Click the image to explore all Offers

পত্রসাহিত্য ।। ময়ূরাক্ষীর তীরে ।। জয়শ্রী ব্যানার্জি

           

তিলোত্তমাকে

    ময়ূরাক্ষীর তীরে 

                    জয়শ্রী ব্যানার্জি 


                                 ঋতুরাজ্ঞী  চক্রবর্তী
                                       বর্ধমান
                                ২৭ শে কার্তিক ১৪৩০
                                ১৪ /১১/২০২৩
প্রিয় কথা,
    তোমার চিঠি পেয়েছি । তুমি  ,কমলকলি দি , অভিজিৎ দা, রিমঝিম,মাসিমা সবাই আশা করি ভালো আছো। মাসিমাকে প্রণাম দিও ।  এখন কার্তিকের শেষ প্রায়।  বেলা ৩ টে বেজে গেছে ।হৈমন্তী হিমেল হাওয়া তে বেশ শীত  শীত করছে ।  দাঁড়াও কালো শালটা একটু ভালো করে জড়িয়ে নিই।
আমি ছোটো পিসির বাড়ি থেকে ট্রেনে ফিরছি ।  ট্রেনেই লিখছি তোমায় । পিসির বাড়িতে  পিসেমশাইদের বংশের প্রতিষ্ঠিত আদি কালীপুজো হয়। সেই কারণেই গেছিলাম । দুদিন আনন্দ,আড্ডাতে  কালী পুজো ভালই কাটলো।
    এই ওন লাইনের যুগে যেখানে চিঠি হারিয়ে গেছে এখনও অরণ্য আর  তোমাকেই আমি চিঠি দিই মাঝে মাঝে।  তোমরাও ভালো বাসো আমার চিঠি পড়তে ও লিখতে তাই অভ্যাস টা ছাড়তে পারিনা ।আমিও তোমাদের উত্তরের জন্য বসে থাকি । হ্যাঁ দেখা হয়েছিল ,মনে হয়েছিল দেখা করাটা খুব দরকার । যে অভিমান  দুজনের বুকের মধ্যে রোজ নিঃশব্দে ফোঁটা ফোঁটা বৃষ্টি হয়ে যায় সেই বৃষ্টিতে দুজনে একবার অন্তত ভিজি । ভেবেছিলাম এই শেষ ! দূরে চলে যাব একদম সব কিছু থেকে ,ওর থেকেও ...! 
তার পর দেখা করি  একদিন ময়ূরাক্ষীর তীরে। তখন প্রায় দুপুর। বিজয়া দশমী, কোজাগরী পূর্ণিমার পর এক অদ্ভূত বিষন্নতা আকাশে বাতাসে তখন ! জারুল ,মহুয়া , মাদার  গাছ ঘেঁষাঘেষি করে দাঁড়িয়ে । একদিকে শালবন । পাতার কেমন মর্মর ধ্বনি।
দূরে কোনো সাঁওতাল পল্লী থেকে কার বাজানো বাঁশির সুর ভেসে আসছিল । চোরা রোদ্দুর এসে পড়ছিল আমাদের  শরীরে চুলে ওর চশমায়  হয়তো আমার ঝুমকো দুলেও । এদিক ওদিক দেওয়ালে নকশা আঁকা ছোট ছোট কুটির।  বাহারে ঝুমকো লতা বেড়ার গায়ে গায়ে । কোথাও চাল কুমড়ো লাউ ধরেছে । ছোট ছোট জায়গায় নানা  সবজি আর ফুল গাছ লাগানো আছে। রাঙা মাটির পায়ে চলা পথ  নদীর ধারে ধারে ।     লেবু ফুলের গন্ধ মেশা বাতাস । কিছু দূরে নজরে পড়ে যাযাবর বেদে দের অস্থায়ী আস্তানা। 
কোথাও ঘাসের জাজিম বিছানো যেন !একটা কাঠের সাঁকো সেখানে বসেছিলাম । সাঁকো টার একপাশে একটা শ্বেত করবীর গাছ । তার ঝরা পাতা  সাঁকো তে এদিক  ওদিক ছড়িয়ে । ঢালু তটে যত রাজহংসের দল চড়ে বেড়াচ্ছিল। 
