প্রবীর বারিক
ষষ্ঠী পুজোর জন্য বাপের বাড়ি থেকে ডাক এলো।
মা - " তোর মেয়ে তো দুই ছাড়িয়ে তিনে পা দেবে।ভাবছি এবার ষষ্ঠী মায়ের পুজো করব।"
মন্দিরা - " কবে পুজো হবে? তোমার জামাই আসতে পারবে কিনা বলতে পারবো না।গত সপ্তাহে চেন্নাই গেল। অফিসে কাজের চাপ আছে।"
মা - " সামনের ভাদ্র মাসের আট তারিখে।বছরে একবারই এই পুজো হয়। জামাই থাকলে ভালো হতো।"
মন্দিরা - " সামনের শনিবার আসুক।জিজ্ঞেস করে দেখব ছুটি পাবে কিনা?"
তিন বছর আগের কথা মনে পড়ে গেল।তখন মন্দিরা প্রসব যন্ত্রণায় হাসপাতালে ছটফট করছে।পাশে মা বসে।মেয়ের কষ্ট দেখে নিজেকে সামলাতে পারে না।বাচ্চা প্রসবের জন্য ষষ্ঠী মায়ের ভূমিকা আছে।ষষ্ঠী মাতা নাকি নবজাত শিশুর সাথে খুনসুটি করে,আদর করে,স্বপ্ন দেখায়।তাই নাকি শিশু ভূমিষ্ঠ হওয়ার পূর্বে মাতৃগর্ভে হাত পা নাড়ায়,খেলা করে।এতে মায়ের যন্ত্রণা বাড়ে।মন্দিরার মা মৃণালিনী প্রত্যেক বছর গ্রাম্য দেশজ পুকুরে ষষ্ঠী মায়ের আরাধনা করে।
হাসপাতালে ক্রন্দনরতা মন্দিরাকে দেখে মনে মনে ষষ্ঠী মাতাকে জপ করে ।আগত নাতি নাতনি যাতে সুষ্ঠুভাবে পৃথিবীর আলো দেখে সেই প্রত্যাশায় ভক্তিভরে ষষ্ঠী মাতার স্তব গান করতে থাকে সবার অগোচরে।
যথারীতি হাসপাতালে ফুটফুটে কন্যা সৃজার জন্ম হল।পিতার গড়ন নিয়েছে শিশুটি।জন্মেই মা বলে চিৎকার করে কেঁদে ওঠে।
মন্দিরার প্রাণ জুড়িয়ে যায়।মৃণালিনীর মনও বিচলিত হয়। সদ্যোজাত নাতনিকে দেখতে গৃহকার্য ছেড়ে খুব ভোরেই রওনা দেয় ভীমচক হাসপাতালে।
চোখে মুখে আনন্দানুভূতির বহিঃপ্রকাশ দেখা দেয়।
ছোট্ট সৃজাকে কোলে তুলে নিতেই মিটিমিটি তাকিয়ে থাকে দিদিমার দিকে। গালে আলতো হাত দিতেই খিলখিলিয়ে হেসে ওঠে।
মন্দিরা - " মা পেটের সেলাইটা খুব ব্যথা করছে।"
মা - " জল খেয়ে নে মা। কাল রাত থেকে জল খাসনি তুই।জল না খেলে ইনফেকশন হয়ে যাবে।"
মন্দিরা - " আর পারছি না মা।উঠতে দুর্বল লাগছে।পেতে টান পড়লে সেলাই কেটে যাবে।দ্বিতীয়বার সেলাই করা খুব যন্ত্রণার হয়।
গতকাল রাতে নার্স এসে ধমক চমক দিয়ে যায় শাশুড়ীকে।" মেয়ের মা কোথায়? শাশুড়ি শাশুড়িই থাকে,মা হতে পারে না ।এখনও ড্রেসিং করাতে পারলো না । যাও তুমি বেরিয়ে যাও ।"
এতে মন্দিরার শাশুড়ি ক্ষিপ্ত হয়ে নার্সকেও দু চার কথা শোনায়।মনে মনে কষ্টও পায়।" আমি তাহলে শাশুড়ি থেকে গেলাম মা হতে পারলাম না।"
মৃণালিনী মেয়েকে ধমক দেয় " তুই যদি না উঠে জল খাস আমি বাড়ি চলে যাব।নিজের কষ্ট নিজে বুঝে নিবি।"
মায়ের কথা শুনে মন্দিরার জ্ঞান ফিরল।অনেক কষ্টে কনুইয়ে ভর দিয়ে বিছানায় বসে।বাথরুমে যাওয়ার শক্তি নেই ।মায়ের কাঁধে হাত রেখে পায়ে টিপ দিয়ে হাঁটার চেষ্টা করে সে।
এদিকে সৃজা খিদের চোটে কেঁদেই চলেছে।মন্দিরার বুকে একফোঁটাও দুধ নেই ।হাসপাতালে অন্য মায়েদের কাছে হাত পাতে মৃণালিনী।সবাই মুখ ফিরিয়ে নেয়।অসহায় মৃণালিনী আঁচলে মুখ চেপে কাঁদতে থাকে।ঈশ্বর ছাড়া কেউই তার সহায় নেই।নার্স বারংবার তাগাদা দিতে থাকে " বাচ্চাকে দুধ খাওয়াও,কেঁদে কেঁদে দম আটকে যাবে।"
