স্মরনেঃ বাঙালি মানসে অতুলপ্রসাদের সেন
পাভেল আমান
একপ্রকার নীরবে নিভৃতে কেটে গেল অতুলপ্রসাদ সেনের জন্মদিন। সংবাদপত্র টেলিভিশন থেকে শুরু করে সোশ্যাল মিডিয়াতে তাকে নিয়ে আলোচনা চর্চা ও সরণ খুব একটা নজর এলোনা। মাঝে মাঝেই একটি প্রশ্ন মননে আবর্তিত হয় আমরা কি প্রতিনিয়ত আমাদের বাংলা ভাষা সাহিত্য ও সংস্কৃতির ধারক বাহক ও উত্তরসূরীদের ভুলতে বসেছি? অথচ বাংলা ভাষা সাহিত্য সংগীত সর্বোপরি বাংলা সংস্কৃতি তার অবদান অপরিসীম। বাংলা সাহিত্যে ও সংগীতে এক অতিপরিচিত, অনন্য ও উজ্জ্বল নাম অতুলপ্রসাদ সেন। হাজার বছরের বাংলা গানের ধারায় বাণী ও সুরে তিনি সঞ্চার করেছেন একটি স্বকীয় মাত্রা। কেবল গীতিকার হিসেবেই নন—রাজনীতিবিদ, সমাজ-সংস্কারক, শিক্ষানুরাগী, সাহিত্য-সংগঠক, আইনজ্ঞ এবং সর্বোপরি একজন সংবেদনশীল মানুষ হিসেবেও বাঙালির কাছে তিনি সমধিক পরিচিত।মোদের গরব, মোদের আশা, আ মরি বাংলা ভাষা!/ মাগো তোমার কোলে, তোমার বোলে, কতই শান্তি ভালবাসা!/ কি যাদু বাংলা গানে! গান গেয়ে দাঁড় মাঝি টানে/ গেয়ে গান নাচে বাউল, গান গেয়ে ধান কাটে চাষা।' এ গানটি আজও মানুষের মুখে মুখে ফেরে।
সংগীতের এই সাধকের জন্ম ১৮৭১ সালের ২০ অক্টোবর ঢাকায় তারই মাতুলালয়ে। পৈতৃক বাড়ি ছিল দক্ষিণ বিক্রমপুরে। বাবার নাম রামপ্রসাদ সেন এবং মায়ের নাম হেমন্ত শশী।ব্রাহ্ম পরিবারের ছেলে অতুলপ্রসাদ কৈশোরে পিতৃহীন হয়ে সান্নিধ্য পেয়েছিলেন মাতামহ কালীমোহন গুপ্তের, সে যুগের বিখ্যাত গীতিকার ও গায়ক। বাবা রামপ্রসাদ সেনও ছিলেন সঙ্গীতজ্ঞ। অতুলপ্রসাদের চেতনায় গান এসেছিল সেই সূত্রে অতুলপ্রসাদ ১৮৯০ সালে প্রবেশিকা পাসের পর কলকাতার প্রেসিডেন্সি কলেজে ভর্তি হন ও কিছুদিন অধ্যয়ন করেন। পরে লন্ডনে গিয়ে আইন বিষয়ে শিক্ষা অর্জন করেন। আইন পরীক্ষায় সফলভাবে উত্তীর্ণ হয়ে ১৮৯৪ সালে তিনি বাংলায় ফিরে আসেন এবং রংপুর ও কলকাতায় অনুশীলন শুরু করেন। পরবর্তীকালে তিনি লক্ষ্ণৌ চলে যান। সেখানে তিনি স্থায়ীভাবে বসবাস শুরু করেন।
বাংলাভাষীদের নিকট অতুলপ্রসাদ প্রধানত একজন সঙ্গীতজ্ঞ ও সুরকার হিসেবেই পরিচিত। তাঁর গানগুলি প্রধানত স্বদেশী সঙ্গীত, ভক্তিগীতি ও প্রেমের গান এ তিন ধারায় বিভক্ত। এজন্য তাঁর অধিকাংশ গানই হয়ে উঠেছে করুণ রস-প্রধান। উনিশ শতকের শেষ থেকে বিশ শতকের মাঝামাঝি সময় পর্যন্ত রবীন্দ্রপ্রতিভার প্রভাববলয়ের মধ্যে বিচরণ করেও যাঁরা বাংলা কাব্যগীতি রচনায় নিজেদের বিশেষত্ব প্রকাশ করতে সক্ষম হন, অতুলপ্রসাদ ছিলেন তাঁদের অন্যতম। বাংলা সঙ্গীতে অতুলপ্রসাদই প্রথম ঠুংরির চাল সংযোজন করেন।তিনি বাংলা ভাষায় গজল প্রবর্তনেরও পথপ্রদর্শক। উর্দু ও ফার্সি গজলের ওস্তাদদের সঙ্গে অতুলপ্রসাদের পরিচিতি তাঁকে এই বিশেষ শৈলীটি বাংলা সংগীতে আনার জন্য অনুপ্রাণিত করেছিল। তিনি বাংলায় প্রায় ছয় বা সাতটি গজল তৈরি করেন এবং বাংলা সংগীতের একটি ধারার পথিকৃৎ করেন যা পরবর্তী সময়ে কাজী নজরুল ইসলামের অবদানে বেশ সমৃদ্ধ হয়।
তেষট্টি বছরের পার্থিব জীবনে অতুলপ্রসাদ লিখেছেন সাকুল্যে ২০৮টি গান। তাও বাংলার বাইরে বসে, ব্যস্ত কর্মজীবনের ফাঁক-ফোকরে। ভারত স্বাধীন হওয়ার পর ১৯৪৮ সালে লখনউতে তাঁর আবক্ষ-মূর্তি উন্মোচনের সময় উত্তরপ্রদেশের রাজ্যপাল সরোজিনী নাইডু শ্রদ্ধা-সমাচারে লিখে পাঠিয়েছিলেন, "হি চোজ় ল ফর হিজ় ব্রেড, বাট পোয়েট্রি ওয়াজ় হিজ় নার্সিসাস ফ্লাওয়ার, ফুড ফর হিজ় সোল।"বাংলা গানের ভুবনকে দিয়ে গেছেন অপার ঐশ্বর্য। প্রকৃতির গান, স্বদেশচেতনার গান, ঈশ্বর-নিবেদিত সঙ্গীত, প্রেমগীতি এবং বিবিধ— এ ভাবেই স্বচ্ছন্দে তাঁর গানের বিষয় বিভাজন করা যায়।জীবনের বেশির ভাগ সময় বাংলার বাইরে থেকেও ভোলেননি দেশজ বাউল-কীর্তন, ভাটিয়ালি গান। অতুলপ্রসাদ সেনের সাহিত্যিক ও সাংগীতিক জীবন নিয়ে চর্চা গবেষণা হোক তরুণ প্রজন্মের মধ্যে। পরিশেষে একটি কথা প্রতিবছর যথাযোগ্য মর্যাদায় কবি সুর সাধক অতুলপ্রসাদ সেনের জন্মদিন পালিত হোক যথাযোগ্য মর্যাদায়।
===============
রচনা -পাভেল আমান- হরিহরপাড়া- মুর্শিদাবাদ