে ওকে সঙ্গ দিতে হয় আমার সাধ্য না থাকলেও। আমার তেমন অর্থবল নেই।
ভ্রমণে যাবার মতো অর্থের যোগান থাকে না। অধিকাংশ সময় ও ওর নিজের টাকায় আমাদের সকলের জন্য টিকিট বুক করে। বললেও শোনে না, বলে, " তুই যতটা পারবি দিবি । বাকিটা আমি দিয়ে দেব। দেখ, আমি তো যেতেই পারি একা কিন্তু তেমন আনন্দ নেই। সবাই মিলে এনজয় করলে ভ্রমণের মজা পাওয়া যায়। "ওর দৌলতে আমাদের সমুদ্রে, পাহাড়ে, বনে, জঙ্গলে অনেক জায়গায় ঘোরা হয়ে গেছে।
প্রকৃতিকে বোঝবার এক সূক্ষ্ম অনুভূতি আছে ওর, আছে এক কবি মন । সুউচ্চ তুষারাবৃত শৈলশিখর, নীলনির্জন সমুদ্রোপকূলের উপর আছড়ে পড়া উত্তাল তরঙ্গমালা, সবুজ বনানী, নিসর্গশোভা কিংবা নিরিবিলি আরণ্যক পরিবেশ কি নয়, ও পাশে না থাকলে আমার পক্ষে এসবের রহস্য উদ্ঘাটন করা অসম্ভব। ওর কবি মন দিয়ে ও তার বর্ণনা করতো আর আমি তা শুনতে শুনতে কোথায় হারিয়ে যেতাম ।
প্রকৃতি হয়ে উঠতো আমার কাছে হাস্যময়ী লাস্যময়ী মানবী। এজন্য ও আমার মনে অনেকটা জায়গা করে নিয়েছে। আর ওর এই নিসঙ্গতা, পরকে আপন করার নেশা, অপরের মা কে মা সম্বোধন করে প্রনাম করা-------এ সবের জন্য ও আমার মায়ের মনকে জয় করে নিয়েছে। কন্যাদায়গ্রস্তা বিধবা মা মনের কোন বাসনা নিয়েই হয়তো প্রায়ই দেবাকে বলতো, " বাবা, তুমি একা থাকো । একটা বে থা তো করতে পারো। একা থাকার সুবিধে যেমন আছে, অসুবিধেও অনেক। অসুখ বিসুখ, আপদ - বিপদ কত কিছুই তো আছে। "দেবা মুখের কথা কেড়ে নিয়ে বলে, " এই বেশ আছি মা । একা কোথায়। মেসে আরও কত লোক আছে। তা ছাড়া আপনারা তো আছেনই ।"
যাইহোক দেবার কথা মনে পড়তেই ছুটলাম ওর মেসে। সেখানে গিয়ে জানতে পারলাম ও রাজগীর বেড়াতে গেছে। অবাক হলাম। ও তো আমাদের ছাড়া একা কোথাও যায় না। নিশ্চিত হবার জন্য ছুটলাম ট্রাভেল এজেন্সির অফিসে । ম্যানেজার সুনীল বাবু বললেন — "একজন শিক্ষিতা সুন্দরী মহিলা হিস্ট্রিতে পি.এইচ.ডি করছেন, বাবা–মাকে নিয়ে চলেছেন রাজগীর ভ্রমণে। একটা সীট খালি ছিল তাই আমি দেবাকে বললাম যেতে। আর ঐ মহিলাও দেবাকে যাবার জন্য ধরলো । ও অনুরোধ এড়াতে পারলো না।
সেখান থেকে বেরিয়ে পড়লাম । মনটা ভেঙে গেল। একঘেয়ে জীবন থেকে বেরিয়ে এসে প্রাকৃতিক পরিবেশে মিশে গিয়ে একটা মুক্ত বাতাস শরীরে প্রবেশ করিয়ে যে মুক্তির আনন্দ আমি পেয়েছি তা শুধু ওর জন্য। তার জন্য একটা ধন্যবাদ ওর অবশ্যই প্রাপ্য। ভালই হয়েছে।
এরপর বেশ কিছুদিন কেটে গেল। এক রবিবার দুপুরে হঠাৎ কলিংবেল বেজে উঠলো। দরজা খুলে দেখি — দেবা, পাশে এক বিবাহিত সুন্দরী মহিলা। বুঝতে আর বাকী রইলো না। আমি স্থবির হয়ে ওদের মুখের দিকে তাকিয়ে ছিলাম কিছুক্ষন। নিজেকে হারিয়ে ফেলে ছিলাম। নিস্তব্ধতা ভঙ্গ করে দেবাই মুখ খুলল, "কি রে ঢুকতে দিবি না" ? সম্বিত ফিরে পেয়ে আমি বললাম, "ও হ্যাঁ আয়, ভিতরে আয়"।
দেবা মায়ের পায়ে হাত দিয়ে প্রণাম করে বললো, "মাসীমা বিয়ে করে আপনার কথা রেখেছি" ।
মায়ের মুখে মলিন হাসি খেলে গেল। বললো, "বেশ করেছো"। বলে মাথায় হাত দিয়ে আশীর্বাদ করলো। চোখের কোণায় আসা অশ্রু গোপন করে ঘরের ভিতরে ঢুকে গেলেন। আমরা আর ওর সঙ্গে স্বাভাবিক ভাবে কথা বলতে পারলাম না। কত আপন অথচ কত পর।
ভদ্রতার মুখোশ পরে সেবা এক অকথিত বিশ্বাসের বুকে ছুরি মেরে নব বিবাহিত বধুকে নিয়ে অতিথি হয়ে এসেছে ঘরে। অতিথি আপ্যায়ন তো করতেই হবে ।
==================================
Samir Kumar Dutta
23/1/A, Mohanlal Bahalwala Road
P.O Bally, Dist. Howrah 711201