সকাল সকাল স্নান সেরে মৃণালিনী ষষ্ঠী মা কে স্মরণ করে সৃজার সুস্থতা কামনা করে মা ষষ্ঠীর আবাহন করার মানত করে ।মন্দিরকে জোর করে জল খাইয়ে বুকে চাপ দিতে থাকে মা।কয়েক ফোঁটা দুগ্ধ চামচে করে সৃজার মুখে তুলে দিতেই তৃপ্তি সহকারে তা খেয়ে ঘুমিয়ে পড়লো সৃজা।জয় মা ষষ্ঠী বলে হাত জড়ো করে প্রণাম করে মৃণালিনী।
শনিবার প্রশান্ত চেন্নাই থেকে গ্রামের বাড়ি ফেরে।বাড়ি ফিরতেই সৃজা বাবার কাঁধে লাফ দেয়।সেকি আনন্দ পুচকি মেয়েটার। সারা সপ্তাহের জমানো ভালোবাসা আজ পিতাকে উজাড় করে বিলিয়ে দেয় মেয়েটি ।প্রশান্ত মেয়ের কপালে আলতো চুমু খেয়ে বাৎসল্য সুখে ভেসে যায়।মেয়ের জন্য ছোটো ফুল আঁকা ছাতা এনেছে চেন্নাই থেকে।ছাতা পেয়ে সৃজা দরজা খুলে বৃষ্টি ভেজা রাস্তায় বেরিয়ে পড়ে।অনাবিল হাসি ঘিরে ধরেছে মেয়েটিকে।
ভাদ্র মাসের বৃষ্টি শুরু হয়েছে।নিম্নচাপ সৃষ্টির দরুন তা প্রবল আকার ধারণ করে।প্রশান্ত পরের দিন স্ত্রী o কন্যাকে শ্বশুরবাড়িতে ছেড়ে দিয়ে আসে।
শ্বশুরবাড়ি না গিয়েই ফিরে আসতে হল। কারণ পরের দিন কোম্পানির নতুন অ্যাসাইনমেন্ট চালু হবে। সি ই ও এর নির্দেশ কোনমতেই ফাঁকি দেওয়া চলবে না।
বাস থেকে নেমে টোটোতে করে মন্দিরা ও সৃজা রওনা দেয়।পথিমধ্যে হঠাৎ মুষলধারে বৃষ্টি ।
সৃজা - " আমার বাবা কোথায়?বৃষ্টিতে ভিজে যাবে।"
মন্দিরা - " তোমার বাবা তো বাড়ি গেল। কাল অফিস আছে। "
সৃজা - " আমার আবার কাছে যাব ।কোন কথা শুনবো না ।"
এই বলে সৃজা অঝোরে কান্না জুড়ে দেয়।চিপস,চকলেট,খেলনা - কোনকিছুই তাকে বশ করতে পারল না।পিতার জন্য মন উতলা হয়ে উঠে। কাঁদতে কাঁদতে সৃজা কখন ঘুমিয়ে গেল নিঃশব্দে।
দাদু,দিদিমা, মাসি,দাদা,বুড়ি মাসি - সবাইকে নতুন দেখে প্রথমে চুপ করে মায়ের কোলে মুখ লুকিয়ে নেয়।ধীরে ধীরে খেলনা বাটি নিয়ে রান্না রান্না খেলা শুরু করে দিদিমার সাথে।দিদিমাকে ছোটো পুতুল সাজিয়ে চামচ দিয়ে খাইয়ে দেয়,স্নান করিয়ে দেয়,স্কুলে পাঠায় ।দুষ্টুমি করলে গালে থাপ্পড় মারে।
মামার কাঁধে চড়ে সারাগ্রাম ঘুরে আসে।মামার চুল টেনে খুনসুটি করে ।বাড়ির কথা ভুলে যায় সৃজা।
ষষ্ঠী পুজোর দিন মৃণালিনী সকাল থেকে স্নান সেরে শুদ্ধ বস্ত্রে পুজোর আয়োজন করতে থাকে।
বাঁশের পাতা, দ্রুবাঘাস,আলু,বেগুন, ঝিঙে, কুঁদরি,উচ্ছে আলাদা আলাদা পাতায় সাজিয়ে রাখে।তালপাতা মণ্ডপের চতুরপার্শে চারটি কাঠিতে গেঁথে দেওয়া হয়। উপরে চাঁদোয়া দিয়ে ঘিরে দেওয়া হয়।মাটির ঢেলায় ষষ্ঠী মায়ের মূর্তি তৈরি করা হয়।দই থেকে ঘি তৈরি করার ঘূর্ণি চাক্কিও দেবীকে প্রদান করতে হয়।
দেবীর পুজো পুকুর পাড়ে সম্পন্ন হয়।দেবীর নিমিত্তে শাড়ি প্রদান করা হয়।পুকুরে প্রজ্জ্বলিত প্রদীপ ভাসিয়ে দেওয়া হয়।
শান্তিতলা গ্রামে ননীর মা'ই ষষ্ঠী পুজোর পুরোহিত।দীর্ঘ বিশ বর্ষযাবৎ এলাকায় দাপটের সাথে পূজার্চনায় সিদ্ধহস্ত তিনি।দক্ষিণা হিসেবে চাল, ডাল,সবজি,শাড়ি নগদ ৫০০ টাকা নেন।
ষষ্ঠী মায়ের পুজোর পর সারা রাত্রিব্যাপী ষষ্ঠী মায়ের পালাকীর্তনও সম্পন্ন হয়।গায়কী ও নর্তকীরা শিশুকে কোলে নিয়ে ছন্দ ও সুরে শিশুদের আত্মীয়দের কাছ থেকে ষষ্ঠী মায়ের কল্যাণার্থে দক্ষিণা আদায় করতে থাকে।গ্রাম বাংলার গৃহে গৃহে ষষ্ঠী মায়ের মাহাত্ম্য আজও বিরল নয়।
==============
প্রবীর বারিক