    নদীতে একটা লাল পাথর দিয়ে বাঁধানো ঘাট,  সেখানে পা ডুবিয়ে বসলে দেখা যায়  সাদা কালো নুড়ি গুলি । ময়ূরাক্ষীর কালো স্বচ্ছ শীতল গভীর জল ।  উঠতেই ইচ্ছা করছিল না ।কথা বলছিলাম নিঝুম  নৈঃশব্দের শব্দে আর  ভিতরের ভেজা কিছু কাব্যে । নাবলা  কথাগুলো  সেই মুহূর্ত ,সেই পরিবেশ একে অপরের কাছে না জানি কেমন করে যেন পৌঁছে দিয়েছিল !
অতঃপর ফেরার মুহূর্তে  আমি চোখ তুলে তার চোখের দিকে একটি বার চাইলাম ..! আমার কাছে তখন  সেই চাওয়া শেষ বারের মত মনে হয়েছিল , 
    আর সেই  আমার অপলক চাওয়া নিয়ে  তার চোখের শান্ত নীল নির্জনে আমি হারিয়ে  গেলাম ।
যেমন করে গাছের সারি ঘেঁসে নিবিড় হয়ে আসে বিকালের ছায়া , তার চোখ জুড়ে যেন  ঘন ছায়া নেমে আসছিল ধীরে .....!
    দূর হতে বন থেকে ভেসে আসছিল  ঝিঁঝিঁ শব্দ! গাছ গাছালির চারদিকে কেমন যেন ঝিম ধরা ভাব একটা । চরাচরের বাকি শব্দ রা বোধায় বিদ্রোহ করে চুপ হয়ে আছে  ।কানের পাশে শিরশিরে  হাওয়া যেন ফিসফিসিয়ে বলছে ,
ডুব দাও ...ডুব দাও! 
    ভীষণ মায়া হলো ...মনে হলো ওকে যেতে দিলে বা আমি চলে গেলে  এই হয়তো  আমাদের শেষ দেখা !  সেই মুহূর্তে হৃৎপিণ্ডের আওয়াজ কত ডেসিবেল আমি জানিনা ।  মনে হলো ব্রহ্মাণ্ড বলবে,যাকে তুমি চেয়েছিলে গভীর ভাবে আমার কাছে , যে শাশ্বত চিরন্তন প্রেম চেয়েছিলে ,আমি কথা রেখেছি কিন্তু তুমি ফিরিয়ে দিয়েছো ! 
    আমি তার শান্ততা কে স্পর্শ করলাম । তার অবিন্যস্ত চুল কপাল হতে সরিয়ে দিলাম । তাকে বন্ধিত করলাম বুকে।  আমার বুকের ভিতর যে নদী টি আছে তা তার বুকের সমুদ্রে মিশে গেলো ...আর মেশার আগে আমার কাজল চোখের কিউমুলোনিম্বাস মেঘ হতে বৃষ্টিরা ফোঁটা ফোঁটা হয়ে ভেজাতে লাগলো দুজনের চোখ মুখ চিবুক আর খুব গোপনে ভিতর বুকে! অস্ফুটে সে বলল, তোমার সাথে আমার দেখা হয়নি কেনো আগে ? 
    মনে হলো এর পরেও যদি আমি তার ভিতরের, যত মেঘ বৃষ্টি ঝড় রোদ্দুর  কে অমৃতের মতো পান না করি তাহলে তার সাথে বড়োই নিষ্ঠুরতা হবে !
    এক মিনিট থমকালাম ,বন্ধ চোখের ভিতর যা  আপণ খোলা চোখে তাহাই স্বপন ! আমি খোলা চোখে স্বপ্ন দেখছি না তো !   এতদিন ইচ্ছার কাছে কত রচনা লিখেছি , শর্ট প্রশ্ন করেছি  , সব গুলোর অনুবাদ করলে সেই আসে । যদি অঙ্কে ধরি সে   সেই সমীকরণ , ভৌত বিজ্ঞানে বিক্রিয়া, জীবন বিজ্ঞানে হৃৎপিণ্ড, ইতিহাসে যুদ্ধ , ভূগোলে পৃথিবী সাহিত্যে আমার  ধূসর হেমন্তের চিঠি,আমার বর্ষার ঝর ঝরে কবিতা ,মুক্তগদ্য !   আমার অহর্নিশের সব অনুভূতির এক কথায় প্রকাশ  করলে সে নাম অরণ্য !
যেমন করে আলোক রশ্মি ইথার তরঙ্গের দিকে এগোয় আমিও গেলাম  শুধু হৃৎস্পন্দন মাধ্যম 
তার পর  , গ্রহ, নক্ষত্র উল্কা, ছায়াপথ আলোকবর্ষ ,আকাশগঙ্গা বিশ্বব্রহ্মাণ্ড আর আকাশের নিচে  এই পৃথিবীর এক কোণে  ময়ূরাক্ষীর তীরে আমার সেই কাঙ্খিত  পুরুষের অধর সেই প্রথম স্পর্শ করলাম । 
তার  ব্যক্তিত্ব তার পৌরুষত্বের কাছে আমি হেরে গেলাম । আমি তার সেই নির্জন নিবিড় অরণ্যের মতো দু নয়নে নিজেকে হারালাম। তার সেই সমুদ্র বুকে ডুবলাম।  সেখানে উত্তাল ঢেউ এ ভালোবাসার দাগ কাটলাম ।
    অদূরে ময়ূরাক্ষী তে তখন জলের ছলাৎ শব্দ । খেয়া গেলো বুঝি ! অরণ্যের নীল হাফ সোয়েটার থেকে  কেমন সুন্দর একটা পারফিউমের গন্ধ আসছিল  ! ওর পুরুষালি বুকে মাথা রাখতে রাখতে চেয়ে দেখি শ্বেত করবী হাওয়াই দুলছে। অত:পর   অলি তিতলি কুসুমিত সৌরভে ; আর  অন্তরে অনন্ত সে  ...!
 তোমাদের পুরুলিয়া তে ভাবছি এবার বসন্ত তে যাবো ।যদি এবার নাও পারি আগামী বসন্ত তে অবশ্যই ।ফাগুনে  বন পলাশের আগুন দেখবো । মেমারি এলে বর্ধমানে কবে আসবে জানিও, দেখা করব । টাউন হলের মাঠ কি  রাজবাড়ী হোক কৃষ্ণসায়র পার্ক কি দামোদরের ধার হোক ,একদিন দুই বান্ধবীর দারুন আড্ডা হবে ।  একদিন প্রদীপ্ত দা কে দেখলাম । বর্ধমান স্টেশনে । গণদেবতা ধরবেন বলে দাঁড়িয়েছিলেন, সঙ্গে ওনার বৌ ছেলে ।  আমায় একটু এড়িয়ে গেলেন দেখে । ইতস্তত করে স্মিত হেসে জানতে চাইলেন আমি কেমন আছি ? হয়তো বউ বাচ্ছা আছে বলে ।  হাসিটা করুন লেগেছিল আমার কেমন! নিজের ভুল বুঝতে পেরেছিলেন কিনা জানা হয়ে ওঠেনি !  পরিস্থিতি ছিলো না প্রতারণা ! 
খুব জানতে মন চায়ছিল তখন  এখনও কি কমলকলি দি কে মনে পড়ে ওনার ? জিজ্ঞাসা করা হয়নি যদিও ! কি জানি হয়তো, হয়তো বা না । 
    আর কমলকলির দির? হেডমিস্ট্রেস মিস কমলকলি কাঞ্জিলালের  চশমা পড়া চোখ কি স্কুল থেকে ফেরার সময় গাংপুর স্টেশন এলে এখনও কি আগের মতোই সেই  তাকেই খোঁজে? স্মৃতি তে কি চুলের মতোই একটা দুটো করে রুপোলি প্রলেপ পড়ছে ? দেখা হলে জিজ্ঞাসা করবো ।
বাড়িতে আসার নিমন্ত্রণ তো অবশ্যই থাকলো ।
    প্রার্থনা কোরো আমার সবথেকে কাছের বন্ধু আর আমার  ভালোবাসা অরণ্য কে  যেন আমি  হারিয়ে না ফেলি । অনেক যত্নে রাখতে পারি যেন!  অরণ্য যেন  আমায় বিহানের মতো  কষ্ট দিয়ে ছেড়ে না যায়। জানো তো সব আমার সয়। শুধু ভালোবাসলেই বৃষ্টি হয়!  আমার ভালবাসা নিও । রিমঝিমের জন্য  আদরবাসা থাকলো । সুন্দর করে সংসার করো । পুরুলিয়া ঘুরে দেখো। ভালো থেকো  ।
                                   
ইতি 
                                         তোমার প্রিয়  ঋতু 





কথাকলি ভট্টাচার্য 
C/o অভিজিৎ ভট্টাচার্য 
সুরুলিয়া, ডিয়ার পার্ক রোড
ল্যান্ড মার্ক  বকুল তলা 
পুরুলিয়া।
==================
 



Post a Comment

0 Comments
* Please Don't Spam Here. All the Comments are Reviewed by Admin.